লৌকিক সাহিত্যের নানা দিক প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester WBCHSE

১। ছড়া কাকে বলে? ছড়ার বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ দাও।
লোকসাহিত্যের বিচিত্র শাখার মধ্যে অন্যতম হল ছড়া। ছড়া মূলত ছন্দ ও পদ্য নির্ভর লোকসাহিত্য, যা লোকসমাজের মুখে মুখে প্রচারিত হয়ে আসছে জীবনচর্চার সূত্র ধরে। ছড়া সম্পর্কে লোকসংস্কৃতিবিদ বরুণকুমার চক্রবর্তী সংজ্ঞা দিয়েছেন, “ব্যষ্টি রচিত হয়েও স্বল্পায়তনবিশিষ্ট ছন্দবদ্ধ পদসমূহ যা নাকি সমষ্টি কর্তৃক গৃহীত হয়ে সমষ্টির সম্পদরূপে পরিচিতি অর্জন করে। যেখানে ছন্দ নির্মিত কৌশল এবং অসংলগ্ন চিত্রের সমাবেশই মুখ্য, মূলত শিশু ভোলানাথদের মনোরঞ্জনের জন্য যা নাকি মুখে মুখে রচিত এবং মূলত নারী কর্তৃক ব্যবহৃত তাকেই আমরা ছড়া বলে অভিহিত করতে পারি।”
(1) ছড়ার বৈশিষ্ট্যসমূহ: (১) ছন্দ মাধুর্যময়তা, (২) অসংলগ্নতা, (৩) শিশুর মনোরঞ্জনকারী, (৪) স্বল্প সুর সংযোজনা, (৫) বাস্তব ও কল্পনার বিচিত্র প্রতিচ্ছবি প্রকাশ, (৬) জীবনের সহজ সত্য, (৭) Myth-এর প্রভাব, (৮) ব্যষ্টির সৃষ্টি নয়, সমাজের সৃষ্টি।
(2) উদাহরণ: আড়ি আড়ি আড়ি/কাল যাব বাড়ি/পরশু যাব ঘর/কি করবি কর/হনুমানের ল্যাজ ধরে/টানাটানি কর।
২। ছড়ায় সমাজচিত্র কীভাবে প্রকাশিত হয়েছে, তা সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ছড়া মানুষের আদিমতম সাহিত্য প্রয়াসগুলির মধ্যে বহুল চর্চিত বিষয়। বাংলা লোকসমাজে প্রচলিত ছড়াগুলিকে লোকসমাজের দর্পণ বলা হয়। সমাজ, বাস্তব ও দৈনন্দিন জীবনের বহু বিষয় সত্য রূপে প্রতিফলিত হয়েছে ছড়ায়। যেমন-
(1) মেয়েলি ব্রতের ছড়াগুলির মধ্য দিয়ে নারীজীবনের বিভিন্ন কথা ও প্রসঙ্গ উদ্ভাসিত হয়েছে। উল্লেখ্য-সেঁজুতি ব্রতের ছড়ায় সতীন সম্পর্ক।
“অশথ তলায় বসত করি।
সতীন কেটে আলতা পরি।।
সাত সতীনের সাত কৌটা।
তারি মাঝে আমার এক অভ্রের কৌটা।।
অভ্রের কৌটা নাড়ি চাড়ি।
সাত সতীনকে পুড়িয়ে মারি।।“
(2) সমাজজীবনে নিজের পিতৃপরিবারের দায়িত্ব ও কর্তব্যবোধ সম্পর্কে প্রচলিত ছড়া।
“বাপের বোন পিসি,/ভাতকাপড়ে পুষি।
মার বোন মাসি,/কাদায় ফেলে আসি।”
(3) বর্গীর আক্রমণ, অত্যাচারের ছবি ছড়ায় ছন্দে প্রাচীন কালের সমাজচিত্র হয়ে উঠেছে।
“খোকা ঘুমালো পাড়া জুড়ালো বর্গী এল দেশে।
বুলবুলিতে ধান খেয়েছে খাজনা দেব কিসে?”
