মৌলিক অধিকার ও কর্তব্যসমূহ প্রশ্ন উত্তর

১। নাগরিকদের দুটি কর্তব্য লেখো।
নাগরিকদের দুটি কর্তব্য
[1] রাষ্ট্রের প্রতি শ্রদ্ধা, সম্মান প্রদর্শন হল নাগরিকদের প্রধান কর্তব্য। রাষ্ট্রের আদর্শের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শনের সঙ্গে সঙ্গে আইনকেও মান্য করতে হয়। রাষ্ট্রের সংকটময় পরিস্থিতিতে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে রাষ্ট্রের নাগরিকরা-এটাই কাম্য। এ ছাড়াও ভোট প্রদান করে উপযুক্ত যোগ্যতাসম্পন্ন প্রতিনিধি নির্বাচন করার কর্তব্য নাগরিকদের উপরেই বর্তায়।
[2] আন্তর্জাতিক ভ্রাতৃত্ববোধ ও বিভিন্ন জাতির প্রতি মানবতাবোধ নাগরিকদের গুরুত্বপূর্ণ কর্তব্যের মধ্যে পড়ে। বিশ্বশান্তি ও নিরাপত্তা রক্ষা, ঘৃণা-বিদ্বেষহীন ও বৈষম্যহীন আচরণ নাগরিকদের মেনে চলতে হয়।
২। অধিকার এবং কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
অধিকার ও কর্তব্যের মধ্যে সম্পর্ক হল নিম্নরূপ-
অধিকারের মধ্যেই কর্তব্য নিহিত: অধিকার ও কর্তব্যের ধারণা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। একটিকে বাদ দিয়ে অন্যটির আলোচনা সম্ভব নয়। অধিকার ও কর্তব্য উভয়ই সৃষ্টি হয়েছে মানুষের সমাজবোধ থেকে। সমাজের বাইরে এদের কোনো অস্তিত্ব নেই। সমাজের বিভিন্ন দাবিগুলিকে রাষ্ট্র স্বীকৃতি দিলে তা অধিকারে রূপান্তরিত হয়। এই অধিকারগুলি নাগরিকদের কাছ থেকে কিছু দায়িত্বপালন আশা করে, যেগুলি কর্তব্য নামে পরিচিত।
অধিকারের ভিত্তি হিসেবে সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য: সামাজিক দায়িত্ব ও কর্তব্য পালনকে অধিকারের ভিত্তি হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। এ প্রসঙ্গে বেন ও পিটার্স বলেন যে, কর্তব্য পালনের উপর অধিকারভোগ নির্ভরশীল। হবহাউস-এর বক্তব্য হল, অধিকারভোগ সামাজিক দায়িত্ব পালনের শর্তসাপেক্ষ। সমাজ ব্যক্তিকে অধিকার দান করে, যাতে সে তার ব্যক্তিত্বের সর্বাঙ্গীণ বিকাশের মাধ্যমে নিজেকে সমাজকল্যাণে নিয়োজিত করে।
৩। মৌলিক অধিকারের সংজ্ঞা বিশ্লেষণ করো।
মৌলিক অধিকার: মৌলিক অধিকার বলতে সাধারণভাবে সেই অধিকারগুলিকে বোঝায়, যেগুলি নাগরিকদের ব্যক্তিসত্তার বিকাশে একান্তভাবে অপরিহার্য। নাগরিকদের জীবন ও ব্যক্তিত্বের বিকাশের জন্য বিশ্বের প্রায় সব দেশে মৌলিক অধিকার স্বীকৃত ও সংরক্ষিত হয়েছে। এককথায় মৌলিক অধিকার হল সেই সকল অধিকার, যা সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত ও সংরক্ষিত এবং শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের নিয়ন্ত্রণমুক্ত। অধ্যাপক জোহারি-র মতে, মৌলিক অধিকার হল এমন এক ধরনের অধিকার, যা দেশের সর্বোচ্চ আইনের দ্বারা সুরক্ষিত। এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলার (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) রায় দেওয়ার সময় বিচারপতি পতঞ্জলি শাস্ত্রী বলেন, ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি এই কারণেই মৌলিক, যে এটিকে শাসন বিভাগ ও আইন বিভাগের এক্তিয়ারমুক্ত করে রাখা হয়েছে।
৪। ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার গৃহীত হয়েছে কোন্ দেশের সংবিধানকে অনুসরণ করে? কোন্ মামলার রায়ে সুপ্রিমকোর্ট মৌলিক অধিকার সমূহকে ‘মহাসনদ’ বা ‘Magna carta’ বলে আখ্যা দেয়?
