প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্য | প্রত্যক্ষণের ধর্ম | প্রত্যক্ষণের পর্যায় | প্রত্যক্ষণের উপাদান | প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের গুরুত্ব

প্রত্যক্ষণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কয়েকটি স্তরের ভিতর দিয়ে সংবেদন প্রত্যক্ষণের স্তরে উন্নত হয়। এই স্তরগুলি হল-পৃথক্করণ, সদৃশকরণ, অনুষঙ্গ, পুনরুৎপাদন, স্থানকাল নির্দেশ এবং বিশ্বাস।

প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্য | প্রত্যক্ষণের ধর্ম | প্রত্যক্ষণের পর্যায় | প্রত্যক্ষণের উপাদান | প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের গুরুত্ব
প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্য | প্রত্যক্ষণের ধর্ম | প্রত্যক্ষণের পর্যায় | প্রত্যক্ষণের উপাদান | প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ | শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের গুরুত্ব

প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্য

মানসিক প্রক্রিয়া: (i) যে-কোনো ধরনের প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে উপস্থাপন ও পুনরুৎপাদন এই দুই ধরনের মানসিক ক্রিয়া কাজ করে। (ii) যে-কোনো ধরনের প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে জ্ঞানমূলক ও প্রত্যভিজ্ঞামূলক প্রক্রিয়া কাজ করে। জ্ঞানমূলক প্রক্রিয়া দ্বারা কোনো বস্তুর অস্তিত্ব সম্বন্ধে জানা যায় আর প্রত্যভিজ্ঞা দ্বারা তাকে চেনা যায়। সুতরাং প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে বস্তুর অস্তিত্ব ও বিশেষত্ব উভয়ই উপলব্ধি করা যায়। (iii) প্রতি মুহূর্তে আমরা নানা ধরনের উদ্দীপকের সম্মুখীন হই। যখন মন সক্রিয়ভাবে অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সংবেদনের অর্থ উপলব্ধি করতে পারে তাই হল প্রত্যক্ষণ। সুতরাং প্রত্যক্ষণ হল সক্রিয় মানসিক প্রক্রিয়া।

নির্বাচনমূলক প্রক্রিয়া: আমাদের সামনে অসংখ্য উদ্দীপক রয়েছে, তার মধ্যে থেকে একটিকে বেছে নিয়ে যে-কোনো ইন্দ্রিয়ের কাছে হাজির করে এবং ওই উদ্দীপক স্নায়ু দ্বারা বাহিত হয়ে মস্তিষ্কে সংবেদন সৃষ্টি করে। সেই সংবেদন যখন অতীত অভিজ্ঞতার সঙ্গে যুক্ত হয়ে অর্থ বুঝতে সমর্থ হয়, তখন হয় প্রত্যক্ষণ।

সংশ্লেষক প্রক্রিয়া: যখন কোনো কিছু প্রত্যক্ষণ হয়, তখন তাকে একক হিসেবে দেখি অর্থাৎ বিভিন্ন সংবেদনের সংশ্লেষণের ফলে একক অভিজ্ঞতা সঞ্চয়নই হল প্রত্যক্ষণ।

সুসংগঠিত রূপ: কোনো বস্তুর বিভিন্ন অংশগুলি বিচ্ছিন্নভাবে দেখা না দিয়ে যখন বিচ্ছিন্ন রূপগুলি ঐক্যবদ্ধ ও সুসংগঠিত হয়, তখন সেই বস্তুকে আমরা প্রত্যক্ষণ করি।

মনোযোগনির্ভর: প্রত্যক্ষণের জন্য প্রয়োজন বিভিন্ন ধরনের সংবেদনমূলক বৈশিষ্ট্যসমূহের বিশ্লেষণ। বিশ্লেষণের জন্য প্রয়োজন মনোযোগ। তাই প্রত্যক্ষণ হল মনোযোগনির্ভর।

স্মৃতিনির্ভর: প্রত্যক্ষণের একটি বৈশিষ্ট্য হল পুনরুৎপাদন। পুনরুৎপাদনের জন্য স্মৃতির প্রয়োজন। তাই প্রত্যক্ষণ স্মৃতিনির্ভর প্রক্রিয়া।