(4) বিয়ের যৌতুক গ্রহণ এবং বিয়ের পর যৌতুকের জন্য বধু নির্যাতনের কাহিনি ছড়ার মধ্যে প্রকাশ পেয়েছে।
“এত টাকা নিলে বাবা ছাঁদন তলায় বসে-
এখন কেন কাঁদ বাবা গামছা মুখে দিয়ে।
আমরা যাব পরের ঘরে পর অধীন হয়ে
পরের বেটি মুক করবে মুখনাড়া দিয়ে।
দুই চক্ষের জল পড়বে বসুধারা দিয়ে।”
৩। ধাঁধা কাকে বলে? ধাঁধার বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ দাও।
ধাঁধা লোকসাহিত্যের অন্যতম প্রাচীনতম গুরুত্বপূর্ণ শাখা ও অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। এনসাইক্লোপিডিয়া ব্রিটানিকাতে ধাঁধার সংজ্ঞা অনুসারে বলা চলে-যা গ্রামের সংহত মানুষের সৃষ্টি, মৌখিক ঐতিহ্যে প্রবাহিত, যার মধ্যে অর্থচাতুর্যের পরিচয় ও গূঢ় অর্থের ব্যঞ্জনা প্রকাশ পায়, যা ধন্দ বা দ্বন্দ্বের সৃষ্টি করে এবং প্রশ্নের আকারে যা ধরা হয় তাকেই ধাঁধা বলা হয়।
ধাঁধার বৈশিষ্ট্যসমূহ
(1) ধাঁধার মাধ্যমে পরিণত শিল্পীমন, রসবোধ বা সূক্ষ্ম হাস্যরসের ইঙ্গিত মেলে।
(2) ধাঁধার আবেদন মূলত বুদ্ধিগ্রাহ্য।
(3) আপাতত একটি অর্থ, প্রকৃত উদ্দেশ্যে অন্য অর্থ-এইরূপ বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ দুই অর্থ বিদ্যমান।
(4) নিগূঢ় ব্যঞ্জনা থাকায় হঠাৎ সহজে বুঝা যায় না। একটু ভাবিত হয়।
(5) একটি মাত্র ভাবকে রূপকের আশ্রয়ে প্রশ্নচ্ছলে প্রতিপাদ্য করা হয়, এমন কৌশল বা চাতুর্য ধাঁধায় পরিলক্ষিত হয়।
উদাহরণ
(1) পায়ে ধরে সাধা,/রা নাহি দেয় রাধা।।
শেষে দিল রা/পাগোল ছাড়ো পা।। (ধারাগোল)
(2) ঘর আছে দরজা নাই/মানুষ আছে কথা নাই। (ডিম)
৪। ধাঁধা ও প্রবাদের সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লেখো।
ধাঁধা ও প্রবাদ আপাতদৃষ্টিতে এক বলে মনে হলেও তাদের মধ্যে বেশ কিছু সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্য লক্ষ করা যায়। সেগুলি হল-
সাদৃশ্য
(1) লোকসাহিত্যের ধাঁধা ও প্রবাদ শ্রেণিবিচারে ও গঠনভঙ্গির দিক থেকে সমধর্মী। উভয়েই সংক্ষিপ্ত, পদ্য অথবা গদ্যধর্মী সরস রচনা।
(2) ধাঁধা ও প্রবাদের অর্থ সহজে বোধগম্য হয় না। একটু বুদ্ধি দিয়ে উপলব্ধি করতে হয়। যেমন- ঢেঁকি বিষয়ক নিম্নোক্ত ধাঁধাঁগুলি প্রবাদের সমরূপ-(ক) বাজার বাড়ির হাতি, নিত্য খায় লাথি।
(খ) খেতে দিয়ে কেড়ে নেয় তাতেই সন্তোষ।
ধাঁধাগুলির মধ্যে প্রবাদের রূপ অত্যন্ত প্রত্যক্ষ হয়ে আছে।
(3) দৈনন্দিন জীবনের কর্মব্যস্ততার অবসরে জীবনের নির্মম অভিজ্ঞতার কথা প্রবাদের ভাষায় ব্যক্ত হয়, অন্যদিকে ধাঁধার ক্ষেত্রেও অবসর বিনোদনে খেলাচ্ছলে ধাঁধা জিজ্ঞাসা করা ও উত্তর দেওয়ার রীতি প্রচলিত ছিল।
বৈসাদৃশ্য
