আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর Class 11 | Agun Natok Question Answer

Table of Contents

আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর Class 11 | Agun Natok Question Answer

আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর
আগুন নাটকের প্রশ্ন উত্তর

১। ‘আগুন’ নাটকের প্রথম দৃশ্যের সংক্ষিপ্ত বর্ণনা দাও।

অথবা

‘আগুন’ নাটকে প্রত্যুষকাল বা সকালবেলার যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে তার সংক্ষিপ্ত বিবরণ দাও।

সকালবেলার বর্ণনা : মানবদরদি নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য তাঁর লেখা ‘আগুন’ নাটকের প্রথম দৃশ্যে একটি অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারের চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন। এই দরিদ্র পরিবারের সদস্য সংখ্যা মাত্র তিনজন। ভোরের অস্পষ্ট আলোয় সাংসারিক টুকিটাকি যে জিনিসগুলো দেখা যায় সেগুলি হল-একটা মেটে জালা, তার পাশেই বাঁশের আলনার উপর ঝুলন্ত দু-একখানা নোংরা কাপড়, একটি ছেঁড়া চট আর একটি পুরোনো ছেঁড়া কাঁথা। মেঝের উপর তিনজন লোক কাঁথা মুড়ি দিয়ে ঘুমোচ্ছে। অস্পষ্ট নীল আলোয় তাদের দেখা যাচ্ছে। তারপর হঠাৎ মোরগ ডাকার আওয়াজ শোনা গেল, আজানের আওয়াজ শোনা গেল, লোকটা পাশ মুড়ে শোওয়ার চেষ্টা করল। খানিক বাদে কাকের ডানা ঝাপটানোর আওয়াজ শোনা গেল, মোরগটা আবার ডেকে উঠল, একটু পরে হাই তোলার আওয়াজ ও আড়মোড়া ভাঙার শব্দও শোনা গেল। এইভাবে লোকটি ঘুম থেকে জেগে উঠল।

নাটকের প্রথম দৃশ্যের পুরুষ চরিত্রটি ঘুম থেকে ওঠে এবং তাকে বলতে শোনা যায় যে, আর শুয়ে থাকলে চলবে না। আগের দিন মণিচাঁদ দেরিতে চালের দোকানে যাওয়ায় লাইনের একদম শেষে দাঁড়িয়েছিল। ফলে চাল পেতে পেতে তার বেলা বারোটা বাজে। আবার, কুড়োনের মা চাল না পেয়ে খালি হাতে ফিরে এসেছে। এবার লোকটি বিড়ি ধরিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠে ছেলে নিতাইকে ঘুম থেকে উঠতে তাগাদা দেয়, পাশে শুয়ে থাকা স্ত্রীকে ঠেলা দেয়। লোকটি বলে ওঠে -“হ্যাদে ও নেত্যর মা, ওঠ এইবেলা। আর কত ঘুমুবি ক’ দিনি।”

পুরুষের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, তার স্ত্রী ও ছেলে গ্রাম থেকে পাওয়া কলমি শাক, দাঁতন কাঠি, কলা ইত্যাদি নিয়ে গিয়ে বাজারে বিক্রি করবে আর বিক্রি করে যে পয়সা হবে তা দিয়ে তারা চাল কিনবে। তবে ঘটনাচক্রে স্ত্রী ও ছেলেকে ঘুম থেকে ওঠাতে গিয়ে লোকটি বিরক্ত হয়ে নিজেই উঠে পড়ে আর ব্যস্ত হয়ে বেরিয়ে যায়। পরে দেখা যায় নেত্যর মা নেত্যকে ঘুম থেকে উঠতে বাধ্য করে। নেত্য বা নিতাই ঘুম থেকে উঠে বসে চালের লাইন নিয়ে বলে ওঠে- “আচ্ছা তাল হইছে রোজ সকালে।” অর্থাৎ, একটু শান্তি করে ঘুমোনোর জো নেই। তারপর মা ও ছেলে তাদের সওদা করার জিনিসগুলি গুছিয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়ে।

২। “মেঝের উপর জন তিনেক লোক কাপড় মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ে ঘুমুচ্ছে।”-আলোচ্য অংশটির উৎস নির্দেশ করো। ‘জন তিনেক’ বলতে কাদের বোঝানো হয়েছে? তাদের যে অবস্থার কথা নাটকে বর্ণিত হয়েছে তার কারণ ব্যাখ্যা করো।

উৎস: আলোচ্য উদ্ধৃতাংশটি ‘অরণি’ পত্রিকায় প্রকাশিত বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘আগুন’ থেকে নেওয়া হয়েছে। এটি নাটকের প্রথম দৃশ্যের অংশবিশেষ।

