নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester WBCHSE

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। নৈতিক বিচারের কর্তা কে? ব্যাখ্যা করো।

নৈতিক বিচারের কর্তা

নৈতিক বিচারের কর্তা কে? সেই আলোচনায় বিভিন্ন নীতিতাত্ত্বিক ভিন্ন ভিন্ন মত পোষণ করেছেন-

(1) বিবেক (Conscience): স্বজ্ঞাবাদী জোসেফ বাটলার (Joseph দুটি দিক বর্তমান- 

  • বিচারমূলক বা জ্ঞানাত্মক দিক (Reflective or Cognitive) 
  • এবং কর্তৃত্বমূলক বা অনুজ্ঞাসূচক দিক (Authoritative or Butler) আমাদের বিবেককে নৈতিক বিচারের কর্তারূপে (Subject of Moral Judgement) অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, আমাদের বিবেকের Imperative)। বিবেকের বিচারমূলক দিকটি কর্মকর্তার কর্ম, চরিত্র, উদ্দেশ্য, অভিপ্রায় প্রভৃতির ভালো-মন্দ বিচার করে। অন্যদিকে, বিবেকের কর্তৃত্বমূলক দিকটি কর্মকর্তার কর্ম, চরিত্র প্রভৃতি বিচার করে তাদের মধ্যে কোন্টিকে গ্রহণ করতে হবে তার নির্দেশ দিয়ে থাকে।

(2) নৈতিক সমঝদার (Moral Connoisseur): শ্যাফ্টস্বারি (Shaftsbury) বলেন, নৈতিক বিচারের কর্তা হলেন নৈতিক সমঝদার। কোনো শিল্পী যেমন কোনো শিল্পকর্মের ভালো-মন্দ বিচার করতে পারেন, নৈতিক সমঝদারও তেমনি মানুষের ঐচ্ছিক ক্রিয়ার ভালো-মন্দ বিচার করেন।

(3) নিরপেক্ষ দর্শক (Impartial Spectator): দার্শনিক অ্যাডাম স্মিথ (Adam Smith) বলেন, নৈতিক বিচারের কর্তা হলেন নিরপেক্ষ দর্শক। তাঁর মতে নিরপেক্ষ দর্শকরূপে ব্যক্তি প্রথমে নিজের কাজের এবং পরবর্তীতে অপরের কাজের নৈতিক বিচার করে। এইভাবে ঐচ্ছিক কর্মের নৈতিক বিচারে ব্যক্তি নিজেকে দুটি ভিন্ন সত্তারূপে মনে করেন-

  • নিরপেক্ষ বিচারকরূপে আমি এবং
  • বিচার্য ব্যক্তিরূপে আমি। প্রথম প্রকার ‘আমি’ হল নিরপেক্ষ দর্শক, বিচারক এবং দ্বিতীয় প্রকার ‘আমি’ হল কর্মকর্তা, অভিযুক্ত।

(4) আদর্শ আমি (Ideal Self): স্মিথের মতকে সমর্থন করে অধ্যাপক ম্যাকেঞ্জি (Mackenzie) আদর্শ আমিকে নৈতিক বিচারের কর্তারূপে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে, প্রত্যেক ব্যক্তির দুটি স্বতন্ত্র সত্তা রয়েছে-

  • আদর্শ আমি (Ideal Self) এবং 
  • বাস্তব আমি (Actual Self) | নৈতিক বিচারের কর্তারূপে ‘আদর্শ আমি’ নৈতিক আদর্শের ভিত্তিতে ‘বাস্তব আমি’-র কৃতকর্মের ভালো-মন্দ বিচার করে।

২। অ্যারিস্টটলের ন্যায়তত্ত্ব ব্যাখা করো।

অ্যারিস্টটলের ন্যায়তত্ত্ব

অ্যারিস্টট্ল ন্যায়পরায়ণতা শব্দটিকে দুটি অর্থে ব্যবহার করেন। যথা- নীতি (Law) ও বিধি (Conduct)