(1) প্রবাদের মধ্যে মানব চরিত্রের তীব্র সমালোচনার ভাব ব্যঞ্জিত হয় বলে এর ভাষা ঝাঁঝালো ও প্রত্যক্ষ, ধাঁধা অবসর বিনোদনের সঙ্গী বলে তার ভাষা তেমনি কঠিন নয়, কোমলতায় গ্নিগ্ধ। যেমন-
এক গাছে তিন তরকারি/দাঁড়ায় আছে লাল বিহারী। (সজনে) এতে ব্যঙ্গ ও সমালোচনার ভাব কিছু নেই, সহজ কাব্যধর্মী সরস ভাষায় রচিত।
(2) ধাঁধা কৌতুকের বিষয়, কিন্তু প্রবাদ কঠিন জীবনের সত্যোপলব্ধি, তাতে কৌতুকের ছোঁয়া নেই। প্রবাদে বাস্তব জীবন প্রতিফলিত হয়, ঠিক তেমনি ধাঁধা হল মানস কল্পনার রঙিন ফসল।
(3) সভ্যতার আদিকালে ধাঁধার একটি সামাজিক মূল্য ছিল। প্রবাদ সমাজজীবন অভিজ্ঞতার ফল। ধাঁধার অনেক পরে প্রবাদের জন্ম।
(4) ধাঁধা আদিম ঐন্দ্রজালিক ধর্মবিশ্বাস থেকে উদ্ভূত বলে মনে হয়, কিন্তু প্রবাদ সর্বপ্রকার ভাবসংস্কার মুক্ত বাস্তব সমাজ অভিজ্ঞতায় সৃজিত লোকমুখে ছড়িয়ে পড়া কথা।
শেষকথা
লোকসাহিত্যের অঙ্গ হল-ধাঁধা ও প্রবাদ। জীবনবোধের গভীরতায় ধাঁধা ও প্রবাদ একে অপরের পরিপূরক। বর্তমানে ধাঁধার প্রয়োগ ও প্রচলন লুপ্ত হয়ে গেলেও প্রবাদ দৈনন্দিন জীবনে এখনও বহুলভাবে প্রচলিত।
৫। প্রকৃতি, গার্হস্থ্য, দেবদেবী বিষয়ক, কার্যাবলির সঙ্গে তুলনা করে ধাঁধার উদাহরণ দাও।
প্রকৃতি বিষয়ক ধাঁধা
(1) একটুখানি গাছে, রাঙা বউটি নাচে। (লঙ্কা)
(2) আকাশ পাতাল সিঁড়ি/বিনি কুমোরের হাঁড়ি
বিনি সাজার দই/তাতে জল থই থই। (নারকেল)
গার্হস্থ্য বিষয়ক ধাঁধা
(1) তিন অক্ষর নাম তার রান্না হয় ঘরে
প্রথম অক্ষর বাদ দিলে মেয়েলোক পরে। (খিচুড়ি)
(2) এখান থেকে দিলাম সাড়া,
সাড়া গেল বামুন পাড়া। (শঙ্খধ্বনি)
(3) কার্যাবলির সঙ্গে তুলনা সাগরেতে জন্মতার লোকালয়ে বাস, মায়ে ছুঁলে পুত্র মরে একি সর্বনাশ। (লবণ)
দেবদেবী বিষয়ক ধাঁধা
(1) বৃন্দাবনে বাস তার কিবা নাম ধরে?
যশোদার পুত্র হয়ে ননী চুরি করে। (কৃষ্ণ)
(2) সোনার বরণ দেহ তার তরুণ সন্ন্যাসী।
লোকজন সঙ্গে নিয়ে হইল উদাসী।। (গৌরাঙ্গ বা শ্রীচৈতন্যদেব)
কার্যাবলির সঙ্গে তুলনা বিষয়ক ধাঁধা
(1) সাগরেতে জন্ম তার লোকালয়ে বাস
মায়ে ছুঁলে পুত্র মরে একি সর্বনাশ। (লবণ)
৬। উদাহরণসহ প্রবাদের সংজ্ঞা ও বৈশিষ্ট্য লেখো।
প্রবাদ মানুষের বাস্তব অভিজ্ঞতার বুদ্ধিদীপ্ত ফল। প্রবাদ সম্পর্কে স্পেনদেশীয় লোকসংস্কৃতিবিদের মন্তব্য, “A proverb is a short sentence based on long experience.” এ ছাড়াও লোকসংস্কৃতি মহলে সর্বজন স্বীকৃত প্রবাদ বিষয়ক আশুতোষ ভট্টাচার্যের প্রদেয় সংজ্ঞা-
“প্রবাদ বিস্তৃততম জীবন অভিজ্ঞতার সংক্ষিপ্ততম সাহিত্যিক প্রকাশ। মানুষের জীবন অভিজ্ঞতা তার নিজস্ব প্রাত্যহিক ব্যাবহারিক জীবনকে কেন্দ্র করেই গঠিত হয় এবং এই অভিজ্ঞতা দেশে এবং কালে কতকগুলি বিষয়ে মূলত এক ও অভিন্ন, ফলে প্রবাদ বিশেষ কোনো মানবগোষ্ঠীর মধ্যে ক্রমে সংখ্যায় বৃদ্ধি পেলেও মৌখিক সাহিত্যের অন্যান্য বিষয়ের মতো বিশেষ কোনো মৌলিক পরিবর্তনের সম্মুখীন হয় না।”