পটভূমি: প্রত্যক্ষণের সময় বিশেষ পটভূমিতে সেই বস্তুর অবয়ব দেখি। যেমন- একজন ব্যক্তিকে কোনো সামাজিক কাজে প্রত্যক্ষণ করছি এক্ষেত্রে তার পটভূমি হল সামাজিক কাজ এবং সে যে কাজ করছে, তা হল তার অবয়ব।

ধর্ম: প্রত্যক্ষণের জন্য চারটি ধর্ম রয়েছে। সেগুলি হল- গুণ, তীব্রতা, ব্যাপ্তি ও স্থায়িত্ব। দর্শন, শ্রবণ, ঘ্রাণ, স্বাদ ইত্যাদি হল গুণ। তীব্রতা হল গাঢ় রং বা হালকা রং, জোড়ে শব্দ বা আস্তে শব্দ ইত্যাদি। ব্যাপ্তি বলতে বোঝায় প্রত্যক্ষণের বিষয় কতটা জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে রয়েছে। স্থায়িত্ব বলতে বোঝায় প্রত্যক্ষণের বস্তু কতটা সময় ধরে বর্তমান।

ব্যক্তিগত পার্থক্য: যে-কোনো বস্তু বা ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত পার্থক্য দেখা যায়। যেমন- একজন ব্যক্তি ঝাল খেতে পছন্দ করে, আবার একজন ব্যক্তি মিষ্টি খেতে পছন্দ করে। উভয়ের প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে পার্থক্য লক্ষ করা যাবে।

অনুভূতিনির্ভর : প্রত্যক্ষণ অনুভূতিনির্ভর। একই বস্তু বা ঘটনা কোনো ব্যক্তির কাছে সুখকর অনুভূতি দেয় আবার ওই ঘটনা বা বস্তু অপর ব্যক্তির কাছে সুখকর অনুভূতির সৃষ্টি নাও করতে পারে।

দৃষ্টিভঙ্গি নির্ভর: একই বস্তু বা ঘটনা বা ব্যক্তির প্রতি বিভিন্ন জনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য দেখা যায় ফলে প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রেও পার্থক্য থাকবে।

অভিজ্ঞতা: প্রত্যক্ষণের সঙ্গে বর্তমান ও অতীত উভয় ধরনের অভিজ্ঞতা যুক্ত। বিভিন্ন ধরনের মানসিক বৈশিষ্ট্য যেমন- প্রক্ষোভ, অনুরাগ, প্রেষণা, মনোভাব ইত্যাদি প্রত্যক্ষণে অভিজ্ঞতার সমন্বয়ে সাহায্য করে।

অর্থপূর্ণতা: আমরা যে-সমস্ত বস্তু প্রত্যক্ষ করি তার সঙ্গে বিশেষ কিছু জ্ঞান আরোপিত করে বস্তুটি সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভ করি। বস্তুটি কী ধরনের অর্থ বহন করবে তা নির্ভর করবে বস্তুটির নিজস্ব প্রকৃতি এবং বস্তুটি কী পরিমাণে আমাদের প্রত্যক্ষণকে প্রভাবিত করে তার উপর।

স্থানব্যাপ্তি: কোনো জিনিসকে আমরা ছোটো দেখি আবার কোনো জিনিসকে আমরা বড়ো দেখি। প্রত্যক্ষণের এই বৈশিষ্ট্যকে বলা হয় স্থানব্যাপ্তি। ত্বক ও অক্ষিপটের উপর প্রত্যেক বিন্দুর এক-একটি বিশেষ গুণ আছে, যার দ্বারা কোনো বিস্তৃত উদ্দীপকের প্রত্যেক বিন্দুর বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে জ্ঞান পাওয়া যায়। এই বিশেষত্বকে বলা হয় স্থানীয় সংকেত।

সক্রিয়তামূলক প্রক্রিয়া: প্রত্যক্ষণ তখনই সম্ভব হয়, যখন মন সক্রিয়ভাবে অতীত অভিজ্ঞতার আলোকে বর্তমান সংবেদনের অর্থ অনুধাবন করতে সমর্থ হয়।

