বিজ্ঞান ও কুসংস্কার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞানের কাজ মানবমনের যুক্তি, বিচারবুদ্ধি এবং অনুসন্ধিৎসার উদ্বোধন আর কুসংস্কারের অবস্থান ঠিক তার বিপরীতে। বর্তমানে আমরা বিজ্ঞান বুদ্ধি ও বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তির বলয়ে বসবাস করলেও, কুসংস্কারের প্রভাবকে এড়াতে পারি না-কুসংস্কারও আমাদের সঙ্গে সঙ্গে চলে। আজও নানান কুসংস্কারের ভূত আমাদের ঘাড়ে চেপে বসে আছে! তাকে নামানোর সাহস ও শিক্ষা এখনও আমাদের করায়ত্ত হয়নি। আজও সে আমাদেরকে ভয় দেখায়!
কুসংস্কার হল মানুষের যুক্তিবোধহীন অন্ধবিশ্বাস এবং মিথ্যা ধারণা। ইংরেজিতে একে বলে ‘Superstition’, যা বহুদিন ধরে চলে আসছে-এমন অন্ধবিশ্বাস মানুষের অজ্ঞতার কারণে কুসংস্কারে পরিণত হয়েছে। এই প্রযুক্তিনির্ভরতার যুগেও মানুষ তন্ত্রমন্ত্র, ঝাড়ফুঁক করে আরোগ্যের পথ খোঁজে আর ভূতপ্রেত, ডাইনি, জিন ইত্যাদির ভয়ে মানুষকেই মারে!
মানুষ প্রাগৈতিহাসিক যুগ থেকেই প্রকৃতির রহস্যভেদ করার এবং অবাধ্য প্রকৃতিকে নিজের আয়ত্তে আনার চেষ্টা করছে। এই চেষ্টার ফলেই বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানচেতনার জন্ম। মানবসভ্যতার একদিকে যেমন জন্ম নিয়েছে নানান ভীরু-অন্ধ-অলৌকিক বিশ্বাস, অন্যদিকে তেমনই বিজ্ঞানচেতনা। বিজ্ঞান বুদ্ধি দিয়ে আমরা বিশ্বের ব্যাখ্যাহীন বিষয়গুলিকে বোঝার চেষ্টা করেছি। কিন্তু আজও মন থেকে কুসংস্কারকে সম্পূর্ণ দূর করতে সক্ষম হইনি। অদৃষ্টবাদী, অলৌকিকে বিশ্বাসী কূপমণ্ডুক ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন মানুষের কাছে বিজ্ঞানচেতনা বারবার হার মেনেছে। তবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন যুক্তিবাদী মানুষ এটুকু বুঝতে শুরু করেছে যে, যুক্তিতর্কের বাইরে প্রমাণের ঊর্ধ্বে অন্ধবিশ্বাসের কোনো স্থান নেই।
যুগ যুগ ধরে বিজ্ঞানমনস্কতার ক্রমবর্ধমান প্রসার এবং গ্যালিলিওর মতো অসামান্য মনীষীদের আপসহীন আত্মত্যাগ মানুষের অন্ধবিশ্বাস ও অসহায় ধর্মীয় আনুগত্যের অচলায়তনে আঘাত হেনেছে। এভাবেই মধ্যযুগে ইউরোপে মানুষ প্রথম সন্দেহ প্রকাশ করল ধর্মীয় ব্যাখ্যায়। গড়ে উঠল নতুন এক মূল্যবোধ এবং বিশ্বাস-মানুষ বুঝল, সব প্রাচীন তত্ত্ব, তথ্য এবং মতবাদই চোখ বুজে গ্রহণযোগ্য নয়; বিচার ও যুক্তিশীলতার কষ্টিপাথরে যাচাই করে তবেই গ্রহণীয় হয় সব কিছু। এই সংশয়, সন্দেহের মধ্য দিয়ে সত্যান্বেষী মানুষের যথার্থ বিজ্ঞান বুদ্ধির প্রতি বিশ্বাস বৃদ্ধি পেল। এ হল সেই বিশেষ জ্ঞান যা মানুষকে এগিয়ে নিয়ে চলেছে কাল থেকে কালান্তরে, শুধু অত্যাশ্চর্য সব আবিষ্কার মানেই তো বিজ্ঞান নয়। বিজ্ঞানের ইতিহাস এক অর্থে বিজ্ঞানমনস্কতার ইতিহাস; ক্রমশ মানুষের মুক্তমনা হয়ে ওঠার ইতিহাস।