‘জন তিনেক’ : ‘আগুন’ নাটকের প্রথম দৃশ্যে নাট্যকার যে পরিবারের চিত্র তুলে ধরেছেন সেই পরিবারের তিনজন সদস্যের কথা বোঝাতে ‘জন তিনেক’ বলা হয়েছে।

অবস্থার কারণ : বিজন ভট্টাচার্য পঞ্চাশের মন্বন্তরের প্রেক্ষাপটকে তাঁর প্রথম নাটকে ঠাঁই দিয়েছেন। এই অসময়ের কালপর্বে খাদ্যের সংকট সর্বত্র। দিনে দিনে মৃত্যুমিছিল গ্রাম থেকে শহরে বিস্তৃত হচ্ছিল। ‘আগুন’ নাটকে খন্ড খন্ড চিত্রের মাধ্যমে তা-ই তুলে ধরেছেন নাট্যকার।

নাটকের প্রথম দৃশ্যে নাট্যকার একাঙ্কের ক্ষুদ্র পরিসরের উপযোগী করে নির্মাণ করেন গ্রামের এই খাদ্যসংকটের চিত্র। গ্রাম বাংলার অতিদরিদ্র নেত্যর মায়ের মধ্যে দেখা যায় খাদ্যের লাইনে দাঁড়ানোর ব্যস্ততা। নেত্যর মা নেত্যকে ঘুম থেকে ওঠার জন্য তাড়া লাগাতে থাকে। কারণ হিসেবে বলে, দেরি হলে আর চাল ‘পাতি হবে নানে’। অর্থাৎ, চালের লাইনে দাঁড়াতে দেরি হলে আর চাল পেতে হবে না। বস্তুত, সমকালীন বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর ও কালোবাজারি জনিত খাদ্যসংকটের প্রেক্ষাপটেই উদ্ধৃতাংশে বর্ণিত তিনজনের জীবনে অন্নচিন্তা প্রকট হয়ে উঠেছে।

৩। “ঘুমোসখন বাবা, ঘুমোসখন। দুপুরবেলা ঘুমোসখন। এখন চল নে উঠে পড় খপ করে।”-বক্তা কে? তিনি কাকে উঠে পড়তে বলেছেন? তাকে উঠে পড়তে বলার কারণ ব্যাখ্যা করো।

বক্তা : আলোচ্য অংশটি বিজন ভট্টাচার্যের লেখা একাঙ্ক নাটক ‘আগুন’ থেকে নেওয়া হয়েছে। উদ্দিষ্ট উক্তিটির বক্তা হলেন প্রথম দৃশ্যে উল্লিখিত নেত্যর মা।

উদ্দেশ: তিনি অর্থাৎ নেত্যর মা নেত্য অর্থাৎ নিতাইকে ঘুম থেকে উঠে পড়তে বলেছেন।

কারণঃ ‘আগুন’ নাটকের প্রেক্ষাপট যেহেতু মন্বন্তর তাই খাদ্যের জন্য হাহাকার সর্বত্র- গ্রাম থেকে শহর, নিম্নবিত্ত থেকে মধ্যবিত্ত উঁচু জাত থেকে নীচু জাত। নাটকের মোট পাঁচটি দৃশ্যের মধ্যে প্রথম দৃশ্যে বর্ণিত বিষয়বস্তুও তার ব্যতিক্রম নয়। প্রথম দৃশ্যের সকালটাই বলে দেয় নাট্যকার কাদের নিয়ে নাটক তৈরি করেছেন এবং তাদের মধ্যে দিয়ে তিনি সমাজকে কী বার্তা দিতে চাইছেন। ১৯৪১-এ দেখা যায় রাশিয়ার সঙ্গে চুক্তি ভঙ্গ করে জার্মানি আক্রমণ করছে সোভিয়েত ইউনিয়নকে। তার প্রতিক্রিয়ায় শুরু হয় জনযুদ্ধ। ভারতের কমিউনিস্টরা এই যুদ্ধে শামিল হন। জাপানি বোমার আক্রমণে কলকাতায় তখন রাতে ব্ল্যাক আউট। শত্রুপক্ষকে আটকাতে ব্রিটিশ সরকার নিল পোড়ামাটির নীতি। মাঠের ফসল পুড়িয়ে খাক করে দেওয়া হল। দেশে দেখা দিল প্রচণ্ড খাদ্যাভাব। তারপর থেকেই মন্বন্তর।

নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য নাটকের প্রথম দৃশ্যে যে পারিবারিক চিত্র তুলে ধরেছেন, সেখানে আমরা দেখতে পাই একই পরিবারের তিনজন মানুষ- মা, বাবা ও তাদের একমাত্র সন্তান নিতাই ওরফে নেত্য। মন্বন্তরের কবলে পড়ে সমস্ত পরিবার দুটো চাল জোগাড় করতে হিমসিম খাচ্ছে। গ্রাম বাংলা থেকে পাওয়া কলমি শাক, নিমকাঠের দাঁতন কাঠি, কলা ইত্যাদি বাজারে বিক্রি করে যা পয়সা হবে তা দিয়ে দুটো চাল কিনে আনবে। চাল আনলে রাত্রিতে বাড়িতে হাঁড়ি চড়বে। দোকানে চাল পাওয়া নিয়েও তৈরি হয় ভীষণ সমস্যা। সেই ভোরবেলা থেকে দোকানে লাইন দিতে হবে। বেশি দেরি হলে চাল পাওয়া যাবে না। তাই নেত্যর মা নেত্যকে ভোরবেলা ঘুম থেকে উঠতে তাগাদা দেয় নাহলে ওই দিকে চাল পাবে না, চাল না পেলে খাবারও সেদিন আর জুটবে না।

৪। আগুন নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে কয়টি চরিত্র আছে? দৃশ্যটিতে কথক চরিত্রকে নাট্যকার যেভাবে উপস্থাপিত করেছেন তার পরিচয় দাও।

দ্বিতীয় দৃশ্যের চরিত্র : গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকের দ্বিতীয় দৃশ্যে দুটি চরিত্র আছে-জনৈক কৃষাণ ও তার স্ত্রী।

কথক চরিত্র : এই দৃশ্যের কথক চরিত্র হল জনৈক কৃষাণ। সকালের প্রথম আলোয় নিজেদের চালাঘরের সামনের একফালি উঠোনে সে খালি গায়ে দাঁড়িয়ে আছে, হাঁটু পর্যন্ত কাপড় গোটানো, মাথায় গামছা ফেটির মতো বাঁধা। হাতের কাস্তেটা দিয়ে পিঠ চুলকোতে চুলকোতে মন্বন্তরক্লিষ্ট সময়ে সে তার স্ত্রীকে রেশনের লাইনে দাঁড়ানোর জন্য কেষ্টর মায়ের সঙ্গে সকাল সকাল বেরিয়ে পড়তে বলে। এই প্রসঙ্গে সে আরও যে কথা বলে সেগুলির মধ্য দিয়ে তার চরিত্রের বেশ কতকগুলি দিক উদ্ভাসিত হয়।

আশাবাদী: ভয়াবহ মন্বন্তরে প্রতিনিয়ত জীবনযুদ্ধে পরাজিত হয়েও উজ্জ্বল ভবিষ্যতের আশায় সে কখনো-কখনো উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। তাই আগামী চৈত্রে ফসল উঠলে চলমান বিপর্যয় থেকে মুক্তি মিলবে বলে স্ত্রীকে সে অভয় দেয়।

আশাহতের আশঙ্কা : আশঙ্কা তবু থেকেই যায়। কেন-না, জীবনের রূঢ় অভিজ্ঞতায় সে বুঝেছে, একটা ছিমছাম জীবনের স্বপ্ন দরিদ্র মানুষের কাছে অধরা থেকে যায় – “…এ পয্যন্ত তো কত কিছু করবো বলে ঠিক করলাম, পাল্লাম কই…”।

স্ত্রীর প্রতি ভালোবাসা: কৃষাণের স্ত্রী স্বামীর কোনো কথার উত্তর না দিয়ে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। পাঠকের বুঝতে অসুবিধা হয় না যে সে দৃষ্টিতে আছে অসহায়তা। কিন্তু কৃষাণ তাতে ক্ষুণ্ণ হয় না, বরং স্ত্রী যাতে ক্রোধ প্রকাশ না করে তার অনুরোধ করে সে বারংবার বলে-“ফের আবার ওই রকম করে তাকাচ্ছিস মুখপানে।” স্ত্রীকে তাড়াতাড়ি রেশনের দোকান থেকে ফিরে রান্না করতে অনুরোধ করে, কেন-না মাঠ থেকে ফিরে আসার পর তার ‘ধড়ে যেন প্রাণ আর তিষ্ঠুতি চায় না।’

এইভাবে দারিদ্র্যজীর্ণ হয়েও জীবনবোধে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে কৃষাণ চরিত্রটি।

৫। “তুই আসবি সেই দুটোয়, তারপর রাঁধবি। তারপর খাব। একটু তাড়াতাড়ি ফিরিস।”- বক্তা কে? তিনি কাকে উদ্দেশ করে এ কথা বলেছেন? বলার কারণ ব্যাখ্যা করো। 

