মৌলানা আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা আলোচনা করো

মৌলানা আজাদের স্বাধীনতা সম্পর্কিত ধারণা
একজন জাতীয়তাবাদী, স্বাধীনতা সংগ্রামী হওয়ার দরুণ তাঁর বিভিন্ন রচনা, লেখনী এবং বক্তৃতায় রাজনৈতিক স্বাধীনতার ধারণা ব্যক্ত হলেও, তিনি কেবল ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসন থেকে ভারতের রাজনৈতিক মুক্তির কথাই বলেননি, তার পাশাপাশি বৌদ্ধিক, সামাজিক ও আধ্যাত্মিক মুক্তির কথাও বলেছিলেন। এগুলি সংক্ষেপে আলোচিত হল-
(1) বৌদ্ধিক স্বাধীনতা
আজাদ শিক্ষা এবং বুদ্ধিবৃত্তির বিকাশের গুরুত্বের উপর জোর দিয়েছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃত স্বাধীনতা কেবলমাত্র মনের আলোকায়নের মাধ্যমেই অর্জিত হতে পারে। বৌদ্ধিক স্বাধীনতা (Intellectual Freedom)-র প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি বৃহত্তর দার্শনিক ও রাজনৈতিক বিশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে অনুধাবন করা যায়। তাঁর বৌদ্ধিক স্বাধীনতার বিষয়ে মূল দিকগুলি হল-
- বৈজ্ঞানিক ও যৌন্ত্রিক অনুশাসনের জন্য সমর্থন: আজাদ বৌদ্ধিক স্বাধীনতার অত্যাবশ্যক উপাদান হিসেবে বৈজ্ঞানিক ও যৌক্তিক অনুসন্ধানকে সমর্থন জানানোর পাশাপাশি শিক্ষা ও জনজীবন উভয়ক্ষেত্রকেই সমর্থন জানিয়েছিলেন। তিনি শিক্ষা ও জনজীবন উভয়ক্ষেত্রেই বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও যুক্তবাদী পন্থা অবলম্বন করতে মানুষকে উৎসাহিত করেছিলেন।
- শিক্ষা ও জ্ঞান: মৌলানা বিশ্বাস করতেন যে, প্রকৃত বৌদ্ধিক স্বাধীনতা শিক্ষা ও জ্ঞান লাভের মাধ্যমেই শুরু হয়। এ জন্যই তিনি একটি আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থার পক্ষে সওয়াল করেছিলেন, যেখানে ঐতিহ্যগত ইসলামীয় শিক্ষার পাশাপাশি সমসাময়িক বিষয়কেও অন্তর্ভুক্ত করার কথা তিনি বলেছিলেন। আজদ যুক্তি দিয়েছিলেন যে, শিক্ষাকে কেবল ধর্মীয় শিক্ষার মধ্যে সীমাবদ্ধ করা উচিত নয়, বরং একটি মুক্ত এবং সমালোচনামূলক মনন বিকাশের জন্য জ্ঞানের পরিধি বিস্তৃত করা উচিত। তিনি ইংরেজি শিক্ষার প্রয়োজনীয়তাকেও গভীরভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
- মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা: আজাদের কাছে বৌদ্ধিক বিকাশের অপর অর্থ হল ব্যক্তির মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা। তিনি মুক্ত চিন্তার অবাধ আদান-প্রদানে বিশ্বাসী ছিলেন। এর মধ্যে সমালোচনা ও বিতর্কের অধিকারকেও অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন। সমালোচনার অধিকারকে তিনি সমাজের অগ্রগতির অপরিহার্য শর্ত হিসেবে বিবেচনা করেছিলেন। আজাদ নিজে তাঁর লেখনী এবং কণ্ঠস্বরকে ব্যবহার করে ভারতের স্বাধীনতা এবং সামাজিক সংস্কারের পক্ষে সওয়াল করেছিলেন।
- ঔপনিবেশিকতা বিরোধী এবং জাতীয়তাবাদ: ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে আজাদের সংগ্রাম তার বৌদ্ধিক স্বাধীনতার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত ছিল। তিনি ঔপনিবেশিকতাকে এমন একটি ব্যবস্থা হিসেবে দেখেছিলেন যে, আসল স্বাধীনতা তখনই অর্জিত হতে পারে যখন ভারত ঔপনিবেশিক আধিপত্য থেকে মুক্তিলাভ করবে এবং জনগণ স্বাধীনভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারবে, কথা বলতে সক্ষম হবে।
- সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে সংযোগ: তিনি মনে করতেন সাংস্কৃতিক বিকাশের সঙ্গে বৌদ্ধিক বিকাশ সম্পর্কযুক্ত। তিনি ভারতীয়দেরকে তাদের সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের সঙ্গে পুনঃসংযোগ স্থাপনের পাশাপাশি আধুনিকতাকেও গ্রহণে উৎসাহিত করেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ঐতিহ্য ও আধুনিকতার এই মিশ্রণ জাতির বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য অত্যন্ত আবশ্যক।
