নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদের ধারণা ব্যাখ্যা করো

নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদের ধারণা
ছাত্রজীবনে যে জাতীয়তাবাদী চেতনার উন্মেষ ঘটেছিল নেতাজির মধ্যে, পরবর্তীকালে কর্মজীবনে তা রূপান্তরিত হয় সংগ্রামী জাতীয়তাবাদে। প্রাথমিকভাবে রাজনৈতিক দিক থেকে তিনি জাতীয়তাবাদী ছিলেন। কিন্তু – তাঁর জাতীয়তাবাদী তত্ত্বে উগ্র জাত্যাভিমানের কোনো জায়গা ছিল না। বরং তাঁর ভারত সম্পর্কিত ভাবনা পূর্ণতা পেয়েছে বিশ্বমানবতাবোধের মাধ্যমে। সারাজীবন ধরে নেতাজির ধ্যান-জ্ঞান ছিল একটাই, তা হল পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন। জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে তাঁর অভিমত উঠে এসেছিল ১৩৩৪ বঙ্গাব্দে কলকাতায় দেওয়া এক বক্তৃতায়। সেখানে তিনি বলেছিলেন- পরাধীন দেশে যদি কোনো ‘ism’ (মতবাদ) সর্বান্তকরণে গ্রহণ করতে হয় তবে তা হল ‘Nationalism’ (জাতীয়তাবাদ)।
ভারতের বৈচিত্র্যের মধ্যে ঐক্যের কথা মনে করিয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “… ভারতীয় সমাজের অন্তর্নিহিত ঐক্য এবং ভারতীয় সভ্যতার প্রবাহমানতা সম্পর্কে সম্পূর্ণভাবে সচেতন হতে হবে।… কাশ্মীর থেকে কন্যাকুমারী, বাংলা থেকে গুজরাট একটাই সভ্যতা।” তিনি মনে করতেন, অর্থনৈতিক চেতনার বিস্তার ধর্মের উন্মাদনা ডেকে নিয়ে আসে। সুভাষচন্দ্র বিশ্ব যুক্তরাষ্ট্রের (World Federation) স্বপ্ন দেখেছিলেন। ভারতকে কখনোই তিনি সাম্রাজ্যবাদী শক্তি হিসেবে দেখতে চাননি। কৃষ্টিজাত চেতনা, সাংস্কৃতিক সমন্বয়, বিশ্বজনীন মানবতাবাদের দৃষ্টিতেই ভারতকে দেখতে বলেছিলেন তিনি।
নেতাজির জাতীয়তাবাদের উল্লেখযোগ্য দিকগুলি হল-
(1) অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদের প্রধান একটি উপাদান হল অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি। নেতাজি উপলব্ধি করেছিলেন, ব্রিটিশ শাসিত ভারতে ভারতবাসীরা নিজেদের গৌরবোজ্জ্বল অতীত ঐতিহ্যের কথা ভুলতে বসেছে। তিনি বলতেন, ‘এই বিস্তৃতি আমাদের অধঃপতনের মূল।’ এজন্য নেতাজি চেয়েছিলেন অতীত ঐতিহ্যের পুনর্জাগরণ। তিনি ভারতীয় ভাষা, রীতিনীতি এবং ঐতিহ্যের উন্নতিসাধনে সচেষ্ট হয়েছিলেন। বিভিন্ন শিক্ষাগত সংস্কারের ব্যবস্থাও তিনি করেছিলেন। নেতাজি মনে করতেন শিক্ষাগত সংস্কারই ভারতীয়দের মধ্যে অতীত ঐতিহ্যের গৌরবের অনুভূতি ভারতীয়দের আত্মশক্তিতে বিশ্বাসী করে তুলবে।
(2) হীনমন্যতাবোধের বিলুপ্তি
সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদী ধ্যানধারণায় হীনমন্যতাবোধের কোনো স্থান ছিল না। বেশিরভাগ ভারতীয়দের মনে এই ধারণা বদ্ধমূল ছিল যে, ‘ইউরোপীয় জাতিগুলি অধিকতর উন্নত।’ এই হীনমন্যতাবোধের যাবৎ ভারতীয়দের পরাধীনতার গ্লানি সহ্য করতে হয়েছে। সবার আগে এই হীনমন্যতাবোধ কাটিয়ে ওঠার বিষয়টিকে জাতীয়তাবাদ গড়ে তোলার একটি বড়ো কাজ বলে তিনি মনে করতেন। কারণ ব্রিটিশ শাসকরা শুধুমাত্র অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছিল তা কিন্তু নয়, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনধারাতেও হস্তক্ষেপ করে আধিপত্য কায়েম করেছিল। তাই তিনি মানুষের মধ্যে আত্মচেতনা এবং মর্যাদাবোধ গড়ে তুলে জাতীয় আন্দোলন পরিচালনা করতে সচেষ্ট হয়েছিলেন।