মৌলিক অধিকারের উৎস: ভারতীয় সংবিধানে তৃতীয় অধ্যায়ে (Part-III) নাগরিকদের জন্য কতকগুলি গুরুত্বপূর্ণ অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছে। এগুলিকে মৌলিক অধিকার বলা হয়। সংবিধান ১২ থেকে ৩৫ নং অনুচ্ছেদের মধ্যে এগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। সংবিধানের প্রনেতারা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অর্থাৎ অধিকারের বিল থেকে মৌলিক অধিকার সম্পর্কে অনুপ্রেরণা পেয়েছেন।
এ কে গোপালন বনাম মাদ্রাজ রাজ্য মামলায় (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) সুপ্রিমকোর্ট মৌলিক অধিকার গুলিকে ‘মহাসনদ’ বা ‘Magna carta’ বলে আখ্যা দেয়। বিচারপতি পি বি গজেন্দ্র গাদকর এর মতে, মৌলিক অধিকারগুলি হল ভারতের গণতান্ত্রিক জীবনধারার ভিত্তি।
৫। মৌলিক অধিকারের দুটি প্রকৃতিগত বিষয় উল্লেখ করো।
মৌলিক অধিকারের প্রকৃতির বিষয়দুটি নিম্নরূপে ব্যক্ত করা হল-
আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বে স্থাপিত: সংবিধানে মৌলিক অধিকারগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের ঊর্ধ্বে স্থাপন করা হয়েছে। তার ফলে আইন বিভাগ ও শাসন বিভাগের কোনো কার্যকলাপের দ্বারা মৌলিক অধিকারগুলিকে ক্ষুণ্ণ করা যায় না।
মৌলিক অধিকারগুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য: ভারতের সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকারগুলি ব্যক্তি ও গোষ্ঠী উভয়ের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। যেমন-সাম্যের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার প্রভৃতি কোনোভাবে লঙ্ঘন করা হলে ব্যক্তির মতো গোষ্ঠীও বিচারালয়ে আবেদন করতে পারে।
৬। মৌলিক অধিকারগুলিকে ‘মৌলিক’ বলা হয় কেন?
মৌলিক অধিকারগুলিকে মৌলিক বলার কারণ: সংবিধান বিশেষজ্ঞ ড. দূর্গাদাস বসুর অভিমত অনুসারে, মৌলিক অধিকার হল এমন কতকগুলি অধিকার, যা দেশের সংবিধান কর্তৃক সংরক্ষিত। এগুলিকে ‘মৌলিক’ বলা হয় কারণ সাধারণ অধিকার যেখানে আইনসভার সাধারণ আইন দ্বারা সংরক্ষিত হয়, সেখানে মৌলিক অধিকারকে সংরক্ষিত করেছে দেশের আইন ও সংবিধান। এই অধিকারগুলিকে সংবিধান সংশোধন ছাড়া অন্য কোনো পদ্ধতিতে পরিবর্তন করা যায় না। সর্বোপরি দেশের সর্বাত্মক উন্নয়নের জন্য অর্থাৎ বস্তুগত, নৈতিক, বৌদ্ধিক ও আধ্যাত্মিক উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে প্রয়োজনীয় হল মৌলিক আইন।
৭। মৌলিক অধিকারের দুটি ইতিবাচক দিক বা গুণাবলি সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
মৌলিক অধিকারের দুটি গুণাবলি হল-
জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম: মৌলিক অধিকারগুলি জরুরি অবস্থার ক্ষেত্রে সমালোচিত হলেও সেটি পুরোপুরি ঠিক নয়, কারণ দেশে সুশাসন চালু রাখার স্বার্থে জরুরি অবস্থা সংক্রান্ত বিধিবিধানের গুরুত্ব অপরিসীম। তাছাড়া জরুরি অবস্থা ঘোষণা মানেই মৌলিক অধিকারের সংকোচন এই ধারণা ঠিক নয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে যখন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বাঁধে তখন জরুরি অবস্থা জারি করা হয়। সেই সময় নাগরিক অধিকার সংকুচিত হয়নি।
আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য: আদালত কর্তৃক বলবৎযোগ্য অধিকারগুলিকে ভারতীয় নাগরিকদের মৌলিক অধিকার নাম দিয়ে সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তাই মৌলিক অধিকার ক্ষুণ্ণ হলে নাগরিকগণ আদালতের দ্বারস্থ হয়ে প্রতিকারের দাবি জানাতে পারে।
৮। মৌলিক অধিকারের দুটি সীমাবদ্ধতা উল্লেখ করো।
নিম্নে মৌলিক অধিকারের নেতিবাচক দিক বা সীমাবদ্ধতাদুটি আলোচনা করা হল-
জাতীয় স্বার্থ: ভারতের সংবিধানে নাগরিকদের জন্য স্বীকৃত মৌলিক অধিকারের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের সীমাবদ্ধতা ও বাধানিষেধ এত বেশি পরিমাণে সংযোজিত আছে যে মৌলিক অধিকারভোগের সুষ্ঠু পরিবেশ ভারতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে।
