শ্রীমদ্ভগবতগীতা – নিষ্কাম কর্মের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

1.শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা কী? গীতা অনুসারে আমাদের সব কাজের লক্ষ্য কী?
শ্রীমদ্ভগদ্গীতা
পৃথিবীতে যেমন নানা সময়ে পৌরাণিক কাহিনী সম্বলিত নানা মহাকাব্য রচিত হয়েছে, তেমনি ভারতেও দু’টি মহাকাব্য রচনা হয়েছিল- বাল্মিকীর লেখা রামায়ণ ও বেদব্যাসের লেখা মহাভারত। এই মহাভারতের মোট ১৮টি অধ্যায়। তার মধ্যে ষষ্ঠ অধ্যায়ে ভীষ্মপর্ব-এর ২৫ থেকে ৪২ তম অধ্যায়ে ৭০০টি শ্লোকের আকারে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা গ্রন্থ। সাতশত শ্লোকের ধর্মগ্রন্থ হওয়ায় এই গ্রন্থটিকে ‘সপ্তমতী’-ও বলা হয়। ‘ভগবৎ’ কথাটির অর্থ হল ভগবান ও ‘গীতা’ কথাটির অর্থ হল এমন কিছু যা গান গেয়ে বলা হয়েছে। (ভগবৎ গীতা = ভগবদ্গীতা) সুতরাং, ‘ভগবদ্গীতা’ কথাটির অর্থ হল ভগবানের দ্বারা উচ্চারিত বাণী। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের নীতিসম্মত ধর্মোপদেশ গীতায় ছন্দবদ্ধ শ্লোকের আকারে ধ্বনিত হয়েছে। শ্রীকৃষ্ণের উচ্চারিত ভারতীয় ধর্ম ও নৈতিকতার এই মেলবন্ধনকে ‘গীতা’ বলে অভিহিত করা হয়। কাব্যিক আকারে সংকলিত হওয়ার কারণে স্ত্রীলিঙ্গ ‘গীতা’-এই নামকরণ করা হয়েছে।
গীতা অনুসারে আমাদের কাজের লক্ষ্য
গীতা অনুসারে আমাদের সব কাজের লক্ষ্য হল- আধ্যাত্মিক প্রকৃতির উৎকর্ষসাধন তথা মোক্ষলাভ করা। আর মোক্ষলাভের জন্য প্রয়োজন নিষ্কামভাবে কর্ম করা। ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে এই নিষ্কাম কর্মযোগে কোনো প্রকার প্রচেষ্টা নিষ্ফল হয় না। এই নিষ্কাম কর্মযোগের অল্পমাত্র অনুষ্ঠানও আমাদের মোক্ষরূপ লক্ষ্যে উপনীত করে।
2. কর্ম বলতে কী বোঝো? কর্ম ও ফলের সম্পর্ক কীরূপ?
কর্ম
সংস্কৃত ‘কৃ’ ধাতু থেকে ‘কর্ম’ শব্দের উদ্ভব, যার অর্থ হল কাজ করা। কর্ম মানুষের ইচ্ছাশক্তির প্রকাশ। প্রতিটি ঐচ্ছিক ক্রিয়ার অবশ্যই কোনো উদ্দেশ্য থাকে। এই উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো উপায় অবলম্বন করা হয়। কাজটির উদ্দেশ্য, উপায় ও কাজের সম্ভাব্য পরিণাম সম্পর্কে ধারণার ওপর নির্ভর করে কর্মের ভালো-মন্দ বিচার করা হয়।
কর্ম ও ফলের সম্পর্ক
শারীরিক ও মানসিক সবরকম কাজই হল কর্ম। কর্মের সঙ্গে ফলের কার্যকারণ সম্পর্ক আছে। কর্মফল মূলত তিন প্রকার। যথা- ভালো, মন্দ ও মিশ্র। মানুষ তার কর্ম অনুযায়ী ফলভোগ করে। সৎ কর্মের ফল সুখ ও পুণ্য এবং অসৎ কর্মের ফল দুঃখ। কোনো জীবের পক্ষে কর্মফলকে এড়ানো সম্ভব নয়। অবশ্য নিষ্কাম কর্মের ফলভোগ করতে হয় না। কেবল সকাম কর্মের ফলই ভোগ করতে হয়।
3. কর্মবাদ ও জন্মান্তরবাদ এই দুইয়ের মধ্যে কোনো প্রকার সম্পর্ক আছে?