(1) নীতি: অ্যারিস্টট্ল মনে করেন সমাজস্থ প্রতিটি মানুষের একটি প্রামাণ্য আচরণবিধি থাকবে যাকে ন্যায়পরায়ণতার ধর্ম (Virtue of Rightousness) বা নৈতিক ন্যায়পরায়ণতা বলা যেতে পারে। সমাজের প্রতিটি মানুষ একে অপরের প্রতি সৎ গুণাবলি প্রদর্শন করবে। এই অর্থে ন্যায়বিচার হল এক ধরনের নৈতিক প্রবণতা (Moral Dispositon) যা মানুষকে ন্যায়সম্মত কাজ করতে প্রণোদিত করে। এই প্রকারের ন্যায়পরায়ণতা সম্পূর্ণ ন্যায়পরায়ণতা (Complete Justice)। এই ন্যায়পরায়ণতাকে অ্যারিস্টট্ল সর্বজনীন ন্যায়পরায়ণতা বলেছেন। এটি আইনের প্রতি সম্পূর্ণ আনুগত্যকে বোঝায়, যা কেবলমাত্র আদর্শরাষ্ট্রে থাকবে।

(2) বিধি: এই অর্থে ন্যায়পরায়ণতা বলতে অ্যারিস্টট্ল সমানতা বা তুল্যতা (Equality) -কে বুঝিয়েছেন। এটি হল ন্যায়পরায়ণতা শব্দের সংকীর্ণ অর্থ। এই প্রকারের ন্যায়পরায়ণতা হল বাহ্যিক ও পরিমাপযোগ্য বস্তুর সঙ্গে যুক্ত। এই ধরনের ন্যায়পরায়ণতাকে নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতা (Particular Justice) বলা হয়। নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণতা বিভিন্ন শ্রেণির জনগোষ্ঠীর মধ্যে সম্পদ, সম্মান ও শ্রমের সমবণ্টনের কথা বলে।

নির্দিষ্ট ন্যায়পরায়ণকে অ্যারিস্টটল দুটি ভাগে ভাগ করেছেন-

  • বণ্টনভিত্তিক ন্যায়বিচার (Proportional Equality): এই ন্যায়পরায়ণতা মূলত রাজনৈতিক সুবিধার সঙ্গে সম্পর্কিত। এই ধরনের ন্যায়বিচারে প্রতিটি মানুষের মধ্যে তার প্রাপ্য সম্পদ সমানুপাতিক হারে বণ্টিত হয়। তাই একে বিপ্লব প্রতিরোধকারী ন্যায়বিচার বলা হয়।
  • সংশোধনমূলক ন্যায়বিচার (Corrective Justice): সংশোধনমূলক ন্যায়বিচার বাণিজ্য সংক্রান্ত কাজের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। এই ন্যায়বিচারের লক্ষ্য হল সামাজিক অবিচারের ফলে প্রত্যেক ব্যক্তি যা হারিয়েছেন তা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করা এবং প্রত্যেকের অধিকারের উপর অবৈধ হস্তক্ষেপ প্রতিহত করা।

সংশোধনমূলক ন্যায়বিচারের আবার দুটি ভাগ- 

স্বেচ্ছাক্রিয়া নির্বাহ যা দেওয়ানী আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত ও অস্বেচ্ছাক্রিয়া নির্বাহ যা ফৌজদারী আইনের সঙ্গে সম্পর্কিত।

অ্যারিস্টট্ল সমতা অর্থে আরও একটি ন্যায়পরতার উল্লেখ করেছেন। সেটি হল সমন্বয়ের ন্যায়পরতা। এ ধরনের ন্যায়পরায়ণতায় একজন আপ্তপুরুষ থাকেন, যিনি ন্যায়বিচার বণ্টন করবেন। এ ধরনের ন্যায়বিচার হল বেসরকারী আইনের ন্যায়বিচার (Justice of Public Law)।