(3) জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ
ভারতের জাতীয় ঐতিহ্যের প্রতি শ্রদ্ধাবোধ নেতাজির জাতীয়তাবাদের অন্যতম একটি দিক। ভারতীয়রা যে এক সুমহান ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী একথা বারে বারে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সুভাষচন্দ্র। তার লেখা ‘The Indian Struggle’ গ্রন্থে নেতাজি সেই সুমহান ঐতিহ্যের পরিচয় দিতে গিয়ে জানিয়েছেন, ‘ভারতীয় সভ্যতা খ্রিস্টপূর্ব ৩০০০ বছর বা ততোধিক পুরোনো এবং সেই সুদূর অতীত থেকেই সভ্যতা ও সংস্কৃতির একটি ধারা প্রবাহমান। এই বিরামহীন প্রবাহ… ভারতবাসীর প্রাণোচ্ছল সংস্কৃতি ও সভ্যতার প্রধান পরিচয়।’
নেতাজি আরও জানিয়েছেন, ‘ভারতীয় জাতি একাধিকবার মরেছে- কিন্তু মৃত্যুর পর পুনর্জীবন লাভ করেছে। তার কারণ এই যে, ভারতের অস্তিত্বের সার্থকতা ছিল এবং এখনও আছে। ভারতের একটি বাণী আছে যেটা জগতসভায় শোনাতে হবে, ভারতের শিক্ষার মধ্যে এমন কিছু আছে যা বিশ্বমানের পক্ষে অত্যন্ত প্রয়োজনীয় এবং তা গ্রহণ না করলে বিশ্বসভ্যতার প্রকৃত উন্মেষ ঘটবে না।
(4) অদম্য ও অপ্রতিহত জাতীয়তাবোধ
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশশক্তির বিরুদ্ধে ভারতীয়দের মনে এক অদম্য ও অপ্রতিহত জাতীয়তাবোধ সঞ্চারিত করেছিলেন। স্বাধীনতা অর্জনের ক্ষেত্রে তিনি বৈপ্লবিক পদ্ধতিতে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি মনে করতেন ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনকে উৎখাত করার জন্য সশস্ত্র সংগ্রামের প্রয়োজন। নেতাজি ইউরোপ ও এশিয়ার বিপ্লবী আন্দোলন দ্বারা গভীরভাবে প্রভাবিত হয়ে ভারতের জন্য অনুরূপ কৌশল গ্রহণ করতে চেয়েছিলেন। জার্মানিতে গিয়ে তিনি যে আজাদ হিন্দ বাহিনী ও আজাদ হিন্দ সরকার গঠন করেছিলেন তা তাঁর জ্বলন্ত জাতীয়তাবাদী চেতনার স্বাক্ষর বহন করে।
(5) অখণ্ড জাতীয়তাবাদ
সুভাষচন্দ্র বসু ভারতের জন্য সম্পূর্ণ স্বাধীনতার (পূর্ণ-স্বরাজ) প্রবল পক্ষপাতী ছিলেন। তিনি ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের সঙ্গে কোনোরকম আপোস করেননি এবং ভারতের নিরঙ্কুশ সার্বভৌমত্ব চেয়েছিলেন।
তবে আন্দোলনের পথ হিসেবে তিনি মহাত্মা গান্ধির অহিংস নীতিকে সমর্থন করেননি। তিনি প্রকৃত জাতীয়তাবাদ প্রতিষ্ঠা করতে ব্রিটিশ শাসকদের বিরুদ্ধে সক্রিয় প্রতিরোধ গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
(6) প্রগতিশীল এবং অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ
