অরণ্য, অরণ্যপ্রাণী সংরক্ষণ ও মানবজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

ভারতের প্রথম নভশ্চর ক্যাপটেন রাকেশ শর্মা মহাকাশ থেকে পৃথিবীর বর্ণনা দিয়ে বলেছিলেন যে, নিকষ কালো মহাকাশে পৃথিবীর মতো এমন সুন্দর গ্রহ আর তিনি একটিও দেখতে পাচ্ছেন না। সবুজ রঙের স্নিগ্ধ আলোয় গ্রহটি উজ্জ্বল। এই শ্যামলিমার উৎস অরণ্যলালিত জীবজগৎ-পৃথিবীর সম্পদ।
প্রকৃতি গড়ে উঠেছে, উদ্ভিদ ও প্রাণীর পারস্পরিক নির্ভরতা নিয়ে। উদ্ভিদজগতের ওপর নির্ভর করে গড়ে উঠেছে প্রাণীজগৎ। প্রতিটি প্রাণের সঙ্গে উদ্ভিদের এক অচ্ছেদ্য বন্ধন। এই বন্ধন কোথাও খাদ্যের প্রয়োজনে, কোথাও অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে, কখনও-বা জীবনধারণের তাগিদে। এই শৃঙ্খলকে পারিভাষিক শব্দে বলা হয় বাস্তুসংস্থান।
আমাদের বাস্তুসংস্থানে ফাটল ধরিয়েছে একটি প্রাণী। তার নাম মানুষ। মানুষ তার বুদ্ধি আর প্রযুক্তি নিয়ে ক্রমশ হয়ে উঠেছে পৃথিবীর অধীশ্বর। নিজের প্রয়োজনে অন্য প্রাণকে সে ব্যবহার করেছে অবাধে। মানুষের আগ্রাসী লোভের মুখে পৃথিবীর উদ্ভিদরাজ্য আজ প্রায় নিঃশেষিত। অনুরূপ বন্যপ্রাণীদের অনেকেই চলে গেছে বিলুপ্তির দেশে। প্রাগৈতিহাসিক যুগে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ধ্বংস হয়ে গিয়েছিল বিশাল সরীসৃপ ডাইনোসর, হাতির পূর্বসূরি ম্যামথ, স্যারর-টুথ টাইগার বা খাড়া-দাঁত বাঘ। এই শতকে মরিশাস দ্বীপ থেকে হারিয়ে গেছে ডোডো নামে পাখি। আমেরিকার প্রেইরি বনভূমি থেকে হারিয়ে গেছে বাইসন, মেরু অঞ্চল হারিয়েছে তার স্বর্ণশৃগাল। মানুষের লোভের শিকার হয়েছে তারা। অনিয়ন্ত্রিত অরণ্য ধ্বংসের পরিণাম দেখা যাচ্ছে চারদিকে। এভাবে চলতে থাকলে পৃথিবীতে যে বায়োডাইভার্সিটি বা প্রাণবৈচিত্র্য রয়েছে, তা হয়ে যাবে নিঃশেষ।
বন্যপ্রাণী অবলুপ্তির প্রধান কারণ হল অরণ্যনিধন। মানুষ তার বিলাসব্যসন ও দৈনন্দিন প্রয়োজনে অরণ্যসম্পদের যথেচ্ছ ব্যবহার করে চলেছে। ভারতে ইংরেজ শাসন প্রবর্তনের পর শুধুমাত্র রেললাইনের স্লিপারের জন্য ভারতের শতাব্দী-প্রাচীন বিশাল বৃক্ষগুলিকে যেভাবে কেটে ফেলা হয়েছে, তা ভাবলে শিউরে উঠতে হয়।
এই পৃথিবীতে আমাদের এই মানবজীবন বিচ্ছিন্ন কোনো সৃষ্টি নয়। ধরিত্রীতে মানুষের সৃষ্টিলগ্নে অরণ্যই ছিল প্রধান আশ্রয়। অরণ্যই মানুষকে দিয়েছে খাদ্য, বস্ত্র, আশ্রয়। সভ্যতার অগ্রগতিতেও অরণ্য তাই আমাদের জীবন থেকে হারিয়ে যায়নি। অরণ্য, বন্যপ্রাণী এবং তার সঙ্গে জড়িত যে পরিবেশ, সেইসব নিয়েই পারস্পরিক নির্ভরতায় আমাদের মানবজীবন গঠিত। এদের ভিতর একটি বিনাশ হলে, অপরটিও গিয়ে দাঁড়াবে মৃত্যুর মুখোমুখি।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য ইদানীং গড়ে উঠেছে নানা আন্তর্জাতিক ও জাতীয় সংস্থা, যেমন-WWF বা ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ড-লাইফ ফেডারেশন। এ ছাড়া বিভিন্ন ব্যক্তি বা সংস্থার উদ্যোগে গড়ে উঠেছে সংরক্ষণ আন্দোলন। সুন্দরলাল বহুগুণা ও চিপকো আন্দোলন, মেধা পাটেকরের ‘নর্মদা বাঁচাও’ আন্দোলন প্রভৃতি ভারতে অরাজনৈতিক পরিবেশ সংরক্ষণ আন্দোলনের অন্যতম।
আশার কথা এই যে, বর্তমানে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে গড়ে উঠেছে নানা অভয়ারণ্য এবং বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ প্রকল্প। গুজরাটের গির অরণ্যের সিংহ প্রকল্প, সুন্দরবনের বাঘ-কুমির প্রকল্প, কাজিরাঙায় গন্ডার প্রকল্প- এসব প্রকল্পগুলি মানুষের ভবিষ্যৎ সুরক্ষার দিকে একটি ইতিবাচক পদক্ষেপ।