৩। জন রলসকে অনুসরণ করে তাঁর ন্যায়বিচার তত্ত্ব আলোচনা করো। ন্যায়বিচারের মৌলিক নীতিগুলি সংক্ষেপে লেখো।

রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্ব

জন রল্স -এর ন্যায়বিচার তত্ত্ব আধুনিক সমাজদর্শন এবং রাষ্ট্রদর্শনের একটি উল্লেখযোগ্য মতবাদ। রল্স একজন ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদী এবং সেই কারণে তিনি একজন উদারনীতিবাদী (Liberalist)। একজন উদারনীতিবাদীরূপে রল্স গণতন্ত্রকে একটি আদর্শ সমাজব্যবস্থা ও রাষ্ট্রব্যবস্থারূপে মনে করেছেন। তিনি একটি আদর্শ সুসংবদ্ধ গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা (Well Ordered Society)-এর কথা বলেছেন যা ন্যায়বিচার নির্ভর হবে। তিনি তাঁর প্রথম বই ‘A Theory of Justice’ -এ এমন নৈতিক ভিত্তির অনুসন্ধান করেছেন যার সাহায্যে গণতন্ত্রের প্রধান মূল্যবোধ যেমন স্বাধীনতা ও সাম্যকে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হবে।

(1) রলসের ন্যায়বিচার তাত্ত্বর সারকথা: রলসের ন্যায়বিচার তত্ত্বে নিম্নলিখিত বিষয়গুলি নিয়ে আলোচনা করা হয়

  1. রল্স -এর রাষ্ট্রদর্শনে ন্যায়বিচার বলতে সামাজিক ন্যায়বিচারকে বোঝানো হয়েছে। 
  2. রল্স ছিলেন সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থক। সমাজ সৃষ্টির ফলে সামাজিক সুবিধা ও অসুবিধা সৃষ্টি হয়েছে। এই অসুবিধাগুলি দূর করার কথা রল্স ‘Justice as Fairness’-এ উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে ন্যায়বিচার হল সমদর্শিতা এবং অবঞ্চনা। অর্থাৎ ন্যায়বিচারে কোনো নাগরিক যেন বঞ্চিত না হয়।
  3. রল্স মনে করছেন এমন কোনো অবস্থা আমরা কল্পনা করতে পারি যেখানে সকলেই সমান। একমাত্র সেই অবস্থাতেই ন্যায়বিচারের নীতিগুলি নির্ধারণ করা সম্ভব। রল্স এই অবস্থার নাম দিয়েছেন ‘আদি- অবস্থা’ (Original Position) I
  4. এই প্রসঙ্গে রল্স ‘Veil of Ignorance’ অর্থাৎ অজ্ঞতার আবরণের কথা বলেছেন। ব্যক্তি যখন তাদের বিশেষ বিশেষ পরিচয় এবং বিশেষ বিশেষ তথ্য ভুলে থাকতে পারবে যে তারা ধনী না নির্ধন, হিন্দু না খ্রিস্টান, তখনই তারা এই ন্যায়ের নীতি নির্ধারণ করতে পারবে।
  5. রল্স উপযোগবাদীদের সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখের নীতিকে সমর্থন করেননি। তিনি ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যের উপর গুরুত্ব দিয়েছেন এবং প্রত্যেক ব্যক্তির তত্ত্বপূর্ব দায়িত্ববোধ ও ন্যায়বোধের কথা বলেছেন (Pre- theoretical Justice)
  6. রল্স এই প্রসঙ্গে কতগুলি Primary Goods-এর কথা বলেছেন সেগুলি হল ব্যক্তির অলঙ্ঘনীয় অধিকার। এগুলি হল স্বাধীনতা, আত্মসম্মান, আইনের সম্মুখে সমভাবে বিবেচিত হওয়ার অধিকার, বৃত্তি নির্বাচন এবং সেই বৃত্তিতে যুক্ত হওয়ার অধিকার ইত্যাদি।

