সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর Class 11

একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিস্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে মোট 40 নম্বরের লিখিত পরীক্ষা হবে। এই 40 নম্বরের মধ্যে সরকারের বিভিন্ন রূপ অধ্যায় থেকে মোট 8 নম্বর আসবে। পরীক্ষায় এখান থেকে একটি বড়ো প্রশ্নের উত্তর করতে হবে। বড়ো প্রশ্নের ধরন হবে গোটা 6 নম্বরের এবং ছোটো প্রশ্নের ধরন হবে গোটা ২ নম্বরের। আজকের এই প্রশ্নোত্তর পর্বে একাদশ শ্রেণির দ্বিতীয় সেমিষ্টার রাষ্ট্রবিজ্ঞান পরীক্ষার জন্য এই অধ্যায় থেকে খুব গুরুত্বপূর্ণ বেশ কয়েকটি প্রশ্নের উত্তরসহ তুলে ধরা হল।

সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর

সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর
সরকারের বিভিন্ন রূপ প্রশ্ন উত্তর

১। গণতন্ত্রের বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো।

আধুনিককালে রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলতে বোঝায়, জনগণের মতামতের ভিত্তিতে পরিচালিত শাসনব্যবস্থা। এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় সরকার জনমতকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে থাকে। কারণ এই মতামতের মধ্য দিয়েই জনসাধারণের আশা-আকাঙ্ক্ষা, ইচ্ছা- অনিচ্ছা প্রভৃতি প্রকাশ পায়। ফলে গণতান্ত্রিক সরকার জনগণের মতকে কখনোই উপেক্ষা করতে পারে না। এককথায় যে শাসনক্ষমতার উপর রাষ্ট্রের সকল জনসাধারণের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়, তাকেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা বলা হয়। সরকারের যাবতীয় ক্ষমতার উৎস এখানে জনগণ। এ প্রসঙ্গে জে এস মিল বলেছেন, “The whole people or numerous portion of them exercise the governing power through deputies periodically elected by themselves.” I গণতন্ত্রের বেশ কয়েকটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে, যা রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নাগরিকদের অংশগ্রহণ এবং অধিকার সুরক্ষা নিশ্চিত করে। বৈশিষ্ট্যগুলি হল-

(1) গণসার্বভৌমত্ব 

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারি কর্তৃপক্ষ জনগণের সম্মতির ভিত্তিতে গড়ে ওঠে এবং টিকে থাকে। নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণ তাদের এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে থাকে।

(2) আইনের অনুশাসন

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সকল ব্যক্তি এবং সমাজস্থ সকল ধরনের প্রতিষ্ঠানসমূহ রাষ্ট্রীয় আইনের প্রতি অনুগত থাকে। যে-কোনো ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে আইনের প্রতি দায়বদ্ধশীল থেকে নিজ নিজ কার্যসম্পাদন করতে হয়, অন্যথায় এই আইন বাস্তবে সকলের উপর সমভাবে প্রযুক্ত হয়। একেই আইনের অনুশাসন (Rule of Law) বলা হয়।

(3) রাজনৈতিক সাম্য

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা মূলত রাজনৈতিক সাম্যের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। রাজনৈতিক সাম্য বলতে, রাজনীতি তথা রাষ্ট্রনীতিতে সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগসুবিধা প্রাপ্তিকে বোঝায়। প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ বা ভোটদানের অধিকার, নির্বাচিত হওয়ার অধিকার বা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার ইত্যাদি ক্ষেত্রে সমান সুবিধা ভোগ করাকেই রাজনৈতিক সাম্যের মূল কথা বলে মনে করা হয়। এখানে রাজনৈতিক অংশগ্রহণে জন্মগত বা ধনগত বৈষম্যকে স্বীকার করা হয় না, সকলেই সমমর্যাদা ও সমানাধিকারসম্পন্ন।

(4) সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন ও সংখ্যালঘু অধিকার সংরক্ষণ

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠের সিদ্ধান্তকে অধিক গুরুত্ব দেওয়ার ফলে এই ধরনের শাসনব্যবস্থা সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসনে পরিণত হয়। রাজনৈতিক ভোটাভুটিতে যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে, সেই দলের নেতা বা নেত্রী সরকার গঠন ও পরিচালনা করার সুযোগ পান। অনেকে তাই মনে করেন, গণতন্ত্র কখনোই সমাজের সমগ্র অংশের শাসন নয়, কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশেরই শাসনমাত্র। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা জনকল্যাণকামী গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের তত্ত্ব প্রচার করে এরূপ ধারণা পোষণ করেছেন যে, আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন প্রতিষ্ঠিত হলেও সংখ্যালঘুদের আর্থ-সামাজিক, রাজনৈতিক অধিকার-সহ সমাজের সকল ক্ষেত্রের নানাবিধ অধিকার সংরক্ষণের ব্যবস্থা এখানে করা হয়েছে।