ভ্রান্ত প্রত্যক্ষ : প্রত্যক্ষণ অনেকসময় ভ্রান্তও হতে পারে। যখন সংবেদনকে আমরা সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে পারি, তখন তাকে বলা হয় প্রত্যক্ষণ। কিন্তু যখন আমরা সংবেদনকে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করতে অসমর্থ হই তখন ভ্রান্ত প্রত্যক্ষণের সৃষ্টি হয়। এটিও প্রত্যক্ষণের একটি বৈশিষ্ট্য।

সুতরাং প্রত্যক্ষণের বৈশিষ্ট্যগুলিকে পর্যালোচনা করে বলা যায় প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে ইন্দ্রিয়জাত সংবেদনগুলি বিশ্লিষ্ট হয় এবং পরবর্তী পর্যায়ে তা অতীত অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংশ্লেষিত হয়ে সুসংবদ্ধ এককধর্মী জ্ঞান আহরণে সাহায্য করে।

প্রত্যক্ষণের ধর্ম

গুণ: বিভিন্ন ধরনের প্রত্যক্ষণ গুণগত দিক দিয়ে পৃথক। তাদের উৎসের মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। যেমন- রং, শব্দ, গন্ধ, স্বাদ, ঠান্ডা, গরম ইত্যাদি প্রত্যক্ষণসমূহ পরস্পর গুণগত পার্থক্যযুক্ত।

তীব্রতা : ক্ষীণ শব্দ, তীব্র শব্দ, ক্ষীণ আলো, তীব্র আলো, ভারী-হালকা ইত্যাদি তীব্রতাবোধক বিষয়গুলি প্রত্যক্ষণের গুরুত্বপূর্ণ ধর্ম।

বিস্তৃতি: কোনো একটি বস্তু অনেকটা স্থান জুড়ে রয়েছে বা অপর একটি বস্তু কম অংশ জুড়ে রয়েছে, এটি হল বিস্তৃতি। বিস্তৃতি দ্বারা প্রত্যক্ষণের বস্তুর অবস্থানকে চেনা যায়।

স্থায়িত্ব: প্রত্যক্ষণে কোনো একটি বস্তু বা ঘটনা যেমন অনেকক্ষণ স্থায়ী হতে পারে, আবার কোনো বস্তু বা ঘটনা স্বল্প স্থায়ীও হতে পারে। যেমন- একটি মিটিং-এর স্থায়িত্বকাল অনেক বেশিও হতে পারে আবার কোনো একটি মিটিং-এর স্থায়িত্বকাল অল্প সময়ের জন্যও হতে পারে।

অভিনবত্ব: অভিনব উদ্দীপকের প্রতি প্রত্যক্ষণের আগ্রহ বাড়ে আবার পুরোনো প্রত্যক্ষণযুক্ত বিষয়ের প্রতি আগ্রহ কম হয়।

পুনরাবৃত্তি: প্রত্যক্ষণের ক্ষেত্রে একই উদ্দীপককে যদি বার বার উপস্থাপন করা হয় অর্থাৎ পুনরাবৃত্তি হয়, তবে সেই উদ্দীপক শক্তিশালী হয়।

মনোভাব: যে-বস্তু বা উদ্দীপকের প্রতি আমাদের মনোভাব বেশি হয়, তার প্রতি আমাদের প্রত্যক্ষণের দৃঢ়তা বাড়ে।

প্রেষণা: প্রত্যক্ষণের বন্ধনকে স্থায়ী করতে হলে উদ্দীপক নির্বাচনের জন্য প্রেষণা জাগ্রত করা প্রয়োজন। যে-বস্তু বা বিষয়ের প্রতি প্রেষণা বর্তমান থাকে, সেই বস্তু যা বিষয়ের প্রতি প্রত্যক্ষণ সহজ হয়।

চেষ্টানির্ভর: প্রত্যক্ষণের মধ্যে একটি ক্রমাগত প্রচেষ্টা ও ভুলের ক্রিয়া থাকে। প্রত্যক্ষণের জন্য প্রাণী নানারকম অঙ্গসঞ্চালন করে, যতক্ষণ না পর্যন্ত সে কৃতকার্য হয়। 

