কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য লেখো

কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্যসমূহ
কর্তৃত্ববাদের কতকগুলি নিজস্ব মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। এই বৈশিষ্ট্যগুলিকে বিশ্লেষণ করলে কর্তৃত্ববাদের প্রকৃতি বা স্বরূপ সম্পর্কে একটা স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়, এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) কেন্দ্রীভূত নেতৃত্ব
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাগুলিকে শক্তিশালী কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব দ্বারা চিহ্নিতকরণ করা যায়, যা একজন একক শাসক (স্বৈরশাসক), অভিজাত গোষ্ঠী বা এলিট শাসক, সামরিক জুন্টা বা প্রভাবশালী রাজনৈতিক দল দ্বারা পরিচালিত হয়। যাবতীয় রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত শাসক বা শাসকগোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে। এরূপ শাসনব্যবস্থায় শাসক সাধারণ ও স্বাধীন প্রতিষ্ঠানগুলির কাছে দায়বদ্ধ থাকেন না। কর্তৃত্ববাদ কোনোরূপ ক্ষমতার ভারসাম্য ছাড়াই সমাজের রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং সামাজিক দিকগুলির উপর উল্লেখযোগ্য নিয়ন্ত্রণ কায়েম করে।
(2) সীমিত রাজনৈতিক বহুত্ববাদ
কর্তৃত্ববাদে গণতন্ত্রের মতো বহুদল ও বহুমতের কোনো স্থান নেই। মোটের উপর কর্তৃত্ববাদ বহুত্ববাদকে প্রত্যাখ্যান করে। পরিবর্তে সীমিত বহুত্ববাদকে সমর্থন করে। বহুত্ববাদের সীমাবদ্ধতা রাজনৈতিক গোষ্ঠী এবং স্বার্থগোষ্ঠীর মধ্যেও প্রসারিত হয়। যে সংগঠনগুলি কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাকে চ্যালেঞ্জ জানায়, কর্তৃত্ববাদে সেই ধরনের রাজনৈতিক বিরোধিতাকে প্রান্তিক (Marginalized) করে দেওয়া হয়, অথবা রাজনৈতিক বিরোধিতাকে সহযোজিত (Co-opted) করা হয়, নতুবা দমন (Suppressed) করা হয়। কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলিতে শাসক বা শাসক দল নিজের বা নিজেদের ক্ষমতাকে বজায় রাখতে এবং রাজনৈতিক বহুত্ববাদকে দমন করতে, পৌর সমাজ ও বিরোধী দলগুলিকে নিষিদ্ধ করতে পারে, গণমাধ্যমের স্বাতন্ত্র্যকে সীমাবদ্ধ করতে পারে। এমনকি নির্বাচনি প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করতে পারে।
(3) দমনপীড়ন ও নিয়ন্ত্রণ
কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় মূলত সামাজিক শৃঙ্খলা বজায় রাখার উদ্দেশ্যে এবং বিরোধী মতামতকে দমন করার লক্ষ্যে দমনপীড়ন, সেন্সরশিপ (Censorship), ভীতি প্রদর্শন এবং নজরদারি ব্যবস্থার উপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়। এমনকি এ ধরনের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী বা প্রতিপক্ষ, কর্মী এবং সাংবাদিকদের প্রায়শই হয়রানি, নিগ্রহ, বিচারবহির্ভূত হত্যা বা হিংসার শিকার হতে হয়। অনেকসময় তাদের নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও কারাবন্দি করে রাখা হয় বা আইনি নিপীড়ন করা হয়।
(4) নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম
কর্তৃত্ববাদী ব্যবস্থায় গণমাধ্যম বা মিডিয়া সরকারি নিয়ন্ত্রণাধীন থাকে। এখানে গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক ব্যবস্থার মতো গণমাধ্যমের স্বাধীনতা থাকে না। জনমত গঠন, শাসনের বিষয়সূচি প্রচার এবং ভিন্নমতের সমালোচনা করার উদ্দেশ্যে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত গণমাধ্যম এবং প্রচারণা (Propaganda)-কে ব্যবহার করে। এক্ষেত্রে কর্তৃত্ববাদী নেতারা প্রায়শই সেন্সরশিপ, ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তিমূলক প্রচারণাকে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করেন।
