সমাজজীবনে ছড়ার গুরুত্ব (Marks 5)

লৌকিক জীবনযাত্রার ইতিকথা নিহিত থাকে ছড়ার মধ্যে। কোনো এক সময় অজানা-অচেনা ব্যক্তিবিশেষের হৃদয়-আঙিনায় তাদের গভীর ভাবানুভূতি থেকে একটু একটু করে বিভিন্ন ছড়ার সৃষ্টি হয়েছিল।

সমাজজীবনে ছড়ার গুরুত্ব

সমাজজীবনে ছড়ার গুরুত্ব
সমাজজীবনে ছড়ার গুরুত্ব

ছড়াকে ‘শিশুসাহিত্য’ বলার কারণ কী?

ছড়া, শিশুর জন্য: অসংলগ্নতা ছড়ার ধর্ম কিন্তু এটি ছড়ার সংকীর্ণতা নয়, বরং অদ্ভুত, উদ্ভট, অসংলগ্ন ভাষার জন্যই ছড়া শিশুদের মনোগ্রাহী হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্রনাথ এই প্রসঙ্গে বলেছেন, “… ছড়াগুলিও স্নেহরসে বিগলিত হইয়া কল্পনাবৃষ্টিতে শিশুহৃদয়কে উর্বর করিয়া তুলিতেছে। লঘুকায় বন্ধনহীন মেঘ আপন লঘুত্ব এবং বন্ধনহীনতা গুণেই জগদ্ব্যাপী হিতসাধনে স্বভাবতই উপযোগী হইয়া উঠিয়াছে, এবং ছড়াগুলিও ভাবহীনতা, অর্থবন্ধনশূন্যতা এবং চিত্রবৈচিত্র্যবশতই চিরকাল ধরিয়া শিশুদের মনোরঞ্জন করিয়া আসিতেছে- শিশু মনোবিজ্ঞানের কোন সূত্র সম্মুখে ধরিয়া রচিত হয় নাই।”

অর্থাৎ, ছড়া হল নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমাজের স্বপ্নদর্শী মনের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ। তাই, কেবল শিশুদের জন্যই ছড়া রচিত হয়নি; বরং ছন্দ ও অসংলগ্নতার জোরে তা শিশুদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে।

শিশুর মনোগ্রাহী: ছড়ায় শিশুর সদাচঞ্চল দৃষ্টির মতোই টুকরো টুকরো অজস্র ছবি ভেসে ওঠে। অর্থ বা ভাষার অসংলগ্নতা ছড়ার ধর্ম, আর অসংলগ্নতাই শিশুমনের পরিচায়ক। সুসংলগ্ন কার্যকারণসূত্র ধরে কোনো – বিষয়কে শেষ পর্যন্ত অনুধাবন করা শিশুর পক্ষে সম্ভব নয়। তাই অসংলগ্ন ছড়া ও ছড়ার ছন্দ শিশুমনকে আকৃষ্ট করে।

শিশুর মন অর্থসন্ধানী নয়। প্রসঙ্গ ব্যাখ্যার্থে বলা যেতে পারে- ‘খোকা ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো, বর্গি এল দেশে’ ছড়াটি বর্গির আক্রমণকে নির্দেশ করলেও শিশু ছড়ার এই অর্থের প্রতি আকৃষ্ট হয় না, বরং ছড়ার ছন্দ তার মনের মধ্যে একটা দোলা সৃষ্টি করে। এই শব্দঝংকারই শিশুকে ভুলিয়ে রাখে বা শব্দের দোলায় তার চোখে ঘুম জড়িয়ে আসে। ছড়ার অর্থ নয়, ছড়াসৃষ্ট ‘কাইনেটিক সাউন্ড’ (Kinetic Sound) দ্বারা শিশু আকৃষ্ট হয়।

শিশুর মন কোনো নিয়ম মেনে চলে না, ছড়াও নিয়মবন্ধনহীন। যেমন-সুকুমার রায় রচিত ছড়াগুলি নিয়মহীন ‘ননসেন্স’-এর আলোতেই শিশুকে মুগ্ধ করে। নিয়মের বাঁধন মানে না বলেই ছড়া শিশুর কাছে মনোরঞ্জক ও আনন্দদায়ক।

শিশুর মন অত্যন্ত কল্পনাপ্রবণ। ছড়ার কাল্পনিক বিষয়বস্তু তাই সহজেই শিশুমনকে আকৃষ্ট করে।

ছন্দ-সংগীত-কল্পনার অহৈতুকী আবেদনে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে শিশুর মন।

ব্রতের ছড়া কী? ছড়াকে ‘নারীসাহিত্য বলা হয় কেন?