এই জগৎ ও জীবনে কর্ম ছাড়া মানুষ কখনোই থাকতে পারে না। যতদিন শরীর থাকবে মৃত্যু না হবে, ততোদিন মানুষকে কোনো-না-কোনো কর্ম করতেই হবে। মানুষের পক্ষে কর্মহীন জীবন অসম্ভব। যে মতবাদ অনুসারে মানুষকে তার কৃতকর্মের ফল অবশ্যই ভোগ করতে হবে সেই মতবাদকে ‘কর্মবাদ’ বলা হয়। মানুষ কর্মানুযায়ী ফলভোগ করে। সৎ কর্মের ফল সুখ এবং পুণ্য আর অসৎ কর্মের ফল দুঃখ এবং পাপ। কোনো জীবের পক্ষে কর্মফল ভোগ এড়ানো সম্ভব নয়। তবে নিষ্কাম কর্মের ফলভোগ করতে হয় না, কেবল সকাম কর্মের ফলভোগ করতে হয়। কর্মবাদের ফলশ্রুতিই হল জন্মান্তরবাদ।
4. ভারতীয় দর্শনে ‘কর্মবাদ’ বলতে কী বোঝায়? কর্মবাদকে কি অদৃষ্টবাদ বলা যায়?
কর্মবাদ
ভারতীয় দর্শনের অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল কর্মবাদে বিশ্বাস। এটি একপ্রকার নৈতিক কার্যকারণবাদ। কর্মবাদ বলে যে, কর্মের ফল বিনষ্ট হয় না। যে যেমন কর্ম করে, সেই কর্ম অনুসারে তাকে ফল ভোগ করতে হবে। এই নিয়মের ব্যতিক্রম নেই। কৃত কর্মকে কারণ বলা হয়, আর সুখ ও দুঃখ ভোগ হল কর্মফল। ভালো কাজের ফল ভালো হয় আর মন্দ কাজের ফল মন্দ হয়।
কর্মবাদের ক্ষেত্রে মানুষের ইচ্ছার স্বাধীনতা স্বীকার করা হয়েছে। তাই কর্মবাদ অদৃষ্টবাদ নয়। অদৃষ্ট কোনো ব্যক্তির কৃতকর্মে সমষ্টিগত শক্তি ছাড়া আর কিছু নয়। বর্তমান জীবনে নিরন্তর ঐচ্ছিক প্রচেষ্টার দ্বারা কর্মফল পরিবর্তিত করা যায়। প্রত্যেক কৃতকর্ম অবশ্যম্ভাবীরূপে ফল উৎপাদন করবে। কর্মকে আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। তাই কর্মবাদ নৈতিক দায়িত্ব ও নৈতিক প্রচেষ্টার সঙ্গে অসঙ্গতিপূর্ণ নয়। মাওলান
5. ফলাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে কর্ম কয়প্রকার ও কী কী ? অথবা, সকাম ও নিষ্কাম কর্ম কাকে বলে?
ফলাকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে কর্ম
কর্মফলের আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে কর্মকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা- সকাম কর্ম ও নিষ্কাম কর্ম।
(1) সকাম কর্ম: যে কর্মের ক্ষেত্রে ফললাভের আকাঙ্ক্ষা থাকে বা কর্মফল ভোগের বাসনা থাকে তাকে বলে সকাম কর্ম। আমরা আমাদের প্রতিদিনের জীবনে যেসমস্ত কর্ম সম্পাদন করি তার প্রতিটিই কোনো-না-কোনো ফলভোগের বাসনা থেকে করা হয়। এই সকল কর্মই হল সকাম কর্ম।
(2) নিষ্কাম কর্ম: কোনোরূপ ফলভোগের কামনা-বাসনা ছাড়াই আসক্তিহীন ভাবে যে কর্ম করা হয় তা হল নিষ্কাম কর্ম। গীতায় যে কর্মযোগের কথা বলা হয়েছে তা হল নিষ্কাম কর্ম।
6. ফলভোগের ভিত্তিতে কর্ম কয়প্রকার ও কী কী?