নেতাজি সুভাষচন্দ্রের জাতীয়তাবাদ ছিল প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদ। এই জাতীয়তাবাদের মধ্যে কোনো সম্প্রদায়গত সংকীর্ণতার স্থান ছিল না। প্রাদেশিকতার ধর্মও তার মধ্যে পাওয়া যায় না। দেশবাসীর উদ্দেশ্যে তিনি সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধ্বে ওঠার যে আহবান জানিয়েছিলেন তার মূল কথা ছিল, ‘আমাদের অতীতের দিকে তাকাতে হবে, তার মধ্যে হিন্দু মুসলমানের কোনো ব্যাপার নেই, এ হল বহু সংস্কৃতির মিলনের ফল।’ তিনি সমস্ত ভারতীয়দের মধ্যে একতার ধারণাকে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। তিনি সকলকে বুঝিয়েছিলেন, স্বাধীনতার জন্য সামাজিক-ধর্মীয় পটভূমি নির্বিশেষে এক সম্মিলিত প্রচেষ্টার প্রয়োজন।
ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতাজির এক নিজস্ব ধারণা ছিল। তাঁর ‘The Indian struggle’ গ্রন্থে এই ধারণার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে নেতাজি বলেছিলেন, ভারতীয় জাতীয়তাবাদ সংকীর্ণ, স্বার্থপর ও আক্রমণাত্মক নয়। এই জাতীয়তাবাদ মানবজাতির সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ সত্যম শিবম ও সুন্দরমের দ্বারা অনুপ্রাণিত। ভারতীয় জাতীয়তাবাদ আমাদের মধ্যে সত্যবাদীতা, সততা, পুরুষত্ব এবং সেবা ও ত্যাগের ভাবধারাকে সঞ্চারিত করেছে [Indian nationalism is neither narrow nor selfish, nor aggressive. It is inspired by the highest ideals of human race Satyam (the true), Shivam (the god), Sundaram (the beautiful). Nationalism in India has instilled into us truthfulness, honestly, manliness and the spirit of service and sacrifise.]I
(7) বিপ্লবী জাতীয়তাবাদের পক্ষে সামরিক জোট
নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ভারতবর্ষের স্বাধীনতার জন্য সামরিক ও কৌশলগত সমর্থন ও সহযোগিতা পেতে নাৎসি জার্মানি, জাপান-সহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সঙ্গে জোটবদ্ধ হওয়ার চেষ্টা করেছিলেন। কাবুল থেকে orlando mozatto নামক ইতালীয় ছদ্মনাম নিয়ে মস্কো গিয়েছিলেন, তারপর সেখান থেকে বার্লিনে। সেখানে গিয়ে তিনি হিটলারের সঙ্গে দেখা করতে চেয়েছিলেন। ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে হিটলার রাশিয়া আক্রমণ করে। সেই সময় নেতাজি হিটলারের কাছে এক প্রস্তাব দিয়ে ব্রিটিশ শক্তিকে পরাস্ত করার পরিকল্পনা করেন, তিনি মূলত ভারতীয় সেনাবাহিনী গঠন করে তাকে জার্মান সেনাবাহিনীর অনুগামী করে মধ্য এশিয়া দিয়ে উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে ব্রিটিশ শক্তিকে আক্রমণের পরিকল্পনা করেন। সুভাষচন্দ্র আশা করেছিলেন যেহেতু জার্মান ব্রিটেনের শত্রু; সেহেতু হিটলার নিশ্চয়ই তাকে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে সহায়তা করবে। কিন্তু সেই ধারণা ভ্রান্ত প্রমাণিত হয়। জার্মানির জাতীয়তাবাদ ছিল সংকীর্ণ, স্বার্থপর এবং উদ্ধত প্রকৃতির।