রলসের ন্যায়তত্ত্বের মৌলিক নীতি

রল্স তাঁর ‘Theory of Justice’ গ্রন্থের পঞ্চম অধ্যায়ে ন্যায়বিচারের দুটি মৌলিক নীতি নিয়ে আলোচনা করেছেন। সেগুলি হল-

(1) স্বাধীনতার নীতি: প্রতিটি ব্যক্তির কতগুলি মৌলিক স্বাধীনতা থাকবে। সমাজে প্রত্যেকের স্বাধীনতা ভোগবিন্যাসকে যতদূর সম্ভব বৃদ্ধি করা হবে। প্রত্যেকে সমান স্বাধীনতা ভোগের অধিকার পাবে। প্রত্যেকে স্বাধীনতা ভোগের ততটুকুই অধিকার পাবে, যতটুকু অপরের স্বাধীনতা ভোগের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। রল্স এই প্রথম নীতিটিকে স্বাধীনতার নীতি বলেছেন। তিনি মনে করেন প্রতিটি ব্যক্তির জীবনে কতগুলি প্রাথমিক অভীষ্ট থাকে। এগুলিকে রল্স বলেছেন প্রাথমিক অভীষ্ট (Primary Goods)। রল্স-এর এই স্বাধীনতার নীতি থেকে দুটি শর্ত আমাদের কাছে স্পষ্ট হয়-

  • প্রত্যেকে সমান স্বাধীনতা ভোগ করবে, কিন্তু সমাজে কম-বেশি স্বাধীনতা ভোগ তখনই স্বীকৃত হবে, যখন সেই স্বাধীনতা অন্যের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করবে না।
  • প্রত্যেকের স্বাধীনতা কম বা বেশি হতে পারে। কিন্তু যে ব্যক্তি বেশি স্বাধীনতা ভোগ করে, সেই ব্যক্তির স্বাধীনতা কম স্বাধীনতা ভোগকারীকে কোনো ক্ষতি করবে না বরং সেই স্বাধীনতা (বেশি স্বাধীনতা ভোগকারীর) কম স্বাধীনতা ভোগকারী ব্যক্তির কাছে গ্রহণযোগ্য হবে।

(2) পার্থক্যের নীতি: সমাজে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অসাম্য থাকবে। এই অসাম্য সমাজের সবথেকে অসুবিধাগ্রস্ত প্রান্তিক মানুষদের উন্নতিতে সহায়তা করবে এবং সমস্ত সামাজিক ও রাজনৈতিক পদ বা যোগ্যতার ক্ষেত্রে প্রত্যেকে বিবেচিত হবে এবং পদগুলি অর্জনে সমান সুযোগ- সুবিধা পাবে। রল্স এই দ্বিতীয় নীতিটিকে বলেছেন পার্থক্যের নীতি। এই পার্থক্য নীতি থেকে দুটি শর্ত লক্ষ করা যায়-

  • সমাজে সবথেকে অসুবিধাগ্রস্ত এবং প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষদের উন্নতিতে সহায়তা করবে।
  • সমস্ত সামাজিক, রাজনৈতিক পদগুলি অর্জনের ক্ষেত্রে সকলে সমান সুযোগ পাবে এবং যোগ্যতার শর্ত সকলের ক্ষেত্রে সমান হবে।

৪। রল্স কীভাবে উপযোগবাদের সমালোচনা করেছেন? রল্স আদি অবস্থা বলতে কী বুঝিয়েছেন?