প্রত্যক্ষণের মনোবৈজ্ঞানিক বিশ্লেষণ বা প্রত্যক্ষণের পর্যায় 

প্রত্যক্ষণকে বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে যে, কয়েকটি স্তরের ভিতর দিয়ে সংবেদন প্রত্যক্ষণের স্তরে উন্নত হয়। এই স্তরগুলি হল-পৃথক্করণ, সদৃশকরণ, অনুষঙ্গ, পুনরুৎপাদন, স্থানকাল নির্দেশ এবং বিশ্বাস। এই স্তরগুলি সম্পর্কে নিম্নে আলোচনা করা হল-

পৃথক্করণ (Discrimination): প্রত্যক্ষণের প্রথম স্তরটি হল পৃথক্করণ। এই স্তরে কোনো বস্তুকে প্রত্যক্ষ করার জন্য অপর বস্তু থেকে তাকে পৃথক করা হয়। অর্থাৎ বিজাতীয় বস্তুগলি থেকে ওই বিশেষ বস্তুটিকে পৃথক করে দেখা হয়। যেমন-কোনো বস্তুকে ‘খাতা’ হিসেবে জানতে হলে যে-সমস্ত বস্তু ‘খাতা’ নয়, এমনসব বিজাতীয় বস্তু যেমন-বই, কালি, কলম, কম্পাস, পেনসিল ইত্যাদি থেকে সে যে পৃথক, তা জানা একান্তভাবে প্রয়োজনীয়।

সদৃশকরণ (Assimilation): দ্বিতীয় স্তরে পৃথকৃত বস্তুকে অন্যান্য সদৃশ সংবেদনের সঙ্গে অতীতে যেসব সংবেদন পাওয়া গেছে, তাদের সঙ্গে সাদৃশ্য খোঁজা হয়। যেমন- রাস্তায় পড়ে থাকা বিশেষ কৌশলে প্রস্তুত বস্তুটিকে ‘কলম’ বলে জানতে হলে অতীতে যেসব কলমের অভিজ্ঞতা আছে, তার সঙ্গে বর্তমান ‘কলমের’ যে সাদৃশ্য আছে তা অনুধাবন করা হয়। এইভাবে বুঝে নেওয়ার প্রক্রিয়াকে বলা হয় সদৃশকরণের প্রক্রিয়া।

অনুষঙ্গ ও পুনরুৎপাদন (Association and Reproduction): তৃতীয় স্তরে প্রত্যক্ষণ প্রক্রিয়া তখনই সংঘটিত হয়, যখন মানসপটে লক্ষ লক্ষ অভিজ্ঞতার পুনরুৎপাদন ঘটে এবং বর্তমান অভিজ্ঞতার সঙ্গে লব্ধ অভিজ্ঞতার অনুষঙ্গ স্থাপিত হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ‘কলমের’ প্রত্যক্ষণের জন্য পূর্বে কলমকে দেখে যে অভিজ্ঞতা হয়েছিল, সেই অভিজ্ঞতার যেমন পুনরুৎপাদন প্রয়োজন, তেমনই অনুষঙ্গ স্থাপনের মাধ্যমে তাকে চিনে রাখাও প্রয়োজন।

বন্ধুচেতনা ও খানকাল নির্দেশ (Objectification and Localisation) : চতুর্থ স্তরে সংবেদনটির স্থান ও কাল নির্দেশ করা হয়। অর্থাৎ সংবেদন যা থেকে সৃষ্ট হয়, সেটি যে বাহ্যিক জগতের একটি বস্তু এবং ওই বস্তুটি যে একটি নির্দিষ্ট স্থান ও কালে অবস্থিত তা প্রত্যক্ষণের দ্বারা নিরূপণ করা হয়।

বিশ্বাস (Belief): যে বস্তুর জন্য সংবেদন সৃষ্টি হচ্ছে, তাকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে প্রত্যক্ষণের স্তরে উন্নীত করতে হলে বিশ্বাসের প্রয়োজন। কারণ প্রত্যক্ষণের ফলে যে বস্তুটি সম্বন্ধে অভিজ্ঞতা অর্জিত করা হল তা যে একটি যথার্থ বস্তু সেই বিষয়ে প্রত্যক্ষণই হল বিশ্বাস।