অথবা, 

“কেষ্টর মা-র সঙ্গে আগেভাগে গে নাইনির একেবারে সে পেরথমে দাঁড়াবি।”-বক্তা কে? তিনি কাকে উদ্দেশ করে এ কথা বলেছেন? এ কথা বলার কারণ ব্যাখ্যা করো।

বক্তা : বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটক থেকে উদ্ধৃত আলোচ্য অংশের বক্তা হল জনৈক কৃষাণ।

উদ্দিষ্ট: আলোচ্য উক্তিটি কৃষাণ তার স্ত্রীর উদ্দেশে করেছে।

উক্তিটির কারণ : পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত ‘আগুন’ নাটকটি সমকালীন সমাজবাস্তবতার প্রতিচ্ছবি। প্রতিনিয়ত ক্ষুধার আগুনে দগ্ধ হতদরিদ্র মানুষের বেঁচে থাকার সংগ্রাম এই নাটকে প্রতিফলিত হয়েছে। নাটকটির প্রতিটি দৃশ্যপট জুড়ে রয়েছে স্বল্পমূল্যে রেশন থেকে চাল-ডাল সংগ্রহের জন্য দরিদ্র থেকে মধ্যবিত্ত প্রতিটি পরিবারের ব্যস্ততা। সকাল সকাল লাইনে না দাঁড়ালে হবে না, ঠেলাঠেলি ভিড়ে মানুষ অপেক্ষা করতে থাকে, তারপরেও রেশনের চাল-ডাল পাওয়ার কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।

এমন অনিশ্চিত ভবিষ্যতের চিন্তায় রাতের ঘুমও ঠিকমতো হয় না। একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে সকলের ঘুম ভাঙে। কৃষাণও তেমনি ঘুম ভাঙার পর স্ত্রীকে অনুরোধ করে খুব তাড়াতাড়ি কেষ্টর মায়ের সঙ্গে লাইনে গিয়ে দাঁড়াতে। সে গোরু নিয়ে যাবে মাঠে। সারাদিন অভুক্ত থাকার পর দুপুরে ফিরে এসে ক্ষুধায় সে আর অপেক্ষা করতে পারে না। স্ত্রী দেরি করে ফিরলে রান্নাও হবে দেরিতে। তাই তার কাতর অনুরোধ, স্ত্রী যেন একটু তাড়াতাড়ি ফেরে।

৬। আগুন’ নাটকের তৃতীয় দৃশ্যের বর্ণনা দাও। ‘আগুন’ নাটকের প্রথম দৃশ্যে কারখানার শ্রমিকের যে পারিবারিক চিত্র প্রকাশিত হয়েছে তার বর্ণনা দাও।

তৃতীয় দৃশ্যের বর্ণনা : বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘আগুন’। এই নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে নাট্যকার তুলে ধরেছেন কারখানার শ্রমিকের পারিবারিক চিত্র।