(5) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন

গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল, অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন (Free and Fair Election)। এখানে নির্বাচন প্রক্রিয়াটি নিরপেক্ষভাবে পরিচালিত হয়, যাতে রাষ্ট্রের সকল যোগ্য নাগরিক যে-কোনো দলের প্রার্থী কিংবা যে-কোনো দলের সদস্যপদ গ্রহণের সমান সুযোগ ভোগ করতে পারে।

(6) প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার

গণতন্ত্র বলতে বর্তমানে প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকেই বোঝায়। বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্রই বর্তমানে আয়তন ও জনসংখ্যার দিক থেকে বৃহৎ। ফলত, জনসাধারণের পক্ষে কখনোই প্রত্যক্ষভাবে বা সরাসরি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করা সম্ভব নয়। তাই আধুনিককালে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র (Indirect or Representative Democracy) প্রাধান্য পেয়েছে।

(7) প্রতিনিধি নির্বাচন

এই শাসনব্যবস্থায় জনগণ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই প্রত্যক্ষভাবে শাসনকার্য পরিচালনা করে না। নির্দিষ্ট সময় অন্তর জনগণ সর্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের প্রতিনিধিদের দ্বারা শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে। জনপ্রতিনিধিরাই শাসনক্রিয়াকে সচল রাখতে সাহায্য করে।

(8) গণঅংশগ্রহণ

গণতন্ত্রে নাগরিকরা কখনও সরাসরি আবার কখনও বা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয় সংক্রান্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের অধিকার লাভ করে থাকে।

(9) জনসম্মতিতে এবং জনস্বার্থে পরিচালিত

গণতন্ত্রে সরকার পরিচালনার দায়িত্ব সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণির হাতে ন্যস্ত থাকে। কিন্তু, এই শাসনকার্য কেবলমাত্র সংখ্যাগরিষ্ঠের স্বার্থেই নয়, জনগণের সার্বিক কল্যাণের জন্যও পরিচালিত হয়। এই শাসনব্যবস্থায় সংখ্যালঘু স্বার্থ সংরক্ষণ ও তাদের মতামতকেও স্বীকৃত প্রদান করা হয়, তাই রাষ্ট্রের সংখ্যালঘু অংশও গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। অর্থাৎ, রাষ্ট্রের সমগ্র অংশই গণতন্ত্রকে সমর্থন করে। এই কারণেই গণতন্ত্রকে জনসম্মতির উপর প্রতিষ্ঠিত সরকার (Government based on Consent) বলে অভিহিত করা হয়।

(10) জনমতের গুরুত্ব

গণতন্ত্র যেহেতু জনমতের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত, তাই অনেকে জনমতকে গণতন্ত্রের প্রাণ বলার পক্ষপাতী। জনমতকে উপেক্ষা করে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা পরিচালিত হতে পারে না। তাই সকল সরকারি সিদ্ধান্ত জনমতের ভিত্তিতে গৃহীত হয়।

(11) মানবাধিকারের সংরক্ষণ

গণতন্ত্রের একটি অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল মানবাধিকারের সংরক্ষণ। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় মৌলিক অধিকার ও স্বাধীনতা, বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, আইনসভায় মতামত প্রকাশের অধিকার, ধর্মীয় স্বাধীনতা প্রভৃতির মাধ্যমে রাষ্ট্র নাগরিকদের মানবাধিকার সংরক্ষিত রাখার প্রচেষ্টা করে।

(12) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির উপস্থিতি

গণতন্ত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির (Separation of Powers) উপস্থিতি লক্ষ করা যায়। অর্থাৎ, সরকারের তিনটি বিভাগ যথা-শাসন বিভাগ, আইন বিভাগ ও বিচার বিভাগ সম্পূর্ণ স্বতন্ত্রভাবে তাদের কার্যসম্পাদন করে। কিন্তু সরকারের কোনো একটি বিভাগ যাতে স্বৈরাচারী হয়ে না ওঠে বা ক্ষমতা কুক্ষিগত করে না ফেলতে পারে, সেক্ষেত্রে বর্তমানে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি (Checks and Balance)-টিও প্রাধান্য পেয়েছে।

(13) বহুত্ববাদ

আধুনিক গণতন্ত্রের অপর একটি বৈশিষ্ট্য হল বহুত্ববাদ (Pluralism)-এর স্বীকৃতি। বর্তমানে রাজনৈতিক মতামতের বৈচিত্র্যময়তা, বহুবিধ রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি, স্বার্থগোষ্ঠীসমূহের অস্তিত্বকে গণতন্ত্রে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে এবং তাদের সহাবস্থানকে উৎসাহ প্রদান করা হয়েছে।

(14) দায়বদ্ধতা ও স্বচ্ছতা

গণতন্ত্রে সরকার জনগণের কাছে দায়বদ্ধ থাকে। সরকারি কার্যাবলির উপর জনগণের বিশ্বাস সুনিশ্চিত করতে এবং দুর্নীতি প্রতিরোধ করার উদ্যোগ গ্রহণ করতেই সরকারকে জনসাধারণের নিকট জবাবদিহি করতে হয়। ফলে সরকারি কার্যের স্বচ্ছতা বৃদ্ধি পায়।

২। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের গুণাবলি আলোচনা করো।

রাষ্ট্রতাত্ত্বিকরা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যেসকল যুক্তি দিয়েছেন সেগুলি হল-

(1) বিশুদ্ধ বা প্রকৃত গণতন্ত্র

‘জনগণের শাসন’-কেই যদি গণতন্ত্রের আক্ষরিক অর্থ হিসেবে ধরে নেওয়া হয়, তবে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রই হল প্রকৃত গণতন্ত্র-এমনটাই অনেকে মনে করেন। কারণ নির্বাচিত প্রতিনিধির পরিবর্তে জনসাধারণ এখানে প্রত্যক্ষভাবে সরকার পরিচালনার যাবতীয় কার্যাদিতে অংশগ্রহণ করতে পারে।

(2) সহজ ও সরল প্রকৃতির

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র তুলনামূলকভাবে অত্যন্ত সরল ও সহজ প্রকৃতির হয়ে থাকে।

(3) রাজনৈতিক সচেতনতা ও স্বদেশপ্রীতির উন্মেষ

এরূপ গণতন্ত্রে প্রত্যক্ষভাবে জনগণ সরকার গঠনের এবং সরকার পরিচালনা করার সুযোগ পায় বলে, জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক চেতনা ও স্বদেশপ্রীতি জাগ্রত হয়।

(4) বিপ্লব ও বিদ্রোহ মুক্ত

অনেকে মনে করেন, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে প্রত্যেক নাগরিক রাষ্ট্রীয় শাসনকার্য পরিচালনায় অংশ নিতে পারেন বলে, সরকার ও সরকারি কার্যকলাপের বিরুদ্ধে জনগণের কোনো অভিযোগ থাকে না। তাই এই শাসনব্যবস্থা গৃহযুদ্ধ, বিপ্লব ও বিদ্রোহ ইত্যাদির সম্ভবনা থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত বলে মনে করা হয়।

(5) আমলাতন্ত্রের প্রভাবরোধ

প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় আমলাতন্ত্র প্রভাব-প্রতিপত্তি বিস্তার করতে পারে না।

(6) ব্যয়সাপেক্ষ

এরূপ শাসনব্যবস্থা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার ন্যায় ব্যয়বহুল নয়।

(7) আইন প্রণয়ন পদ্ধতি

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে আইন প্রণয়ন পদ্ধতিটি অত্যন্ত সহজ ও সরল প্রকৃতির হয়ে থাকে। এরূপ গণতন্ত্রে জনগণ নির্দিষ্ট একটি স্থানে সমবেত হয়ে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা গ্রহণ করে থাকে। ফলে সময়ের অপচয়ও ঘটে না।

(8) স্বৈরাচারিতা রোধ

এরূপ শাসনব্যবস্থায় জনগণ সরাসরি রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণ করে থাকে বলে, সরকারের স্বৈরাচারী হওয়ার সম্ভবনা প্রায় থাকে না- এমনটাই অনেকে মনে করেন।

(9) দায়িত্বশীলতা বৃদ্ধি

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে রাষ্ট্রের সকল নাগরিকগণ রাজনৈতিক ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণের সমসুযোগ পায় বলে, জনগণের মধ্যে ক্ষোভ বা হীনমন্যতা কোনোটাই সৃষ্টি হতে পারে না। ফলে তাদের মধ্যে নিজের রাষ্ট্রের প্রতি দায়িত্বশীলতা ও কর্মনিষ্ঠা বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।

(10) জরুরি অবস্থার উপযোগী

অত্যন্ত দ্রুততার সহিত জনগণের প্রত্যক্ষ উপস্থিতিতে সরকারি কার্যের সমস্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ করা সম্ভব হয় বলে, এই শাসনব্যবস্থাকে অনেকে জরুরি অবস্থায় উপযোগী বলে মনে করেন।

৩। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের দোষগুলি আলোচনা করো।

উপরোক্ত বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণাবলি থাকা সত্ত্বেও প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের কতকগুলি দোষ বর্তমান। সেগুলি হল-

(1) অকার্যকর শাসনব্যবস্থা

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় অধিকাংশ রাষ্ট্রই বৃহদায়তন ও বিপুল জনসংখ্যাবিশিষ্ট। আর এরূপ শাসনব্যবস্থার সবচেয়ে বড়ো ত্রুটি হল বৃহদায়তন রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে এই ব্যবস্থা শুধুমাত্র অকার্যকরই নয়, অকাম্যও বটে। কারণ, একটি বৃহৎ রাষ্ট্রের সকল জনগণ দেশের নানান প্রান্ত থেকে এসে একত্রিতভাবে আইন প্রণয়ন করবে- এই ধারণা নিছকই একটি কল্পনামাত্র।