প্রত্যক্ষণের উপাদান

প্রত্যক্ষণের উপাদানগুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ হল—

শিখন: কোনো জিনিস যখন প্রত্যক্ষণ করা হয় তখন সে সম্বন্ধে আমাদের অভিজ্ঞতা হয় এবং অভিজ্ঞতার সঞ্চয়নই হল শিখন। তাই বিশ্বজগতে যা-ই প্রত্যক্ষ করি না কেন, প্রতি ক্ষেত্রে শিখন ঘটে।

সামাজিক মনোভাব: জন্মের পর থেকে পরিবার, সমাজ, বিদ্যালয় বিভিন্ন সামাজিক প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন আচার, আচরণ, রীতি-নীতি ইত্যাদি প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমাদের মধ্যে সামাজিক মনোভাব জাগ্রত হয়।

পূর্ব অভিজ্ঞতা: পূর্ব অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে আমরা অনেকসময় বর্তমান অনেক অভিজ্ঞতাকে প্রত্যক্ষণ করি, তাই পূর্ব অভিজ্ঞতা প্রত্যক্ষণের আর একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান।

প্রেষণা: যদি ব্যক্তির মধ্যে প্রেষণা সঞ্চার করা হয়, তবে প্রেষণা বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাহায্য করে। যেমন-কোনো শিক্ষার্থীকে কোনো বিষয়ে পাঠগ্রহণে প্রেষণা সঞ্চার করা হল তখন সেই শিক্ষার্থী ওই বিষয়টিকে আরও ভালোভাবে প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আয়ত্ত করার চেষ্টা করে।

মূল্যবোধ: মানুষের মধ্যে মূল্যবোধ জাগ্রত করা উচিত। বিভিন্ন ব্যক্তির বিভিন্ন মূল্যবোধ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে একজন ব্যক্তির মধ্যে বিভিন্ন মূল্যবোধ জাগ্রত হয়। যেমন- আমরা সুভাষ চন্দ্র বসুর দেশাত্মবোধকে উপলব্ধি করি বই, পত্রপত্রিকা প্রত্যক্ষণ করে। নৈতিকতাবোধ, সহযোগিতা, সহানুভূতি ইত্যাদি মূল্যবোধ জাগ্রত করতে হলে প্রয়োজন যথাযথ প্রত্যক্ষণের।

প্রত্যাশা: কোনোকিছু পাওয়ার আশায় আমাদের অনেককিছুকে ভালোভাবে প্রত্যক্ষণ করতে হয়। একেই বলা হয় প্রত্যাশা। যেমন-কোনোকিছুতে সাফল্যলাভের প্রত্যাশা সম্ভব হয় যথাযথ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে।

প্রত্যক্ষণের শ্রেণিবিভাগ

সংবেদনের উপর নির্ভর করে প্রত্যক্ষণ হয়। চোখ, কান, নাক, জিহ্বা ও ত্বকের সাহায্যে বাইরের বস্তুর সঙ্গে যোগাযোগ হয় এবং সংবেদনও সেইমতো পাঁচ ধরনের ভাবা যায়। যেহেতু প্রত্যক্ষণ সংবেদননির্ভর, তাই প্রত্যক্ষণও পাঁচ প্রকার হয়। যথা –

দর্শনজনিত প্রত্যক্ষণ (Visual Perception): এই প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে কোনো দর্শনজাত বস্তু সম্পর্কে আমরা জ্ঞান লাভ করতে পারি।

শ্রবণজনিত প্রত্যক্ষণ (Auditory Perception) : শ্রবণজনিত প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমরা পরিবেশ থেকে আগত বিভিন্ন শব্দকে বুঝতে পারি। যেমন-কোন্টি কাকের ডাক বা কোন্টি কোকিলের ডাক, তা বুঝতে পারি।

স্পশর্জনিত প্রত্যক্ষণ (Tactual Perception): এই ধরনের প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ধরনের স্পর্শ অনুভব করতে পারি। যেমন-কোন্ পদার্থটি গরম বা কোন্ পদার্থটি ঠান্ডা ইত্যাদি।

স্বাদজনিত প্রত্যক্ষণ (Gustatory Perception): খাদ্যবস্তু ঝাল বা টক অথবা মিষ্টি, তা বোঝা যায় এই প্রত্যক্ষণের মাধ্যমে।