তৃতীয় দৃশ্যের শুরুতে আমরা দেখতে পাই, দূরে কলের ভোঁ শোনা যাচ্ছে, আর বাড়ির ছোটো একটা বারান্দায় উবু হয়ে বসে আছে শ্রমিক সতীশ। সকালে কাক ডাকার শব্দ শোনা যাচ্ছে। ঘরের ভিতরে ঘুমোচ্ছে সতীশের স্ত্রী ও কন্যা। স্টেজে তাদের দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু সতীশ বারান্দায় বসে বিড়ি টানছে এটা লক্ষ করা যাচ্ছে। তার দৈহিক গঠন মজবুত, খালি গা, মাথার চুল উশকোখুশকো। খানিক বাদে মাথা চুলকে ঘাড় বেঁকিয়ে তার ঘুমন্ত মেয়েকে লক্ষ্য করে ডাকতে শুরু করে। ঘুমন্ত মেয়ে ও মাকে সতীশ সকালবেলা ‘কুম্ভকর্ণ’ বলে বসে। পাশে থাকা সহকর্মী জুড়োনকেও ডাকতে শোনা যায়। সংসার জীবন না করে জুড়োন যে ভালো আছে সেই আপশোশও শোনা যায় সতীশের মুখে। মন্বন্তরের কবলে পড়ে সতীশ সংসার টানতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছে। লাইনে দাঁড়িয়েও দোকান থেকে দু-মুঠো চাল পায় না সে। শেষমেশ প্রতিবেশী মিস্ত্রির কাছ থেকে প’দেড়েক চাল কর্জ করে গত রাত্রে কোনোক্রমে চালিয়েছে। আজ সকাল থেকে কারখানার কাজে বের হওয়ার আগেই পেটে খিদের ভীষণ জ্বালা শুরু হয়েছে, অর্থাৎ পেটে খিদের আগুন জ্বলছে। তাই সকাল সকাল দুটো খেয়ে কাজে বের হবে বলে মেয়েকে বারবার ডাকছে। সতীশের মেয়ের নাম ফুলকি। ফুলকি ও তার মা ক্ষিরি তাও ঘুম থেকে ওঠে না। এইবার সতীশ বিরক্ত বোধ করে এবং তাকে বলতে শোনা যায়- “হেই ফুলকি আরে নিকুচি কোরলো তোর ঘুমের। বলি তোদের ঘুমের জন্যে কি কারখানার গেট খোলা থাকবে নাকি?” অর্থাৎ, কারখানাতে প্রবেশ করার একটি নির্দিষ্ট টাইম আছে সেই টাইমে না প্রবেশ করলে সে আর প্রবেশ করতে পারবে না। তাই বাড়িতে যা আছে তাই দুটো খেয়ে সে দ্রুত রওনা দেবে। এদিকে কারখানার কাজ করলেও মেয়ে ও স্ত্রীর জন্য সতীশ দু-বেলা দুটো খাবার ঠিকঠাক জোগাড় করতে পারে না। আর কারখানাও যে শ্রমিকদের মিথ্যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে শুধু খাটিয়ে মারছে তা জুড়োন ও সতীশের কথোপকথনে জানা যায়। সকালবেলা সতীশের কর্কশ কণ্ঠে বিরক্ত হয়ে স্ত্রী ক্ষিরি বলে ওঠে- “নিজে হাতে করে আনলে তো কাল দেড় প’ চাল কর্জ করে। তার ভেতর এক প’ চালের ভাত তো নিজেই খেলে। এখন সকালবেলাই তোমার পিন্ডি জোগাই কোত্থেকে বলতো।” অর্থাৎ, গত কালকের ধার করা দেড় প’ চালের এক প’ সতীশ নিজেই খেয়ে ফেলেছে বাকি আর থাকা সম্ভব নয়। তাই খামোকা সকালবেলা চিৎকার করলেও তা অর্থহীন। এই কথা বলতে বলতে ক্ষিরি কেলোর বাবা কেলোর মাকে কত সুখে রেখেছে সেই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে। এই সমস্ত কথায় সতীশের মাথা গরম হয়ে যায়। শেষমেশ স্ত্রী ক্ষিরিকে সে লাথি মেরে বসে। ক্ষিরি তখন “ওরে বাপরে গেলাম গো, মেরে ফেললে গো…” বলে আর্তনাদ করে ওঠে। তৃতীয় দৃশ্যের শেষটায় এইভাবে মেয়ে ও মায়ের সমবেত চিৎকার শোনা যায়। আর সতীশ ‘যা মরগে যা’ বলে ছিটের হাফ শার্ট চাপিয়ে কাঁধে গামছা ফেলে দ্রুতবেগে প্রস্থান করে।

৭। “কিন্তু এদিকে যে ভারি মুশকিলেই পড়লাম।”-বক্তা কে? তার মুশকিলে পড়ার কারণ কী, ব্যাখ্যা করো।

বক্তা : আলোচ্য অংশটি সমাজসচেতন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা প্রথম একাঙ্ক নাটক ‘আগুন’ থেকে নেওয়া হয়েছে। উদ্ধৃতাংশের বক্তা হলেন তৃতীয় দৃশ্যের নায়ক সতীশ।

মুশকিলে পড়ার কারণ: নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য তৃতীয় দৃশ্যে যে চিত্র অঙ্কন করেছেন তা একটি উল্লেখযোগ্য সামাজিক চিত্রণ। এখানে সাধারণ খেটে-খাওয়া দিনমজুরের পারিবারিক জীবনকে নাট্যকার তুলে ধরেছেন। এখানে তুলে ধরেছেন সতীশ নামক একজন দিনমজুরের জীবনকাহিনি। সতীশ কারখানায় কাজ করে, সংসার তার স্ত্রী ও কন্যাকে নিয়ে। খাদ্যসংকটের কারণে সতীশ মুশকিলে পড়ে যায়। কারখানায় মজুরি করেও সে তার পরিবারকে দু-বেলা দু-মুঠো খাদ্য জোগান দিতে পারে না, পাড়ার মুদির দোকানে লাইন দিয়ে চাল কিনতে হয়। তাও আবার সবাই যে চাল পাবে এমনটা নয়, লাইনে দাঁড়াতে দেরি করলে খালি হাতে বাড়ি ফিরতে হবে। কথা প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সতীশ-জুড়োনকে এও বলতে শোনা যায় যে, জুড়োন একলা মানুষ, খাচ্ছেদাচ্ছে ফুর্তিতে আছে, তাকে অন্য কারওর খাবারের কথা ভাবতে হয় না, কিন্তু সতীশ সাংসারিক মানুষ বলে সংসারে থেকে তাকে বাকি মানুষগুলোর খাবারের কথাও ভাবতে হয়।