যাই হোক পরবর্তীকালে ১৯৪৩ খ্রিস্টাব্দে তিনি জাপানের আহবানে সাবমেরিনে করে জলপথে প্রায় সাড়ে তিন মাস ধরে যাত্রা করে প্রথমে সিঙ্গাপুরে এবং তারপরে সুমাত্রা যান। এরপর জাপান গিয়ে বিপ্লবী রাসবিহারী বসুর সঙ্গে দেখা করে আন্দোলন সম্পর্কে নতুন দিশা পান।
জাপানের প্রধানমন্ত্রী তোজোর কাছে তিনি প্রভূত সহযোগিতা পেয়েছিলেন। তোজো ভারতের ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন এবং ঘোষণা করেছিলেন ভারত থেকে ব্রিটিশ প্রভাবকে উচ্ছেদ করতে সবরকম সাহায্য করতে প্রস্তুত আছে জাপান। এভাবে নেতাজি বুদ্ধিদীপ্ততার সঙ্গে সামরিক জোট তৈরি করেছিলেন।
(8) জাতীয়তাবাদের উত্তরাধিকারী
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর চিন্তাধারা ছিল বিপ্লবাত্মক এবং কঠিন। যা সশস্ত্র প্রতিরোধ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ঐক্য এবং আর্থ-সামাজিক ন্যায়বিচারের মিশ্রণ দ্বারা আবর্তিত হয়েছিল। তিনি ভারতের শক্তি এবং ঐক্য ও সমৃদ্ধিকে সুনিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন।
তার উত্তরাধিকার আগামী প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করে চলেছে। ভারতীয়দের জন্য ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা ও ক্ষমতায়নের জন্য তাঁর লড়াই শিক্ষণীয় হয়ে থেকে যাবে। ভারতের অচেতন শক্তিকে জাগিয়ে তুলতে আজও নেতাজির চিন্তাধারা অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকরূপে গণ্য হয়।
(9) সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবোধ
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে সুভাষচন্দ্র বসুর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ছিল ভারতের স্বাধীনতার প্রতি তাঁর প্রতিশ্রুতি এবং একটি ন্যায়সঙ্গত ও ন্যায়ভিত্তিক সমাজের জন্য তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির সংমিশ্রণ। তাঁর সমাজতান্ত্রিক ধারণাগুলি মার্কসবাদ এবং সোভিয়েত মডেল সহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দর্শন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিল। তিনি অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং সামাজিক সংস্কারকে জাতির অগ্রগতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করতেন। অর্থনীতিতে রাষ্ট্রীয় হস্তক্ষেপ, শিল্পায়ন এবং সমাজের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর উন্নয়নের পক্ষে তিনি সমর্থন জানান। অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বার্থে একটি কেন্দ্রীয় পরিকল্পিত অর্থনীতির কথা তিনি উল্লেখ করেন। তাঁর মতে এরূপ অর্থনীতিতে রাষ্ট্র একটি প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করবে।