ফলভোগের ভিত্তিতে কর্ম
কর্মের ফলভোগের ভিত্তিতে কর্মকে দুইভাগে ভাগ করা যায়। যথা-
(a) আরব্ব বা প্রারব্ধ কর্ম ও (b) অনারদ্ধ কর্ম।
(1) আরব্ব বা প্রারব্ব কর্ম: পূর্ব ও বর্তমান জীবনের যে সকল কর্মের ফলভোগ শুরু হয়েছে, তবে শেষ হয়নি তাকে বলা হয় আরব্ব বা প্রারব্ব কর্ম।
(2) অনারব্ব কর্ম: পূর্ব ও বর্তমান জীবনে যেসকল কর্ম সম্পাদিত হয়েছে, কিন্তু যার ফলভোগ এখনো শুরু হয়নি, তাকে বলে অনারব্ব কর্ম।
অনারব্ব কর্ম আবার দুই প্রকার। যথা – প্রাক্তন বা সঞ্চিত কর্ম এবং ক্রিয়মান বা সঞ্চায়মান কর্ম।
- প্রাক্তন বা সঞ্চিত কর্ম: যে কর্ম অতীতে সম্পাদন করা হয়েছে, কিন্তু তার ফলভোগ এখনো শুরু হয়নি তাকে বলে প্রাক্তন বা সঞ্চিত কর্ম।
- ক্রিয়মান বা সঞ্চয়মান: যে কর্ম বর্তমান জীবনে করা হচ্ছে কিন্তু তার ফলভোগ শুরু হয়নি তাকে ক্রিয়মান বা সঞ্চায়মান কর্ম বলে।
7. বৈদিক মতে কর্মের প্রকার আলোচনা করো।
বৈদিক মতে কর্ম
গীতায় চারপ্রকার বৈদিক কর্মের উল্লেখ পাওয়া যায়। যথা- নিত্য কর্ম, নৈমিত্তিক কর্ম, কাম্য কর্ম এবং নিষিদ্ধ কর্ম।
(1) নিত্যকর্ম: যে কর্ম আমাদের দৈনন্দিন জীবনে অবশ্য পালনীয় এবং যে কর্ম অনুষ্ঠানে পাপ উৎপন্ন হয় তাকে নিত্য কর্ম বলে। যেমন- সকালে ঘুম থেকে ওঠা, শৌচ, আহার গ্রহণ ইত্যাদি হল নিত্য কর্ম। এই কর্ম অনুষ্ঠানে কোনো পুণ্য জন্মায় না।
(2) নৈমিত্তিক কর্ম: কোনো বিশেষ ঘটনা উপলক্ষে যে কর্ম করা হয় তাকে নৈমিত্তিক কর্ম বলে। যেমন- আত্মীয়ের জন্ম ও মৃত্যুতে অশৌচ পালন ইত্যাদি।
(3) কাম্য কর্ম: ফললাভের উদ্দেশ্যে যে কর্ম সম্পাদিত হয় তাকে কাম্য কর্ম বলা হয়। যেমন- বৃষ্টির কামনায় কৃতকারীরী যজ্ঞ ইত্যাদি।
(4) নিষিদ্ধ কর্ম: শাস্ত্রে কিছু কর্ম সম্পর্কে বলা হয়েছে যে সেগুলি থেকে বিরত থাকাই শ্রেয় অর্থাৎ যে কর্ম সম্পাদন করলে অনিষ্ট ফল উৎপন্ন হয়, তাকে বলা হয় নিষিদ্ধ কর্ম। যেমন- ব্রাহ্মণ হত্যা ইত্যাদি।
8. ‘নিয়ত কর্ম’ বলতে কী বোঝো?
