মৌলিক অধিকারের প্রকৃতি আলোচনা করো

মৌলিক অধিকারের প্রকৃতি
প্রায়োগিক বাস্তবতা ও মূলগত বৈশিষ্ট্যের নিরিখে ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত ও সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারসমূহের প্রকৃতি অনুধাবন করা যায়। মৌলিক অধিকারের প্রকৃতির বিষয়টিকে নিম্নরূপে ব্যক্ত করা হল-
(1) আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বে স্থাপিত
সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে। তার ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কোনো কার্যকলাপের দ্বারা মৌলিক অধিকারগুলিকে ক্ষুণ্ণ করা যায় না।
(2) মৌলিক অধিকারগুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য
ভারতের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন-সাম্যের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি কোনোভাবে লঙ্ঘন করা হলে ব্যক্তির মতো গোষ্ঠীও বিচারালয়ে আবেদন করতে পারে।
(3) জরুরি অবস্থায় অধিকারগুলি ক্ষুন্ন হতে পারে
এ কে আয়ার-এর মতে, জাতীয় নিরাপত্তার বনিয়াদের উপর ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলি প্রতিষ্ঠিত। তাই দেশ ও জাতি যখন সংকটের সম্মুখীন হয়, তখন নিরাপত্তার স্বার্থে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারগুলিকে নিয়ন্ত্রণ বা স্থগিত করার ব্যবস্থাও সংবিধানে উল্লেখ করা রয়েছে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, সংবিধানের ৩৫৮ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, জরুরি অবস্থা ঘোষিত হওয়ার পর পার্লামেন্ট আইন প্রণয়ন করে অথবা শাসন বিভাগ কোনো আদেশ জারি করে ১৯ নং ধারায় বর্ণিত মৌলিক অধিকারকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে।
(4) প্রকৃতিগতভাবে মৌলিক অধিকারগুলি সামাজিক ও রাজনৈতিক
ভারতের সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি মূলত সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রকৃতি। নাগরিকদের যাতে ব্যক্তিত্বের বিকাশ ঘটে, সমাজ ও রাষ্ট্রীয় জীবনে সে যাতে উপযুক্ত মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত হতে পারে সেজন্য তাদের কিছু মৌলিক অধিকারের প্রয়োজন হয়। তবে মৌলিক অধিকার লঙ্ঘিত হলে নাগরিক আদালতের শরণাপন্ন হতে পারে (৩২ নং ধারা)।
(5) সকলের জন্য মৌলিক অধিকার প্রযোজ্য নয়
মৌলিক অধিকারের মধ্যে কিছু অধিকার আছে যা একমাত্র ভারতীয় নাগরিকগণই ভোগ করতে পারবে। যেমন-সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার, বাক্ ও মতপ্রকাশের অধিকার প্রভৃতি। আবার এমন কতকগুলি অধিকার আছে যেগুলি নাগরিক-অনাগরিক (বিদেশি) সকলেই সমানভাবে ভোগ করতে সমর্থ, যেমন-আইনের দৃষ্টিতে সাম্য, ধর্মের অধিকার, শোষণের বিরুদ্ধে অধিকার প্রভৃতি।
(6) অনিয়ন্ত্রিত নয়
ভারতীয় নাগরিকগণের মৌলিক অধিকারগুলি অনিয়ন্ত্রিত নয়। সংবিধানে বর্ণিত প্রত্যেকটি মৌলিক অধিকারের উপর কোনো-না-কোনো শর্ত আরোপ করা হয়েছে, যেমন-সামাজিক শৃঙ্খলা, জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বজায় রাখার জন্য মৌলিক অধিকারের উপর বাধানিষেধ আরোপ করা প্রভৃতি। তবে এই বাধানিষেধ যুক্তিসংগত কি না তা বিচারের দায়িত্ব আদালতের উপরই ন্যস্ত করা হয়েছে।
(7) সরকার ও আইনসভার বিরুদ্ধে প্রযোজ্য
বি আর আম্বেদকরের মতে, মৌলিক অধিকারগুলি আইন প্রণয়নে ক্ষমতাসম্পন্ন অথবা ক্ষমতাধিকারী যে-কোনো কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধেই প্রযোজ্য।
ইতিবাচক ও নেতিবাচক মৌলিক অধিকার
মৌলিক অধিকারের প্রকৃতিকে দুই দিক থেকে পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, মৌলিক অধিকারের মধ্যে কিছু গুণ বা ইতিবাচক দিক এবং কিছু দোষ বা নেতিবাচক দিক আছে। প্রথমে মৌলিক অধিকারের ইতিবাচক দিক বা গুণগুলি সম্পর্কে আলোচনা করা হল-
(1) নিবর্তনমূলক আটক আইনের গুরুত্ব
