প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চার পরিচয় দাও

প্রাচীন ভারতে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা
কৃষির জন্য মাস, বছর প্রভৃতির হিসাব রাখার প্রয়োজন বলে অন্যান্য দেশের মতো ভারতও অনুভব করেন। কিন্তু ভারতে কৃষির থেকেও যাগযজ্ঞ, নানা ধর্মানুষ্ঠান প্রভৃতি বিষয়ে জ্যোতিষচর্চার প্রয়োজন ছিল বেশি। বৈদিক যুগে জ্যোতিষকে একটি স্বতন্ত্র বিদ্যা হিসেবে মনে করা হত। এই সময়ে ভারতবর্ষে জ্যোতির্বিদ্যার অগ্রগতি ঘটেছিল। ব্রাহ্মণ্য সাহিত্যে জ্যোতিষ্ককে বলা হয়েছে নক্ষত্রবিদ্যা এবং জ্যোতির্বিদকে বলা হয়েছে গণক। কালনির্ণয়, পঞ্জিকা প্রণয়ন এবং গ্রহনক্ষত্রের সমাবেশ থেকে মানুষের ভাগ্যগণনা ছিল হিন্দু জ্যোতিষের প্রধান কাজ।
(1) মাস ও বছর গণনা: প্রথমদিকে বৈদিক হিন্দুরা মূলত ৩০ দিনে ১ মাস ও ১২ মাসে ১ বছর (৩৬০ দিন) হিসেব করে পঞ্জিকা তৈরি করতেন। আবার কখনো-কখনো ১৩ মাসেও বছরকে নির্ণয় করা হত। সেক্ষেত্রে অতিরিক্ত ১টি মাসকে মলমাস হিসেবে গণ্য করা হত। এ ছাড়া বৈদিক হিন্দুরা মকরক্রান্তি, কর্কটক্রান্তি, ক্রান্তিবিন্দুদ্বয় – মহাবিষুব ও জলবিষুব ইত্যাদি বিষয়গুলি নিয়মিত পর্যবেক্ষণ করতেন যা সময় গণনার ক্ষেত্রে তাদের সহায়তা করত।
(2) রাশিচক্র: বৈদিক যুগে হিন্দুরা রাশিচক্রের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। ঋকবেদের একটি স্তোত্রে আকাশপথে সূর্যের আপাতগতিকে ১২টি পাকিযুক্ত চাকার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। অপর একটি স্তোত্রে উল্লিখিত রয়েছে সেই চাকার ৩৬০টি দাঁত রয়েছে। টীকাকার সায়নের মতে, চাকার ১২টি পাকি হল রাশিচক্রের ১২টি প্রতীক।
(3) গ্রহসংক্রান্ত জ্ঞান: ভারতীয়রা ঋকবেদের সময়কাল থেকে ৭টি গ্রহ সম্পর্কে অবগত ছিল, তার মধ্যে অন্যতম গ্রহ হল মঙ্গল, বৃহস্পতি, শুক্র। বৈদিকযুগে চাঁদের যে নিজস্ব কোনও আলো নেই, তা সূর্যের আলোয় আলোকিত এই ধারণা সম্পর্কে সম্ভবত ভারতীয়রা অবগত ছিল। শতপথব্রাহ্মণে পৃথিবীকে পরিমণ্ডল হিসেবে আখ্যায়িত করতে দেখে অনেকেই মনে করেন পৃথিবীর আকৃতি গোলাকার, এই জ্ঞানও বৈদিক যুগের ধারণায় পরিচিত ছিল। বৈদিক শাস্ত্রের পণ্ডিত লুডউইগ, তারকেশ্বর ভট্টাচার্য, একেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রমুখের মতে, বৈদিক যুগে পৃথিবীর আহ্নিক গতি ও বার্ষিক গতি অনুমান করা সম্ভব হয়েছিল।
(4) বেদাঙ্গ জ্যোতিষ: প্রাচীন ভারতে জ্যোতিষীয় জ্ঞানের অতি মহামূল্যবান গ্রন্থ হল বেদাঙ্গ জ্যোতিষ। এই গ্রন্থটি বৈদিক যুগের পঞ্জিকা বিশেষ। এই গ্রন্থে ৩৬০ দিনে বছর গণনার পরিবর্তে ৩৬৬ দিনে বছরের হিসাব রাখা শুরু হয়। এই গ্রন্থ থেকে শীত ও গ্রীষ্মকালে অয়নবিন্দুতে অশ্লেষা ও ধনিষ্ঠা নক্ষত্রের অবস্থান সম্পর্কে জানা যায়।
(5) প্রাচীন ভারতের উল্লেখযোগ্য জ্যোতির্বিদগণ: খ্রিস্টীয় পঞ্চম শতকের বিখ্যাত হিন্দু জ্যোতির্বিদ ছিলেন আর্যভট্ট। তাঁর শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ছিল আর্যভটীয়। তিনি তাঁর রচনায় সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বের কথা তুলে ধরেন। তিনিই প্রথম পৃথিবীর আহ্নিক গতির কথা উল্লেখ করেন। এ ছাড়া সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণ, বার্ষিক গতির বিষয়গুলিও আর্যভট্টের বক্তব্যে উঠে আসে। আর্যভট্ট ছাড়াও লাটদেব, বরাহমিহির, ব্রহ্মগুপ্ত প্রমুখ জ্যোতিষচর্চায় কৃতিত্ব দেখান। বরাহমিহিরের পঞ্চসিদ্ধান্তিকা ও বৃহৎসংহিতা এবং ব্রহ্মগুপ্তের ব্রহ্মস্ফুট সিদ্ধান্ত গ্রন্থে বিভিন্ন গ্রহনক্ষত্রের অবস্থান, সূর্যগ্রহণ, চন্দ্রগ্রহণের কারণ ইত্যাদি নানাবিধ বিষয়সমূহের আলোচনা রয়েছে।