গন্ধলব্ধ প্রত্যক্ষণ (Perception of Smell): কোনো বস্তুর গন্ধ, যেমন- গোলাপের গন্ধ, রান্নার গন্ধ ইত্যাদি আমরা গন্ধলব্ধ প্রত্যক্ষণের মাধ্যমেই বুঝতে পারি।

অনেক মনোবিদ প্রত্যক্ষণকে আবার তিন ভাগে ভাগ করেছেন। যথা-

সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ (Direct Perception): সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণ বলতে বোঝায় আমাদের যে পাঁচটি জ্ঞানেন্দ্রিয় রয়েছে, সেগুলির মধ্যে থেকে যে-কোনো একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে কোনো একটি বস্তুর বিশেষ কোনো গুণকে জানা বা নির্ধারণ করা। যেমন-অতিরিক্ত গরম জলে আঙুল দিয়ে স্পর্শ করলে জলটি কতটা গরম, সে সম্পর্কে জানা যায়। সাক্ষাৎ প্রত্যক্ষণকে মৌলিক প্রত্যক্ষণও বলা হয়।

অর্জিত প্রত্যক্ষণ (Acquired Perception): যে সংবেদন বিশেষ ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পাওয়ার কথা, তা যদি সেই নির্দিষ্ট ইন্দ্রিয় ছাড়া অন্য একটি ইন্দ্রিয়ের মাধ্যমে পাওয়া যায়, তখন তাকে অর্জিত প্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন – অতীতে বরফে হাত দিয়ে দেখেছি, তা ঠান্ডা। বর্তমানে বরফের দিকে তাকালেই আমাদের পূর্ব অভিজ্ঞতা মনে পড়ে।সংপ্রত্যক্ষণ (Apperception): মনের মধ্যে যেসকল অভিজ্ঞতা পূর্ব থেকেই সুসংবদ্ধ হয়ে আছে, সেগুলি অভিজ্ঞতার আলোকে যখন কোনো নতুন ঘটনাকে প্রত্যক্ষ করা হয়, তখন সেই প্রত্যক্ষণকে সংপ্রত্যক্ষণ বলা হয়। যেমন কোনো একজন সাধারণ মানুষ একটি মাছকে দেখে শুধুমাত্র একটি মাছ হিসেবেই প্রত্যক্ষণ করেন। কিন্তু একজন মৎস্যবিজ্ঞানী ওই মাছটিকে ভালো করে নিরীক্ষণ করেন এবং পূর্ববর্তী অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে মাছটির শ্রেণিবিন্যাস করেন।

শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণের গুরুত্ব

আধুনিক শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ শিক্ষার্থীকে বস্তুধর্মী অভিজ্ঞতা গঠনে সাহায্য করে এবং বস্তুর সামগ্রিক রূপটিকে প্রত্যক্ষণ করতে সাহায্য করে। শিক্ষায় প্রত্যক্ষণের প্রভাবগুলি হল নিম্নরূপ-

শিখন : শিক্ষার জন্য যে ব্যক্তিগত প্রক্রিয়া সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তার মধ্যে প্রথম হল শিখন। শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা অভিজ্ঞতা অর্জন করে। প্রত্যক্ষণ শিখনকে প্রভাবিত করে। সঠিক প্রত্যক্ষণ যেমন শিখন প্রক্রিয়াকে সহজ করে তোলে, তেমনই ত্রুটিপূর্ণ প্রত্যক্ষণ শিখন প্রক্রিয়াকে সমস্যাপূর্ণ করে তুলতে পারে।

ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ ও প্রত্যক্ষণ : ইন্দ্রিয়গুলি হল আমাদের সকল অভিজ্ঞতার মূলভিত্তি। ইন্দ্রিয়ের সুসংহত বিকাশ না ঘটলে প্রত্যক্ষণের কাজ সঠিক হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। যেহেতু জ্ঞান অর্জনের প্রধান ভিত্তি ইন্দ্রিয় প্রশিক্ষণ, তাই এর উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এই ধরনের প্রশিক্ষণ পরবর্তীকালে শিশুর শিক্ষার পথকে প্রশস্ত করে।