সতীশের এই প্রসঙ্গ উল্লেখ করে এও বলা যায় যে, খাদ্যের এমন পরিস্থিতিতে কোম্পানি, অর্থাৎ কারখানা চাল জোগাবে ভরসা দিয়েও তাদের চাল দিচ্ছে না। যেখানে তাদের মতো শ্রমিকেরা রাতদিন এক করে পরিশ্রম করে চলেছে সেখানে তাদেরই খাদ্যের জোগান নেই। এমতাবস্থায় সতীশ হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে পড়ে। সে কীভাবে তার সংসার বাঁচাবে, কীভাবে সে নিজে বাঁচবে সে বিষয়ে সে সন্দিহান হয়ে পড়ে। তাই সে বলে ওঠে- ‘ভারি মুশকিলেই পড়লাম।’

৮। “দেখ, মুখ সামলে কথা বলিস ক্ষিরি, এই বলে দিলাম। নইলে… (লাথি মারল।)”-কোন্ পরিস্থিতিতে বস্তা এরূপ আচরণ করে? তার এরূপ আচরণ কতটা সমর্থনযোগ্য?

পরিস্থিতি: গণনাট্য আন্দোলনের অন্যতম পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্যের প্রথম নাটক ‘আগুন’ বাংলায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দের ভয়াবহ মন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত। এই মারণ দুর্ভিক্ষে যারা জীবিত, তারা ক্ষুধার অন্ন জোগার করতে রীতিমতো হিমশিম খায়। মানুষের মৃত্যুমিছিল দেখে ইংরেজ সরকার বাধ্য হয় রেশনে স্বল্পমূল্যে খাদ্যশস্য বিক্রি করতে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় তা এতই নগণ্য যে ভোর থেকে লাইনে দাঁড়িয়েও মানুষ তা পায় না।

নাটকটির তৃতীয় দৃশ্যে কারখানার কর্মচারী সতীশের স্ত্রী ক্ষিরি আর মেয়ে ফুলকি সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়েও চাল পায়নি। রাতে সতীশ প’দেড়েক চাল ধার করে আনলে তাদের খাওয়া জোটে। সারাদিনের পরিশ্রমে ক্লান্ত সতীশ নিজেই সিংহভাগ ভাত খেয়ে ফেলে। পরেরদিন সকালে কারখানায় যাওয়ার আগে সতীশ আবার তাকে খেতে দিতে বলে। চাল অবশিষ্ট না থাকায় মা-মেয়ে কেউ কোনো কথা বলে না। শেষে সতীশের বারংবার ডাকাডাকিতে স্ত্রী ক্ষিরি রেগে গিয়ে কটুকথা বলে। শুরু হয় উভয়ের কলহ। এমতাবস্থায় কেলোর বাবা নামক জনৈক ব্যক্তির সঙ্গে সতীশের তুলনা করে তার স্ত্রী অপমানসূচক কথা বললে নিজের ক্রোধকে সংবরণ করতে না পেরে সতীশ স্ত্রীকে লাথি মারে।

আচরণের মূল্যায়ন : স্ত্রীকে লাথি মারার মতো ঘটনাকে কখনোই সমর্থন করা যায় না। পরিস্থিতি যেমনই হোক, ক্রোধকে সংবরণ করা এবং স্ত্রীর প্রতি ন্যূনতম সম্মান দেখানো যে-কোনো পুরুষের প্রাথমিক কর্তব্য। কিন্তু ঘটনার প্রেক্ষাপটও এখানে সমানভাবে দায়ী। সুতীব্র ক্ষুধা, চোখের সামনে প্রতিনিয়ত নিজেকে প্রতারিত হতে দেখা, তীব্র অসহায়তা মানুষকে বহুক্ষেত্রে চেতনাহীন করে তোলে। সতীশ সেই অন্ধ পরিস্থিতির শিকার। স্ত্রীকে লাথি মারার জন্য সতীশের চেয়ে দুর্ভিক্ষ সৃষ্টিকারী ইংরেজ ও দুর্নীতিগ্রস্ত স্বজাতীয়রা অনেক বেশি দায়ী।

৯। “ওরে বাপরে গেলাম গো, মেরে ফেললে গো…”-বক্তা কে? বক্তার এরকম চিৎকারের কারণ ব্যাখ্যা করো।

