ন্যায়ের অর্থ

ন্যায়ের অর্থ

ন্যায়ের অর্থ
ন্যায়ের অর্থ

ন্যায় মূলত একটি নৈতিক ধারণা। এর সঙ্গে সততা ও নৈতিকতা, আদর্শবোধ এবং বিশুদ্ধতার মতো ধারণাগুলি যুক্ত। তাই ন্যায় হল সত্য ও বিশুদ্ধতার প্রতীক। জাস্টিনিয়ান ইনস্টিটিউটস্ (The Institutes of Justinian)-এর ধারণা অনুযায়ী, ন্যায় হল “সঠিক, সাধারণ ও সামঞ্জস্যপূর্ণ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার একটি মানসিক অনুভূতি ও সদিচ্ছা”। ন্যায় বলতে মূলত, ধারাবাহিকভাবে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে পরস্পরের সামাজিক মর্যাদা ও অধিকারকে স্বীকার করে নেওয়াকে বোঝায়। যদিও জাস্টিনিয়ান ইনস্টিটিউটস্-এর বহু পূর্বেই প্রাচীন গ্রিসে প্লেটো তাঁর ন্যায় তত্ত্ব গড়ে তুলেছিলেন। তাঁর মতে, ন্যায় হল ব্যক্তিকে তাঁর প্রাপ্যটুকু প্রদান করা।

ন্যায় প্রসঙ্গে তাঁর আরও মত হল, রাষ্ট্রজীবনে ন্যায়ের গুণ বিকশিত হয় তখনই, যখন সমাজের শ্রেণিগুলি নিজেদের শ্রেণিগত কর্মে নিযুক্ত থাকেন এবং অন্য শ্রেণির কাজে হস্তক্ষেপ থেকে বিরত থাকেন (“Justice is nothing but to stay in one station and to do the duties of that station.”)। প্লেটো-র মতে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মধ্যে সমন্বয়সাধনের মধ্যেই ন্যায়ের ধারণা নিহিত থাকে। আবার, ন্যায়ের অর্থ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অ্যারিস্টট্ল তিন ধরনের ন্যায় প্রতিষ্ঠার কথা বলেন। যথা- বণ্টনমূলক ন্যায়, সংশোধনমূলক ন্যায় এবং বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায়।

বণ্টনমূলক ন্যায়বিচার বলতে সমাজে পণ্য ও অধিকারের বণ্টন বা বিতরণকে বোঝায়। এক্ষেত্রে অ্যারিস্টট্ল সমবণ্টনের কথা বলেননি। বরং তিনি ব্যক্তিকে তার প্রাপ্যটুকু দেওয়ার কথা বলেন। বণ্টনমূলক ন্যায় সংক্রান্ত তাঁর বিখ্যাত নীতিটি হল, “Equals should be treated equally and unequals unequally.” অর্থাৎ সমানদের সঙ্গে সমআচরণ এবং অসমদের সঙ্গে অসমআচরণ। সংশোধনমূলক ন্যায়বিচার হল এমন একটি ধারণা, যা একজন ব্যক্তির দ্বারা অন্য ব্যক্তির উপর হওয়া অন্যায়কে বা অবিচারকে সংশোধন করে সমাজে ন্যায় স্থাপন করে। এবং বিনিময় সংক্রান্ত ন্যায় বলতে ক্রয়-বিক্রয়ের স্বেচ্ছামূলক আদানপ্রদানের ক্ষেত্রে কোনো দ্রব্য বা পরিসেবার বিনিময়ে অন্য দ্রব্য বা পরিসেবার অনুপাত বা Proportion নির্ধারণকে বোঝায়।

(1) ইমান্যুয়েল কান্ট এর অভিমত

জার্মান দার্শনিক ইমানায়েল কান্ট (Immanuel Kant)-এর ন্যায়ের ধারণাটি তাঁর নৈতিক দর্শনে গভীরভাবে নিহিত। তিনি তাঁর ন্যায়ের ধারণাটি ‘দ্য মেটাফিজিক্স অফ মরালস্’ গ্রন্থে ব্যাখ্যা করেছেন। কান্টের কাছে, ন্যায়বিচার নিছক ন্যায্য ফলাফল অর্জনের বিষয় নয়, বরং কান্টের ন্যায়তত্ত্বের কেন্দ্রবিন্দু হল ব্যক্তির স্বাধীনতার ধারণা। তাঁর মতে, ন্যায় তখনই অর্জিত হয় যখন সকল ব্যক্তি নৈতিক আইন মান্য করে চলে এবং অন্যের স্বাধীনতা বা স্বায়ত্তশাসনকে সম্মান প্রদর্শন করে। শুধু তাই নয়, তাঁর ন্যায়ের ধারণার সঙ্গে ব্যক্তিকে তাদের প্রাপ্য প্রদানের ধারণাটিও জড়িত। সংক্ষেপে বলা যায়, কান্টের ন্যায় হল, সর্বজনীন নৈতিক নীতিগুলি মেনে চলার পাশাপাশি ব্যক্তির স্ব-শাসন ও ব্যক্তি মর্যাদার প্রতি সম্মান প্রদর্শন করা।