ক্রমাগত সংসদীয় আক্রমণ: সংবিধান অনুসারে ভারতীয় সংসদ সংবিধান সংশোধনের মাধ্যমে মৌলিক অধিকারগুলিকে পরিবর্তন করতে পারে। অথচ বারংবার সংসদের হস্তক্ষেপের ফলে মৌলিক অধিকারগুলির অলঙ্ঘনীয় চরিত্র বিপন্ন হয়ে পড়েছে।
৯। ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ করার দুটি কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করো।
ভারতীয় সংবিধানে মৌলিক অধিকার সমূহ লিপিবদ্ধ করার কারণ হল-
গণতান্ত্রিক অধিকারের সংরক্ষণ: সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, নাগরিকদের গণতান্ত্রিক অধিকারগুলিকে সংরক্ষণ করার জন্য মৌলিক অধিকারসমূহ লিপিবদ্ধ করা জরুরি। মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ থাকার ফলে রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষ সেগুলিকে বাস্তবে রূপায়িত করতে বাধ্য থাকে। শুধু তাই নয়, আদালতও মৌলিক অধিকারগুলির তত্ত্বাবধানের জন্য উপযুক্ত দায়িত্ব পালন করে।
গণচেতনা সৃষ্টি: সংবিধান বিশেষজ্ঞদের মতে, মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে বলেই জনগণ নিজেদের অধিকার সম্পর্কে সচেতন থাকার সুযোগ পান। অধিকারগুলির বাস্তব প্রয়োগ এবং সীমাবদ্ধতা সম্পর্কে তাঁদের একটা স্পষ্ট ধারণা তৈরি হয়।
১০। মৌলিক অধিকারের দুটি বৈশিষ্ট্য লেখো।
ভারতের সংবিধান কর্তৃক স্বীকৃত এবং ঘোষিত মৌলিক অধিকারগুলির দুটি বৈশিষ্ট্য হল-
① বিভিন্ন দেশের সংবিধান ও তত্ত্বের প্রভাব: ভারতীয় সংবিধানে সমগ্র তৃতীয় অধ্যায়ে মৌলিক অধিকারগুলি লিপিবদ্ধ রয়েছে। সংবিধান রচয়িতারা এক্ষেত্রে পাশ্চাত্যের বিভিন্ন উদারনৈতিক, গণতান্ত্রিক দেশের সংবিধান ও রাজনৈতিক তত্ত্বের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকারের সনদ, মানবাধিকার সংক্রান্ত ফ্রান্সের ঘোষণা, আয়ার্ল্যান্ডের সংবিধান, রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ডাইসির আইনের অনুশাসন তত্ত্ব এবং গান্ধিজির চিন্তাধারা ইত্যাদির কথা এ প্রসঙ্গে উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করা যায়।
② কার্যকরের বিবিধ পদ্ধতি: ভারতীয় সংবিধানের মৌলিক অধিকারগুলি একইভাবে কার্যকর নয়। কতকগুলি মৌলিক অধিকার সরাসরি বলবৎ হয়, আবার কতকগুলি বলবৎ করার জন্য বিশেষ আইনগত ব্যবস্থা নিতে হয়। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, ১৭ নং ধারার অস্পৃশ্যতা বর্জন বা ১৮ নং ধারার উপাধি-সংক্রান্ত বিধিনিষেধ মৌলিক অধিকার বলে বিবেচিত নয়।
১১। মৌলিক অধিকারগুলি সংবিধানে কীভাবে লিপিবদ্ধ হয়েছে?
সংবিধানে মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধকরণ: সংবিধান প্রনয়নকালে সাতটি মৌলিক অধিকার লিপিবদ্ধ করা হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৮ খ্রিস্টাব্দে ৪৪ তম সংবিধান সংশোধনকালে ৩১ নং ধারাটি (সম্পত্তির অধিকার) বাতিল করা হয়। বর্তমানে ৬টি মৌলিক অধিকার সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে (১২ থেকে ৩৫ নং ধারা) এগুলি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। তবে ১২ থেকে ৩৫ নং ধারায় অধিকারগুলি আলোচিত হলেও ১৪ থেকে ৩৫ নং ধারায় এগুলি সংরক্ষিত হয়েছে।
১২। বর্তমানে সংবিধানে সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারগুলি সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
সংবিধানে সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারসমূহ: বর্তমানে সংবিধানের তৃতীয় অধ্যায়ে সংরক্ষিত মৌলিক অধিকারগুলি হল-
[1] সাম্যের অধিকার (১৪, ১৫, ১৬, ১৭ ও ১৮ নং ধারা)
[2] স্বাধীনতার অধিকার (১৯, ২০, ২১ ও ২২ নং ধারা)
[3] শোষনের বিরুদ্ধে অধিকার (২৩ ও ২৪ নং ধারা)
[4] ধর্মীয় স্বাধীনতার অধিকার (২৫, ২৬, ২৭ ও ২৮ নং ধারা)
[5] সংস্কৃতি ও শিক্ষার অধিকার (২৯ ও ৩০ নং ধারা)
[6] সাংবিধানিক প্রতিবিধানের অধিকার (৩২, ৩৩, ৩৪, ৩৫ ও ২২৬ নং ধারা)
১৩। ভারতীয় সংবিধানে সাম্যের অধিকার বলতে কি বোঝায়?