(2) আইন প্রণয়ন ও নীতিনির্ধারণ অসম্ভব

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে দেশের সকল যোগ্য নাগরিকগণ মতামত প্রকাশের সমসুযোগ পায়। এর ফলে কোনো বিশেষ পরিস্থিতিতে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আইন প্রণয়ন বা নীতি নির্ধারণের ক্ষেত্রে নানান সমস্যা সৃষ্টির সম্ভবনা থাকে। কারণ এমতাবস্থায় সকলেই নিজেদের অভিমত প্রকাশ করতে আগ্রহী হয়ে পড়ে। ফলে, পরস্পরবিরোধী নানান মতামতগুলির মধ্যে সমন্বয়সাধন করে নীতি নির্ধারণ ও আইন প্রণয়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে।

(3) অগণতান্ত্রিক নীতিনির্ধারণ

অনেকে মনে করেন, রাষ্ট্রপরিচালনার ন্যায় জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কার্যসম্পাদনের জন্য যে রাজনৈতিক জ্ঞান, বিচক্ষণতা ও দূরদৃষ্টিতা থাকা বাঞ্ছনীয়, তা রাষ্ট্রের সকল নাগরিকদের মধ্যে থাকা সম্ভব নয়। ফলে এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় জনস্বার্থবিরোধী কার্যাবলি সম্পাদন অগণতান্ত্রিক নীতি প্রণয়ন ইত্যাদি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।

(4) স্বৈরতন্ত্রের উন্মেষ

এই ধরনের শাসনব্যবস্থায় যদি নাগরিকদের রাষ্ট্রীয় কার্যকলাপে ঔদাসীন্যতা দেখা দেয়, তাহলে মুষ্টিমেয় কিছু ব্যক্তির হাতে শাসনক্ষমতা কেন্দ্রীভূত হওয়ার সম্ভবনা পরিলক্ষিত হয়। ফলস্বরূপ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা স্বৈরতন্ত্রে রূপান্তরিত হয়।

(5) সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিপন্থী

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকে সাংস্কৃতিক বিকাশের পরিপন্থী বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্রের সকল জনসাধারণই যদি শাসনকার্যে অংশগ্রহণ করে, তাহলে শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা, সংগীত প্রভৃতি দিকগুলি ক্রমাগত অবহেলিত হতে থাকবে। এতে দেশের সর্বাঙ্গীণ বিকাশ ব্যাহত হবে।

(6) আপতকালীন পরিস্থিতির পক্ষে অনুপোযোগী

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আপতকালীন পরিস্থিতির ক্ষেত্রে উপযোগী নয় বলে অনেকে অভিমত পোষণ করেছেন। বহিঃশক্তির আক্রমণ বা আভ্যন্তরীণ যুদ্ধবিগ্রহের পরিস্থিতিতে যদি দ্রুত সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রয়োজন হয়, তখন জনগণের ইচ্ছা-অনিচ্ছার উপর ভিত্তি করে ক্রমাগত কালবিলম্ব হয়।

(7) বৈচিত্রপূর্ণ ভাষা ও সংস্কৃতি

বহু ভাষাভাষি ও বহু সংস্কৃতিসম্পন্ন জনগণের বৈচিত্র্যপূর্ণতা একই রাষ্ট্রে পরিলক্ষিত হলে, সেই রাষ্ট্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র সাফল্যমন্ডিত হওয়ার সম্ভবনা একেবারেই থাকে না।

(8) শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে শাসনতান্ত্রিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয় বলে সমালোচনা করা হয়। কারণ, যখনই সাধারণ মানুষ সরকারি কার্যাবলিতে প্রত্যক্ষভাবে অংশ নেয়, তখনই তারা পরস্পর পরস্পরের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়-এই ধারণার বশবর্তী হয়ে সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে যায় এবং যার ফল বিপথগামী হয়। তবে একথা সত্য যে, সুষ্ঠুভাবে শাসনকার্য পরিচালনার জন্য দেশের প্রতি যে মমত্ববোধ, কর্তব্যপরায়ণতা, সুশিক্ষিত বিচারবোধ, দেশপ্রেম প্রয়োজন তা কখনোই সকলের মধ্যে উপস্থিত থাকে না। ফলে এরূপ গণতন্ত্র বাস্তবে ব্যর্থ হয়।

(9) ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির অনুপস্থিতি

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রে ক্ষমতা স্বতন্ত্রীকরণ নীতির বাস্তব প্রয়োগ কখনোই সম্ভব হয়ে ওঠে না। কারণ এখানে আইন, শাসন ও বিচার বিভাগের কার্যাবলির মধ্যে তেমন কোনো সুস্পষ্ট পার্থক্য পরিলক্ষিত হয় না। ফলে অনেক সময় রাষ্ট্রপরিচালনায় জটিলতারও সৃষ্টি হয়।

(10) অনুপযুক্ত শাসনব্যবস্থা

বর্তমানে আধুনিক জনকল্যাণকামী রাষ্ট্রের বহুমুখী কার্যকলাপের পরিপ্রেক্ষিতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র কখনোই উপযুক্ত গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নয়।