নিয়ত কর্ম
নিয়ত কর্ম মানে দৈনন্দিন জীবনের ক্রিয়াকলাপ যা মানুষ নিজের স্বাস্থ্য বজায় রাখবার জন্য এবং বিভিন্ন সামাজিক দায়বদ্ধতা পালনের জন্য করে। নিয়ত কর্ম হল নিজের এবং অন্যান্যদের প্রতি কর্তব্য। যেমন, শরীর রক্ষার্থে স্নান, আহার ইত্যাদি। শরীর রক্ষা, নিজের পিতা- মাতা, সন্তান, আত্মীয়দের প্রতি দায়িত্ব, সমাজের প্রতি দায়িত্ব, দান, ধ্যান ইত্যাদি কর্তব্য কর্ম।
নিয়ত কর্ম সম্পাদন করলে পুণ্য পাওয়া যায় না, কিন্তু নিয়ত কর্তব্য মানুষের জীবনের আবশ্যিক কর্তব্য, তাই মানুষকে নিয়ত কর্তব্য সম্পাদন করতে হবে। তবে কর্ম সম্পাদন করবার সময় সর্বোত্তম পরম ঈশ্বরের নাম স্মরণ করে, কর্তব্য সম্পাদন করাই হল সর্বোত্তম পরম উপায়।
9. গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে কীভাবে নিষ্কাম কর্ম প্রসঙ্গে ধারণা দেন?
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় উল্লেখিত কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের নায়ক হলেন অর্জুন। যিনি কৌরব ও পাণ্ডবদের মধ্যেকার যুদ্ধের সময় নৈতিক দ্বন্দ্বে পতিত হন। তাঁর মধ্যে সংশয় হয় যে তিনি যুদ্ধ করবেন নাকি করবেন না। যুদ্ধ করা নীতিমূলক হবে কিনা।
যুদ্ধক্ষেত্রে স্বজনবর্গকে সম্মুখে দেখে অর্জুন ব্যথিত হলেন এবং তাদের বধ করার ইচ্ছা পরিত্যাগ করে অস্ত্রত্যাগ করলেন। অর্জুনকে যুদ্ধে প্রবৃত্ত করতে তাঁর সারথীরূপী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তাঁকে নিষ্কাম কর্মের উপদেশ দেন এবং স্বধর্ম পালন করতে বলেন। অর্জুনের ধর্ম হল ক্ষাত্রধর্ম, যুদ্ধ করাই তাঁর একান্ত কর্তব্য।
গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্ম প্রসঙ্গে অনাসক্ত ভাবে কর্ম করার কথা বলেছেন এবং আসক্তি ত্যাগ করতে হলে আগে জানতে হবে আসক্তি কেন জন্ম হয়। আসক্তির জন্ম হয় আমিত্ববোধ থেকে। এই আমিত্ববোধ ত্যাগ করতে পারলেই নিষ্কামভাবে কর্ম করা সম্ভব হবে। এভাবেই গীতায় শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কাম কর্ম প্রসঙ্গে ধারণা দেন।
10. কর্মযোগ চতুঃসূত্রী কী? অথবা, নিষ্কাম কর্মের সূত্রগুলি কী কী?
