সবুজায়ন বনাম নগরায়ণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

সভ্যতার বিকাশ আধুনিক পৃথিবীর জনসংখ্যা বৃদ্ধির একটি অন্যতম কারণ। এর ফলে মানুষের দরকার হয়ে পড়েছে বাসযোগ্য ভূমির। তাই মানুষ নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করেছে, জলাশয় ভরাট করেছে, নিজ আবাসভূমি তৈরির উদ্দেশ্যে। বর্তমান বিশ্বের ভয়াবহ জনবিস্ফোরণ প্রকৃতির সুস্থতাকে বিনষ্ট করেছে। সর্বত্রই চলেছে নগরায়ণের প্রস্তুতি। অবাধে সবুজ ধ্বংস করে গড়ে উঠছে পরিকল্পিত টাউনশিপ ও অট্টালিকা। পৃথিবী বড়ো ধূসর আজ। আকাশের রং কালো। ধোঁয়ার আচ্ছাদনে মোড়া তার নীলাভ সুষমা।
এদেশে কলকাতা, দিল্লি, মুম্বাই, চেন্নাই প্রভৃতি শহরগুলি ছিল দেশের সর্ববৃহৎ শিক্ষা ও বাণিজ্যকেন্দ্র। বর্তমানে জনসংখ্যা বৃদ্ধির প্রয়োজনে এই শহরগুলি ছাড়াও গড়ে উঠেছে অনেক উপনগরী। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে তাল মিলিয়ে তৈরি হচ্ছে নিত্যনতুন বাসস্থান। ফলে শহরতলির ক্ষেত্র আজ বহুদূর প্রসারিত। কোথাও গাছপালা কেটে, আবার কোথাও জলাশয় বুজিয়ে গড়ে উঠেছে বিশাল অট্টালিকা।
যুগের গতির সঙ্গে তাল রাখতে গিয়ে মানুষ প্রাকৃতিক ভারসাম্যকে নষ্ট করছে। সরকারি এবং বেসরকারি উদ্যোগে ভারতের বড়ো বড়ো শহর এবং শহরতলিতে গড়ে উঠেছে ফ্ল্যাটবাড়ি। বর্তমানে নগরায়ণে আক্রান্ত সবুজ। এর জন্য শুধু মানুষের অপরিমিত স্বার্থই দায়ী নয়, দায়ী যুগের চাহিদা এবং সর্বব্যাপী পরিবর্তনের মোহ।
পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে গাছ। তাই এই সমস্যা থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য তৈরি হয়েছে ‘বনসৃজন প্রকল্প’। নির্বিচারে গাছ কাটা নয়, নির্বিচারে গাছ লাগিয়ে যাওয়াই হবে এখন আমাদের প্রধান কাজ।
জনবসতির অনুপাতে গাছের পরিমাণ নির্দিষ্ট হওয়া দরকার। গাছ না-থাকলে বর্ষা হওয়া কঠিন। গাছই টেনে আনে জলভরা মেঘ, আনে মৌসুমি বাতাসের শীতলতা। মৌসুমি বৃষ্টির কল্যাণেই আমাদের দেশে চাষবাস হয়।
অপরিকল্পিত নগরায়ণের গতি যত বাড়বে, দেশের সবুজ তত ধ্বংস হবে। পরিবেশ ভয়ংকরভাবে দূষিত হবে। আজকে বিশ্ব উন্নায়নের কারণও এই নগরায়ণ। সেই সুজলা, সুফলা, শস্যশ্যামলা সমভূমি আর কোথায়? কোথায় সেই সবুজের সমারোহ। চারিদিকেই শুধু ইট-কাঠ-পাথরের জঙ্গল। মানুষ নানা রোগ-ব্যাধিতে আক্রান্ত। পারস্পরিক সহানুভূতি, সহমর্মিতা, মূল্যবোধ আজ মানুষের বর্ণহীন মন থেকে অবসিত। নগরায়ণের ফলে বেড়েছে যানবাহন ও কলকারখানার সংখ্যা। ফলে শব্দ, বায়ু ও জল দূষিত হচ্ছে ক্রমাগত। মানুষ মুক্ত বাতাসের বদলে নাকে টানছে বিষাক্ত গ্যাস। ক্যানসারের মতো দুরারোগ্য ব্যাধি বাসা বাঁধছে শরীরে, হারিয়ে যাচ্ছে সৌন্দর্য। রূপ-রস-গন্ধে ভরা পৃথিবী আজ যেন মলিন ও বিবর্ণ হয়ে পড়েছে।
যুগের প্রয়োজনে নগরায়ণ হয়তো অবশ্যম্ভাবী; কিন্তু তাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে রাখতে হবে। যথেচ্ছভাবে সবুজ ধ্বংস করে নগরায়ণ চলবে না। এলাকাভিত্তিক বনসৃজন প্রকল্পকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। কলকাতার মতো বড়ো শহরে প্রতি এক কিলোমিটারে রাস্তার দু-ধারে যথেচ্ছ গাছ থাকা প্রয়োজন, নইলে বায়ু ও শব্দের দূষণ রোধ করা যাবে না। নগরায়ণ হলেও, তা যেন সবুজকে ধ্বংস না-করে। জলাশয় এবং গাছ বাঁচিয়ে এবং নতুন গাছ লাগিয়ে নগরায়ণকে দূষণমুক্ত করতে হবে। এজন্য সরকারি পদক্ষেপের সঙ্গে জনগণকেও ইতিবাচক ভূমিকা পালন করতে হবে। তবেই মানুষের মনে টিকে থাকবে প্রাণবন্ত সবুজ ও সজীবতার রেশ।