ব্রতের ছড়া: বাস্তব জীবনের সুখসমৃদ্ধিকে লক্ষ্য করে, নারী ও তার ব্যবহারিক সুখ-দুঃখের কথাই প্রতিধ্বনিত হয়েছে ব্রতের ছড়ার মাধ্যমে। ব্রতের ছড়ার মধ্যে কেবল পুরাকালের ছবি নয়, বাঙালি সমাজজীবনের বহুমুখী চিত্র উপস্থিত হয়। এর ফলে, এইসব ছড়াগুলির মধ্যে মানবিক জীবনের বাস্তব অনুভূতির পরম স্পর্শ পাওয়া যায়। যেমন-

“তুষ তুষলি কাঁধে ছাতি।। 
বাপমার ধন যাচাযাচি।। 
স্বামীর ধন, নিজপতি।
বাপের ধন কান্নাকাটি।
পুত্রের ধন পরিপাটি।।” (তোষলাব্রত)

“আমি সতী লীলাবতী।
ভাইয়ের বোন পুত্রবতী।
হয়ে পুত্র মরবে না।
পৃথিবীতে ধরবে না।” (পুণ্যিপুকুর ব্রত)

কারণ: ‘ছড়া’ কেবল নারীর রচনা নয়। ছড়ার বাগুঙ্গি ও রচনারীতি দেখে তা নারীসৃষ্ট বলে মনে হলেও, আদতে নারী-পুরুষ নির্বিশেষেই যে ছড়া রচনা করেছে তা বলা যায়। তবে, নারী হল ‘ছড়া’-র আদি সংরক্ষক। নারী তথা মা-দিদিমাদের মুখে মুখে ছড়া অনুরণিত হয়েছিল বলেই তা সংকলন করা সম্ভব হয়েছে। ছড়া কেবল ঘরের কোণে নারীকণ্ঠে উচ্চারিত হয়, নারীদের তেমন উল্লেখ্য কোনো কাজ থাকে না বলেই তারা সারাদিন ছড়া কাটে আর শিশু সামলায়-এই সংকীর্ণ অর্থেই ছড়াকে ‘নারীসাহিত্য’ বলে কার্যত দেগে দেওয়া হয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে যে, ছড়ার পরিসর অনেক বিস্তৃত এবং একমাত্র নারীরাই ছড়াকে মান্যতা দিয়ে তার সেই বিপুল সংগ্রহকে একা কাঁধে বয়ে নিয়ে এসেছিল, ছড়ার আদি সংরক্ষকরূপে বৃহত্তর ভূমিকা পালন করেছিল। এই মহৎ অবদানের জন্য ছড়াকে ‘নারীসাহিত্য’ বলে অভিহিত করা আবশ্যক।

হেঁয়ালি ছড়া কী? ছড়ার খেয়ালি ভাব সম্পর্কে সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

‘হেঁয়ালি ছড়া: লোকসাহিত্যের এই সংরূপটি নানা নামে ভূষিত। একে-‘সমস্যা’, ‘প্রহেলিকা’ বা ‘ছিলকা’ বলা হয়। এখনও ছোটো-বড়ো সবাই অবসরের আসরে রসিকতার মধ্য দিয়ে হেঁয়ালি ছড়া বলেন। যেখানে ‘বুদ্ধি’ই একটা বড়ো ভূমিকা গ্রহণ করে। প্রশ্নগুলি সাধারণত দুটি ছত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। আর উত্তরগুলি হয় একটি বা দুটি পদের। উদাহরণ সহযোগে বিষয়টি স্পষ্ট করা হল-

কালো রে কু বলে। 
আমায় কেনো থেঁতিলে। 
লম্বারে হুলি।
পথে কেনো শুলি।। (তাল ও সাপ)

বন থেকে বেরুল টিয়ে। 
সোনার টোপর মাথায় দিয়ে।। (আনারস)

এক নৌকা সুপারি। 
গুনতে পারো ব্যাপারি।। 
একে ‘ধাঁধা’-রই একটি অভিন্ন রূপ বলা যায়। (আকাশের তারা)