(11) জনগণের আবেগ দ্বারা পরিচালিত শাসনব্যবস্থা

সর্বোপরি বলা যায় যে, প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে আইন ও শাসনকার্য পরিচালনার ক্ষেত্রে জনগণ অনেক সময় উত্তেজনা বা ভাবাবেগের দ্বারা পরিচালিত হয়। এরূপ পরিস্থিতিতে আইন প্রণয়ন বা শাসনকার্য পরিচালনা করলে, দেশের কল্যাণের পরিবর্তে অকল্যাণ হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি থাকে।

৪। প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের বিলুপ্তির কারণগুলি লেখো।

প্রাচীন গ্রিসের ও রোমের নগররাষ্ট্রগুলি ছিল মূলত ক্ষুদ্রায়তনবিশিষ্ট। এইসব নগররাষ্ট্রের জনসংখ্যাও ছিল অত্যন্ত সীমিত বা স্বল্প। জনগণের একটা বৃহৎ অংশকে অর্থাৎ স্ত্রী, শিশু ও ক্রীতদাসদের নাগরিক হিসেবে গণ্য করা হত না। ফলে, ওই স্বল্পসংখ্যক পুরুষ নাগরিকদের নিয়ে অতি সহজেই নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট স্থানে একত্রিত হয়ে রাষ্ট্রপরিচালনায় অংশগ্রহণ করা সম্ভব হত। তৎকালীন যুগের রাষ্ট্রীয় সমস্যাবলি ছিল তুলনামূলক কম এবং প্রকৃতিগত বিচারে সহজ ও সরল। তাই, অত্যন্ত কম সময়ে এবং তৎপরতার মাধ্যমে সমস্যার সমাধান এবং সিদ্ধান্তগ্রহণ সম্ভব হত। কিন্তু, আধুনিককালে প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার অবলুপ্তির পশ্চাতে বেশ কয়েকটি কারণ রয়েছে। সেগুলি হল-

(1) রাষ্ট্রের আয়তন ও জনসংখ্যা বৃদ্ধি

বর্তমানে রাষ্ট্রগুলির আয়তন বৃদ্ধির পাশাপাশি জনসংখ্যাও বিপুল পরিমানে বৃদ্ধি পেয়েছে, যা প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র প্রয়োগের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করেছে।

(2) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে জটিলতা বৃদ্ধি

এ ছাড়া বর্তমান যুগের সমস্যাগুলির পরিমাণ সংখ্যাগত দিক থেকে যেমন অনেকটাই বেশি, তেমনই প্রকৃতিগত দিক থেকেও অপেক্ষাকৃত জটিল। আর সেকারণেই জনসাধারণের পক্ষে কখনই প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্তগ্রহণ করা সম্ভব নয়।

(3) মনোযোগের অভাব

তাছাড়া বর্তমানে রাষ্ট্র তথা সমাজজীবনের মূল চালিকা শক্তি হয়ে উঠেছে অর্থ। অর্থনৈতিক সমস্যা মানুষকে এতটাই জর্জরিত করে তুলেছে যে, তারা রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে অংশগ্রহণের সুযোগ পেলেও শাসনকার্য পরিচালনায় মনোযোগী হয়ে উঠতে পারছে না। এই কারণে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র আজ বিলুপ্তির পথে অগ্রসর হয়েছে।

(4) অজ্ঞ ও অশিক্ষিত জনগণ

আবার, বর্তমান বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অভাবনীয় উন্নতি, শিল্পায়ন, নগরায়ণ, জটিল আন্তর্জাতিক সন্ধি, চুক্তি ও আইন ইত্যাদি পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে অশিক্ষিত ও রাজনৈতিক জ্ঞানহীন নাগরিকদের পক্ষে রাষ্ট্রীয় শাসনকার্যে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করার ব্যবস্থা প্রহসনমাত্র। তাই আজ এই শাসনব্যবস্থা বিলুপ্তির সম্মুখীন হয়েছে।