- ধর্মনিরপেক্ষ ধারণা গ্রহণ: আজাদ ধর্মীয় সহনশীলতা এবং ধর্মনিরপেক্ষ ধারণার কট্টর সমর্থক ছিলেন। তিনি ধর্মনিরপেক্ষতাকে বৌদ্ধিক স্বাধীনতার রাজনৈতিক অভিব্যক্তি হিসেবে দেখেছিলেন। তিনি একথা বিশ্বাস করতেন যে, গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র ব্যক্তিচিন্তার মুক্ত আদান-প্রদান এবং বৌদ্ধিক বিকাশের জন্য সর্বোত্তম পরিবেশ প্রদান করে। কারণ, ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় নিপীড়নের ভয় ছাড়াই ব্যক্তি স্বাধীনভাবে মতামত প্রকাশ ও আচার-আচরণ পালনের অধিকার ভোগ করতে পারে।
(2) সামাজিক স্বাধীনতা
আজাদ-এর স্বাধীনতার দৃষ্টিভঙ্গির মধ্যে সামাজিক ন্যায়বিচার এবং সমতার ধারণাও অন্তর্ভুক্ত ছিল। তিনি প্রান্তিক ও সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের সপক্ষে কথা বলেন এবং বিভিন্ন সামাজিক স্তরের মধ্যে ব্যবধান দূরীকরণের প্রচেষ্টা করেন। তিনি এমন এক সমাজগঠন করতে চেয়েছিলেন, যেখানে প্রত্যেকের সমান সুযোগ ও অধিকার থাকবে। সামাজিক স্বাধীনতা (Social Freedom) প্রসঙ্গে তার অবদানগুলি হল-
- বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে অংশগ্রহণ: আজাদ জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন আন্দোলন যেমন-অসহযোগ (Non-Cooperation), আইন অমান্য (Civil Disobedience), ভারত ছাড়ো (Quit India) প্রভৃতিতে অংশগ্রহণের মাধ্যমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলে সমাজমুক্তির কথা বলেছিলেন।
- ঐক্য ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি গঠন: আজাদ হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের একজন দৃঢ় প্রবক্তা ছিলেন। তিনি মনে করতেন, ঐক্যবদ্ধ সমাজই ভারতে ব্রিটিশ শাসনকে উচ্ছেদ করতে সক্ষম, যা বাস্তবিক অর্থেই ভারতের সামাজিক মুক্তি ঘটাবে। এ কারণেই তিনি ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের জন্য সকল সম্প্রদায়ের সম্মিলিত প্রচেষ্টার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন।
- শিক্ষার সংস্কার: সামাজিক স্বাধীনতা লাভের প্রধানতম শর্ত হিসেবে আজাদ শিক্ষার বিস্তারের উপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। তিনি এ প্রসঙ্গে বিদ্যমান শিক্ষাব্যবস্থার সংস্কার ও আধুনিক বৈজ্ঞানিক শিক্ষা, উচ্চশিক্ষার উপর জোর দিয়েছিলেন।
- ধর্মীয় সহিষ্ণুতা: তিনি ধর্মনিরপেক্ষ বৈষম্যহীন সমাজ গঠনের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যেখানে ব্যক্তিরা বৈষম্য বা নিপীড়নের ভয় ছাড়াই স্বাধীনভাবে ধর্মাচরণ ও ধর্মপালন করতে পারবে, যা সামাজিক স্বাধীনতার পথকে প্রশস্ত করবে বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর সুফি পটভূমি, আধ্যাত্মিকতা, সহনশীলতা এবং সকল ধর্মের মধ্যে ঐক্য তাঁর চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করেছিল। সুফিবাদের অন্তর্ভুক্তিমূলক দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের বহুত্ববাদী দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে একত্রিত হয়েছিল।
- অর্থনেতিক সমতা : আজাদ সামাজিক স্বাধীনতা অর্জনে অর্থনৈতিক সমতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছিলেন। তিনি অর্থনৈতিক বৈষম্য হ্রাস এবং সকলের জন্য সমান সুযোগের নীতিগুলিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। এ ছাড়াও সম্পদের সুষম বণ্টনের গুরুত্বের কথাও তিনি বলেছিলেন।
(3) আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা
স্বাধীনতা সম্পর্কে আজাদের উপলব্ধি তার ধর্মীয় বিশ্বাস দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়েছিল, তিনি ইসলামকে এমন একটি ধর্ম হিসেবে ব্যাখ্যা করেছিলেন, যা ন্যায় বিচার, সহানুভূতি এবং স্বাধীনতার ধারণাকে সমর্থন করে। আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা (Spritual Freedom) সম্পর্কে তাঁর মূল দিকগুলি হল-