(5) দুর্বল আইনের অনুশাসন
কর্তৃত্ববাদী রাষ্ট্রগুলিতে যে আইনি কাঠামো থাকে, তা সাধারণত দুর্বল হয় এবং আইনের অনুশাসন প্রায়শই অভিজাত শাসকশ্রেণির স্বার্থের অধীনস্থ হয়। আইন ও আইনি প্রতিষ্ঠানগুলি ন্যায়বিচার, সাম্য এবং মানবাধিকারের নীতিগুলিকে প্রতিষ্ঠা করার পরিবর্তে কর্তৃত্ববাদী শাসনের কার্যকলাপকে বৈধতা প্রদানের চেষ্টা করে। ফলে, কর্তৃত্ববাদী শাসনের কর্মকান্ডকে বৈধতা প্রদান করতে এবং রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে নিপীড়ন করার উদ্দেশ্যে আইনি প্রতিষ্ঠানকে বেছে বেছে ব্যবহার করা হয়।
(6) সীমিত নাগরিক স্বাধীনতা
কর্তৃত্ববাদী শাসনগুলিতে সাধারণত নাগরিকদের বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, সভাসমিতি এবং সংঘ গঠনের মতো পৌর অধিকারগুলিকে সংকুচিত করা হয়। এরূপ শাসনব্যবস্থায় নাগরিকদের নির্বাচনে ভোট দেওয়ার স্বাধীনতা, রাজনৈতিক সক্রিয়তা, শাসনব্যবস্থার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ বা শাসনের বিরুদ্ধে যে-কোনো সমালোচনামূলক অভিব্যক্তির উপর বিধিনিষেধ আরোপিত হয়। এক্ষেত্রে সরকার সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বরকে রোধ করতে পারে, গণমাধ্যমের স্বাধীনতার উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে, শাসনব্যবস্থার স্থায়িত্বের জন্য হুমকিস্বরূপ জনবিক্ষোভকে সীমিত করতে পারে ইত্যাদি। ফলে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় নাগরিকরা যাবতীয় মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা – সীমিত আকারে ভোগ করে।
(7) দায়বদ্ধতার অভাব
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় রাজনৈতিক নেতৃত্বগণ নির্বাচক তথা জনগণের নিকট দায়বদ্ধ থাকেন এবং গণতান্ত্রিক দেশে নিয়মিত, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একদম বিপরীতে অবস্থিত কর্তৃত্ববাদে, জনগণের প্রতি শাসকগণের জবাবদিহিতা বা দায়বদ্ধতার অভাব পরিলক্ষিত হয়। কর্তৃত্ববাদী নেতাগণ তাদের কর্তৃত্বকে সুসংহত করার জন্য ডিক্রি, জরুরি ক্ষমতা, আইনি ও নির্বাচনি প্রক্রিয়ার কারচুপি ইত্যাদিকে ব্যবহার করে থাকেন।
(8) প্রশাসনের সামরিকীকরণ
কিছু কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায়, দেশের সামরিক বাহিনী বা নিরাপত্তা বাহিনী রাষ্ট্রীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থায় ও সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। সামরিক নেতা বা নিরাপত্তা সংস্থাগুলি প্রায়শই ক্ষমতার মূল পদে অধিষ্ঠিত থাকেন, নীতি প্রণয়নের ক্ষেত্রে সিদ্ধান্তগ্রহণকে প্রভাবিত করে এবং অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাকে বজায় রাখে।
(9) ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসন বা একদলীয় শাসন
কর্তৃত্ববাদী শাসকরা জাতীয় স্থায়িত্ব এবং সমৃদ্ধির অপরিহার্য প্রতীক হিসেবে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সংস্কৃতি (Personality Cult) গড়ে তোলেন। কর্তৃত্ববাদী নেতৃত্ব সমাজের উপর ব্যাপক নিয়ন্ত্রণ স্থাপন করেন। উদাহরণ হিসেবে, উত্তর কোরিয়ার শাসক কিম জং উন (Kim Jong Un)-এর কথা বলা যায়। বিকল্পভাবে, কর্তৃত্ববাদী – শাসনগুলিকে একদলীয় শাসন দ্বারাও চিহ্নিত করা যেতে পারে, যেখানে একটি একক রাজনৈতিক দল সরকারের সকল শাখায় একচেটিয়া আধিপত্য বিস্তার করে, রাজনৈতিক বহুত্ববাদী ভাবনাকে সীমিত করে এবং বিরোধীদের দমন করে। যেমন চিন এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের কমিউনিস্ট দলের শাসনের কথা বলা যায়।