  • প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যাবস্থায় অনুসৃত পদ্ধতিসমূহ: প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থার মধ্যে যেসব পদ্ধতি বিদ্যমান সেগুলি হল- গণভোট (Referendum), গণউদ্যোগ (Initiative), গণঅভিমত (Plebiscite) এবং প্রত্যাহার (Recall)।
  • গণভোট (Referendum): আইনসভার খসড়া বিলকে (Draft) আইনে পরিণত করার আগে সম্মতির জন্য জনসাধারণের কাছে পেশ করার পদ্ধতিকে গণভোট বা গণনির্দেশ বলা হয়। আক্ষরিক অর্থে গণভোেট বলতে বোঝায়, যে-কোনো সরকারি প্রস্তাব জনগণের কাছে উপস্থাপন করা (Refer to the people)। এক্ষেত্রে জনসাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠের ভিত্তিতে ভোটের মাধ্যমে আইনসভার খসড়া বিলকে সম্মতি দিলে তা আইনে পরিণত হয়, নতুবা তা বাতিল বলে গণ্য গণভোট সাধারণত দু-রকমের হতে পারে। যথা- বাধ্যতামূলক (Obligatory) এবং ঐচ্ছিক (Optional)। যেক্ষেত্রে আইনসভার পাস করা সমস্ত আইনের খসড়া বিলকে জনসাধারণের সম্মতির জন্য পাঠানো হয়, তাকে বাধ্যতামূলক গণভোট আখ্যা দেওয়া হয়। প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যায় যে, কোন্ বিষয়ে বাধ্যতামূলক গণভোট নেওয়া হবে তা সংবিধানে লিপিবদ্ধ থাকে। সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত আইনে বা কোনো গুরুত্বপূর্ণ আইন প্রণয়ণের ক্ষেত্রে বাধ্যতামূলক গণভোট নেওয়া হয়। অন্যদিকে, যেক্ষেত্রে নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটদাতাদের আবেদনে আইনসভার কোনো খসড়া বিলকে জনগণের সম্মতির জন্য গণভোটে উপস্থাপন করা হয়, তাকে ঐচ্ছিক গণভোট বলা হয়। সাধারণ আইনের বিষয়ে ঐচ্ছিক গণভোট গ্রহণের প্রবণতা দেখা যায়। সুইটজারল্যান্ডের সংবিধানে গণভোট নেওয়ার ব্যবস্থা কিছু ক্ষেত্রে এখনও চালু রয়েছে।
  • গণউদ্যোগ (Initiative): যেক্ষেত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত আইনসভা কোনো বিষয়ে আইন প্রণয়নে অসমর্থ হয়, সেক্ষেত্রে জনগণ যদি নিজেরা উদ্যোগী হয়ে প্রত্যক্ষভাবে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে আইন প্রণয়নের ব্যবস্থা নেয়, তাকে গণউদ্যোগ বলা হয়। এই পদ্ধতির মাধ্যমে সাংবিধানিক নির্দেশ অনুসারে, নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটদাতারা নিজেরাই উদ্যোগী হয়ে কোনো বিশেষ বিষয়ে আইন প্রণয়নের জন্য আইনসভাকে অনুরোধ করে থাকে। এক্ষেত্রে গণউদ্যোগ ভোটদাতাদের কাছে একটি ইতিবাচক হাতিয়ার হিসেবে কাজ করে। গণউদ্যোগ সাধারণত দু-রকম হতে পারে। যথা- সুগঠিত (Formulated) এবং অগঠিত (Unformulated)। যেক্ষেত্রে ভোটদাতারা নিজেরাই কোনো আইনের সম্পূর্ণ খসড়া প্রস্তাব তৈরি করে, সেক্ষেত্রে তাকে সুগঠিত গণউদ্যোগ নামে অভিহিত করা হয়। অন্যদিকে, যেক্ষেত্রে অসম্পূর্ণ খসড়া প্রস্তাবকে ভোটদাতারা সম্পূর্ণ করার জন্য আইনসভাকে অনুরোধ করে, সেক্ষেত্রে তাকে অগঠিত গণউদ্যোগ বলা হয়। প্রসঙ্গত বলা যায় যে, গণউদ্যোগের মাধ্যমে গৃহীত আইনের প্রস্তাবকে গণভোটে পেশ করা বাধ্যতামূলক। সুইটজারল্যান্ডে গণউদ্যোগের ব্যবস্থা রয়েছে।
  • গণভাভিমত (Plebiscite): রাষ্ট্রবিজ্ঞানী সি এফ স্ট্রং (C F Strong)- এর বক্তব্য অনুসারে, গণঅভিমত কথাটির অর্থ হল জনগণের আদেশ। প্রত্যক্ষ ভোটের মাধ্যমে কোনো রাজনৈতিক বিষয়ে জনগণের মতামত গ্রহণকে গণঅভিমত বলা হয়। গণভোেট এবং গণঅভিমতের মধ্যে পার্থক্য হল কোনো আইন সংক্রান্ত প্রস্তাবকে নিয়ে ‘গণভোট’ নেওয়া হয় এবং অন্যদিকে, রাজনৈতিক দিক থেকে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উপরে জনগণের মতামত নেওয়ার জন্য গণঅভিমত গ্রহণ করা হয়। ফ্রান্সে পঞ্চম প্রজাতন্ত্র গঠন করার সময় প্রেসিডেন্ট দ্য গল (De Gaulle) গণঅভিমত নেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলেন।
  • পদচ্যুতি (Recall): প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের এক গুরুত্বপূর্ণ পদ্ধতি হল পদচ্যুতি। এই পদ্ধতির মাধ্যমে নির্বাচকমণ্ডলী নির্বাচিত কোনো জনপ্রতিনিধিকে তার জনস্বার্থবিরোধী কাজের জন্য নির্দিষ্ট কার্যকাল পূর্ণ হওয়ার আগেই প্রত্যাহার করে নিতে পারেন। সংবিধান অনুযায়ী, নির্দিষ্টসংখ্যক ভোটদাতা সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধির পদত্যাগ দাবি করতে পারেন। এ ধরনের দাবি পরবর্তীকালে প্রস্তাবের আকারে গণভোটে পেশ করা হলে, সংশ্লিষ্ট নির্বাচনি এলাকার সংখ্যাগরিষ্ঠ নির্বাচকের সমর্থনে সংশ্লিষ্ট প্রতিনিধিকে পদত্যাগ করতে হয়। সুইটজারল্যান্ডে পদচ্যুতির নির্দেশ কার্যকরী রয়েছে।