- আধ্যাত্মিক এবং রাজনৈতিক স্বাধীনতার একত্রীকরণ : আজাদ বিশ্বাস করতেন যে, কেবলমাত্র রাজনৈতিক স্বাধীনতার মাধ্যমে প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করা যায় না। প্রকৃত স্বাধীনতা অর্জন করতে হলে, আধ্যাত্মিক ও নৈতিক বিকাশ ছাড়া রাজনৈতিক স্বাধীনতা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে। মৌলানা-র মতে, আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার মধ্যে দিয়ে অজ্ঞাত এবং কুসংস্কারের মতো অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খল থেকে ব্যক্তি নিজেকে মুক্ত করতে সক্ষম হবেন।
- বিশ্বজনীন ভাতৃত্ববোধ: আজাদের আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার ধারণার মধ্যে সর্বজনীন ভ্রাতৃত্বের ধারণাও নিহিত ছিল। তিনি কেবল ভারতের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান ঐক্যের কথা বলেননি। বিশ্বজনীন ক্ষেত্রে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে বোঝাপড়া, পারস্পরিক সহযোগিতা স্থাপনের মাধ্যমে ভ্রাতৃত্ববোধ অর্জনের দ্বারা আধ্যাত্মিক মুক্তির স্বপ্ন দেখেছিলেন। এক্ষেত্রে তিনি সুফিবাদের অভ্যন্তরীণ শুদ্ধি, প্রেম, সমবেদনা ইত্যাদির দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন।
- শিক্ষার মাধ্যমে আধ্যাত্মিক মুক্তি: আজাদের মতে, শিক্ষা হল আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা অর্জনের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। তিনি মনে করতেন, অজ্ঞতা স্বাধীনতা অর্জনের পথে এক প্রতিবন্ধকতাস্বরূপ। তাই শিক্ষার আলোতেই প্রকৃত মুক্তির স্বাদ উপভোগ করা যায়।
- ধর্মের ভূমিকা: তিনি ধর্মনিরপেক্ষতা এবং আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার মধ্যে কোনোরূপ বিরোধ দেখেননি। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, ধর্মীয় সহনশীলতা ও সহানুভূতি ধর্মীয় নিপীড়নের পরিবর্তে স্বাধীনতার পথকে প্রসারিত করে।
- মানব মর্যাদা প্রতিষ্ঠা: আজাদের মতে, আধ্যাত্মিক স্বাধীনতা প্রত্যেক ব্যক্তির মর্যাদা ও অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করে। আধ্যাত্মিক পরিপূর্ণতার জন্য প্রত্যেক ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো পথ অনুসরণ করার স্বাধীনতা প্রদান করা আবশ্যক বলে তিনি মনে করতেন।
- অহিংস এবং শান্তি: ইসলামীয় শিক্ষা এবং গান্ধিবাদী নীতি দ্বারা প্রভাবিত আজাদ ছিলেন অহিংসার প্রবক্তা। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতা সংগ্রাম অহিংস পদ্ধতিতে পরিচালনা করা উচিত। তাঁর মতে, প্রকৃত আধ্যাত্মিক স্বাধীনতার জন্য স্থায়ী শাস্তি অপরিহার্য।
(4) রাজনৈতিক স্বাধীনতা
মৌলানার ধারণার প্রধান আলোচ্য বিষয়ই হল রাজনৈতিক স্বাধীনতার (Political Freedom) ধারণা। খুব অল্প বয়সে মৌলানা আজাদ রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের হাত থেকে ভারতকে স্বাধীন করার প্রচেষ্টায় জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে সামিল হয়েছিলেন, জাতীয় কংগ্রেসে (Indian National Congress, INC) যোগদান করেছিলেন এবং সর্বকনিষ্ঠ কংগ্রেস সভাপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। জাতীয় কংগ্রেসে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন এবং মহাত্মা গান্ধি ও জওহরলাল নেহরু-র মতো নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করেছিলেন। তিনি এমন একটি মুক্ত ভারতের কল্পনা করেছিলেন, যেখানে সমস্ত সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু-মুসলমান শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করতে পারে। ভারতকে রাজনৈতিকভাবে স্বাধীন করার পশ্চাতে তাঁর মূল অবদান হল-
