বিজ্ঞানের জয়যাত্রা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞানের জয়রথে চড়ে আমরা যে এগিয়ে চলেছি তা প্রতিদিন ও প্রতিমুহূর্তে অনুভব করা যায়। মানবসভ্যতার বাহক হল বিজ্ঞান। হাজার হাজার বছর আগে মানুষ ছিল অরণ্যচারী, ছিল অসহায়, এখন কিন্তু সে অবস্থা নেই। গুহাবাসী মানুষ যেদিন আগুনকে আবিষ্কার করল, নগ্ন গায়ে গাছের ছালকে পরিধেয় হিসেবে ব্যবহার করতে শিখল, সেদিন থেকেই শুরু হল আমাদের বিজ্ঞানের জয়যাত্রা। বুনো ঘোড়াকে বশ করে বন ছেড়ে বেরিয়ে এল মানুষ-গড়ে তুলল জনপদ, শহর, নগর। পাড়ি দিল এক দেশ থেকে আর-এক দেশে। বিজ্ঞান হল তার সহচর। বিজ্ঞানের পিঠে চড়ে ওই যে চলা শুরু হল, তা আর থামল না, আজও আমরা চলেছি।
আকাশের বিদ্যুৎকে মানুষের সেবায় নামিয়ে আনল বিজ্ঞান। তারও আগে আবিষ্কৃত হল চাকা। চাকার ওপর চাপল গাড়ি। বাষ্প টেনে নিয়ে চলল গাড়িকে। মাটিতে পাতা হল রেলপথ। রেলগাড়ি চলতে থাকল মানুষের প্রয়োজনে, পাড়ি দিল দূরদূরান্তে।
বিদ্যুৎ ব্যবহার করে মানুষ জ্বালাতে লাগল আলো। চলতে থাকল কলকারখানা, ট্রেন-ট্রাম এবং আরও কিছু যানবাহন। পিছনে হারিয়ে গেল মানুষের অরণ্যজীবন।
বিজ্ঞানের কৌশলে আকাশেও আমরা উড়তে শিখলাম। প্রথমে আবিষ্কৃত হল বেলুন। তারপর দেখা দিল উড়োজাহাজ। বিশাল পৃথিবী আর বিশাল রইল না। আমাদের কাছে খুলে গেল আকাশপথ। পথে পথে যেমন রিকশা চলে, সেইভাবে আকাশপথে চলতে থাকল হেলিকপ্টার।
কেবল আকাশকে জেনেই মানুষ ক্ষান্ত থাকল না। নদীতে-সাগরে মানুষ ভাসিয়ে দিল নৌকো, পালতোলা জাহাজ। আরও পরে চলল স্টিমচালিত জলযান। কেবল সাগর বা নদী নয়, বিজ্ঞানের সাহায্য নিয়ে আমাদের জলযানগুলি পাড়ি দিতে থাকল মহাসাগরে। মহাসাগর আমাদের মুঠোয় চলে এল। কেবল জলের উপরিভাগে নয়, বিজ্ঞানের সহায়তায় সাগর-মহাসাগরের তলাতেও চলল মানুষের বিজয় অভিযান। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা এগিয়ে চলল দুর্বার গতিতে।
প্রথমে এই জয়যাত্রা ছিল ধীর গতিতে। বিংশ শতকে এসে এই জয়যাত্রা পেল প্রবল গতি এবং এই গতি হল সর্বত্রগামী। এল ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি। চিকিৎসা জগতেও এল ‘লেসার’-এর প্রয়োগ, বেতারতরঙ্গ আগেই আবিষ্কৃত হয়েছিল। এখন তা আমাদের প্রতিদিনের ব্যবহারে ঢুকে পড়ল। এল ‘ইলেকট্রনিক্স’-বিজ্ঞানের ব্যাপক প্রয়োগ। ইলেকট্রনিক্স-এর ব্যবহার আমাদের দূরকে নিকট করল। চন্দ্র অভিযান এখন নিতান্তই ঘরের ব্যাপার হয়ে গিয়েছে। এখন আমাদের যন্ত্রযান চলেছে মঙ্গল গ্রহেও। সেখানে মঙ্গলযান ‘কিউরিওসিটি’ কাজ করছে একজন দক্ষ বৈজ্ঞানিকের মতো। সে একইসঙ্গে মঙ্গলের মাটি, মঙ্গলের আবহাওয়া, তার অতীত ইতিহাস খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে এবং আমাদের গবেষণাগারে তার ছবি পাঠাচ্ছে।
বিজ্ঞানের জয়যাত্রায় আমরা ‘সৌরজগৎ’-কে ছাড়িয়ে অনন্ত বিশ্বের পথে পা বাড়িয়েছি। মহাকাশের নীহারিকাপুঞ্জ আজ বিজ্ঞানের কাছে আর রহস্যময় নয়। আমরা এখন আরও এগিয়ে মহাবিশ্বের পথিক। মানুষের অগ্রগতিকে সহায়তা দিয়েছে বিজ্ঞান। চিকিৎসাতে বিজ্ঞান এনে দিয়েছে অসাধারণ সাফল্য। শিক্ষার জগতে বিজ্ঞান এনেছে বিপ্লব। বিজ্ঞানের ‘জয়যাত্রা’ কতখানি এবং কী গতিতে এগিয়ে চলেছে, তার বিবরণ দিতে গেলে কোনো প্রবন্ধে কুলোয় না, তার জন্য লেখা দরকার গ্রন্থের পর গ্রন্থ। বিজ্ঞানের অগ্রগতি আজ অনন্ত ও অসীম।
শোনা যায়, বিশ্ব সৃষ্টি হয়েছিল এক মহাবিস্ফোরণ বা ‘বিগ ব্যাং’-এর মাধ্যমে। এই সৃষ্টির পর বিশ্বব্রহ্মান্ডের আকার ও পরিধি দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। এই বৃদ্ধিকে আমরা বলি ‘Expanding Universe’, এই উপমা প্রয়োগ করে আমরা বলতে পারি, বিজ্ঞানের জয়যাত্রা দিনে দিনে বেড়েই চলেছে। বিজ্ঞানের জয়যাত্রা কোনোদিনই থামবে না।