অনুকরণ: শিশুরা বয়স্কদের অনুকরণের মাধ্যমে অনেক কিছু শেখে। শিক্ষক ও অভিভাবক তাদের রোল মডেল হিসেবে কাজ করে। অনুকরণমূলক শিখনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ কার্যকরী ভূমিকা নেয়। তাই শিক্ষক বা অভিভাবকদের এমন কিছু আচরণ করা উচিত নয়, যা প্রত্যক্ষণ করে শিশুদের মধ্যে কুঅভ্যাস গড়ে উঠতে পারে।

দক্ষতা অর্জন: শিক্ষার উদ্দেশ্য হল শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন দক্ষতা অর্জনে সাহায্য করা, এই দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নির্দিষ্ট দক্ষতা কী উপায়ে সম্পন্ন হচ্ছে তার বিভিন্ন পর্যায়গুলিকে সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলে তবেই সঠিক দক্ষতা অর্জন করা যায়। প্রত্যক্ষণ সঠিক না হলে দক্ষতা অর্জনে সমস্যা আসে।

সমস্যা সমাধান: শিক্ষার অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হল সমস্যা সমাধান। সমস্যা সমাধানের মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের অভিজ্ঞতা অর্জন সম্ভব হয়। যথাযথ প্রত্যক্ষণ সমস্যা সমাধানে সাহায্য করে।

অর্জিত জ্ঞানের প্রয়োগ: অর্জিত জ্ঞানকে নতুন পরিস্থিতিতে সঠিকভাবে প্রয়োগ করার জন্য পূর্ব অভিজ্ঞতাকে বর্তমান অভিজ্ঞতার সঙ্গে অভিযোজন করার প্রয়োজন হয়। এই অভিযোজনের ক্ষেত্রে উভয় ধরনের অভিজ্ঞতার যথাযথভাবে প্রত্যক্ষণের প্রয়োজন। তাই শিক্ষার্থীর প্রয়োগ করার ক্ষমতা নির্ভুলভাবে প্রত্যক্ষণ করার ক্ষমতার উপর নির্ভর করে।

পাঠ আয়ত্তীকরণ : পাঠ্য বিষয়ের অন্তর্ভুক্ত জ্ঞানকে আয়ত্ত করতে হলে বিভিন্ন বিষয়ের বিভিন্নভাবে প্রত্যক্ষণ প্রয়োজন। যেমন- জ্যামিতির জ্ঞান যথাযথভাবে অর্জন করতে হলে জ্যামিতিক চিত্র ভালোভাবে প্রত্যক্ষণ করা দরকার। আবার সাহিত্যের জ্ঞান আহরণে সাহিত্যের দিককে যথাযথভাবে প্রত্যক্ষণ করা দরকার। বিজ্ঞানের জ্ঞান আহরণের জন্য বিভিন্ন যে পরীক্ষা-নিরীক্ষা রয়েছে, সেগুলিকে ভালোভাবে প্রত্যক্ষণ করা উচিত ইত্যাদি।

সক্রিয়তা: প্রত্যক্ষণের জন্য প্রয়োজন সক্রিয়তা। শিক্ষাও হবে সক্রিয়তাভিত্তিক। তাই প্রত্যক্ষণ ও শিক্ষা উভয়েই সক্রিয়তার উপর নির্ভরশীল।

সুতরাং শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ যথাযথ না হলে শিক্ষা সফল হয় না। বিভিন্ন ধরনের শিখনকে সহজ ও স্থায়ী করে তুলতে হলে প্রয়োজন যথাযথ প্রত্যক্ষণের। প্রত্যক্ষণ, শিখন প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, তাই শিখনের মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা সম্ভব। শিক্ষকের উচিত শিক্ষার্থীদের যথাযথ প্রত্যক্ষণ ক্ষমতা যাতে বাড়ে সেদিকে নজর দেওয়া। তাই বলা যায় শিক্ষাক্ষেত্রে প্রত্যক্ষণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

আরও পড়ুনLink
শ্রীমদ্ভগবতগীতা – নিষ্কাম কর্মের ধারণা প্রশ্ন উত্তরClick Here
বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তরClick Here
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তরClick Here
নিরপেক্ষ ন্যায় – মূর্তি, সংস্থান ও বৈধতা বিচারClick Here

Leave a Comment