- জাতীয় কংগ্রেসে ভূমিকা পালন: মৌলানা আজাদ রাজনৈতিক ক্ষেত্রে একজন অনুপ্ররণাদানকারী ব্যক্তি ছিলেন। তিনি আনুমানিক ১৯২০ খ্রিস্টাব্দে খিলাফৎ আন্দোলনের সূত্রে কংগ্রেস দলের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত হন। ১৯২৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি মাত্র ৩৫ বছর বয়সে কংগ্রেস দলের সর্বকনিষ্ঠ সভাপতি নিযুক্ত হন। আজাদ কংগ্রেসের মঞ্চকে ব্যবহার করেই স্বরাজবাদী ও খিলাফৎ নেতাদের ঐক্যবদ্ধ করার চেষ্টা করেন। এ প্রসঙ্গে ১৯২৪ খ্রিস্টাব্দে দিল্লিতে ঐক্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। আজাদ কংগ্রেসের ওয়ার্কিং কমিটি এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবেও দায়িত্বপালন করেছিলেন। ১৯২৮ খ্রিস্টাব্দে সাইমন কমিশনের রিপোর্টের বিরোধিতা করে মতিলাল নেহেরু-র সভাপতিত্বে নেহরু রিপোর্ট পেশ করা হলে, আজাদ তাকে সমর্থন করেন। ফলে মহম্মদ আল জিন্নাহ-সহ মুসলিম লিগের বিভিন্ন নেতাদের দ্বারা তিনি ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। আজাদ ধর্মের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচনমণ্ডলীর দাবিকে সমর্থন করেননি, পরিবর্তে ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন ভারতের জন্য আহবান জানান। এ ছাড়াও গান্ধিজির পূর্ণ স্বরাজ গঠনের আহবানকেও সমর্থন করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ভারত শাসন আইনের অধীনে নির্বাচন আহবান করা হলে আজাদ প্রার্থী বাছাই, সমাবেশ সংঘটিত করার কাজে নিযুক্ত হন।
- জাতীয়তাবাদী বিভিন্ন আন্দোলনে যোগদান: পরাধীন ভারতে ১৯১৯ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে যে খিলাফৎ আন্দোলন গড়ে উঠেছিল, তাতে মৌলানা আবুল কালাম আজাদ সক্রিয়া ভূমিকা পালন করেন। ভারতীয় মুসলিমরা তুরস্কের সুলতানকে খলিফা বা মুসলিম ধর্মগুরু বলে মনে করত। কিন্তু প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়কালে (১৯১৪-১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ) ইংল্যান্ড-সহ মিত্রপক্ষ তুরস্ককে পরাজিত করে সুলতানের ক্ষমতাকে খর্ব করলে ভারতীয় মুসলমানদের মনে তীব্র ক্ষোভের সঞ্চার ঘটে। তারা ‘খলিফা’র মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যেই খিলাফৎ আন্দোলন শুরু করেছিল। এই সময় গান্ধিজি তাঁর অসহযোগ আন্দোলনকে ব্যাপক রূপদান করার উদ্দেশ্যে খিলাফৎ আন্দোলনকে অসহযোগ আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত করেন। এই সূত্রেই তিনি গান্ধির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে তুলেছিলেন। আজাদ মনে করেছিলেন, অহিংসার পথ অবলম্বনের মাধ্যমেই কেবল ব্রিটিশ শাসনের হাত থেকে ভারত স্বাধীনতা লাভ করতে পারে। এ কারণেই তিনি গান্ধিজির অহিংস পথের অনুসরণ করেন। যাই হোক, আজাদ অখিল ভারত খিলাফৎ কমিটি (All India Khilafat Committe)-র সভাপতি নির্বাচিত হন। তিনি মুসলমানদের অসহযোগ আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য আন্তরিকভাবে আবেদন জানান। তিনি গান্ধিজির সঙ্গে মিলিতভাবে খিলাফৎ-অসহযোগ আন্দোলনকে জনপ্রিয় করে তোলার প্রচেষ্টা করেন। এই সময় আজাদ সারা ভারত জুড়ে ভ্রমণ করে আন্দোলনের জন্য সমর্থনের ভিত্তি জোগাড় করেন এবং ব্রিটিশ পণ্য ও প্রতিষ্ঠান বর্জন-সহ ব্রিটিশ নীতির বিরুদ্ধে অহিংস-প্রতিবাদে অংশগ্রহণের পক্ষে কথা বলেন। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মধ্যে দিয়েই তিনি হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক বিভাজন দূর করে ঐক্য স্থাপনের প্রচেষ্টা করেন এবং ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে গান্ধিজি ডান্ডি অভিযানের মাধ্যমে লবণ সত্যাগ্রহের সূচনা করলে মৌলানা আজাদ সেই আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। গান্ধিজির লবণ সত্যাগ্রহ আইন অমান্য আন্দোলন নামেও পরিচিত। যাই হোক, আজাদের আহবানে এবং প্রভাবে বেশ কিছু মুসলিম সংগঠন আইন অমান্য আন্দোলনে যোগ দিয়েছিল। তিনি লবণ কর বৃদ্ধি, লবণ উৎপাদন ও বিক্রির উপর ব্রিটিশ সরকারের নিষেধাজ্ঞার তীব্র বিরোধিতা করেন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য ব্রিটিশ সরকার আজাদ-সহ প্রমুখ অংশগ্রহণকারীদের কারারুদ্ধ করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়, আজাদ ভারত ছাড়ো আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিলেন। ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ৮ আগস্ট বোম্বাইতে (বর্তমান মুম্বাই) সারা ভারত কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি (All India Congress Working Commitee)-র ঐতিহাসিক অধিবেশনে ভারত ছাড়ো (Quit India) আন্দোলনের প্রস্তাব গৃহীত হয়। কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে এই সময় আজাদ সারা দেশে হাজার হাজার মানুষকে সর্বাত্মক সংগ্রামে প্রস্তুত হওয়ার জন্য উৎসাহিত করেছিলেন, কংগ্রেস সভাপতি হিসেবে আজাদ সারা ভারত ভ্রমণ করে বক্তৃতা দেন ও বিদ্রোহের পরিকল্পনা করেন। যদিও ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সূচনা লগ্নেই কংগ্রেস সভাপতি-সহ ওয়ার্কিং কমিটির প্রথম সারির নেতাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
- জিন্নাহ এবং দেশত্যাগের বিরোধিতা: মুসলিম লিগের নেতা মহম্মদ আলি জিন্নাহ দ্বিজাতি তত্ত্ব (Two Nation Theory)-এর মাধ্যমে অখণ্ড ভারতবর্ষকে ধর্মের ভিত্তিতে বিভাজিত করার প্রস্তাব জানিয়েছিলেন। ১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে লাহোর অধিবেশনে জিন্নাহ অখণ্ড ভারতবর্ষকে ‘মুসলিম ভারত’ ও ‘হিন্দু ভারতে’ ভাগ করতে চেয়েছিলেন। তিনি দাবি করেন, ‘জাতি’ শব্দের পরিভাষা অনুযায়ী মুসলমানরা একটি স্বতন্ত্র জাতি, এই জন্যই তাদের নিজস্ব পৃথক বাসভূমি, ভৌগলিক এলাকা এবং রাষ্ট্রের প্রয়োজন। কংগ্রেসের সভাপতি হিসেবে আজাদ কঠোরভাবে জিন্নাহ-র দ্বিজাতি তত্ত্ব ও দেশভাগের বিরোধিতা করেছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘দ্বিজাতি’ তত্ত্ব একটি মরীচিকা, যা কখনোই বাস্তবায়িত হবে না। স্বাধীনতা সংগ্রামের একেবারে অন্তিম পর্বে ব্রিটিশ ভারতের গভর্নর জেনারেল লর্ড মাউন্টব্যাটন (Lord Mountbatten) ভারত ভাগের যে পরিকল্পনা করেন, তা মুসলিম লিগ এবং শেষপর্যন্ত কংগ্রেসের অন্যান্য নেতৃবৃন্দরা মেনে নিলেও আজাদ মানতে পারেন নি। তিনি সুস্পষ্ট ভাষায় বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত বিভাজন উভয়পক্ষের মানুষদের জন্য ধ্বংস ডেকে আনবে। তিনি আরও বলেছিলেন, “গোটা ভারতই আমার ভূখণ্ড এবং আমি এর রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক জীবন গড়ে তোলার অংশীদ্বার।… উত্তরাধিকারসূত্রে প্রাপ্ত সম্পদের সব ছেড়ে দিয়ে শুধু তার একটা টুকরো নিয়ে খুশি হওয়া আমাদের কাছে নিশ্চিতভাবে কাপুরুষতা বলে মনে হয়।”
- স্বাধীনতা আন্দোলনে মুসলিমদের আহবান: মৌলানা আজাদ তুর্কি বিপ্লবীদের সংস্পর্শে এসে বুঝতে পেরেছিলেন, ভারতীয় মুসলমানদের উচিত দেশব্যাপী স্বাধীনতা সংগ্রামে নিজেদের নিযুক্ত করা। আজাদ এ প্রসঙ্গে তাঁর আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থে ‘ভারত স্বাধীন হল’-তে লিখেছেন, ‘ভারতীয় মুসলমানরা কী করে ব্রিটিশের নিছক তল্পিবাহক হয় এটা তাদের (তুর্কী বিপ্লবীদের) মাথায় ঢুকত না।’ তরুণ মৌলানা একান্ত চেয়েছিলেন, ব্রিটিশ সরকার যাতে কিছুতেই মুসলমানদের কাজে লাগাতে না পারে। সেই জন্য তিনি যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলেছিলেন। তৎকালীন সময়ে ভারতে মুসলিম রাজনৈতিক নেতৃত্ববৃন্দের মূল কথা ছিল, মসুলমানদের ব্রিটিশ সরকারের অনুগত থাকতে হবে। আজাদ এর মতে, এই অবস্থা থেকে মুসলমান সমাজকে বের করে আনতে হলে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে নতুন আন্দোলনের ধারা গড়ে তুলতে হবে। সেই উদ্দেশ্যেই তিনি মুসলমান সম্প্রদায়কে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগদান করার আহবান জানান। ফলে তাঁর রাজনৈতিক স্বাধীনতা ছিল অন্তর্ভুক্তিমূলক। তিনি এমন এক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করতেন, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থ্যককে অতিক্রম করে ধর্মীয় বা জাতিগত পটভূমি নির্বিশেষে সকলকে ঐক্যবদ্ধ করবে।
- হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সেতুবন্ধন: তাঁর ধর্মনিষ্ঠ মনোভাব হিন্দু- মুসলিম ঐক্য স্থাপনের চিন্তাকে ত্বরান্বিত করেছিল। পরাধীন ভারতে স্বাধীনতার জন্য ব্রিটিশ বিরোধী সংগ্রামে মৌলানা আজাদ হিন্দু-মুসলিম সম্প্রীতির সেতুবন্ধনের গুরুদায়িত্ব পালন করেছিলেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, ভারতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী লড়াইয়ে হিন্দু-মুসলিমদের এক জাতি হয়ে লড়াই করতে হবে। তবেই ভারত স্বাধীন হবে। তিনি মনে করতেন যে, ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই হল ধর্ম নির্বিশেষে সমস্ত ভারতীয়দের জন্য একটি সাধারণ সংগ্রাম। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনকে অখণ্ড, ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক ভারত গড়ার একটি সুযোগ হিসেবে দেখেছিলেন। ভারতের প্রতি তার এই অখণ্ড ও ধর্মনিরপেক্ষ দৃষ্টিভঙ্গি দেশটিকে সামাজিক সম্প্রীতি এবং জাতীয় সংহতির দিকে এগিয়ে নিয়ে যেতে অনুপ্রাণিত করেছিল।
- রাজনৈতিক স্বাধীনতায় নিবেদিত প্রাণ: ব্রিটিশ বিরোধী লড়াইকে আজাদ পবিত্র লড়াই বলে মনে করতেন। এন্ডমন্ড বার্ক-এর মতো তিনি বিশ্বাস করতেন যে, স্বাধীনতা এক স্বাভাবিক বিষয়, ঈশ্বর প্রদত্ত উপহার। কোনো দেশ যত মহানুভবই হোক-না-কেন তার অধিকার নেই অন্যকে পরাধীন করে রাখার। দাসত্ব হল ঈশ্বরের ইচ্ছাবিরুদ্ধ এক বস্তু। ফলে বিদেশি শাসন থেকে দেশকে মুক্ত করার লড়াই হল তাঁর কাছে নৈতিক কর্তব্য। আজাদ লিখেছেন, “বিগত বারো বছর ধরে আমি আমার সম্প্রদায়কে শেখাচ্ছি তাদের অধিকার এবং স্বাধীনতার দাবি জানাতে। আমি মাত্র ১৮ বছরে যখন প্রথম এই বিষয়ে বলতে ও লিখতে আরম্ভ করি আমি সবকিছু এতেই সমর্পণ করেছি। জীবনের সবচেয়ে ভালো সময়ই উৎসর্গ করেছি অর্থাৎ আমার পুরো তারুণ্যটা আদর্শের প্রতি অন্ধ ভালোবাসার জন্য দিয়েছি।… এ হল আমার জীবনের লক্ষ্য এবং যদি আমি বেঁচে থাকি তাহলে এই একমাত্র লক্ষ্যের জন্য বাঁচব।”
- আল-হিলাল’ পত্রিকার ভূমিকা: পশ্চিমি দেশের সফর থেকে ফিরে এসে তরুণ আজাদ ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে মুসলমান সমাজকে জাগরিত করার উদ্দেশ্যে ১৯১২ খ্রিস্টাব্দে আল-হিলাল নামক উর্দু সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করা শুরু করেন। এই পত্রিকায় তিনি ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী বিভিন্ন লেখনী প্রকাশ করতে শুরু করেন, যা মুসলমান সমাজকে জাগরিত করে স্বাধীনতা আন্দোলন গড়ে তোলায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। উর্দু সংবাদপত্রের ইতিহাসে আল-হিলাল প্রকাশ এক যুগান্তকারী ঘটনা। ভারতে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে ‘আল-হিলাল’ পত্রিকায় আজাদ বলিষ্ঠভাবে জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছিলেন। ফলে ব্রিটিশ-সহ ব্রিটিশদের মুসলমান অনুচরবর্গও ভীত হয়ে পড়ে এবং পত্রিকার সম্পাদক আজাদকে খুন করার হুমকি পর্যন্ত দেয়। যদিও ২৪ বছরের তরুণ আজাদ ভীত হননি। উপরন্তু তাঁর পত্রিকার জনপ্রিয়তা বহুগুণ বৃদ্ধি পেয়েছিল। এমতাবস্থায়, ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পত্রিকাটির উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। যদিও আজাদ তাতে উৎসাহ না হারিয়ে আল-বালাঘ (Al-Balagh) নামক সাপ্তাহিক পত্রিকা একই উদ্দেশ্যে প্রকাশ করতে শুরু করেন। এটির উপরও ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশ সরকার নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং আইন দ্বারা মৌলানা আজাদকে কলকাতা থেকে বহিষ্কার করে বিহারের রাঁচিতে নজরবন্দি করা হয়।