সাম্যের অধিকার: ভারতীয় সংবিধানে প্রথম ও গুরুত্বপূর্ণ মৌলিক অধিকার হল সাম্যের অধিকার। সাধারণ ভাবে সাম্য বলতে সকল ব্যক্তির ব্যক্তিত্বের পূর্ণাঙ্গ বিকাশের উপযোগী প্রয়োজনীয় সুযোগসুবিধার স্বীকৃতিকে বোঝায়।
আপাতদৃষ্টিতে ১৪ নং ধারাটিতে দুটি অধিকারের উল্লেখ রয়েছে আইনের দৃষ্টিতে সমতা (Equality before the Law) এবং আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার (Equal protection of the Laws)। এদের মধ্যে প্রথমটি ইংল্যান্ডের সাধারণ আইন থেকে এবং দ্বিতীয়টি আমেরিকার সংবিধান থেকে গৃহীত। বিচারপতি সুব্বা রাও-এর মতে, ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ উক্তিটি নেতিবাচক। অন্যদিকে ‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার’ উক্তিটি ইতিবাচক।
১৪। আইনের দৃষ্টিতে সমতা সম্পর্কে সংক্ষেপে লেখো।
আইনের দৃষ্টিতে সমতা: ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’র অর্থ হল সকল নাগরিক আইনের চোখে সমান। এই ধারণা অধ্যাপক এ ভি ডাইসি-র ‘আইনের অনুশাসন’ তত্ত্বের দ্বিতীয় নীতির অনুসরণে গৃহীত হয়েছে। ডাইসির বক্তব্য হল, আইনের দৃষ্টিতে সমতার অর্থ হল ক্ষমতা, পদমর্যাদা ও অবস্থান নির্বিশেষে কোনো ব্যক্তিই দেশের আইনের ঊর্ধ্বে নয়। প্রধানমন্ত্রী থেকে সাধারণ নাগরিক পর্যন্ত দেশের প্রত্যেক ব্যক্তি সাধারণ আইনের নিয়ন্ত্রণাধীন এবং সাধারণ আদালতের এক্তিয়ারভুক্ত। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে আইভর জেনিংস বলেছেন যে, আইনের দৃষ্টিতে সমতা বলতে বোঝায়, “সমকক্ষদের মধ্যে আইন সমান ও সমভাবে প্রযোজ্য হবে” এবং ‘একই ধরনের কাজের জন্য’ সব প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক জাতি, সম্পদ, সামাজিক মর্যাদা কিংবা রাজনৈতিক প্রভাব প্রতিপত্তি নির্বিশেষে আদালতে অভিযোগ করতে বা অভিযুক্ত হতে পারবে।
১৫। আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার বলতে কী বোঝায়?
আইন কর্তৃক সমভাবে রক্ষিত হওয়ার অধিকার: ‘আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সংরক্ষিত হওয়ার অধিকার’ দ্বারা এটা বোঝায় যে, সমপর্যায়ভুক্ত ব্যক্তিদের ক্ষেত্রে আইন সমভাবে প্রযুক্ত হবে। মার্কিন সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধন থেকে এটি গৃহীত হয়েছে। এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য বনাম আনোয়ার আলি (১৯৫২ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এই অভিমত প্রকাশ করে যে, ‘আইনের দ্বারা সমভাবে সংরক্ষণ বলতে এমন এক অবস্থাকে বোঝায় যেখানে একইরকম পরিস্থিতিতে আইন সবার উপর একইভাবে প্রযোজ্য হয়’। চিরঞ্জিতলাল চৌধুরি বনাম ভারত সরকার ও অন্যান্য (১৯৫০ খ্রিস্টাব্দ) মামলায় সুপ্রিমকোর্ট এক রায়ে ঘোষণা করে যে, ‘সমভাবে সংরক্ষণের অর্থ হল সমান অবস্থায় সমান সংরক্ষণ’। এই অধিকারের অর্থ হল অবস্থা বা প্রকৃতির বিভিন্নতা বিচার করে প্রতিটি আইনকে সকল ব্যক্তির ক্ষেত্রে সমভাবে প্রয়োগ করতে হবে।
১৬। আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতির দুটি ব্যতিক্রম উল্লেখ করো।
আইনের দৃষ্টিতে সমতা নীতির ব্যতিক্রম
[1] রাষ্ট্রপতি ও রাজ্যপালগণ পদাধিকার বলে যেসকল ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকেন এবং যেসকল কার্য ও কর্তব্য সম্পাদন করেন সেজন্য তাঁরা আদালতের কাছে কোনো কৈফিয়ত প্রদানে বাধ্য নন।
[2] সংবিধানের ৩৬১ নং ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী বা রাজ্যপালের বিরুদ্ধে ফৌজদারি মামলা দাখিল করা যায় না, তবে তাদের বিরুদ্ধে দেওয়ানি মামলা দাখিল করা যায় এবং দেওয়ানি মামলা দায়ের করতে হলে বিশেষ পদ্ধতি গ্রহণ করতে হয় এবং মামলা দায়ের করার জন্য ২ মাসের নোটিশ দিতে হয়।
১৭। ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’-কে একটি নেতিবাচক ধারনা কে বলেছেন? কোন্ ধারাকে ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারের প্রান বলা হয়?