খেয়ালি ছড়া: লোকসাহিত্যের অন্যান্য সংরূপের মধ্যে ছড়া একটু বেশি করেই কল্প-খেয়ালি মনের সৃষ্টি। ছড়া সৃষ্টির অন্তরালে এই খামখেয়ালি ভাবনা ছড়াকে করেছে পরিবর্তনশীল। এই নিরন্তর পরিবর্তনশীল জগৎ, শিশুর কাছে সত্য জগৎ। কারণ শিশুর জগৎ ছড়ার খেয়ালি মনের জগতের মতো। উদাহরণ দিয়ে তা স্পষ্ট করা হল-

“খোকা গেলো মাছ ধরতে,

ক্ষীর নদীর কূলে।
ছিপ নিয়ে গেলো কোলাব্যাঙে,

মাছ নিয়ে গেলো চিলে।।”

ছড়াটি বড়োদের কাছে অর্থহীন, কৌতুককর ও বিচিত্র ধরনের হলেও; শিশুহৃদয়কে তা সহজেই অধিকার করে এবং চিরন্তনত্ব লাভ করে।

কিছু কিছু ছড়া যেমন শিশুদের কাছে অর্থহীন হলেও বড়োরা তার অর্থ বোঝে তেমনই কিছু ছড়া নিরর্থক মনে হলেও শিশুরা তাতেই আনন্দ পায়। এইসকল ছড়া শিশুমনে এক স্বপ্নজগৎ রচনা করে, সেখানে থাকে ব্যাঙ্গমা পাখি, সোনার টোপর পরা টিয়ে, দাঁড় বাওয়া কাক। এরকমই আরও একটি ছড়া-“হাট্টিমা টিম্ টিম্। তারা মাঠে পারে ডিম তাদের খাঁড়া দুটো শিং। তারা হাট্টিমা টিম্ টিম্” ছড়ার খেয়ালি জগৎ এভাবেই বয়ে চলে নিরন্তর।

সমাজজীবনে ছড়ার গুরুত্ব আলোচনা করো।

সমাজজীবনে ছড়া: লৌকিক জীবনযাত্রার ইতিকথা নিহিত থাকে ছড়ার মধ্যে। কোনো এক সময় অজানা-অচেনা ব্যক্তিবিশেষের হৃদয়-আঙিনায় তাদের গভীর ভাবানুভূতি থেকে একটু একটু করে বিভিন্ন ছড়ার সৃষ্টি হয়েছিল। কালের নিয়মে নানা পরিবর্তন, পরিমার্জনের মধ্য দিয়ে আজ সেগুলি আরও সংহত ও সামগ্রিক হয়ে উঠেছে। সামাজিক নানা রীতি-রেওয়াজ, সংস্কৃতি, রাজনীতি, অর্থনীতি, গার্হস্থ্য আচার ইত্যাদির নিখুঁত বর্ণনায় ছড়া হয়ে উঠেছে সর্বকালীন।

শিশুরা একেবারে ছোটো অবস্থা থেকেই ছড়ার ছন্দ, ভাষা ইত্যাদি আয়ত্ত করতে থাকায় তাদের মধ্যে পরম্পরা ও সংস্কৃতিগত মর্যাদাবোধ লক্ষ করা যায়। সমাজগঠন এবং তার পরিচালনায়ও ছড়া বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লৌকিক ছড়ার নিজস্ব জগৎটিকে বলেছেন- ‘টুকরো জগৎ’। তিনি আরও বলেছেন-“ইহা আমাদের জাতীয় সম্পত্তি। ….. আজকাল এই ছড়াগুলি লোকে ক্রমশই বিস্মৃত হইয়া যাইতেছে। অতএব জাতীয় পুরাতন সম্পত্তি সযত্নে সংগ্রহ করিয়া রাখিবার উপযুক্ত সময় উপস্থিত হইয়াছে।”

ছড়ায় সামাজিক চিত্র: নবাব আলিবর্দি খাঁ-র আমলে ‘বর্গি’ নামক একদল বহিরাগত দস্যু অত্যন্ত নৃশংস এবং ভয়ংকরভাবে বারে বারে বাংলাকে লুণ্ঠন করে একরকম শ্মাশানে পরিণত করে। সেই আতঙ্কের বাতাবরণ প্রতিফলিত হয় প্রচলিত একটি ছড়ায়-

“ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়োলো বর্গি এল দেশে, 

বুলবুলিতে ধান খেয়েছে, খাজনা দেব কিসে।”