- গণতন্ত্রের প্রতি আস্থা: মৌলানা আজাদ গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, রাজানৈতিক স্বাধীনতা কেবল বিদেশি শাসনের অবসান ঘটায় না, বরং এটি ব্যক্তির অধিকার ও স্বাধীনতা সুরক্ষার পথটিকে সুনিশ্চিত করে। তিনি মূলত সংখ্যালঘু অধিকার সুরক্ষার স্বার্থে গণতন্ত্রের ধারণার সমর্থন জানিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, গণতন্ত্র ব্যক্তির মতামত ও চিন্তা প্রকাশের স্বাধীনতাকে সুনিশ্চিত করে, যার ফলে বিকাশ দমনপীড়নের ভয় ছাড়াই ব্যক্তি সাংস্কৃতিক ও বৌদ্ধিক বিকাশ ঘটাতে পারবে। এর মধ্যেই নিহিত রয়েছে প্রকৃত রাজনৈতিক স্বাধীনতা। তিনি একটি মুক্ত সমাজের অপরিহার্য উপাদান হিসেবে শিল্প, সাহিত্য এবং বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধান ইত্যাদি বিষয়কে উৎসাহিত করেছিলেন।
- কারাবাস এবং আত্মত্যাগ: স্বাধীনতা সংগ্রামে অংশগ্রহণের কারণে আজাদ বহুবার ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের হাতে বন্দি হন। কিন্তু তাতেও তাঁকে ব্রিটিশ সরকার দমিয়ে রাখতে পারেনি। কারাগার থেকেই তিনি তাঁর লেখনী ও বক্তৃতার মাধ্যমে জনসাধারণকে অনুপ্রাণিত করতে থাকেন। আইন অমান্য আন্দোলনে অংশগ্রহণ করার জন্য তিনি জেল বন্দি ছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময়ও তিনি ১৯৪২-১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কারারুদ্ধ ছিলেন। স্বাধীন ভারত গঠনের জন্যই দেশের প্রতি তিনি তাঁর তারুণ্য যৌবন কালকে উৎসর্গ করেছিলেন। ভারত ছাড়ো আন্দোলনের সময় জাতীয় মুক্তির বৃহত্তর উদ্দেশ্যে, তিনি ব্যক্তি স্বাধীনতাকে বিসর্জন দিয়ে ভারতের স্বাধীনতাকে ব্রিটিশদের থেকে ছিনিয়ে নেওয়ার কথা বলেন। তাঁর অসাধারণ বাগ্মীতা এবং ভারতীয় জনগণের আশা-আকাঙ্খাকে তুলে ধরার ক্ষমতার জন্য ভারতের অভ্যন্তরে এবং আন্তর্জাতিক মঞ্চে সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হন, যেখানে তিনি ভারতের স্বাধীনতা ও আত্মনিয়ন্ত্রণের পক্ষে যুক্তি দিয়েছিলেন।
মূল্যায়ন
স্বাধীনতা ও জাতীয়তাবাদে মৌলানা আজাদের অবিস্মরণীয় অবদান থাকা সত্ত্বেও, তিনি বিভিন্ন কারণে সমালোচনার শিকার হয়েছেন। তাঁর বিরুদ্ধে সমালোচনাগুলি হল-
(1) ভারত বিভাজন প্রতিরোধে ব্যর্থতা
আজাদ সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে ভারত ভাগের ঘোরতর বিরোধী ছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলমান ঐক্য ও সম্প্রীতি স্থাপনের জন্য সারা জীবন অক্লান্ত পরিশ্রম করে গেছেন এবং অখণ্ড ভারতের কল্পনা করেছিলেন। সমালোচকদের বক্তব্য হল, তাঁর কল্পনাকে আজাদ বাস্তবায়িত করতে পারেননি। তাঁর সর্বাত্মক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও মুসলিম লিগের ক্রমবর্ধমান প্রভাব এবং জিন্নাহ-র পৃথক মুসলিম রাষ্ট্রের দাবিকে প্রতিহত করতে তিনি ব্যর্থ হন। জিন্নাহ এবং মুসলিম লিগের সঙ্গে তার আলোচনার প্রচেষ্টা কাঙ্খিত ফল দেয়নি। সমালোচকরা আরও বলেন যে, সম্ভবত সাম্প্রদায়িকতা বিষয়ে ঐক্যের গভীর বিশ্বাসের কারণেই হিন্দু- মুসলমান বিরোধের তীব্রতাকে তিনি আঁচ করতে পারেননি, যার ফলে শেষপর্যন্ত দেশভাগকে আটকানো যায়নি।
(2) অতিমাত্রায় নেহরুর প্রভাব
জওহরলাল নেহরু-র সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত থাকার কারণে আজাদ ব্যাপকভাবে সমালোচিত হন। যদিও নেহরু ও আজাদ উভয়ই অখণ্ড গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ স্বাধীন ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও সমালোচকদের যুক্তি ছিল, আজাদ তাঁর নিজের মতামতকে যথেষ্ট জোরালোভাবে জাহির করেননি, বিশেষত দেশভাগের মতো গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে। এর প্রধানতম কারণ হিসেবে সমালোচকরা বলেন যে, নেহরু এবং কংগ্রেস দলের প্রতি আজাদের আনুগত্য কখনোই তাঁকে স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতা দেয়নি। ফলে নিজের মতামত দৃঢ়ভাবে ব্যক্ত করার ও তাঁর মতকে প্রতিষ্ঠিত করার সুযোগ তিনি পাননি।
(3) ধর্মের প্রভাব
