মনসবদারি ব্যবস্থার ত্রুটি আলোচনা করো

মনসবদারি প্রথার ত্রুটিগুলি ছিল কিছুটা সহজাত এবং কিছুটা আরোপিত।
(1) অসৎ মানসিকতা
মনসবদারদের অনেকেই নিজের পদ ও দায়িত্ব সম্পর্কে আন্তরিক ছিলেন না। সম্রাটের প্রতি মেকি আনুগত্য দেখিয়ে উচ্চপদে আসীন থাকা ও ক্ষমতা ভোগ করাই ছিল এদের লক্ষ্য। তাই মনসব ব্যবস্থা আশানুরূপ ফল পায়নি।
(2) দ্বিমুখী নীতি
মনসবদারি ব্যবস্থায় সম্রাটের ইচ্ছার উপরেই সকল সিদ্ধান্ত গৃহীত হত। এতে দেখা যেত, সম্রাটের সুনজরে থাকার দরুন একজন ৫ হাজারি মনসবদার ৫০০ সেনা রাখতে পারতেন। কিন্তু অন্যান্যদের ৫০০০ ঘোড়াই রাখতে হত। এই দ্বিমুখী নীতি মনসবদারি প্রথাকে দুর্বল করে তুলেছিল।
(3) হিসাবে কারচুপি
বহু মনসবদার নির্ধারিত সংখ্যক এবং উৎকৃষ্টমানের সেনা ও যুদ্ধের অশ্ব পরিপোষণে মিথ্যাচার করতেন। সরকারি পরিদর্শনের সময় ভাড়া করা সেনা ও অশ্ব দেখিয়ে সরকারকে ফাঁকি দিতেন। ফলে যুদ্ধের সময় সেনা জোগানে বিপুল ঘাটতি দেখা যেত।
(4) অনিয়ন্ত্রিত স্বৈরাচার
মনসব ব্যবস্থার কঠোর কেন্দ্রীকরণ ও নিয়ন্ত্রণ মুঘল প্রশাসনে স্বাধীন ও স্বনির্ভর অভিজাত শ্রেণি গড়ে উঠতে দেয়নি। মনসবদাররা সম্রাটের ভুল বা অন্যায্য সিদ্ধান্তকে বিনা প্রশ্নে মেনে নিতেন। এই কারণে সম্রাটের স্বৈরাচার অনয়ন্ত্রিত হয়ে ওঠে।
(5) উত্তরাধিকার নীতির কুফল
মনসবের উপর মনসবদারের পরিবারের উত্তরাধিকার স্বীকৃত ছিল না। মনসবদারের মৃত্যুর পর তার মনসব ও স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি সম্রাট বাজেয়াপ্ত করতে পারতেন। এই অনিশ্চিত ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে অধিকাংশ মনসবদারের সঞ্চয় প্রবণতা বিনষ্ট হয়েছিল। মানুচি (Manucci) বলেছেন যে, এই নিয়মের জন্য মনসবদারদের ব্যয়বৃদ্ধি এতটাই বেড়ে গিয়েছিল, যে অনেকক্ষেত্রে তাদের মৃত্যুর পর, তাদের পরিত্যক্ত সিন্দুক, বাক্স প্রভৃতি থেকে ছেঁড়া জুতো-সহ কয়েকটি অপ্রয়োজনীয় জিনিস ছাড়া আর কিছুই পাওয়া যায়নি।
(6) দরবারে গোষ্ঠীতন্ত্র
‘মনসব’ পাওয়া এবং রক্ষা করার ক্ষেত্রে যোগ্যতার মূল্য ছিল না। সম্রাটের ইচ্ছাই ছিল চূড়ান্ত। তাই মনসব থেকে সুযোগসুবিধা লাভের প্রয়োজনে অভিজাতরা গোষ্ঠীবদ্ধ হয়ে সম্রাটের উপর নিজ নিজ প্রভাব বৃদ্ধির চেষ্টা চালান। ঔরঙ্গজেব পর্যন্ত দক্ষ সম্রাটদের আমলে এই কুফল স্পষ্ট হয়নি। কিন্তু পরবর্তীকালে দরবারের অভিজাতদের গোষ্ঠীবদ্ধতা ও অন্তর্দ্বন্দ্ব সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করেছিল।
(7) জায়গিরদারদের ক্ষমতাবৃদ্ধি
মনসবদারদের জায়গির দানের প্রথা ব্যাপক রূপ লাভ করলে, তারা নিজ নিজ অঞ্চলে প্রচ্ছন্ন স্বাধীন শাসন গড়ে তোলেন। এভাবে রাষ্ট্রের মধ্যে রাষ্ট্র স্থাপনের মধ্য দিয়ে মুঘল সাম্রাজ্যের অস্তিত্বকে বিপন্ন করে তোলে জায়গিরদারেরা।
(8) সেনাবাহিনীর সঙ্গে দূরত্ব
মনসবদারি ব্যবস্থায় মূল সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রক ও পরিপোষক ছিলেন মনসবদাররা। ফলে সম্রাট বা প্রধান সেনাপতির সঙ্গে সেনাবাহিনীর প্রত্যক্ষ যোগ বা নিয়ন্ত্রণ ছিল না। ফলে সম্রাটের আত্মশক্তি শিথিল হয়ে পড়েছিল।
(9) সম্রাটদের অযোগ্যতা
সম্রাটদের ব্যক্তিত্বের উপর যেহেতু এই প্রথার সাফল্য নির্ভরশীল ছিল, তাই আকবরের পরবর্তী শাসকদের অযোগ্যতা এই প্রথায় ভাঙন ধরায়। অধ্যাপক কুরেশী, আরভিন প্রমুখের মতে, মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের জন্য এই প্রথার দায়িত্ব ছিল যথেষ্ট।