বাংলা ছড়াকে সাহিত্যের আসনে কে প্রতিষ্ঠা দেন ও তাঁর ‘ছড়া বিষয়ক চর্চার দৃষ্টান্ত দাও। বাংলা লোকছড়া সম্পর্কে তাঁর অভিমত সংক্ষেপে ব্যক্ত করো।

বাংলা ছড়ার সাহিত্যে অনুপ্ৰবেশ: বাংলা ছড়াকে প্রথম সাহিত্যের আসনে প্রতিষ্ঠা দেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। লোকসাহিত্যের ভাষা ও ভাববস্তুর মধ্যে তিনিই জাতীয় সাহিত্যের প্রাণবীজকে প্রথম উপলব্ধি করেন।

রবীন্দ্রনাথের ছড়া চর্চা: ‘ছড়া’ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের প্রথম প্রবন্ধটি হল-‘মেয়েলি ছড়া’ যেটি, ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থে অন্তর্ভুক্তির সময় নাম পরিবর্তিত হয়ে হয় ‘ছেলেভুলানো ছড়া’। এ ছাড়াও তিনি ‘সাহিত্য পরিষৎ’ পত্রিকায় বাঁকুড়ার ২৬টি ছড়া, মেদিনীপুরের ৪টি, বনবিন্নুপুরের ৮টি এবং সাঁওতাল পরগনার ১৬টি ছড়া সংগ্রহ করে, সেগুলির পাঠান্তর প্রকাশ করেন। রবীন্দ্রনাথ সংকলিত ছড়ার সংখ্যা হল প্রায় ৮১টি।

রবীন্দ্রপরবর্তী ছড়া সংগ্রাহক ও সংকলকরূপে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের নাম উল্লেখযোগ্য।

রবীন্দ্রনাথের মতে ছড়া: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর ‘ছেলেভুলানো ছড়া’ প্রবন্ধে বলেছেন, “আমি ছড়াকে মেঘের সহিত তুলনা করিয়াছি। উভয়েই পরিবর্তনশীল, বিবিধ বর্ণে রঞ্জিত, বায়ুস্রোতে যদৃচ্ছা ভাসমান। দেখিয়া মনে হয় নিরর্থক…”

১৯০৭ সালে (১৩১৪ বঙ্গাব্দ) রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘লোকসাহিত্য’ গ্রন্থটি মজুমদার লাইব্রেরি থেকে প্রকাশিত হয়। এই গ্রন্থে বাংলা লোকছড়া সম্পর্কে গ্রন্থকার তাঁর অভিমত ব্যক্ত করেছেন— 

  • ছড়াগুলি আমাদের নিয়ত পরিবর্তিত অন্তরাকাশের ছায়া মাত্র। 
  • এর মধ্যে ভাবের পরস্পর সম্বন্ধ নেই-সে-কথা নিতান্ত পক্ষপাতী সমালোচককেও স্বীকার করতে হবে। 
  • ছড়াগুলি মানসিক মেঘরাজ্যের লীলা, সেখানে সীমা বা আকার বা অধিকার নেই। সেখানে পুলিশ বা আইনকানুনের কোনা সম্পর্ক নেই। 
  • ছড়াকে তুলনা করেছেন মেঘের সঙ্গে-যা পরিবর্তনশীল, বিভিন্ন বর্ণে বর্ণিত, বায়ুস্রোতে যেখানে-সেখানে ভাসমান। 
  • প্রায় প্রত্যেক ছড়ার প্রত্যেক তুচ্ছ কথায় বাংলাদেশের একটি মূর্তি, গ্রামের একটি সংগীত, গৃহের একটি আস্বাদ পাওয়া যায়। 
  • ছড়ার সকল কথাই ভাঙাচোরা, হাসিতে-কান্নাতে-অদ্ভুতে মেলানো।