কর্মযোগ চতুঃসূত্রী
ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন করে কর্মসাধনই হল নিষ্কাম কর্ম। কর্মের কর্তা যখন কর্মের পরিণাম বা ফলের আশা না করে নিজের কর্তৃত্বাভিমানকে সম্পূর্ণ বর্জন করে সকল কর্মফল ঈশ্বরের নিকট সমর্পন করেন এবং শুধুমাত্র কর্মটি করা কর্তব্য মনে করেই করেন তখন সেই কর্মটি হল নিষ্কাম কর্ম।
নিষ্কাম কর্মে শ্রীকৃষ্ণ জ্ঞানমার্গী সাংখ্য অভিমত এবং কর্মমার্গী মীমাংসক অভিমতের সমন্বয় সাধন করেছেন। নিষ্কাম কর্মে বলা হয় কর্ম করো মৌমাংসক মত গ্রহণ এবং সাংখ্যমত বর্জন) কিন্তু ফলাকাঙ্ক্ষা পরিত্যাগ করো (সাংখ্যমত গ্রহণ এবং মীমাংসক মত বর্জন)। এটাই গীতার কর্মযোগ। আত্মজ্ঞানের সঙ্গে কর্মের যোগ। কর্মযোগ সূত্রটিতে (২/৪৭) চারটি চরণ আছে যাকে বলা হয় ‘কর্মযোগের চতুঃসূত্রী’।
(1) চারটি সূত্র: কর্মযোগের চারটি সূত্র হল-
- নিষ্কাম কর্মের ক্ষেত্রে কেবলমাত্র কর্মেই আমাদের অধিকার থাকে।
- কর্মফলে আমাদের কোনো অধিকার নেই।
- কর্মফলের আকাঙ্ক্ষা যেন কোনো কর্মের প্রবর্তক না হয়।
- কর্মহীনতায় যেন আসক্তি না থাকে।
নিষ্কাম কর্মের সাধন প্রসঙ্গে শ্রীকৃয় অর্জুনকে বলেন – যোগস্থ হয়ে, আসক্তি ত্যাগ করে নিষ্কাম কর্ম করতে হবে। সিদ্ধি ও অসিদ্ধির যে সমত্বজ্ঞান অর্থাৎ সিদ্ধিতেও যেমন অসিদ্ধিতেও তেমন জ্ঞান, তাকেই এখানে যোগ বলা হয়েছে। এইরূপ কর্মই প্রকৃষ্ট কর্ম – নিষ্কাম কর্ম।
11. নিষ্কাম কর্মযোগীর অধিকার কর্মে নাকি কর্মফলে-আলোচনা করো।
নিষ্কাম কর্মযোগীর অধিকার কেবলমাত্র কর্মে, কর্মফলে নয়। যখন আমরা কোনো কর্ম সম্পাদন করি, তখন ফলের আকাঙ্ক্ষায় কর্ম করে থাকি। এরূপ কর্মের ফল যেমন সফল বা ভালো হতে পারে তেমন নিষ্ফল হতে পারে বা মন্দ হতে পারে। এইরূপ মনোভাব দ্বারা যিনি কর্মসম্পাদন করেন তিনি বন্ধ হয়ে যান। ভালো হোক বা মন্দ হোক ওই কর্মের ফলের অধিকারী তিনি। ওই কর্মফল তাকে ভোগ করতে হয়। অপরপক্ষে নিষ্কাম কর্মযোগী কোনো ফলের আকাঙ্ক্ষা না করে নিরাসক্ত ভাবে কর্ম সম্পাদন করেন। তিনি তার সকল কর্ম ঈশ্বরকে সমর্পণ করেন। ‘এই কর্মের কর্তা আমি’ এইরূপ কর্তৃত্বাভিমান তার মধ্যে থাকে না। তাই শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন যে “অর্জুন! কর্মে তোমার অধিকার থাকলেও কর্মফলে তোমার অধিকার নেই। ফললাভ যেন তোমার কর্মের হেতু বা প্রবর্তক না হয়। আবার কর্ম না করার প্রবৃত্তিও যেন তোমার না জন্মায়।”
12. নিষ্কাম যোগী কী লাভ করেন? অর্জুনকে কেন নিষ্কামী হতে বলা হয়েছে?
নিষ্কাম যোগীর প্রাপ্তি
নিষ্কাম কর্মযোগী যে সকল কর্ম সম্পাদন করেন তাতে তার কোনো কামনা-বাসনা থাকে না। তিনি সকল প্রকার রাগ, দ্বেষ, কামনা-বাসনা, কর্তৃত্বাভিমান, অহংবোধ থেকে মুক্ত হয়ে পরার্থে কর্ম করে থাকেন। সকল কর্মকেই তিনি ঈশ্বরের কর্ম বলে মনে করেন। তাঁর সমস্ত কর্ম ও কর্মফল ঈশ্বরকে সমর্পণ করার ফলে তিনি জন্ম-মৃত্যু চক্র থেকে মুক্তিলাভ করেন। এভাবেই তিনি চিরশান্তি অর্থাৎ নির্বাণ লাভ করেন।
অর্জুনের প্রতি শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ
অর্জুন যদি কর্মবাদের বশবর্তী হয়ে সকাম ভাবে কর্ম করেন তাহলে তাকে ফলভোগ করতে হবে, কারণ কর্ম থাকলে তার ফলও থাকবে। আর এই কর্মের ফল ভোগ করতে হলে পুনঃ পুনঃ জন্মগ্রহণ করতে হবে এবং তার ফলে সংসার বন্ধনে আবদ্ধ হতে হবে। তাই ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে নিষ্কামী হতে বলেছেন। অর্জুন যেন কামনা বশবর্তী হয়ে কোনো কর্ম না করেন এটাই শ্রীকৃষ্ণের উপদেশ।
13. ভগবদ্গীতার নিষ্কামতত্ত্বের ক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতাকে কি পূর্বস্বীকৃতি রূপে স্বীকার করা যায়?