(2) বার্কারের অভিমত

অধ্যাপক আর্নেস্ট বার্কার (Ernest Barker) তাঁর ‘প্রিন্সিপলস্ অব্ সোশ্যাল অ্যান্ড পলিটিকাল থিওরি’ (Principles of Social and Political Theory) গ্রন্থে ন্যায় বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন। তাঁর মতানুযায়ী, ‘ন্যায়’ শব্দটির ইংরেজি প্রতিশব্দ Justice, লাতিন শব্দ Jus (জাস) Justus (জাস্টাস) ও Justitia (জাস্টিসিয়া) থেকে সৃষ্টি হয়েছে। এই লাতিন শব্দের অর্থ হল সংযুক্ত (Joining) বা সামঞ্জস্যবিধান (Fitting) করা। কাজেই ন্যায় হল রাজনৈতিক মূল্যবোধসমূহের মধ্যে সংযোগকারী একটি ধারণা। বার্কার ন্যায়বিচারকে একটি সমন্বয়সাধনকারী ধারণা (A term of synthesis) বলে উল্লেখ করেছেন। বার্কার- এর মতে, ন্যায় যাকেই স্পর্শ করে তাকেই মিলন বন্ধনে বেঁধে ফেলে (“Justice is the quality or aptitude of joining, it ties together whatever it touches.”)। এই কারণে ন্যায়বিচার হল এমন এক মূল্যবোধ যার মধ্যে অন্যান্য রাজনৈতিক মূল্যবোধের সমন্বয় সাধিত হয়েছে।

বার্কার উল্লেখ করেছেন, একটি সমাজে একই সঙ্গে বিভিন্ন মূল্যবোধের অস্তিত্ব থাকে, যেমন-সাম্য, স্বাধীনতা, সহযোগিতা, সৌভ্রাতৃত্ব। ন্যায়ের কাজ এই আদর্শ বা মূল্যবোধগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করা (“Justice is the reconciler and the synthesis of political values.”)। এই দৃষ্টি থেকে বিচার করলে বলা যায়, ন্যায় হল যাবতীয় মূল্যবোধগুলির একটি বিন্যস্ত, অখন্ড ও ঐক্যবদ্ধ রূপ। ব্যক্তি সাধারণত রাষ্ট্রীয় আইনের মধ্যে ন্যায়বিচারের প্রতিফলন দেখতে চায় এবং ন্যায়বিচারের মানদণ্ডে সে রাষ্ট্রীয় আইনকানুনের প্রকৃতিকে যাচাই করতে চায়। বার্কার এজন্য ন্যায়বিচারের ধারণাকে রাজনৈতিক আনুগত্যের ভিত্তি হিসেবে উল্লেখ করেছেন।

বার্কার-এর অভিমত অনুযায়ী, ন্যায়বিচারের উদ্দেশ্য হল বিভিন্ন রাজনৈতিক মূল্যবোধের মধ্যে সমন্বয়সাধন করে তাকে সুষ্ঠুভাবে প্রয়োগ করা। আমরা রাষ্ট্রকে মেনে চলি কারণ রাষ্ট্র হল এই রাজনৈতিক মূল্যবোধের প্রতীক এবং রাষ্ট্রের হাতে এই মূল্যবোধকে বাস্তবে প্রয়োগের ক্ষমতাও রয়েছে। তাই আমরা রাষ্ট্রের আদেশ, আইন প্রভৃতি মেনে চলি এবং সেই অনুযায়ী আমাদের কর্তব্য সম্পাদন করি। ন্যায় সম্পর্কিত আধুনিক ধারণা ন্যায়পরায়ণ ব্যক্তি অপেক্ষা ন্যায়পরায়ণ সমাজের উপর অধিক গুরুত্ব আরোপ করে। এ প্রসঙ্গে ও পি গউবা-র মত উল্লেখ্য। তাঁর মতে, “The modern concept of justice…is marked by shift of emphasis from the idea of a just or virtuous man to that of a just society”. আধুনিক ন্যায়ের  ধারণায় সামাজিক স্থিতাবস্থা বজায় রাখাই হল ন্যায়ের আবশ্যিক শর্ত।

(3) জন রলস-এর অভিমত

আধুনিক ন্যায়তত্ত্বের আলোচনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ নাম হল জন রলস। তাঁর ‘A Theory of Justice’ (১৯৭১ খ্রি.) গ্রন্থে উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপযোগী ন্যায়ের ধারণার সন্ধান করেছিলেন। উদার গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় যে অসাম্য উপস্থিত ছিল, তাকে দূর করার জন্য তিনি তাঁর ন্যায় তত্ত্বের উপস্থাপনা করেছিলেন। ডি ডি রাফেল (DD Raphael) তাঁর ‘Problem of Political Philosophy’ (১৯৭৬ খ্রি.) গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন, ন্যায়ের ধারণার আধুনিক প্রবক্তারা এক অর্থে সংস্কারবাদী, কারণ তাঁরা প্রচলিত সমাজব্যবস্থার সংস্কারের কথা বলেন।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top