ছড়ার সেকাল-একাল সম্পর্কিত ধারণাটি ব্যক্ত করো।

ছড়ার সেকাল-একাল: কালগতভাবে বিচার করলে, মানুষ সাহিত্যসৃষ্টির অতিপ্রাচীন যেসব প্রয়াসগুলি করেছেন, ছড়া সম্ভবত সেগুলির মধ্যে অন্যতম একটি। সভ্যতা যখন তার আদিম খোলস ছেড়ে একটু একটু করে আলোর পথে অগ্রসর হয়েছে তখন আমাদের প্রাচীন পিতামহরা সমস্যা থেকে উত্তরণের তাগিদে বহুবিচিত্র দেবতাদের অস্তিত্ব কল্পনায় স্তবস্তুতির ছন্দ-সুরের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন। সেখান থেকেই খুলে গিয়েছে ছড়ার উৎসারণের পথ। কালের ক্রমবিবর্তনে আদিম মন্ত্রই পরিণতি লাভকরেছে ছড়ার শরীর-মজ্জায়। অবশ্য ছড়াকে মন্ত্রের ক্রমবিবর্তিত রূপ বলা হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তার মধ্যে থাকা ধর্মবিশ্বাসের রূপটি বহুলাংশেই প্রায় বিলুপ্ত। সেই শূন্যস্থান ক্রমেই পূরণ করেছে কিছু সামাজিক বা পারিবারিক অনুভূতি ও অভিজ্ঞতা। সেকালের ছড়াই স্থান পেয়েছে একালের আধুনিক সাহিত্যে। যেমন-তারাশঙ্করের ‘রাধা’ উপন্যাসে খুঁজে পাই বহুপরিচিত লৌকিক ছড়া-

“ছেলে ঘুমোলো পাড়া জুড়ালো বর্গি এল দেশে, বুলুবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে।”

সমাজজীবনে প্রবচন ও ছড়ার গুরুত্ব আলোচনা করো।

প্রবচনের গুরুত্ব: সমাজজীবন ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে। আর সেখানে ক্রমে ক্রমে লোকমানসের বিকাশ ঘটে। তাই বাংলার লৌকিক সাহিত্যের সমাজজীবনে একটা গাঢ় প্রভাব ও গুরুত্ব তৈরি হয়। প্রবাদ লোকসাহিত্যের একটি বিশিষ্ট ধারা যা লৌকিক উপাদানে সৃজিত এবং তার মধ্যে লোকজীবনের গভীর পর্যবেক্ষণ ও লোকমানসের গূঢ় অভিপ্রায় প্রকাশিত হয় বলে লোকজীবনে এর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রবচন, প্রবাদের সমার্থকরূপে উচ্চারিত হয়, আরও সংক্ষিপ্ত বাক্যরূপ হিসেবে প্রকৃষ্ট কোনো বচনকে প্রকাশ করে। সাধারণভাবে ‘ডাকের বচন’, ‘খনার বচন’-এর মতো কাটাছেঁড়া কথায় আনন্দ-দুঃখ বা কষ্টার্জিত জ্ঞানের বিকাশ ঘটলেও প্রবচনেরও সমাজজীবনে গুরুত্ব সমধিক। প্রকৃষ্ট এই বচনের তীক্ষ্ণ বাক্যরূপ যে উপদেশ দেয়, তাৎক্ষণিক শিক্ষার আলো দেয়-সে বিষয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। তবে প্রবাদের বিস্তৃতি ও গভীরতম আবেদন প্রবচনে নেই।

ছড়ার গুরুত্ব: লোকসাহিত্য শ্রেণিহীন সমাজের তীক্ষ্ণ ছবি ধরে রাখে। কোনো এক সময়ে বাংলার লৌকিক ছড়াগুলি ব্যক্তিবিশেষের মনের আঙিনায় সৃষ্টি হয়েছিল, তারপর ক্রমাগত পুনর্গঠন ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে একটা সংহত ও সামগ্রিক রূপ লাভ করেছিল। তাই ছেলেভুলানো ছড়া, খেলার ছড়া, পারিবারিক ছড়া, মেয়েলি ছড়া, ব্রতের ছড়া-সর্বত্রই আছে সমাজজীবনের ছায়া। বিশেষ পরিস্থিতিতে তা উচ্চারিত হয়, মানবমনকে ঋদ্ধ করে। তাই ছড়াগুলির গুরুত্ব আজও প্রবলভাবে প্রতীয়মান। এভাবেই যুগ যুগ ধরে ঘুমপাড়ানি ছড়া, ছেলেভুলানো ছড়া শিশুকেন্দ্রিক রচনা হিসেবে বেঁচে থাকে। উদাহরণ-

“ঘুমপাড়ানি মাসি পিসি
মোদের বাড়ি এসো
খাট নেই পালঙ্ক নেই
খোকার চক্ষু পেতে বসো।”

আরও পড়ুনLink
শ্রীমদ্ভগবতগীতা – নিষ্কাম কর্মের ধারণা প্রশ্ন উত্তরClick Here
বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তরClick Here
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তরClick Here
নিরপেক্ষ ন্যায় – মূর্তি, সংস্থান ও বৈধতা বিচারClick Here

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top