ভগবদ্গীতার নিষ্কাম কর্মের তত্ত্ব কেবলমাত্র অদৃষ্টবাদকে স্বীকার করে না। এক্ষেত্রে ইচ্ছার স্বাধীনতা হল একটি পূর্বস্বীকৃতি। ব্যক্তি জীবনযাপনের ক্ষেত্রে তার পছন্দমতো পথ নির্বাচনের ক্ষেত্রে স্বাধীন। কর্ম করা বা না করা উভয়ক্ষেত্রেই তার কর্তৃত্ব থাকে। কর্ম করলে যেমন ফলের কামনা থাকে তেমন কর্ম না করলেও ফলের কামনা থাকে। আকাঙ্ক্ষাযুক্ত ব্যক্তির কর্ম করলেও দোষ হবে, না করলেও দোষ হবে। কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হয়ে কর্ম করলে দোষ নেই আর না করলেও দোষ নেই। অর্থাৎ আমাদের কর্তৃত্বাভিমান ও ফলাকাঙ্ক্ষাশূন্য হতে হবে।
আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় যে ব্যক্তি কেবল তার স্বভাবগত প্রবণতা অনুসরণ করতে পারে। কিন্তু আমরা যদি ইচ্ছা করি তাহলে দেহাদি ইন্দ্রিয়কে অতিক্রম করে আমাদের অভ্যন্তরে স্থিত পরমাত্মায় মন সমাহিত করতে পারি।
14. গীতায় নিষ্কাম কর্মের শ্রেষ্ঠত্ব কীভাবে প্রতিপাদিত হয়েছে? অথবা, শাস্ত্রে নিষ্কাম কর্মকে কেন সর্বোচ্চ কর্ম বলা হয়েছে?
নৈতিক দ্বন্দ্ব থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্য ধর্ম ও অধর্ম বিষয়ে সন্দিগ্ধ হয়ে অর্জুন ভগবান শ্রীকৃষ্ণের শরণাগত হন এবং অর্জুনকে সঠিক শিক্ষা দান প্রসঙ্গে নিষ্কাম ভাবে কর্ম করার প্রসঙ্গটি উত্থাপন করেন।
নিষ্কাম কর্ম সৃষ্টির মতোই প্রাচীন। বিনিময়ে কিছু আশা না করেই সূর্য তাপ ও আলো দিচ্ছে। গাছপালা ফল ও অক্সিজেন দেয়। মায়েরা প্রত্যাবর্তনের প্রত্যাশা ছাড়াই সন্তানদের বড়ো করেন। ভিক্ষুককে ভিক্ষা দেওয়া বা রাস্তার কুকুরকে খাবার দেওয়া, গাছকে জল দেওয়া এগুলি সবই নিষ্কাম কর্মের উদাহরণ।
ভগবদ্গীতায় বলা হয়েছে যে, ভগবান সর্বদা নিষ্কাম কর্ম করছেন সুতরাং আমরা জানি বা না জানি সৃষ্টির শুরু থেকেই নিষ্কাম কর্ম বিদ্যমান। এই কর্ম আধ্যাত্মিক বা মোক্ষ লাভের জন্য সম্পাদিত কর্ম। তাই নিষ্কাম কর্মকে শাস্ত্রে সর্বোচ্চ কর্ম হিসেবে উল্লেখ করা যেতে পারে।
15. কর্ম নিষ্কামভাবে কীভাবে লাভ করা যায়? অথবা, নিষ্কাম কর্মের জন্য কীরূপ প্রস্তুতি প্রয়োজন?