বিচারপতি সুব্বা রাও ‘আইনের দৃষ্টিতে সমতা’ কে একটি নেতিবাচক ধারনা বলে গন্য করেছেন।
১৪ নং ধারাকে ভারতীয় সংবিধানে স্বীকৃত সাম্যের অধিকারের প্রাণ বলা হয়।
১৮। জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সামানাধিকারের দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম লেখো।
জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের সমানাধিকারের দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম: এক্ষেত্রে দুটি উল্লেখযোগ্য ব্যতিক্রম হল-
[1] জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে রাষ্ট্র কূপ, জলাশয়, স্নানাগার প্রভৃতি স্থানে যে-কোনো ছোঁয়াচে রোগীর প্রবেশ নিষিদ্ধ করার জন্য আইনমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
[2] রাষ্ট্র নারী, শিশু, তপশিলি জাতি ও উপজাতিদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে।
১৯। সাম্যের অধিকারের ১৬ নং ধারাটি বিবৃত করো।
সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে সকলের সমানাধিকার: ১৬ নং ধারায় রাষ্ট্রের অধীনস্থ নিয়োগ সংক্রান্ত ক্ষেত্রে আইনের সপক্ষে সাম্যনীতির অধিকার কীভাবে প্রযুক্ত হবে তা উল্লেখ করা হয়েছে। ১৬ (১) ধারায় বলা হয়েছে সরকারী চাকুরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে প্রত্যেক নাগরিক সমান অধিকার পাবে। ১৬(২) নং ধারায় বলা হয়েছে সরকারি চাকুরির ক্ষেত্রে জাতি, স্ত্রী-পুরুষ, বংশধারা, বর্ণ, জন্মস্থান বা বাসস্থানের ভিত্তিতে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ করা চলবে না। নিয়োগ ছাড়াও বেতন, পদোন্নতি, ছুটি, পেনশন প্রভৃতি ক্ষেত্রে এই নিয়ম কার্যকর হবে। এ প্রসঙ্গে দূর্গাদাস বসু মন্তব্য করেছেন যে, এই অধিকার কেবলমাত্র সম্প্রদায়গত বৈষম্যের বিরোধিতা করে না বরং স্ত্রীলোকদের ক্ষেত্রে বৈষম্য প্রদর্শনের বিরুদ্ধেও রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
২০। মৌলিক অধিকারের ১৭ নং ধারাটি কী?
অথবা, ভারতে অস্পৃশ্যতা দূরীকরন আইন সম্পর্কে সংক্ষেপে বর্ণনা দাও।
অস্পৃশ্যতা নিষিদ্ধকরণ: অস্পৃশ্যতা দীর্ঘদিন ধরে সমাজজীবনে বিরাজ করেছিল। অস্পৃশ্যতা সমাজের এক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছিল। অবশেষে অস্পৃশ্যতাকে সমাজ থেকে মুছে ফেলার জন্য পদক্ষেপ নেওয়া হয়। সংবিধানের ১৭ নং ধারায় অস্পৃশ্যতার বিলোপসাধন এবং অস্পৃশ্যতা আচরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
সংসদে ১৯৫৫ খ্রিস্টাব্দে অস্পৃশ্যতা বিরোধী আইন পাস করা হয়। তারপর এই আইনটির কিছু সংশোধন হয়। এই আইনটির বর্তমান নাম হল ‘Protection of Civil Rights Act’. এই আইন অনুযায়ী কোনো ভারতীয়কে যদি অস্পৃশ্য বলে অপমান করা হয় বা তাকে তার প্রাপ্য অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়, সেক্ষেত্রে তাকে আইনগত শাস্তি ভোগ করতে হয়। এই আইনে আরও বলা হয়েছে যে, অস্পৃশ্য বলে যদি কোনো ব্যক্তিকে হাসপাতাল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রভৃতিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়, তাহলে তা শাস্তিযোগ্য অপরাধ বলে বিবেচিত হবে। এ ছাড়া সর্বসাধারণের জন্য ব্যবহার্য রাস্তাঘাট, জলের কল, জলাধার, শ্মশান, গোরস্থান প্রভৃতি জায়গায় ব্যবহারের ক্ষেত্রে অস্পৃশ্য বলে কাউকে বঞ্চিত করা যাবে না।
২১। ভারতীয় সংবিধানে উপাধি গ্রহণ ও ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে কত নং ধারায়? সেটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
অথবা, মৌলিক অধিকারের ১৮ নং ধারাটি কী?