অনেক সমালোচকই নিবর্তনমূলক আটক আইনের সমালোচনা করেছেন। কিন্তু বিভিন্ন সময়ে অস্থির অবস্থা মোকাবিলা এবং বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এই ধরনের ক্ষমতার যে প্রয়োজন আছে, তা অস্বীকার করা যায় না। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯ নং ধারায় উল্লিখিত স্বাধীনতার অধিকারের উপর বাধানিষেধ আরোপ করা হয়েছে। আবার ৩২ নং ধারায় শাসনতান্ত্রিক প্রতিবিধানের মতো গুরুত্বপূর্ণ অধিকারের স্বীকৃতি দেওয়া হলেও জরুরি অবস্থার সময় উক্ত ধারার উপর বাধানিষেধ আরোপের ক্ষমতা রাষ্ট্রের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। এ ছাড়াও ১৯৬২ খ্রিস্টাব্দে প্রথম জরুরি অবস্থা জারির সময় ভারত রক্ষা আইন ও অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করে নাগরিকদের মৌলিক অধিকারভোগের সুযোগ থেকে বঞ্চিত করা হয় এবং ১৯৭৫ খ্রিস্টাব্দের জুন মাসে জাতীয় জরুরি অবস্থা জারি করে বহু নাগরিককে জাতীয় নিরাপত্তা আইনে আটক করে রাখা হয়।
(2) জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম
মৌলিক অধিকারগুলি জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে সমালোচিত হলেও সেটি পুরোপুরি ঠিক নয়, কারণ দেশে সুশাসন চালু রাখার স্বার্থে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা মানেই মৌলিক অধিকারের সংকোচন এই ধারণা ঠিক নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে তখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সেই সময় নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়নি।
(3) আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য
আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য অধিকারগুলিকে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নাম দিয়ে সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে নাগরিকগণ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রতিকারের দাবি জানাতে পারে।
নিম্নে মৌলিক অধিকারের প্রকৃতির নেতিবাচক দিক বা সীমাবদ্ধতাগুলি আলোচনা করা হল-
(1) জাতীয় স্বার্থ
ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও বাধানিষেধ এত বেশি পরিমাণে সংযোজিত আছে যে মৌলিক অধিকারভোগের সুষ্ঠু পরিবেশ ভারতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
(2) ক্রমাগত সংসদীয় আক্রমণ
সংবিধান অনুসারে ভারতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকারগুলিকে পরিবর্তন করতে পারে। অথচ বারংবার সংসদের হস্তক্ষেপের ফলে মৌলিক অধিকারগুলির অলঙ্ঘনীয় চরিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
(3) অর্থনৈতিক অধিকারের অনুপস্থিতি
সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি চারিত্রিকভাবে সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রকৃতির হয়। মৌলিক অধিকারে কর্মের অধিকার কিংবা শ্রমের মান অনুযায়ী পারিশ্রমিক লাভের অধিকার স্বীকৃত হয়নি অর্থাৎ অর্থনৈতিক অধিকারের অনুপস্থিতি মৌলিক অধিকারের ব্যাপকতার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করেছে।
মূল্যায়ন
মৌলিক অধিকারের উপরোক্ত পর্যালোচনার শেষে একথা বলা যায় যে, আইনের অধিকার প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে মৌলিক অধিকারের গুরুত্ব অপরিসীম। ভারতের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার মেরুদণ্ড হল নাগরিকদের মৌলিক অধিকার। তাই মানুষের মানবিক মর্যাদা ও সম্মান রক্ষায় মৌলিক অধিকারের ভূমিকা অনস্বীকার্য। তবে প্রকৃতিগত বিচারে মৌলিক অধিকার ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্র রক্ষার ক্ষেত্রে, সমাজের পিছিয়ে পড়া মানুষদের স্বার্থরক্ষার জন্য এবং সকল ভারতীয়দের নিরাপত্তা বিধানে সদর্থক ভূমিকা পালন করে।
Read More – The Garden Party Question Answer