যে-কোনো কাজ করার আগে যথার্থ প্রস্তুতি নেওয়াটা একান্ত প্রয়োজন, তেমন ভাবেই নিষ্কাম কর্ম করার জন্যও তার পূর্বে সঠিক প্রস্তুতি নেওয়ার প্রয়োজন আছে। নিষ্কাম কর্ম বলতে বোঝানো হয় এমন ভাবে কর্ম সম্পাদন করা যেখানে ফলের প্রতি কোনো আসক্তি থাকে না। এই কর্মে নির্জনে সাধনা, ধ্যান, যোগ-এর মাধ্যমে নিজের চিত্তকে শুদ্ধি করতে হয়। এর ফলে আত্মার আসল স্বরূপ সম্বন্ধে অবগত হতে পারা যায় এবং আমিত্ববোধ-এর বিনাশ ঘটে। নিষ্কাম কর্মী সুখ ও দুঃখে সমভাবাপন্ন হয়ে থাকেন এবং তারাই পরবর্তীতে অমৃত লাভ করতে পারেন। কামনার ফল হল সুখ ও দুঃখ ভোগ। আত্মজ্ঞানের উদয় হলে এইরূপ মনোভাব জন্মায় যে, জগৎ পরমাত্মার অতিরিক্ত বিষয় নয়, তা হল পরমাত্মারই অংশস্বরূপ। ব্যক্তির এইরূপ মনোভাবের উদয় হলেই নিষ্কাম কর্মের জন্য প্রস্তুত হওয়া সম্ভব।
16. ব্যক্তি কখন যোগপ্রাপ্ত হয়? অথবা, নিষ্কামী হওয়ার পথে প্রথম পদক্ষেপটি কী?
গীতায় ২য় অধ্যায়ের ৫৩তম শ্লোকে শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে বলেছেন- “নানা প্রকার শাস্ত্রীয় মতভেদে বিক্ষিপ্ত তোমার বুদ্ধি যখন নিশ্চল হয়ে যাবে এবং পরমাত্মায় অচলা হবে, সেই সময় তুমি যোগপ্রাপ্ত হবে।”
‘শুধু পরামাত্মা লাভ করতে হবে’- এই সংকল্প দৃঢ়তার সঙ্গে নিশ্চয় করলে বুদ্ধি অচলা হয়। জগৎ সংসার থেকে সম্পর্ক ছেদ করার জন্য বুদ্ধি নিশ্চলা হয় এবং পরমাত্মার সাথে সম্পর্ক স্থাপন করার জন্য বুদ্ধির অচলা হওয়া প্রয়োজন।
ব্যক্তিকে সর্বদাই মনে রাখতে হবে ভগবদের ইচ্ছাই তার ইচ্ছা এবং তার নিজের কোনো ফলাকাঙ্ক্ষা নেই। প্রত্যেক কর্ম করার সময় তিনি মনে করবেন ভগবানের কর্মই করছি। তিনি এভাবেই জগৎ সংসারের সেবা করবেন এবং জগতের থেকে তার কিছু পাওয়ার নেই- এরূপ ধারণায় বদ্ধমূল হওয়ার পরই ব্যক্তি যোগপ্রাপ্ত হয়।
17. কীভাবে নিষ্কাম কর্মের অনুশীলন করা যায় ?