উপাধি গ্রহন ও ব্যবহার নিবিদ্ধকরণ: মৌলিক অধিকারের ১৮ নং ধারায় বলার হয়েছে শিক্ষা ও সামরিক ক্ষেত্রে বিশেষ গুণগত উপাধি ছাড়া রাষ্ট্র অন্য কোনো উপাধি প্রদান করবেনা। ১৮(২) নং ধারা অনুযায়ী – কোনো ভারতীয় নাগরিক বিদেশি খেতাব গ্রহন করতে পারবে না। আবার, ভারত সরকারের কার্যে নিযুক্ত কোনো বিদেশি ব্যক্তি ভারতের রাষ্ট্রপতির অনুমতি ব্যতিত বিদেশি রাষ্ট্রের উপহার, বেতন, পদ গ্রহণ করতে পারবে না [১৮(৪) নং ধারা]
২২। স্বাধীনতার অধিকার সংক্রান্ত ১৯ নং ধারাটি বিবৃত করো।
ছয় প্রকার স্বাধীনতার অধিকার: বর্তমান সংবিধান ১৯(১) নং ধারায় নাগরিকদের ৬ প্রকার অধিকার লিপিবদ্ধ আছে। যথা-
বাকস্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকার ১৯(১) (ক),
শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার ১৯(১) (খ),
সংঘ বা সমিতি কিংবা সমবায় সমিতি গঠনের অধিকার ১৯(১) (গ),
ভারতের সর্বত্র চলাফেরা করার অধিকার ১৯(১) (ঘ)
ভারতের যে কোনো অঞ্চলে স্বাধীনভাবে বসবাস করার অধিকার ১৯(১) (ঙ) এবং
যেকোনো বৃত্তি, পেশা বা ব্যবসাবানিজ্য করার অধিকার ১৯(১) (চ)।
২৩। ভারতীয় সংবিধানের অন্তর্গত বাক্ ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতার উপর আরোপিত যে-কোনো দুটি বিধিনিষেধ উল্লেখ করো।
বাকস্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকার: সংবিধানের ১৯(১) (ক) নং ধারায় বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতার অধিকার স্বীকৃতি লাভ করেছে।
বাকস্বাধীনতা ও মতামত প্রকাশের অধিকারের নিয়ন্ত্রণসমূহ: সংবিধানে ঘোষিত এই গুরুত্বপূর্ণ অধিকারটির উপর কতকগুলি যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে। সেগুলি হল-
(1) ভারতের সার্বভৌমত্ব ও সংহতি রক্ষা
(2) রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা রক্ষা
(3) বিদেশি রাষ্ট্রের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রক্ষা
(4) দেশের শান্তিশৃঙ্খলা বজায় রাখা
(5) শালীনতা রক্ষা
(6) আদালতের অবমাননা প্রতিরোধ
(7) মানহানি প্রতিরোধ
(৪) অপরাধমূলক কাজে প্ররোচনা প্রতিরোধ [১৯(২) নং ধারা]।
২৪। শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের নিয়ন্ত্রণসমূহ সংক্ষেপে ব্যাখ্যা করো।
শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকার: ১৯(১) (খ) নং ধারায় ভারতীয় নাগরিকদের শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারকে স্বীকার করা হয়েছে। কোনো বিষয় যদি জনস্বার্থ সম্পর্কিত হয় তাহলে সেই বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করার জন্য নাগরিকরা জনসমাবেশ আহবান করতে পারে এবং শোভাযাত্রাতেও সামিল হতে পারে।
শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের নিয়ন্ত্রণসমূহ:
শান্তিপূর্ণ ও নিরস্ত্রভাবে সমবেত হওয়ার অধিকারের উপর কিছু যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপিত হয়েছে। এগুলি হল সভা-সমাবেশ অবশ্যই শান্তিপূর্ণ হবে, নাগরিকদের নিরস্ত্রভাবে সমবেত হতে হবে, জনশৃঙ্খলা এবং সার্বভৌমিকতা ও সংহতির স্বার্থে রাষ্ট্র যে-কোনো সমাবেশের উপর এই বিধিনিষেধগুলি আরোপ করতে পারে। তাছাড়া ষোড়শ সংবিধান-সংশোধনী আইন (১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ) অনুসারে রাষ্ট্র ভারতের সার্বভৌমিকতা ও সংহতি রক্ষার জন্য প্রয়োজনে এই অধিকারগুলির উপর ‘যুক্তিসংগত বিধিনিষেধ আরোপ করতে পারে’ [১৯ (৩) নং ধারা]।
২৫। নাগরিক ও বিদেশিদের জন্য উল্লিখিত দুটি মৌলিক অধিকার উল্লেখ করো।
নাগরিক এবং বিদেশিদের জন্য উল্লিখিত মৌলিক অধিকারসমূহ:
- আইনের দৃষ্টিতে সমতার অধিকার ও আইনসমূহ কর্তৃক সমভাবে সুরক্ষিত হওয়ার অধিকার (১৪ নং ধারা)
- আইন লঙ্ঘন করার অপরাধ ছাড়া শাস্তি না পাওয়ার অধিকার (২০ নং ধারা)
- জীবন ও ব্যক্তিগত স্বাধীনতার সুরক্ষার অধিকার (২১ নং ধারা)
- অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক শিক্ষার অধিকার (২১ ক নং ধারা)
- কিছু বিশেষ ক্ষেত্রে বিনা অপরাধে গ্রেপ্তার ও আটক না হওয়ার অধিকার। (২২ নং ধারা)
২৬। সংঘ বা সমিতি গঠনের অধিকারের নিয়ন্ত্রক বা বিধিনিষেধ সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
সংঘ বা সমিতি গঠনের অধিকার: ১৯(১) (গ) নং ধারা অনুযায়ী ভারতের নাগরিকরা যে-কোনো সংঘ বা সমিতি স্বাধীনভাবে গঠন করতে পারে।
সংঘ বা সমিতি গঠনের অধিকারের নিয়ন্ত্রণসমূহ: এই অধিকারের উপর বিধিনিষেধ আরোপ করে সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তাবিঘ্নকারী, বিশৃঙ্খলাসৃষ্টিকারী এবং নীতি-বিগর্হিত উদ্দেশ্যে গঠিত সংঘ বা সমিতির উপর রাষ্ট্র যুক্তিসংগত নিয়ন্ত্রণ আরোপ করতে পারে। তাছাড়া সংহতি ও সার্বভৌমত্বের প্রশ্নগত ক্ষেত্রে অধিকারটি নিয়ন্ত্রিত হতে পারে [১৯(৪) নং ধারা]। তবে এই বিধিনিষেধগুলিকে বিচার করার ক্ষমতা আদালতের হাতে অর্পিত।
২৭। ভারত কি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র?
১৯৭৬ খ্রিস্টাব্দের ৪২তম সংবিধান সংশোধনী আইনে ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ শব্দটি প্রস্তাবনায় যুক্ত করে ভারতকে একটি ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলার শপথ গ্রহণ করা হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতার অর্থ হল এই যে, এখানে বিশেষ কোনো ধর্মকে রাষ্ট্রীয় ধর্ম হিসেবে গ্রহণ করা হবে না। সব ধর্মের নাগরিকরা নিজেদের পছন্দমতো ধর্মাচরণ করতে পারবে। রাষ্ট্র তাতে কোনোরূপ বাধা প্রদান করবে না।
২৮। সংবিধানে মৌলিক অধিকারের ১৫ নং ধারাটি কী?
