জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক আলোচনা করো

জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক
(1) জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতা পরস্পরবিরোধী নয়
জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাকে যারা পরস্পরের অনুপন্থী বলে মনে করেন তাঁদের মতে, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ গুণ হল আত্মসত্ত্বার প্রত্যয় বিকাশ এবং আত্মসত্ত্বার প্রতি প্রীতিবোধ। তবে আত্মকেন্দ্রিকতার অর্থ কখনোই স্বার্থপরতা নয় বা অপরকে অবিশ্বাস করা নয়। আর জাতীয় জীবন অতিক্রম করে এই ধারণা আন্তর্জাতিক স্তরে স্থান পেলে সর্বপ্রকার দ্বন্দ্ব বিবাদের অবসান ঘটা সম্ভব হবে। আন্তর্জাতিকতার পথকে প্রশস্ত করার মূলমন্ত্রই হল সাম্য, মৈত্রী ও স্বাধীনতা। আন্তর্জাতিকতার সমর্থকরা মনে করেন, এই ধারণা প্রতিষ্ঠা করার জন্য কোনো জাতিভিত্তিক রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা ক্ষুণ্ণ করার প্রয়োজন পড়ে না। এই উদ্দেশ্যকে সফল করার জন্য বিশ্বের প্রতিটি জাতিকেই কোনো না কোনো ক্ষেত্রে আত্মবলিদান করতে হয়। তাই জাতীয়তাবাদকে সম্পূর্ণরূপে বর্জন না করে আন্তর্জাতিকতাকে জাতীয়তাবাদের মধ্য দিয়েই প্রতিষ্ঠা করতে হবে। আদর্শ জাতীয়তাবাদ সর্বদা আন্তর্জাতিকতার সহায়ক।
(2) সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রের প্রতিবন্ধক নয়
বহু রাষ্ট্রতাত্ত্বিক এখনও মনে করেন। যে, সার্বভৌম জাতিরাষ্ট্রগুলিই বর্তমানে বিশ্বশান্তি বিঘ্নিতকরণের এবং যুদ্ধের উৎপত্তির প্রধান কেন্দ্রস্থল। এই জন্যই আন্তর্জাতিকতার মধ্য দিয়ে জাতি রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতাকে সীমিতকরণের মাধ্যমে বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব- তবে এই ধারণা সম্পূর্ণ অভ্রান্ত। রাষ্ট্রের সার্বভৌমিকতা সীমিত করলেই যে যুদ্ধের অবসান ঘটবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তার পরিবর্তে যদি প্রতিটা রাষ্ট্র আন্তর্জাতিকতার আদর্শে প্রকৃতপক্ষে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঐক্যবদ্ধ হয় তাহলে, যুদ্ধের সম্ভাবনা দূরীভূত হতে পারে।
(3) আন্তর্জাতিকতার বিরোধী হিসেবে জাতীয়তাবাদ
বিংশ শতাব্দীর তিনের দশকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহ পরিণামের পরে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের ধারণাটি উত্থাপিত হয়। বিভিন্ন দেশের মনীষীরা সেসময় জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের ধ্যানধারণার বিরুদ্ধে সরব হন। জাতীয়তাবাদকে চিহ্নিত করা হয় আন্তর্জাতিকতার বিরোধী হিসেবে। পৃথিবীতে যুদ্ধের আশঙ্কা দূর করার জন্য জাতি, জাতীয়তাবাদ ও জাতীয় রাষ্ট্রের ধারণা ত্যাগ করার কথা বলা হয়। মনে করা হয় যে, জাতীয়তাবাদ জাতিবিদ্বেষ, সন্দেহ, অবিশ্বাস, বৈরীতা, পররাজ্যলোলুপতা, অন্য জাতির উপর প্রাধান্য প্রতিষ্ঠা, যুদ্ধ ইত্যাদির মাধ্যমে বিশ্বশান্তি বিনষ্ট করে। এর ফলে বিশ্বভ্রাতৃত্ব ও সহযোগিতার আদর্শ বিকশিত হতে পারে না। আন্তর্জাতিকতাবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, ‘জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার শত্রু’।
(4) উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ
জাতীয়তাবাদ সম্বন্ধে উপরোক্ত মন্তব্য আদর্শ জাতীয়তাবাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হতে পারে না, শুধুমাত্র উগ্র এবং বিকৃত জাতীয়তাবাদ মানবতা ও আন্তর্জাতিকতার বিরোধী। আর যাঁরা আন্তর্জাতিকতার পরিপন্থী হিসেবে জাতীয়তাবাদকে বিচার করতে চেয়েছেন তাঁরা জাতীয়তাবাদের বিকৃত বা নগ্নরূপকে প্রত্যক্ষ করার মধ্য দিয়েই এই সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন। স্বৈরাচারী, অগণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে ধ্বংস করে জাতীয়তাবাদ আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রগতিতে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছে। সংকীর্ণ আত্মকেন্দ্রিক ও আগ্রাসী জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতাকে ধ্বংসের দিকে এগিয়ে দিয়েছে। নিজ জাতি সম্বন্ধে শ্রেষ্ঠত্বের ধারণা এবং অন্য জাতির কৃষ্টি ও সভ্যতার প্রতি ঘৃণার মনোভাব বিকৃত জাতীয়তাবাদে দেখা যায়।
উগ্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে অন্ধ স্বদেশপ্রীতিতে জনসাধারণকে আসক্ত করে যুদ্ধকে ডেকে আনা হয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদের সাহায্যে জাতির মধ্যে সাম্রাজ্য বিস্তারের আকাঙ্ক্ষা দেখা দেয়। অন্য জাতিকে পদানত করে স্বজাতির মহিমা প্রতিষ্ঠার এই চেষ্টা যুদ্ধের রূপ নেয়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জার্মানি, ইতালি ও জাপানের বিধ্বংসী ভূমিকা উগ্র জাতীয়তাবাদের এক জ্বলন্ত দৃষ্টান্ত। এভাবে উগ্র এবং বিকৃত জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সাম্রাজ্যবাদ, ঔপনিবেশিকতা, নয়া ঔপনিবেশিকতার উদ্ভব হয়। সুতরাং বিকৃত জাতীয়তাবাদই আন্তর্জাতিকতার একমাত্র শত্রু। সাহিত্য সম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এই অমঙ্গল সৃষ্টিকারী পশ্চিমি বিকৃত জাতীয়তাবাদকে তাই ঘোরতর পৈশাচিক পাপ বলে তীব্র নিন্দা করেছেন।
(5) আদর্শ জাতীয়তাবাদ
আদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার একটি সুসম্পর্ক রয়েছে। আদর্শ জাতীয়তাবাদ মানুষের মনে যে স্বদেশপ্রীতির সৃষ্টি করে তা ক্রমে বিশ্বপ্রীতিতে রূপান্তরিত হয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজের জাতিকে ভালোবাসতে শেখায়, সঙ্গে সঙ্গে অপর জাতিকে ভালোবাসার জন্য প্রেরণা দেয়। আদর্শ জাতীয়তাবাদ প্রগতিশীল। এর ফলে আন্তর্জাতিকতার পথ উন্মুক্ত হয়। প্রকৃত জাতীয়তাবাদী চিন্তাধারা কখনও সংকীর্ণ স্বার্থ ও চেতনার মধ্যে আবদ্ধ থাকে না। সকল দেশ ও মানুষের কল্যাণ কামনায় তা নিয়োজিত হয়।
আদর্শ জাতীয়তাবাদ নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও (Live and Let Others Live) এই বক্তব্য প্রচার করে বিশ্বসভ্যতার প্রগতিকে উন্মুক্ত করেছে। তাই জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতাবাদে উত্তরণের অন্যতম সোপান। জাতীয়তাবাদের প্রবক্তা ম্যাৎসিনি-র মতানুসারে, আদর্শ জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ জাতিসমূহ আন্তর্জাতিকতার পথে কোনো অন্তরায় সৃষ্টি করে না। জিমার্ন-এর মতে, জাতীয়তাবাদের পথেই আন্তর্জাতিকতায় যাওয়া যায়। তাই একথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, আদর্শ জাতীয়তাবাদকে বাদ দিয়ে আন্তর্জাতিকতার পরিবেশ গড়ে তোলা সম্ভব নয়।
(6) জাতীয়তাবাদী মুক্তি আন্দোলন