বক্তা : নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটক থেকে উদ্ধৃত আলোচ্য অংশটির বক্তা হল সতীশের স্ত্রী ক্ষিরি।

বক্তার চিৎকারের কারণ: ‘আগুন’ নাটকের তৃতীয় দৃশ্যে দেখা যায় কারখানার শ্রমিক সতীশ, তার স্ত্রী ক্ষিরি ও কন্যা ফুলকিকে। মন্বন্তর ও কালোবাজারির দৌলতে এই পরিবারও অন্নাভাবে আক্রান্ত। সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়েও দোকান থেকে দু-মুঠো চাল তারা পায় না। শেষমেশ প্রতিবেশী মিস্ত্রির কাছ থেকে প’ দেড়েক চাল কর্জ করে একটি রাত্রে তারা কোনোক্রমে চালিয়েছে। কিন্তু পরের দিন সকাল থেকেই আবার খিদের ভীষণ জ্বালা শুরু হয় সতীশের। তাই দুটো খেয়ে কারখানায় যাবে বলে মেয়েকে বারবার ডাকতে থাকে। ফুলকি ও তার মা ক্ষিরি তাও ঘুম থেকে ওঠে না। এইবার সতীশ বিরক্তি বোধ করে এবং তাকে বলতে শোনা যায়- “…নিকুচি কোরলো তোর ঘুমের। … সেই কবে থেকে ডাকছি। বলছি কি আছে দে দুটো খেয়ে বেরিয়ে পড়ি। যেয়ে ঠেলতে হবে তো আবার ঘানি সারা দিনমান।” কিন্তু সতীশের এই কথায় ক্ষিপ্ত হয়ে পড়ে ক্ষিরি। সে বলে ওঠে-“…আনলে তো কাল দেড় প’ চাল কর্জ করে। তার ভেতরে এক প’ চালের ভাত তো নিজেই খেলে। এখন সকালবেলাই তোমার পিন্ডি জোগাই কোত্থেকে বলতো।” তবে ক্ষিরি এখানেই থেমে থাকে না কেলোর বাবা কেলোর মা-কে কতটা সুখে রেখেছে সেই প্রসঙ্গ তুলে সতীশকে খোঁটা দেয়। এই সমস্ত কথায় সতীশের মাথা গরম হয়ে যায় ও শেষমেশ সে ক্ষিরিকে লাথি মেরে বসে। সতীশের আঘাতেই ক্ষিরি চিৎকার করে ওঠে।

১০। “সে সব কেলেঙ্কারির কথা আর বোলো না গিন্নি।”-বক্তা কে? এখানে কোন্ কেলেঙ্কারির কথা বলা হয়েছে?

বক্তা : নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটক থেকে উদ্ধৃত আলোচ্য উক্তির বক্তা হলেন মধ্যবিত্ত কেরানি হরেকৃষ্ণ।

কেলেঙ্কারির প্রসঙ্গঃ ‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে নাট্যকার মধ্যবিত্ত কেরানি হরেকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী মনোরমার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে ইংরেজ কোম্পানি কীভাবে কালোবাজারিকে প্রশ্রয় দিচ্ছিল তা প্রকাশ করেছেন। এই কালোবাজারির প্রসঙ্গই এখানে ‘কেলেঙ্কারি’ বলে চিহ্নিত হয়েছে। দোকান থেকে চাল কিনতে যাওয়া বিষয়ে কথোপকথনকালে মনোরমা হরেকৃষ্ণকে জিজ্ঞাসা করেন-“… এই না শুনলুম তোমার মুখ থেকে সেদিন যে অফিস থেকে বাবুদের সব দেওয়া থোওয়ার ব্যবস্থা হবে, তার কী হল!” এ কথা শুনেই হরেকৃষ্ণ ‘কেলেঙ্কারি’-র কথাটি বলে। সে বলে যে, বাবুদের নামে শস্তা দরে চাল-ডাল এনে কোম্পানির কর্তারা সেগুলো চড়া দামে বাজারে ছেড়ে দিচ্ছে। “ব্যবসা, খালি ব্যবসা।” এই ব্যাবসার ফল ভোগ করতে হচ্ছে সাধারণ কর্মীদের। হরেকৃষ্ণ বলে-“এদিকে লোকে জানছে যে আমরা খুব শস্তা দরে চাল ডাল পাচ্ছি। আসলে কিন্তু তার সুবিধে ভোগ করছে ম্যানেজার আর তার মোসাহেবরা।” অফিস কর্তৃপক্ষ যেখানে সরকারি কর্মীদের কাছে রক্ষক হয়ে উঠতে পারত সেখানে তারাই হয়ে উঠেছে ভক্ষক। চুরি ও জোচ্চুরির জালে আটক হয়ে সমাজে সাধারণ মানুষের যেভাবে কণ্ঠাগতপ্রাণ হয়ে পড়ে এবং উপরতলার মানুষগুলির ধনভাণ্ডার যেভাবে ফুলেফেঁপে ওঠে তাকেই এখানে ‘কেলেঙ্কারি’ বলা হয়েছে।