প্রবাদের বৈশিষ্ট্য
(1) প্রবাদ মানুষের বাস্তব প্রত্যাভিজ্ঞতার বুদ্ধিদীপ্ত ফল।
(2) শব্দের স্বল্পতায় অর্থের আধিক্য দর্শিত হয়। মার্কিন প্রবাদ বিশেষজ্ঞ আর্চার টেলর প্রবাদের বেশ কিছু বৈশিষ্ট্যের কথা বলেছেন- (ক) চিরন্তনতা, (খ) সত্যতা, (গ) সমাজ অভিজ্ঞতা, (ঘ) স্মরণ যোগ্যতা, (ঙ) সংক্ষিপ্ততা, (চ) বুদ্ধিদীপ্ততা।
উদাহরণ
(1) একে মা মনসা, তায় ধুনোর গন্ধ।
(2) বাইরে কোঁচা লম্বা, ভেতরে অষ্টরম্ভা।
(3) কান টানলে মাথা আসে।
(4) শূন্য কলশির আওয়াজ বেশি।
(5) মেয়ে বাঁচলে জামাইয়ের আদর।
৭। প্রবাদে সমাজচিত্র কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
সংক্ষিপ্ত, সরল, রূপক অলংকারবহুল, সহজ, প্রাচীন এবং সর্বোপরি সত্য লোকসাহিত্য সম্পদ হল প্রবাদ। দৈনন্দিন প্রত্যাভিজ্ঞার ফল হওয়ায় সমাজজীবনের বাস্তব চিত্র প্রবাদে প্রতিফলিত হয়েছে। বাংলা লোকসমাজে লোকমুখে প্রচলিত প্রবাদগুলিকে লোকসমাজের দর্শন বলা যেতে পারে। প্রবাদে ভিন্ন ভিন্ন সময়ের ভিন্ন ভিন্ন আঙ্গিকের সমাজচিত্র ফুটে উঠেছে।
(1) পারিবারিক জীবনের চিরন্তন সত্যের প্রকাশ। শাশুড়ির প্রতি বধূর নিষ্ঠুর মানসিকতার জ্বলন্ত উদাহরণ-
“শাশুড়ি ম’ল সকালে
খেয়ে দেয়ে যদি বেলা থাকে কাঁদব আমি বিকালে।”
(2) সামাজিক কুপ্রথা পণ বিষয়ে-
“ঘুরিয়ে নে পণের টাকা।
এমন বিয়েতে কাজ নেই বাবা।”
(3) বাঙালি সমাজে প্রচলিত লৌকিক প্রথা-শ্রাদ্ধ বিষয়ক-
“কড়ি থাকলে বেয়াইয়ের বাপের শ্রাদ্ধ হয়।
না থাকলে নিজের বাপের শ্রাদ্ধও হয় না।”
(4) নির্মম সতীদাহপ্রথা বিষয়ে প্রচলিত প্রবাদ-
“কার আগুনে কেবা মরে আমি জাতে কলু।
মা আমার কি পুণ্যবতী বলছে, দে উলু।।”
(5) বাঙালি হিন্দুসমাজে পিন্ডদান প্রথা বিষয়ে-
“বাপ থাকতে বিদ্যমান, গয়ায় গিয়ে পিন্ডদান।”
(6) সুদের ভিত্তিতে ঋণ দান ও গ্রহণ বিষয়ে-
“আসলের চেয়ে সুদ মিষ্টি।”
(7) সমাজের প্রচলিত চৌর্যবৃত্তি বিষয়ে-
“চোরের মন বোঁচকার দিকে।”
(8) জীবনের চলার পথ বিষয়ে প্রচলিত লোকবিশ্বাস-
“মঙ্গলের উষা বুধে পা।
যথা ইচ্ছা তথা যা।”
৮। লোককথার সংজ্ঞা, বৈশিষ্ট্য ও উদাহরণ দাও।
প্রকৃতপক্ষে লোককথার সংজ্ঞা নিরূপণ করা দুরূহ। কারণ কথাসাহিত্যের এই বিষয়টি মৌখিক ঐতিহ্যনির্ভর। শ্রুতিনির্ভর বলে এ কাহিনি বর্ণনাকালে এর অনেক কিছুই পরিবর্তিত হয়ে যায়। ‘লোককথার’ বিষয়ে Stith Thompson সংজ্ঞা দিয়েছেন- “The characteristic feature of the folktale is the fact that it is traditional. It is handed down from one person to another and there is no virtue in orginality. This tradition may be purely oral.”
