দৃশ্যমান জ্যোতির্বিদ্যার জনক হিসেবে গ্যালিলিও-র ভূমিকা লেখো

দৃশ্যমান জ্যোতির্বিদ্যার জনক হিসেবে গ্যালিলিও-র ভূমিকা
ইটালির পিসা শহরে প্রখ্যাত জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও গ্যালিলি-র জন্ম (১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে ১৫ ফেব্রুয়ারি)। গ্যালিলিও ছিলেন একদিকে যেমন পদার্থবিজ্ঞানী, জ্যোতির্বিজ্ঞানী, গণিতজ্ঞ আবার অন্যদিকে ছিলেন দার্শনিক। তিনি তাঁর কর্মকাণ্ডের জন্য দৃশ্যমান জ্যোতির্বিদ্যার জনক হিসেবে পরিচিত হন।
(1) দূরবীক্ষণ যন্ত্রের আবিষ্কার: মহাকাশ পর্যবেক্ষণের জন্য দূরবীক্ষণ যন্ত্র আবিষ্কার করে গ্যালিলিও জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চায় সাড়া ফেলে দেন। একটি নলের দুদিকে একটি উত্তল ও একটি অবতল লেন্স স্থাপন করে তিনি লক্ষ করেন যে, লক্ষ্যবস্তুর দূরত্ব প্রায় এক-তৃতীয়াংশ কমে গেছে এবং তার অবয়ব প্রায় নয়গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্যালিলিও তাঁর এই কাচ-যন্ত্রটিকে জ্যোতিষ্কলোকের রহস্যভেদের কাজে নিয়োজিত করেন।
(2) দূরবীক্ষণ দ্বারা পর্যবেক্ষণ: গ্যালিলিও নিজ আবিষ্কৃত দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা টেলিস্কোপের সাহায্যে জ্যোতিষ্কমণ্ডলীর উপর গভীর পর্যবেক্ষণ চালান। এতে উঠে আসা অজানা মহাকাশ সম্পর্কে নানান তথ্য ১৬১০ খ্রিস্টাব্দে Sidereus Nuncius বা The Starry Messenger গ্রন্থে তুলে ধরেন তিনি।
- সূর্যকেন্দ্রিক মহাবিশ্বের ধারণা: গ্যালিলিও ছিলেন কোপারনিকাসের মতবাদের একনিষ্ঠ সমর্থক। তাঁর সূর্যকেন্দ্রিক বিশ্বব্রহ্মান্ডের গঠনকে বৈজ্ঞানিক প্রমাণের সাহায্যে প্রতিষ্ঠা করেন গ্যালিলিও। তাঁর মতে সূর্য কেন্দ্রে অবস্থিত এবং সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলি পরিক্রমা করছে।
- চাঁদের বর্ণনা: গ্যালিলিও চন্দ্রকলঙ্কের কারণ খুঁজতে গিয়ে উল্লেখ করেন ভূপৃষ্ঠের মতোই চাঁদের উপরিভাগও পাহাড়, পর্বত, উপত্যকা, নদী, গহ্বর দ্বারা গঠিত। গ্যালিলিও দূরবীক্ষণ যন্ত্রের সাহায্যে প্রমাণ করেন চন্দ্রপৃষ্ঠ ভূপৃষ্ঠের মতোই অসমতল। তিনি আরও বলেন যে পৃথিবী থেকে চাঁদকে যেমন উজ্জ্বল দেখায় তেমনই চাঁদ থেকেও, দেখা সম্ভব হলে, পৃথিবীকে উজ্জ্বল দেখাবে। কারণ, উভয়েই সূর্যের আলোর প্রতিফলন দ্বারা আলোকিত হয়।
- গ্রন্থ-উপগ্রহ সম্পার্ক ধারণা: গ্যালিলিও বৃহস্পতির চারটি উপগ্রহ ও তাদের পরিক্রমণ তত্ত্ব উপস্থাপন করেন এবং এদের নাম দেন Medicea Sidera (the Medici Stars, গ্যালিলিও-র পৃষ্ঠপোষক কসিমো দ্য মেডিচির নামানুসারে)। কোপারনিকাস ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন যে, মানুষের দৃষ্টিশক্তি বাড়ানো গেলে চাঁদের মতো বুধ ও শুক্রের কলা (Phase) পর্যবেক্ষণ করা যাবে। একে সত্য প্রমাণ করে গ্যালিলিও জানান যে, শুক্রও পৃথিবী এবং চাঁদের মত একই পর্যায়ের নৈসর্গিক বস্তু। সূর্যের আলোকেই শুক্র আলোকিত হয়ে ওঠে।
- সৌরকলঙ্কের রহস্যভেদ: গ্যালিলিও-র অন্যতম আবিষ্কার সৌরকলঙ্ক। ১৬১২ খ্রিস্টাব্দে তিনি সৌরকলঙ্কের রহস্য উন্মোচন করেন। তিনি বলেন, সূর্যের নিকটবর্তী ভ্রাম্যমাণ কতকগুলি ক্ষুদ্র গ্রহের জন্য এই দাগ দেখা যায়। যেহেতু সূর্যের মাঝখান দিয়ে যাওয়ার সময় গ্রহগুলির বেগ বেড়ে যায় এবং সূর্যের প্রান্তভাগের দিকে গেলে তাদের বেগ ক্রমশ কমে যায়, তাই গ্যালিলিও গ্রহগুলির গতিবেগের তারতম্য বিশ্লেষণ করে সূর্যের গায়ের দাগগুলির স্থান পরিবর্তনের কারণ ব্যাখ্যা করেন।
- নক্ষত্র ও নক্ষত্রপুঞ্জ সম্পর্কে ধারণা: গ্যালিলিও-র টেলিস্কোপে বহু নক্ষত্রের অস্তিত্ব পরিলক্ষিত হয়। যেমন-কৃত্তিকা (Pleiades) তারামণ্ডলের ৩৬টি নক্ষত্র, যুগ্ম নক্ষত্র (Double Star), নক্ষত্রপুঞ্জ (Star Clusters), কয়েকটি নীহারিকা প্রভৃতি। তিনি দেখান যে, ছায়াপথ (Milky Way) আসলে অসংখ্য ঘনসন্নিবিষ্ট নক্ষত্রসমষ্টি। এ ছাড়া গ্যালিলিও-র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কার ছিল শনির বলয়। গ্যালিলিও প্রথম দূরবীক্ষণ যন্ত্র ব্যবহার করে মহাকাশের বস্তুগুলির সম্পূর্ণ নতুন ও বৈজ্ঞানিক ধারণা প্রদান করেছিলেন -যা জ্যোতির্বিদ্যার বিকাশে নিয়ে আসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। তাই গ্যালিলিওকে দৃশ্যমান জ্যোতির্বিদ্যার জনক বলা হয়।