কর্মফলের প্রতি আসক্তি পরিত্যাগ করে অর্থাৎ অনাসক্তভাবে কর্ম সম্পাদন করা-ই হল নিষ্কাম কর্ম। এই আসক্তি বর্জনের জন্য রয়েছে দুইটি পথ-
- প্রথমত: একটি হল কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পণ করা – যারা ঈশ্বরবাদী তারা এই মতে বিশ্বাসী। এই মতানুযায়ী পরমেশ্বরের উদ্দেশ্যে কর্মফল অর্পণ করলে ফলের প্রতি আর আসক্তি থাকে না। শ্রীমদ্ভগবদ্গীতায় এই ধরনের নিষ্কাম কর্মের আদর্শের কথা বলা হয়েছে।
- দ্বিতীয়ত: দ্বিতীয় পথের অনুসারী ব্যক্তিরা বলেন, নিজের ইচ্ছানুযায়ী মনের শক্তি, বিচার-বিশ্লেষণ অনুযায়ী কর্ম করলে কর্ম অনাসক্ত হবে। অনাসক্ত কর্ম জগৎ ও জীবনের মঙ্গল সাধন করে, জীব ও জীবনকে মহৎ করে। কর্মফল পরিত্যাগ করে অনাসক্ত কর্ম করাই হল মানুষের সর্বোশ্রেষ্ঠ আত্মোৎসর্গ। মহৎ ব্যক্তিরা জগতের মঙ্গলের জন্য নিজেকে উৎসর্গ করেন। স্বামী বিবেকানন্দ এই ধরনের নিষ্কাম কর্মের অনুশীলনের কথা বলেছেন।
18. গীতা অনুযায়ী নিষ্কাম কর্মের বৈশিষ্ট্য কী? অথবা, কোনো কর্মের কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে কর্মটি নিষ্কাম কর্মরূপে পরিগণিত হবে?
নিষ্কাম কর্মের বৈশিষ্ট্য
গীতা যদিও আপামর জনসাধারণের কাছে হিন্দুদের একটি পবিত্র ধর্মগ্রন্থ রূপেই বিবেচিত হয় কিন্তু গীতা ধর্মগ্রন্থের পাশাপাশি একটি অন্যতম নীতিশাস্ত্রও বটে। ভগবান শ্রীকৃয় অর্জুনকে তার ক্ষত্রিয়ধর্ম রক্ষার জন্য কুরুক্ষেত্রের ধর্মযুদ্ধে উৎসাহিত করেছিলেন বিভিন্ন প্রকার নৈতিক উপদেশাবলির মাধ্যমে। নিষ্কাম কর্মের যে সকল বৈশিষ্ট্য থাকার দরুন ভারতীয় ধর্ম তথা নীতিশাস্ত্রে নিষ্কাম কর্ম সম্পাদনের প্রতি এত গুরুত্ব আরোপ করা হয়েছে সেগুলি নিম্নরূপ
(1) ফলাকাঙ্ক্ষা বর্জন: নিষ্কাম কর্মের কর্তা এই কর্মজনিত পরিণাম বা ফলের প্রতি উদাসীন বা নিরাসক্ত থেকে কর্মটি সম্পাদন করেন।
(2) কর্তৃত্বাভিমান বর্জন: নিষ্কাম কর্মের সম্পাদনেই কর্তার অধিকার, ফলের প্রতি কর্তার কোনো অধিকার নেই। নিষ্কাম কর্মের কর্তা প্রকৃতপক্ষে ঈশ্বর। তাই এই কর্মের কর্তার ‘আমিই কাজটি করছি’- এইরূপ কোনো – কর্তৃত্বাভিমান বা অহংবোধ থাকে না।
(3) নিষ্কাস কার্সর ফল কর্মকর্তাকে ভোগ করাত হয় না: নিষ্কাম কর্মের ফল কর্মকর্তাকে ভোগ করতে হয় না। কেন-না নিমিত্ত কর্তা কর্মফল ভোগের অধিকারী নন। কর্মফল ঈশ্বরে সমর্পিত হওয়ায় ঈশ্বরই এই কর্মের ফল ভোগ করেন।
(4) নিষ্কাস কর্মের অর্থ কর্মত্যাগ নয়: নিষ্কাম কর্ম কামনাবিহীন কর্ম হলেও তা উদ্দেশ্যহীন নয়। নিষ্কাম কর্মযোগী তাঁর সমস্ত কর্ম ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে করে থাকেন এবং সমস্ত কর্মফল ঈশ্বরকে সমর্পণ করেন।
(5) নিষ্কাম কর্ম মোক্ষলাভের সহায়ক: কামনা-বাসনা মুক্ত হওয়ায় এই কর্মজনিত কোনো সংস্কার উৎপন্ন হয় না। ফলে কর্মের ফলভোগ করার জন্য আর জন্মগ্রহণ করতেও হয় না। ফলস্বরূপ মুক্তি বা মোক্ষলাভ ঘটে।