নেতাজি বিশ্বাস করতেন সম্পদের সুষম বণ্টন ও দক্ষ ব্যবহারের জন্য মূল শিল্প ও সম্পদের উপর সরকারের নিয়ন্ত্রণ অপরিহার্য। তাঁর সমাজতান্ত্রিক জাতীয়তাবাদে শ্রমিকদের অধিকারের কথাও তিনি উল্লেখ করেন। শ্রমিকদের ন্যায্য মজুরি, শালীন কাজের পরিবেশ, সামাজিক নিরাপত্তা এবং শ্রমিক সংগঠন বা ইউনিয়নের পক্ষেও তিনি সমর্থন জানান। সুভাষচন্দ্র বসু শ্রমিকদের কল্যাণকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বলে মনে করতেন। সর্বোপরি তাঁর সমাজতান্ত্রিক চিন্তাধারা ভারতকে ঔপনিবেশিক শোষণ ও অভ্যন্তরীন বিভাজন থেকে মুক্ত একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ, শিল্পোন্নত দেশ হিসেবে গড়ে তোলার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
মূল্যায়ন
(1) মানবকল্যাণের তত্ত্ব
নেতাজির স্বদেশ চেতনা তথা জাতীয়তাবাদেরতত্ত্বটি মানবকল্যাণের একটি নতুন দিক উন্মোচন করেছে। তাঁর জীবনে শিক্ষা, ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা, আদর্শ ও বৈশ্বিক আন্দোলনগুলি তাঁর জাতীয়তাবাদী চেতনাকে সমৃদ্ধ করেছে। তিনি জনগণের ক্ষমতায়ন, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য এবং ঔপনিবেশিক পরাধীনতা থেকে জাতিকে মুক্ত করতে চেয়েছিলেন। তাঁর দূরদর্শিতা, কৌশলগত বুদ্ধিমত্তা ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনকে এক নতুন সাহস জুগিয়েছিল।
(2) বিকল্প আদর্শ
জাতীয়তাবাদের প্রতি নেতাজির দৃষ্টিভঙ্গি ছিল মহাত্মা গান্ধি এবং জওহরলাল নেহরুর থেকে আলাদা। গান্ধি যখন অহিংসা এবং সত্যাগ্রহের উপর জোর দিয়েছিলেন, নেহরু তখন সাধারণতন্ত্রের দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন। এই সময় নেতাজি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রাম আরও তীব্রতর করে তুলেছিলেন।
(3) আন্তর্জাতিক দৃষ্টিভঙ্গি
নেতাজির জাতীয়তাবাদ শুধুমাত্র ভারতবর্ষে সীমাবদ্ধ ছিল না বরং এই সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী দৃষ্টিভঙ্গি ভারতের বাইরে বিভিন্ন দেশ-বিদেশেও বিস্তার লাভ করেছিল। বিশ্বব্যাপী নিপীড়িত জনগণের সঙ্গে একাত্মবোধে আবদ্ধ হয়েছিল এই তত্ত্ব। তিনি ভারতকে ব্রিটিশের দখল মুক্ত করতে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় অক্ষশক্তির সাহায্যে সম্পর্ক তৈরি করেছিলেন।
(4) অনুপ্রেরণার শক্তি
ভারতের জাতীয় স্বাধীনতা অন্বেষণে সুভাষচন্দ্র বসু তাঁর সাহস, সংকল্প এবং ত্যাগের পরিচয় দিয়েছেন। আপোসহীন আন্দোলনের ভূমিকায় তাঁর অবাধ্যতা এবং আত্মত্যাগ সমস্ত কিছুকে ছাড়িয়ে গেছে। এইভাবে তাঁর আদর্শ যুগে যুগে বর্তমান এবং আগ্রাসী ভারতীয় প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করেছে এবং করবে।
পরিশেষে বলা যায়, নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জাতীয়তাবাদ ঔপনিবেশিক নিপীড়নের বিরুদ্ধে দৃঢ় প্রতিরোধের প্রতীক হিসেবে এবং বৃহত্তর ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামের মধ্যে স্মারক হিসেবে প্রাসঙ্গিক থেকে যাবে।
আরও পড়ুন – কর্তৃত্ববাদের বৈশিষ্ট্য লেখো