লোককথার বৈশিষ্ট্য
(1) শ্রুতিনির্ভর বিষয়বস্তু লোককথার প্রধান উপকরণ। মৌলিক বিষয়বস্তু এর উপজীব্য হতে পারে না।
(2) লোককথা ব্যক্তিবিশেষের রসবোধের ওপর ভিত্তি করে রচিত হলেও এর একটি সার্বজনীন ভিত্তি আছে। সেই কারণে লোককথা কালজয়ী হয়ে অমরত্ব লাভ করে।
(3) সর্বপ্রাণবাদ (Animism) প্রতিষ্ঠা।
(4) দেশ-কাল-পাত্র নিরপেক্ষ আবেদন আছে।
(5) ধর্মীয় প্রভাবমুক্ত হওয়ায় দেশ-দেশান্তরে সহজে ছড়িয়ে পড়ে।
(6) লোককথা গদ্য ভাষায় রচিত। অন্তগূঢ় অর্থ থাকে এবং তা পরিণত মনেরও রস-পিপাসা চরিতার্থ করতে সক্ষম।
(7) ঐন্দ্রজালিক ক্রিয়ার বিশেষ প্রাধান্য থাকে।
(8) নিয়তি বা অদৃষ্টের বিশেষ স্থান আছে।
উদাহরণ
ঈশপের গল্প, সংস্কৃত পঞ্চতন্ত্রের নীতি, সায়ফুলমূলক বদিউজ্জমান জাতীয় রূপকথা ও রোমাঞ্চকথা, হারকিউলিস বা থিসিয়াসের গ্রিককাহিনি, সংস্কৃত বেতাল পঞ্চবিংশতির বিক্রমাদিত্যের কাহিনি, রবিনহুডের কাহিনি, উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির গল্প প্রভৃতি।
৯। ব্রতকথা কী? ব্রতকথা বিষয়ক কয়েকটি গ্রন্থের নাম লেখো।
লোককথার একটি বিশিষ্ট শাখা ব্রতকথা। ‘ব্রত’ কথাটি প্রতিজ্ঞা, চর্চা বা সাধন অর্থে ব্যবহৃত হয়ে থাকে। তবে সাধারণভাবে শ্রদ্ধার সঙ্গে কোনো বিশেষ লোকাচার উদ্যাপনকেই প্রচলিত অর্থে ব্রতকথা বলা হয়।
বাংলায় লৌকিক দেবতাদের অবলম্বন করে এগুলি রচিত। আদিম সংস্কার ও উচ্চতর সংস্কৃতির মিশ্রণের ফলে এই ব্রতকথাগুলিতে প্রবল অনিষ্টকারী দেবতাকে প্রসন্ন করে তাঁর দ্বারা প্রভূত কল্যাণসাধনের বিশ্বাসই প্রচারিত হয়। বাঙালি জীবনচর্যায় লৌকিক বিশ্বাস; ব্রতের মধ্য দিয়ে পুণ্য অর্জন হয়। ব্রতকথা শুনলে বা পালন করলে অমঙ্গল বা অশুভের বিনাশ হয়। প্রচলিত ব্রতগুলি হল-মনসাব্রত, শিবব্রত, লক্ষ্মীব্রত, পুণ্যিপুকুর ব্রত, শীতলাষষ্ঠী ব্রত প্রভৃতি। ব্রতকথায় নানা মানবিক দোষগুণের আলোকেই দেবতাদের চিত্রিত করা হয়েছে; যা পরবর্তীকালে সাহিত্যে প্রতিফলিত হয়েছে।
- ব্রতকথা বিষয়ক কয়েকটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ হল-সুহাসিনী দেবীর ‘মেয়েলি ব্রতকথা’, ড. শীলা বসাকের ‘বাংলার ব্রত পার্বণ’, অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলার ব্রত’, রামেন্দ্রসুন্দর ত্রিবেদীর ‘বঙ্গলক্ষ্মীর ব্রতকথা’, আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের ‘মেয়েদের ব্রতকথা’ প্রভৃতি।