উপযোগবাদের সমালোচনা

রল্স তাঁর ‘Theory of Justice’ গ্রন্থে Preface অংশে একটি আদর্শ রাষ্ট্রব্যবস্থার কথা বলেছেন। ন্যায়তত্ত্বের নৈতিক ভিত্তি তিনি অন্বেষণ করেছেন। এই প্রসঙ্গে তিনি উপযোগবাদের সমালোচনা করেছেন। উপযোগবাদ অনুসারে একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ এমন নীতির উপর প্রতিষ্ঠিত হবে যেখানে সর্বাধিক ব্যক্তির সর্বাধিক সুখ সম্ভব হবে। সুখের পরিমাণ যেন বৃদ্ধি পায় এবং দুঃখের পরিমাণ যেন হ্রাস পায়। মিল, ব্যোম ও সিজউইক ছিলেন উপযোগবাদের সমর্থক। রল্স এই উপযোগিতার তত্ত্বকে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি বলেছেন উপযোগবাদের এই তত্ত্বে ব্যক্তির সঙ্গে ব্যক্তির যে পার্থক্য বা ভিন্নতা আছে তা স্বীকার করা হয়নি। সর্বাধিক মানুষের সর্বাধিক সুখকে গুরুত্ব দিতে গিয়ে কোনো বিশেষ ব্যক্তির চরম দুর্দশা ডেকে আনতেও এই তত্ত্ব কুণ্ঠাবোধ করে না। এইসঙ্গে রল্স বলেছেন নিপীড়িত মানুষের কষ্টের বিনিময়ে কখনওই ঐশ্বর্য ভোগ সম্ভব নয়।

রলসের মতে আদি অবস্থা

রল্স ছিলেন সামাজিক চুক্তি মতবাদের সমর্থক। তিনি এই মতকে মেনে নিয়ে একটি আদি অবস্থানের কথা বলেছেন। যেখানে তিনি ব্যক্তিকে তার সামাজিক এবং অর্থনৈতিক অবস্থান থেকে বিচ্ছিন্ন করার কথা বলেছেন। ব্যক্তি তার বিশেষ পরিচয়গুলিকে অজ্ঞতার আবরণে (Veil of ignorance) আবৃত রাখে। এই আদি অবস্থায় ন্যায়বিচারের নীতিগুলি নির্ধারণ করা সম্ভব। এটি একটি কাল্পনিক অবস্থা। ন্যায়ের নীতিগুলি যখন নির্ধারণ করবে তখন সেইসব গোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বিশেষ বিশেষ পরিচয় এবং নিজেদের সম্পর্কে জ্ঞাত বিশেষ তথ্যগুলিকে ভুলে থাকবে।

অর্থাৎ তারা কোন্ সামাজিক শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত, তারা ধনী না নির্ধন, পুরুষ না নারী, হিন্দু না খ্রিস্টান, বৌদ্ধ না মুসলিম এগুলি মনে রাখবে না। মানুষ সৌভাগ্যবশত বা প্রকৃতি থেকে যা কিছু পেয়েছে তা ভুলে থাকবে। ধরা যাক কোনো ধনী ব্যক্তি ন্যায়ের নীতি নির্ধারণ করছেন। তিনি যদি নিজের বিশেষ পরিচয় মনে রেখে ন্যায় নীতি নির্ধারণ করেন, তাহলে সেই নীতি তাঁর বিশেষ শ্রেণিস্বার্থ মনে রেখে নির্ধারণ করবেন। নীতিটি সকলের প্রতি সমান হবে না বা ন্যায়সম্মত হবে না।

৫। রবার্ট নজিক-এর প্রাথমিক অধিগ্রহণ তত্ত্ব (Entitlement Theory of Justice) বলতে কী বোঝো?