উপসংহার

প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অসুবিধাগুলিকে কোনোভাবেই অস্বীকার করা যায় না। এতসত্ত্বেও গণতন্ত্রের যথার্থস্বরূপ প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার মধ্যেই যে নিহিত সে কথা অনস্বীকার্য। আদর্শগতভাবে শ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা বলতে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রকেই বোঝায়। এই ধরণের শাসনব্যবস্থায় জনগণের সার্বভৌমত্বের চরম প্রকাশ ঘটে। সাধারণত রাজনৈতিক কার্যকলাপের দৃষ্টান্ত ভালোমন্দ যাই হোক-না-কেন, তা রাষ্ট্রের সকল জনসাধারণকেই ভোগ করতে হয়। এ প্রসঙ্গে অধ্যাপক ল্যাস্কি (Laski) বলেছিলেন, যা সকলকে স্পর্শ করে তা সকলের দ্বারাই নির্ধারিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। আবার, রুশো (Rousseau) ছিলেন প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের অনুরাগী। তাঁর সাধারণ ইচ্ছা তত্ত্ব (Doctrine of General Will)-এর বাস্তবায়ন একমাত্র প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রেই ঘটা সম্ভব। তবে একথাও সত্য যে, বাস্তবে এরূপ শাসনব্যবস্থার সুফল অপেক্ষা কুফলই বেশি। তাই, এই গণতন্ত্র বর্তমানে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়েছে।

৫। পরোক্ষ গণতন্ত্রের গুণাবলি আলোচনা করো।

পরোক্ষ গণতন্ত্রের সপক্ষে যেসকল যুক্তির অবতারণা করা হয় সেগুলি হল-

(1) জনগনের শাসন

পরোক্ষ গণতন্ত্রে জনগণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ সরকারি কার্যাবলিতে অংশগ্রহণ করে এবং যাবতীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। জনগণের স্বার্থে জনগণের প্রতিনিধিরা যে রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত নেন, প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের তুলনায় তা অনেকসময় অধিকতর কার্যকরী ও ফলপ্রদ হয়ে থাকে। যে-কোনো সরকারি বিষয়ে জনগণের অপ্রয়োজনীয় বা প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপকে কেউ কেউ অযৌক্তিক বলে মনে করেছেন।

(2) সুদক্ষ জনপ্রতিনিধি

অনেক সময় দেখা যায় যে, জনপ্রতিনিধিগণ জনসাধারণের চেয়ে অনেক বেশি রাজনৈতিক বিচক্ষণতাসম্পন্ন, অভিজ্ঞ, প্রশাসনিক নীতি প্রণয়নে দক্ষতাসম্পন্ন, যা রাষ্ট্রপরিচালনার মতো গুরুত্বপূর্ণ কাজে সঠিক ও ফলদায়ক সিদ্ধান্তগ্রহণে সহায়তা করে।

(3) বৃহৎ রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে উপযোগী

বৃহৎ আয়তনবিশিষ্ট ও জনবহুল রাষ্ট্রের ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্র অবাস্তব। প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র স্বল্পসংখ্যক এবং পরিচালনাযোগ্য নির্বাচিত ব্যক্তিবর্গদের নিয়ে বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থে রাষ্ট্রপরিচালনা বা রাষ্ট্রশাসনের অনুমতি দেয়।

(4) সরকারের দায়বদ্ধতা

নিয়মিত সময়মাফিক নির্বাচন প্রক্রিয়া সাফল্যমণ্ডিত হওয়ার মধ্য দিয়ে জনপ্রতিনিধিগণ তাদের সম্পাদিত কার্যাবলির জন্য নিজ নিজ নির্বাচনি এলাকার প্রতি অর্থাৎ, জনগণের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। এটি তাদের পরবর্তী নির্বাচনে পুনরায় আসন লাভ নিশ্চিত করতে এবং জনগণের সর্বাধিক কল্যাণসাধনের স্বার্থে কাজ করতে উৎসাহিত করে।

(5) ভোটাধিকারের স্বীকৃতি

পরোক্ষ গণতন্ত্রে দেশের সকল প্রাপ্তবয়স্ক এবং যোগ্য নাগরিকগণ সার্বিক প্রাপ্তবয়স্কের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে জনপ্রতিনিধি নির্বাচনের মাধ্যমে নিজেদের রাজনৈতিক অধিকার প্রয়োগ করে থাকে

(6) অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচন পদ্ধতি

এরূপ শাসনব্যবস্থায় নির্বাচন ক্রিয়া যতটা সম্ভব অবাধ, সুষ্ঠু ও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে থাকে। প্রত্যেকটি ভোটদাতা যাতে অবাধে ভোটদান করতে পারে এবং প্রত্যেক নির্বাচনি প্রার্থীরা যাতে বিনা বাধায় প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে, সেই উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে সুরক্ষিত পরিবেশ সৃষ্টি করা হয় এরূপ গণতন্ত্রে।