আজাদ ধর্মনিরপেক্ষ ভারতের স্বপ্ন দেখলেও তিনি নিজে একজন ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন। অনেক সমালোচক আজাদের এই রূপকে পরস্পরবিরোধী বলে আখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য ও ধর্মনিরপেক্ষ আদর্শ প্রচারের সময়ও ইসলামীয় ঐতিহ্যের উপর জোর দেন। সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, এই দ্বৈততা কখনও কখনও তাঁর রাজনৈতিক অবস্থানকে দুর্বল করে তুলেছে। তাঁর দ্বৈতরূপের কারণে উভয় সম্প্রদায়ের কাছেই সম্পূর্ণ আস্থাভাজন হয়ে উঠতে পারেননি। তিনি দেশভাগ, ধর্ম বা সাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচকমণ্ডলীর দাবির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন। ফলে মুসলমানদের ক্ষোভের সম্মুখীন হন।
(4) আন্দোলনের নেতৃত্বে ভূমিকা
খিলাফৎ আন্দোলন থেকে শুরু করে ভারত ছাড়ো আন্দোলন পর্যন্ত আজাদ বিভিন্ন জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্ব দিলেও তাঁর নেতৃত্ব সন্তোষজনক ছিল না বলে সমালোচকরা অভিযোগ করেছেন। সমালোচকরা মনে করেন, জাতীয় আন্দোলনে আজাদের নেতৃত্ব ততটা কার্যকর ছিল না, যতটা হতে পারত। বরং, আজাদ আন্দোলনের ক্ষেত্রে কৌশলগত পন্থাই অবলম্বন করেছিলেন।
(5) অহিংসা এবং সত্যাগ্রহ
আজাদ গান্ধিজির অহিংস পদ্ধতিকে সমর্থন জানিয়েছিলেন। কিন্তু সমালোচকরা যুক্তি দেন যে, এই কৌশলগুলি সর্বদা ব্রিটিশ শক্তিকে দমন করা এবং স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে কার্যকর ছিল না। তারা পরামর্শ দেন, ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ত্বরান্বিত করার জন্য অহিংস পদ্ধতির পরিবর্তে বৈপ্লবিক পদ্ধতির প্রয়োজন অধিক ছিল। শিশু
(6) আদর্শবাদ
সমালোচকরা আজাদের আদর্শবাদ, বিশেষ করে শিক্ষা, এবং ধর্মনিরপেক্ষতার প্রতি তাঁর বিশ্বাসকে অবাস্তব বলে সমালোচনা করেছেন। সমালোচকদের মতে, তাঁর আদর্শবাদী দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে তাৎক্ষণিক রাজনৈতিক সংকট মোকাবিলায় বাস্তববাদী ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বাধা দিয়েছিল।
উক্ত সমালোচনা সত্ত্বেও বলা যায়, মৌলানা আজাদ কোনো তাত্ত্বিক ছিলেন না, ফলে স্বাধীনতা সম্পর্কে তিনি কোনো তত্ত্বগত ধারণা দেননি। তিনি ছিলেন একজন আপোসহীন জাতীয়তাবাদী স্বাধীনতা সংগ্রামী। একই সঙ্গে তিনি ধর্মনিরপেক্ষ অখন্ড ভারতের স্বপ্ন দেখেছিলেন, যে ভারতবর্ষে সকল ধর্মীয় সম্প্রদায় মিলেমিশে সহাবস্থান করতে পারবে। তিনি স্পষ্টভাবেই ঘোষণা করেন যে, ধর্মের ভিত্তিতে দেশকে বিভক্ত করা উচিত নয়। এ কারণেই তিনি ভারত বিভাজন ও পৃথক রাষ্ট্র হিসেবে পাকিস্তান সৃষ্টির তীব্র বিরোধিতা করেছিলেন এবং যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন যে, এটি ভারতীয় সমাজের ধর্মনিরপেক্ষ এবং বহুত্ববাদী কাঠামোকে দুর্বল করবে। তিনি তাঁর রাজনৈতিক কর্মজীবনের সূচনাপর্ব থেকেই অন্তর্ভুক্তিমূলক জাতীয়তাবাদের প্রচার করেছিলেন। তিনি এমন এক জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী ছিলেন, যা ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক পার্থক্যকে অতিক্রম করে।
তিনি বলেছিলেন, সকল ভারতবাসীর উচিত তাদের ধর্মীয় বা জাতিগত পটভূমি নির্বিশেষে স্বাধীনতার লড়াইয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়া এবং একটি মুক্ত ও প্রগতিশীল জাতিগঠনের জন্য একত্রিত হয়ে কাজ করা। তিনি আরও বলেছিলেন, স্বাধীনতা বলতে কেবল বিদেশি শাসনের অবসানকে বোঝায় না, বরং যে সমাজ সকল ব্যক্তির অধিকারকে (মতামত প্রকাশ, ধর্মীয় স্বাধীনতা) সুরক্ষিত করতে পারে সেই সমাজই প্রকৃতঅর্থে স্বাধীন। ভারতের স্বাধীনতার প্রতি আজাদের অটল প্রতিশ্রুতি, ধর্মনিরপেক্ষ এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ভারতের জন্য তাঁর অনন্য দৃষ্টিভঙ্গির কারণেই স্বাধীন ভারতে আজও তাঁকে স্মরণ করা হয়।
আরও পড়ুন – কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য লেখো