১৫ নং ধারা: সংবিধানের ১৫ (১) নং ধারায় বলা হয়েছে যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ, স্ত্রী-পুরুষ এবং জন্মস্থানজনিত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্যমূলক আচরণ করবে না। এ ছাড়া কোনো নাগরিককে উপরোক্ত যে-কোনো কারণের জন্য দোকান, সাধারণের ব্যবহার্য রেস্তোরাঁ, হোটেল ও প্রমোদস্থলে প্রবেশ বিষয়ে এবং রাষ্ট্র কর্তৃক পূর্ণভাবে বা আংশিকভাবে তৈরি করা কূপ, জলাশয়, স্নানের ঘাট, রাস্তা ও আশ্রয়স্থল ব্যবহার করার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা চলবে না [১৫ (২) নং ধারা)।
২৯। মৌলিক অধিকারের অন্তর্গত ২০ নং ধারাটি লেখো।
২০ নং ধারা: ভারতীয় সংবিধানে বর্ণিত ২০ নং ধারা অনুযায়ী কোনো অপরাধের জন্য নাগরিককে বেআইনি শাস্তি প্রদানের হাত থেকে রক্ষা করা হবে। ২০ (১) নং ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে অভিযুক্ত করা হলে যে সময় অভিযোগ করা হয়েছে ওই সময়কার আইন অনুযায়ী তাকে শাস্তি প্রদান করতে হবে। ২০(২) নং ধারা অনুযায়ী একই অপরাধের জন্য কোনো ব্যক্তিকে একাধিকবার শাস্তি দেওয়া যাবে না। কোনো আইন যদি এ কাজ করে থাকে, তবে সেই আইন সংবিধান বিরোধী বলে বাতিল হয়ে যাবে। ২০(৩) নং ধারা অনুযায়ী কোনো ব্যক্তিকে নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধে সাক্ষ্যদানে বাধ্য করা যাবে না।
৩০। সংবিধানের ২১ নং ধারাতে কী বলা হয়েছে?
২১ নং ধারা: সংবিধানের ২১ নং ধারায় বলা হয়েছে যে, (Procedure established by law) আইননির্দিষ্ট পদ্ধতি ছাড়া কোনো ব্যক্তিকে তার জীবন ও স্বাধীনতার অধিকার থেকে বঞ্চিত করা যাবে না। এই ধারায় ব্যক্তিগত স্বাধীনতার অধিকার বজায় রাখার কথা বলা হয়েছে। তবে সংবিধানের ২১ নং ধারার পরিধিতে মৃত্যুদন্ড অন্তর্ভুক্ত নয়। দূর্গাদাস বসু মনে করেন যে, সংবিধানে উল্লিখিত ২১ নং ধারাটি শাসন বিভাগের স্বেচ্ছাচারী (Arbitrary) বা বেআইনি (Illegal) ক্রিয়াকলাপের বিরুদ্ধে ব্যক্তিকে রক্ষা করলেও এটি আইন বিভাগের আধিপত্যের বিরুদ্ধে রক্ষাকবচ বলে গণ্য হয় না।
৩১। সংবিধানের ২২ নং ধারাটি বিবৃত করো।
২২ নং ধারা: সংবিধানের ২২ নং ধারায় স্বেচ্ছাচার ও অবৈধভাবে গ্রেপ্তার এবং আটকের বিরুদ্ধে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
- ২২(১) নং ধারায় আটক ব্যক্তিকে তার পছন্দমতো আইনজীবীর সঙ্গে পরামর্শ করার এবং আইনজীবীর দ্বারা আত্মপক্ষ সমর্থনের অধিকার প্রদান করা হয়েছে। কোনো ব্যক্তিকে শুধুমাত্র সন্দেহের ভিত্তিতে আটক করা যাবে না।
- ২২(২) নং ধারায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, কোনো ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করলে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিকটতম ম্যাজিস্ট্রেটের আদালতে হাজির করতে হবে।
- ২২(৩) নং ধারানুসারে, নিবর্তনমূলক আটক আইনে ধৃত ব্যক্তি ও শত্রুভাবাপন্ন বিদেশিদের ক্ষেত্রে ২২(১) ও ২২(২) নং ধারায় উল্লিখিত নিয়মগুলি প্রযোজ্য হবে না।
৩২। সংবিধানের ২৩ নং ধারাটি সংক্ষেপে লেখো।
২৩ নং ধারা: সংবিধানের ২৩(১) নং ধারায় বলা হয়েছে, মানুষ নিয়ে ব্যাবসা বা মানুষ ক্রয়-বিক্রয়, বিনা মজুরিতে বেগার খাটানো এবং বলপূর্বক শ্রমদানে বাধ্য করা ইত্যাদি সম্পূর্ণভাবে নিষিদ্ধ। এখানে মানুষ ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ বলতে দাসপ্রথা এবং অসৎ উদ্দেশ্যে নারী ও শিশু ক্রয়-বিক্রয় নিষেধের কথা বলা হয়েছে। ভারতবর্ষে বর্তমানে আর দাসপ্রথার অস্তিত্ব নেই। তবে ভারতের অগণিত হতদরিদ্রদের সামাজিক অবস্থা পর্যবেক্ষণ করলে তা দাসপ্রথার স্মৃতিকে ফিরিয়ে আনে। বর্তমানে ভারতবর্ষে উচ্চবর্ণের ব্যক্তি কর্তৃক নিম্নবর্ণের মানুষদের শোষণের ঘটনা অব্যাহত রয়েছে। এই শোষণের হাত থেকে তাদেরকে মুক্তি দেওয়ার জন্যই সংবিধানের ২৩ নং ধারায় শোষণের বিরুদ্ধে অধিকারটিকে স্থান দেওয়া হয়েছে।