(10) নামমাত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের উপস্থিতি
কর্তৃত্ববাদ গণতন্ত্রের সম্পূর্ণ বিপরীত একটি রাজনৈতিক ব্যবস্থা হলেও, কিছু কিছু কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। আবার, তেমনই কিছু কিছু গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রেও কর্তৃত্ববাদের প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে উভয় প্রকার দেশেই নামমাত্র গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলির উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। এরূপ প্রতিষ্ঠানগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল-বিরোধী রাজনৈতিক
দল, নির্বাচন কমিশন ইত্যাদি। এই প্রতিষ্ঠানগুলি কর্তৃত্ববাদী শাসকদের নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত হয় বলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে না।
(11) কৃত্রিম গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা
বহু গণতান্ত্রিক দেশে শাসকরা জনগণের ভোটের মাধ্যমে ক্ষমতা দখল করেন, ফলে তারা নিজেদের গণতান্ত্রিক সরকারি এমনকি জনপ্রিয় নেতা বলেও দাবি করেন। এই পরিচয় ব্যবহার করে তারা নিজেদের ইচ্ছামতো প্রশাসন পরিচালনা করে থাকেন। অনেকসময়, দেশের আইনসভায় বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে শাসকগণ তাদের ইচ্ছানুযায়ী আইন প্রণয়ন ও আইন সংশোধন করে, এমনকি সম্পূর্ণ সংবিধান পরিবর্তনও করে ফেলতে পারে।
(12) আইনি বৈধতা বিরোধ-বিতর্কের ঊর্ধ্বে
কর্তৃত্ববাদ অনুসারে, আইনের বৈধতা সম্পর্কে কোনোরূপ প্রশ্ন তোলা যায় না। তত্ত্বগতভাবে বিরোধিতা করার ক্ষমতা স্বীকার করা হলেও, বাস্তবে সেই ক্ষমতা প্রয়োগের স্থান থাকে না। আসলে কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রীয় আইন হল প্রত্যেক ব্যক্তির সমষ্টিগত ইচ্ছার প্রকাশ। তাই রাষ্ট্রীয় আইনের সঙ্গে ব্যক্তির ইচ্ছার কোনো পার্থক্য নেই, বিরোধও নেই। সুতরাং আইন প্রণেতা ও প্রয়োগকর্তা এবং যাদের উপর আইন প্রযুক্ত হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রকৃত ইচ্ছার পার্থক্য থাকে না। ফলত, রাষ্ট্র শাসকদের বিরুদ্ধে কোনোরূপ বিরোধিতা বা প্রতিবাদ করা যায় না।
(13) রাজনৈতিক বিরোধিতা অস্বীকৃত
কর্তৃত্ববাদে কোনোরকম রাজনৈতিক বিরোধিতার অধিকার অস্বীকৃত। কর্তৃত্ববাদ অনুসারে, রাজনৈতিক বিরোধিতা রাষ্ট্রদ্রোহিতা হিসেবে বিবেচিত হয়। কোনো ব্যক্তি বা ব্যক্তিবর্গ রাজনৈতিক বিরোধিতা করলে, তার বা তাদের বিরুদ্ধে কঠোর পীড়নমূলক ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয় এবং দমন করা হয়।
(14) অসম ক্ষমতা সম্পর্ক
কর্তৃত্ববাদ অনুসারে, দেশের নাগরিকরা দুটি সুস্পষ্ট ভাগে বিভক্ত। যথা-শাসকশ্রেণি ও শাসিতশ্রেণি। এইরূপ শাসনব্যবস্থায় জনমতকে কোনোরকম গুরুত্ব দেওয়া হয় না। জনসার্বভৌমিকতা এখানে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষিত। জনগণের উপর শাসকের কর্তৃত্বকে জোরপূর্বক আরোপিত করা হয়।
(15) হিংসার প্রয়োগ
বলপ্রয়োগের উপর ভিত্তি করে, কর্তৃত্ববাদী শাসনব্যবস্থাগুলি তার নাগরিকদের উপর হিংসার প্রয়োগ ঘটাতে পারে। এধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকার বা নেতার পরিবর্তন মসৃণ এবং শান্তিপূর্ণ পদ্ধতিতে হয় না। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় ক্ষমতা পরিবর্তিত হয় অভ্যুত্থান মাধ্যমে বা বিপ্লবের ফলে।
(16) সীমিত রাজনৈতিক সংহতিকরণ
কর্তৃত্ববাদী শাসনগুলিতে যেহেতু জনগণের রাজনৈতিক সক্রিয়তা কম হয়, সেহেতু এখানে সীমিত রাজনৈতিক সংহতি পরিলক্ষিত হয়।
Read More – The Garden Party Question Answer