বিজ্ঞানচেতনার বিপরীতে অবস্থান করছে কুসংস্কার এবং অন্ধবিশ্বাস। একদিকে যখন চলছে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা, অন্যদিকে ইংল্যান্ডে তখনও ডাইনি বলে পুড়িয়ে মারা হচ্ছে অসহায় নারীদের। ভারতে চলছে সতীদাহ-সহমরণ, চলছে হাঁচি-টিকটিকি, মাদুলি-তাবিজ-কবচ। অতি সুসভ্য সমাজে আজও টিকে রয়েছে এমন ধরনের কত অন্ধবিশ্বাস। কালো বিড়াল সামনে দিয়ে গেলে সুসভ্য ইউরোপের অনেক লোকই আজও গাড়ি থামিয়ে বসে থাকেন। আজও অনেক সুশিক্ষিত মানুষ খাওয়ার টেবিলে তেরো জনে খেতে বসেন না। এ শতকের শ্রেষ্ঠ বিজ্ঞানী অ্যালবার্ট আইনস্টাইন বলেছিলেন কুসংস্কারের উৎস হল- “It is this undefined source of fear and hope which is the genesis of irrational superstition.” ভয় এবং আতঙ্ক থেকে কুসংস্কারের জন্ম।
আধুনিক ভারত যদিও বৈজ্ঞানিক অগ্রগতির পথে এগিয়ে চলেছে, তবু আমাদের দেশ আজও কুসংস্কারের বেড়াজালে আবদ্ধ। আজও ডাইনি হত্যা, শিশুবলির মতো ঘটনা ভারতের বুকে প্রায়শই ঘটে চলেছে। তবু সবচেয়ে বিস্ময়কর এবং লজ্জাজনক বোধহয় ১৯৯৫ খ্রিস্টাব্দের ২১ সেপ্টেম্বরের ঘটনা-গণেশ মূর্তির দুধপান। পদার্থবিজ্ঞানের ভাষায় যা পৃষ্ঠটান। তাকেই মানুষ দৈব-অলৌকিকতা বলে ভক্তিভাবে মেতে ওঠে। এর চেয়ে আশ্চর্যের আর কী আছে?
আমাদের দেশে বিজ্ঞানের অগ্রগতির খবরাখবর জেনেও বহু মানুষ কুসংস্কারে আচ্ছন্ন। বৈজ্ঞানিকদের হাতে তাবিজ-কবচ প্রায়ই দেখা যায়। – ডাক্তারেরা নির্ভর করেন জ্যোতিষীর ওপরে। জ্যোতিষীর নির্দেশে বহু শিক্ষিত লোক হাতে গ্রহরত্ন ধারণ করে চলেছেন। এঁরা ‘জলপড়া’ খান চোখ বুজে। গুরুচরণামৃত ভক্তির সঙ্গে পান করেন। বলাবাহুল্য এসবই হল তথাকথিত ডিগ্রিপ্রাপ্ত শিক্ষিতদের মনের অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কার। আসলে মানুষের মনের অজ্ঞতা ও ভীরুতাই হল সমস্ত কুসংস্কারের উৎস।
বিজ্ঞানমনস্কতাই পারে ভ্রান্ত ধারণার মোহমুক্তি ঘটাতে। বিজ্ঞানই মানবসভ্যতায় নতুন আলোর দিশারি। অজ্ঞতা, ভীরুতা দূর করে বিজ্ঞানকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলেই কুসংস্কারে জয়লাভ করবে সে। বিজ্ঞানচেতনাই তমসালোকে আশার আলো সঞ্চারিত করবে আর কুসংস্কারমুক্ত হয়ে মানুষের পঙ্কিল মননে ফোটাবে মানবতার শতদল।