(7) একাধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতি

এই গণতন্ত্রে যেহেতু নির্বাচন প্রতিযোগিতামূলক হয়ে থাকে, সেহেতু একাধিক রাজনৈতিক দলের উপস্থিতিকে অন্যতম অপরিহার্য গুণ বলে মনে করা হয়। 

(8) জনগণকর্তৃক নির্বাচিত শাসন বিভাগ

পরোক্ষ গণতন্ত্রে শাসন বিভাগীয় কর্মকর্তাগণ জনসাধারণ কর্তৃক নির্বাচিত প্রতিনিধিদের মাধ্যমে কখনও পরোক্ষভাবে নির্বাচিত, আবার কখনও পরোক্ষভাবে মনোনীত হন।

(9) রাজনৈতিক ও আইনগত সার্বভৌমিকতার মধ্যে পার্থক্য

এরূপ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম একটি গুণ হল এখানে আইনগত সার্বভৌমিকতা এবং রাজনৈতিক সার্বভৌমিকতার মধ্যে পার্থক্য নিরূপণ করা হয়ে থাকে।

(10) গণসার্বভৌমিকতার বাস্তবায়ন

অনেক সময় গণসার্বভৌমত্বের ধারণাকে বাস্তবে প্রতিফলিত করার জন্য পরোক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় গণভোট (Referendum), গণউদ্যোগ (Initiative), গণঅভিমত (Plebiscite) এবং প্রত্যাহার (Recall) ইত্যাদির মতো প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়ে থাকে। তাই, এই সকল কারণে প্রত্যক্ষ গণতন্ত্রের পরিবর্তে অনেকে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক শাসনব্যবস্থাকেই সমর্থক ও গ্রহণ করার পক্ষপাতী।

(11) রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা

একটি সুসংগঠিত প্রশাসনিক কাঠামো এবং সুসংবদ্ধ সিদ্ধান্তগ্রহণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক রাষ্ট্রের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকে অক্ষুণ্ণ রাখতে সাহায্য করে।

(12) সংসদীয় শাসনব্যবস্থার উপস্থিতি

এরূপ গণতন্ত্র রাষ্ট্রপতিশাসিত কিংবা মন্ত্রীপরিষদচালিত (সংসদীয়)-দুই-ই হতে পারে। রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থায় রাষ্ট্রপতি জনগণ কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত হন এবং দেশের প্রকৃত শাসক হিসেবে কার্যসম্পাদন করেন। এক্ষেত্রে ক্যাবিনেটের সদস্যরা তাঁর অধীনস্থ সহকর্মী বা আজ্ঞাবাহী হয়ে থাকেন। অপরদিকে, মন্ত্রীপরিষদচালিত বা ক্যাবিনেটশাসিত শাসনব্যবস্থায় তত্ত্বগতভাবে রাষ্ট্রের প্রধান হিসেবে একজন নিয়মতান্ত্রিক শাসক থাকেন এবং বাস্তবে রাষ্ট্রীয় কার্যপরিচালনার জন্য একজন প্রকৃত শাসক থাকেন। নিয়মতান্ত্রিক শাসক মূলত উত্তরাধিকারসূত্রে মনোনীত অথবা, জনগণের পরোক্ষ ভোটের ভিত্তিতে নির্বাচিত হয়ে থাকেন। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রাষ্ট্রপতিশাসিত শাসনব্যবস্থা এবং গ্রেট ব্রিটেন (যুক্তরাজ্য) ও ভারতে সংসদীয় বা মন্ত্রীপরিষদচালিত শাসনব্যবস্থা রয়েছে।

(13) বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থের প্রতিফলন

আদর্শগতভাবে, প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্র বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থ এবং দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করে, যা প্রশাসনিক কার্যাবলিতে এক ভারসাম্যমূলক এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন প্রতিষ্ঠা করতে তথা পরিচালনা করতে সাহায্য করে।

(14) শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক

পরোক্ষ বা প্রতিনিধিত্বমূলক গণতন্ত্রে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মাধ্যমে শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক গড়ে ওঠে। শাসিতের সমর্থনের ভিত্তিতে এখানে শাসক নির্বাচিত হয়। এই সমর্থনের ভিত্তিতে উভয়ের ব্যক্তিত্ব বিকাশের জন্য অধিকারকে সুনিশ্চিত করা হয়।

(15) সংখ্যালঘুদের অধিকার সংরক্ষণ

জনগণ কর্তৃক পরোক্ষভাবে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সংস্থাগুলি সংখ্যালঘু শ্রেণির অধিকার সংরক্ষণের জন্য বিভিন্ন ব্যবস্থা এবং বিধিনিষেধ বাস্তবায়িত করতে পারে, যা সংখ্যাগরিষ্ঠ শাসন দ্বারা পরিচালিত প্রত্যক্ষ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় উপেক্ষিত হতে পারে।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top