কোভিড-১৯-র বিশ্বব্যাপী আক্রমণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

‘মন্বন্তরে মরিনি আমরা মারী নিয়ে ঘর করি’
কবির এই অমোঘ উক্তি বোধ করি আজ আর শুধুমাত্র বাঙালির কাছে অনুপ্রেরণার নয়-এ উক্তি আজ জাতীয় মঞ্চ থেকে আন্তর্জাতিক মঞ্চের অনুপ্রেরণার রসদ হওয়ার যোগ্য। হ্যাঁ, অতিমারি কোভিড-১৯ যেভাবে দেশকালের বেড়া অতিক্রম করে মানুষের সঙ্গে বৈরিতায় নেমেছে-তা থেকে মুক্তি পেতে আমাদের লড়াই জারি থাকবে। পৃথিবীব্যাপী এর আগেও নানান মহামারি মানুষ নিধনে শামিল হয়েছে-সেদিন যদি তাদের প্রতিহত করতে পারে মানুষ তবে আজও পারবে।
ভাইরাসটি চিনের উহান প্রদেশের বেশ কিছু ব্যক্তির নিউমোনিয়া পরীক্ষার সময় ৩১ ডিসেম্বর ২০১৯-এ মানুষের সমক্ষে আসে। ভাইরাসটির ‘Crowned appearence’ বলে নামটি হল ‘কোরনা’ ভাইরাস। ‘কোরনা’ ভাইরাস গোত্রটি কিন্তু সাধারণ ঠান্ডা লাগা ইত্যাদিতে বহুদিন থেকেই সক্রিয় কিন্তু বর্তমান ‘নোবেল কোরনা ভাইরাস’ যার চরিত্র একটু আলাদা এবং এই ভাইরাসটিই SARS (It cause a kind severe acute Respiratory Syndrome)-এর জন্য দায়ী। ১২ জানুয়ারি ২০২০-তে চিন জনসমক্ষে এর জিনগত গঠন প্রকাশ করে।
এই ভাইরাসটি মূলত আক্রান্ত ব্যক্তিদের হাঁচি-কাশির ড্রপলেটের সঙ্গে ছ-ফুট পর্যন্ত বাতাসে ছড়িয়ে অপরকে সংক্রামিত করতে পারে এবং এগুলি ড্রপলেটের মধ্যে একটা নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যন্ত বেঁচে থাকতে পারে। তাই রাস্তাঘাটে বিভিন্ন স্থান থেকে স্পর্শের মাধ্যমে এই জীবাণু আমাদের মুখের মধ্যে চলে যায় এবং তা মুখগহ্বর থেকে ক্রমশ ফুসফুসে গিয়ে বাসা বেঁধে রেসপিরেটরি সিস্টেমকে অকেজো করে দেয়। এই ভাইরাসটি সাধারণ লোকদের চেয়ে ডায়াবেটিস, হৃদ্রোগী, ফুসফুস ও কিডনি সমস্যাজনিত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে মারাত্মক।
এই রোগের লক্ষণ জ্বর, মাথা ও শরীরে ব্যথা, সেইসঙ্গে গলা ব্যথাও। আক্রান্ত ব্যক্তি গন্ধ ও স্বাদ গ্রহণে অসমর্থ হয়। রোগের পরবর্তী পর্যায়ে শ্বাসকষ্ট দেখা যায়। এসময় শরীরে অক্সিজেনের মাত্রাও কমে যায়। সাবধানতা বলতে সামাজিক দূরত্ব বজায়, হাত ধোয়া এবং মাস্ক ব্যবহার করা ইত্যাদি।
বর্তমান বিশ্বায়নের যুগে এইরূপ সংক্রামক রোগ শুধুমাত্র একটি ভূখণ্ডের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকবে এ কথা ভাবা বাতুলতা মাত্র। চিন, ভারত, রাশিয়া, ইংল্যান্ড, জাপান, আরব, আমেরিকা, ইটালি, মেক্সিকো, স্পেন এবং আফ্রিকার বিভিন্ন দেশেও এই রোগ ব্যাপকাকারে ছড়িয়ে পড়ে। সারা বিশ্বব্যাপী চলে এক মৃত্যুমিছিল। ভারতও এই রোগের প্রাদুর্ভাবে পিছিয়ে ছিল না। দৈনিক মৃত্যুহার, সংক্রামিতের হার এবং সুস্থতার হার ওঠানামা করছে ভারতেও।
ভারতে এই রোগ যেখানে সর্বাধিক প্রভাব বিস্তার করেছিল সেই রাজ্যগুলি হল-মহারাষ্ট্র, দিল্লি, গুজরাট, মধ্য ও উত্তরপ্রদেশ, পশ্চিমবঙ্গ, তামিলনাড়ু, পাঞ্জাব প্রভৃতি। ভারত এই রোগকে নিয়ন্ত্রণের জন্য একদিকে যেমন প্রচার চালিয়ে যাচ্ছিল তেমনি চার দফায় মোট আটষট্টি দিন লকডাউন ঘোষণা করে, পয়লা জুন ২০২০ থেকে আনলক পর্ব শুরু করে। এ ছাড়া বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, টেস্ট ইত্যাদির সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়াতে সচেষ্ট হয়।
এই অতিমারি একদিকে যেমন সামাজিক দূরত্ব তৈরি করে, ঠিক তেমনিভাবে লকডাউনের জন্য দিন আনি দিন খাই মানুষের অভাব ক্রমশ বেড়ে চলে। ছোটো ছোটো ব্যবসায়ীরা, মধ্যবিত্তরাও দুবেলা অন্নসংস্থানের জন্য হিমসিম খায়। শ্রমিক, খেতমজুর ও প্রাত্যহিক মজুররা ভয়ংকর সমস্যায় পড়ে। এ ছাড়া রেল, বিমান, ব্যাবসা ইত্যাদি বন্ধ থাকার জন্য সরকারি কোশাগারেও টান পড়ে। সরকারও সাধারণ পরিসেবাগুলি জনগণকে দিতে হিমসিম খায়। আর্থিক বৃদ্ধির হার ক্রমশ তলানিতে ঠেকে।
শিক্ষাক্ষেত্রে এর প্রভাব ছিল অত্যন্ত ভয়ংকর। সংক্রমণের ভয়ে সমস্তরকম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়েছিল। যদিও অনলাইন ক্লাস চলেছিল বিভিন্ন ক্ষেত্রে। তবে এই পরিসেবা বেশিরভাগ ছাত্রছাত্রীদের কাছেই ছিল অধরা। দেশের ভাবী প্রজন্মের কাছে শিক্ষার এই যে ফাঁক তার অপূরণীয় ক্ষতিস্বরূপ আজও প্রকটভাবে ধরা পড়ে।
এই সংক্রামক রোগকে নিয়ন্ত্রণের প্রথম ও প্রধান উপায় হল সচেতনতা। বিজ্ঞানের কল্যাণে কোরনার টিকা আজ আবিষ্কৃত হয়েছে। সারা বিশ্বজুড়ে চলা টিকাকরণ আজ সমাপ্তির মুখে; বুস্টার ডোজও প্রায় সারা বিশ্বজুড়ে শেষ হয়েছে। তবে টিকাকরণের পরেও যে দুর্ঘটনা ঘটছে না-এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় না; আক্রান্ত হচ্ছে-মৃত্যুহার কমছে। এই ভাইরাসঘটিত মহামারি থেকে মুক্তি পেতে হলে সমগ্র মানবসমাজকে সজাগ হয়ে একসঙ্গে লড়াই করতে হবে -ইতিহাস অন্তত এই শিক্ষাই দেয়।