প্রকৃত জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাকে শক্তিশালী করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এশিয়া, আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকায় সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের মাধ্যমে বহুদেশ স্বাধীনতার আস্বাদ লাভ করেছে। এই তিন মহাদেশের সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয়তাবাদী সংগ্রাম আন্তর্জাতিকতার আদর্শকে শক্তিশালী করেছে। নির্যাতিত জাতির মুক্তি আন্দোলনে বিশ্ববাসীর সমর্থন আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত করেছে। ঔপনিবেশিকতাবাদ বিরোধী তৃতীয় বিশ্বের আন্দোলন এক আন্তর্জাতিক আন্দোলনের রূপ নিয়েছে। তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলির সহযোগী মানসিকতা জাতীয়তার সীমারেখা অতিক্রম করে আন্তর্জাতিকতায় পরিণত হয়েছে।
(7) মার্কসবাদী অভিমত
মার্কসবাদী চিন্তাবিদরা প্রচলিত ধারা থেকে পৃথক হয়ে একটু ভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার ধারণাকে বিশ্লেষণ করেছেন। এঁনারা মনে করেন স্বাধীনতা এবং সার্বভৌমিকতা হল জাতীয়তাবাদের সমার্থক। তাই তারা এই দুটি ধারণাকে পৃথক করে চিহ্নিত করার চেষ্টা করেছেন এবং আন্তর্জাতিকতাবাদকে অধিক গ্রহণযোগ্য বলে মনে করেছেন। ভিন্ন ভিন্ন রাষ্ট্রের বুর্জোয়াদের মধ্যে স্বার্থগত ভিন্নতার কারণে বিরোধের সৃষ্টি হয়। কিন্তু, বিশ্বের যে-কোনো প্রান্তের প্রলেতারিয়েতদের শ্রেণিস্বার্থ মূলত অভিন্ন হয়ে থাকে। ফলত সহজেই তাদের মধ্যে ঐক্যবোধ, সংহতি স্থাপন করা সম্ভব হয়। এই সংহতিবোধই হল প্রলেতারীয় আন্তর্জাতিকতা, যা সুনিশ্চিতভাবে বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদ তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী। এই প্রলেতারিয়েত আন্তর্জাতিকতার অন্যতম প্রধান লক্ষ্যই হল শ্রমজীবি মানুষের শ্রেণিস্বার্থের সঙ্গে রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সমন্বয়সাধন করা।
উপসংহার
জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতার মধ্যে সমন্বয়সাধন খুব সহজ নয়। বিভিন্ন আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্ক মূলত জাতীয় স্বার্থের দ্বারাই পরিচালিত। বিখ্যাত দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল-এর মতে, জাতির সীমানার সঙ্গে রাষ্ট্রের সীমানা প্রায় এক না-হওয়া পর্যন্ত প্রকৃত আন্তর্জাতিকতা গড়ে উঠতে পারে না। তবে মানবজাতির মধ্যে যুদ্ধহীন এক নয়া বিশ্ব গঠনের স্বপ্ন বহু আগেই, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ধ্বংসলীলার পর মূর্ত হয়ে উঠেছে এ কথা বলা যায়। সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ। জাতিপুঞ্জ আন্তর্জাতিকতার স্বপ্ন বাস্তবায়িত করার কাজে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
আদর্শ জাতীয়তাবাদ এজন্য সহযোগী পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। আদর্শ জাতীয়তাবাদের সঙ্গে আন্তর্জাতিকতার কোনো দ্বন্দ্ব নেই। কিন্তু, সংকীর্ণ বা বিকৃত জাতীয়তাবাদকে মানবসভ্যতা এবং আন্তর্জাতিকতার চরমতম শত্রু বলে অনেকে মনে করেন। বস্তুতপক্ষে, মানবসভ্যতার যথার্থ বিকাশসাধনে জাতীয়তাবাদ ও আন্তর্জাতিকতাবাদের সুষ্ঠু সমন্বয়সাধন অত্যন্ত জরুরি। এই সমন্বয়সাধনের ওপর মানবসভ্যতার ভবিষ্যৎ নির্ভরশীল বলে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা অনেকে মনে করেন।
Read More – The Garden Party Question Answer