ন্যায়বিচারের প্রাথমিক অধিগ্রহণ তত্ত্ব

রবার্ট নজিক ছিলেন একজন আমেরিকান দার্শনিক। তাঁর ‘Anarchy State and Utopia’ (1974) গ্রন্থে তিনি রল্স -এর ন্যায়তত্ত্বের একটি বিকল্প ন্যায়তত্ত্ব উপস্থাপিত করেন। ‘Entitlement’ বা অধিকার প্রতিষ্ঠিত হবে ন্যায়ের নীতির উপর। নজিক তিনটি প্রধান উৎসের কথা বলেন, যেখান থেকে ব্যক্তিবিশেষ তাদের যা কিছু প্রয়োজন তা সংগ্রহ করতে পারে-

  • প্রতিটি ব্যক্তির তার শরীর, মস্তিষ্ক এবং কোষ ইত্যাদির উপর নিরঙ্কুশ অধিকার আছে।
  • প্রাকৃতিক জগতের ভূমি, জল, সম্পদ, ধাতুর উপর তার অধিকার আছে।
  • কৃষিজাত এবং শিল্পজাত পণ্য যা কিছু মানুষ তৈরি করে, সেগুলির উপর তাদের অধিকার আছে।

(1) প্রাথমিক অধিগ্রহণ ভাত্ত্বর নীতিগুলি (Principles of Entitlement): প্রাথমিক অধিগ্রহণ তত্ত্বের নীতিগুলি হল-

  1. প্রাথমিক অধিগ্রহণ (Primary Acquisition): এই পদ্ধতির সাহায্যে ব্যক্তিবিশেষ সর্বপ্রথম কোনো প্রাথমিক সম্পদ যেটি মালিকানাহীন, সেটির অনুসন্ধান পান। যেমন- ধরা যাক, এমন কোনো অনধিকৃত দেশ, যেখানে কেউ বসবাস করেন না, সেই স্থান তিনি বৈধভাবে অধিগ্রহণে অধিকারী। এখানেও শর্ত একটাই। ততটুকুই আমি অধিগ্রহণ করতে পারি যেটুকু আমার জন্য যথেষ্ট এবং যতটুকু অধিগ্রহণ করলে অপরের জন্য অবশিষ্ট থাকে।
  2. স্বেচ্ছা হস্তান্তর (Self Transfer): এই নীতি যে-কোনো সম্পত্তির উপর প্রযোজ্য। সম্পত্তিটি প্রাথমিক অধিগ্রহণের দ্বারা অর্জিত হতে পারে অথবা প্রাকৃতিক সম্পদের সঙ্গে নিজের শ্রম, দক্ষতা বা প্রতিভা যুক্ত করে সেটিকে পণ্য হিসেবে বিক্রি করতে পারে। অন্যের শ্রমের দ্বারা উৎপন্নের মালিক আমি অর্থের বিনিময়ে হতে পারি, কিন্তু কখনো বলপ্রয়োগ বা প্রতারণার মাধ্যমে নয়। সে যদি স্বেচ্ছায় সম্মত হয় তবেই আমি চুক্তির মাধ্যমে সেটির মালিকানা পেতে পারি।
  3. সংশোধন (Rectification): কখনো-কখনো ন্যায়বিচারের জন্য রাষ্ট্র বা কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার হস্তক্ষেপের প্রয়োজন হয়। কেন-না ইতিহাসে যেমন জোর করে অন্যের সম্পদ হস্তগত করার নজির আছে, তেমন প্রাকৃতিক সম্পদ অবৈধভাবে অধিগ্রহণের দৃষ্টান্তও আছে। স্বেচ্ছায় হস্তান্তরের দ্বারা যদি অর্থনৈতিক বৈষম্যও দেখা যায়, নজিক আপত্তি করবেন না। কিন্তু এক্ষেত্রে যদি কোনো ব্যক্তিকে বা কোনো দেশকে একটি দুষ্প্রাপ্য সম্পদ থেকে অন্যায়ভাবে বঞ্চিত করা হয় তিনি আপত্তি করবেন। কোনো চিকিৎসক যদি প্রাণঘাতী কোনো অসুখের চিকিৎসায় প্রচুর অর্থ দাবি করেন সেখানে নজিকের আপত্তি নেই, কিন্তু যে জলে সবার অধিকার সেটির উপর অবৈধ নিয়ন্ত্রণ নজিকের মতে অন্যায়।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top