১১। “যে রক্ষক সেই হল গিয়ে তোমার ভক্ষক।”-বক্তা কে? আলোচ্য অংশটি কোথা থেকে নেওয়া হয়েছে? উচ্ছৃত্তাংশটির ব্যাখ্যা করো।

বক্তা : ‘আগুন’ নাটক থেকে গৃহীত উদ্ধৃতাংশের বক্তা হলেন মধ্যবিত্ত কেরানি হরেকৃষ্ণ।

উৎস : আলোচ্য অংশটি বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্য থেকে নেওয়া হয়েছে।

ব্যাখ্যা: চতুর্থ দৃশ্যের নায়ক হরেকৃষ্ণর একজন সরকারি কেরানি। তবে সে সরকারি অফিসে কাজ করলেও সংসারে খাদ্য জোগান দিতে অপারগ। স্ত্রী মনোরমার সঙ্গে কথোপকথনে স্পষ্টতই বোঝা যায় যে, সেই সময়ে আর্থিক অনটন ছিল চরম পর্যায়ে। হরেকৃষ্ণর অফিস থেকে চাল দেওয়ার প্রসঙ্গে আলোচ্য উদ্ধৃতাংশটি উল্লিখিত হয়েছে। ‘যে রক্ষক সেই ভক্ষক’ কথাটির অর্থ হল রক্ষাকর্তাই ভক্ষণকারী বা ভোগবিলাসী। অর্থাৎ, যিনি রক্ষাকারী প্রহরী তিনিই যদি আত্মসাৎ করতে উদ্যত হন তাহলে সাধারণ মানুষের সেখান থেকে কোনো কিছু পাওয়ারই আশা থাকে না। হরেকৃষ্ণর অফিসের ঘটনাটিও ঠিক তাই। অফিসের ম্যানেজার ও মোসাহেবরা নিজেদের আখের গোছাতেই ব্যস্ত। সাধারণ কর্মচারীদের কথা তারা বিন্দুমাত্র ভাবে না। তাদের নামে বরাদ্দ চাল তারা মোটা দড়ে বাজারে বিক্রয় করে দেয়। এসব কারণেই অফিস থেকে যে সাহায্যের কথা মনোরমা তার স্বামী হরেকৃষ্ণর কাছে শুনেছিল, তার কথাই সে তার স্বামীকে জিজ্ঞাসা করলে হরেকৃষ্ণ বলে ওঠে- “যে রক্ষক সেই হল গিয়ে তোমার ভক্ষক।”

১২। “আগুন! আগুন!”-প্রসঙ্গসহ আলোচনা করো।

প্রসঙ্গ: সমাজসচেতন নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘আগুন’ নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে চালের দোকানের লাইনে দাঁড়ানো যুবক প্রশ্নোক্ত কথাটির বক্তা। চালের লাইনে দাঁড়ানো মানুষদের ওপর সিভিক গার্ড নানারকম অনাচার করতে থাকে। এমনই এক অনাচারের শিকার হয় ৪র্থ পুরুষ। আচমকাই চপেটাঘাত করে সিভিক গার্ড তাকে বারবার লাইন ছেড়ে বেরিয়ে যাওয়ার মিথ্যে অপবাদে দুষতে থাকে। তবে তার এই অন্যায়ের প্রতিবাদ করে লাইনে দাঁড়ানো অন্যান্যরা এবং সেই প্রতিবাদকে কেন্দ্র করে যখন সিভিক গার্ড ৪র্থ পুরুষকে ঘুসি মারতে উদ্যত হয় সেই পরিস্থিতিতেই যুবক “আগুন! আগুন!” করে চেঁচিয়ে ওঠে।

ব্যাখ্যা: উত্তপ্ত পরিবেশকে ঠান্ডা করতে যুবকটি “আগুন! আগুন!” বলে ওঠে। তবে তার এই কথা অপ্রাসঙ্গিক ছিল না। তাদের ওই মুহূর্তে যে ধরনের সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়েছিল তার জন্য দায়ী সমকালীন মন্বন্তরবিদ্ধ সমাজ। তেতাল্লিশের মন্বন্তর ও কালোবাজারির প্রেক্ষাপটে ধনী-দরিদ্র-উচ্চনীচ নির্বিশেষে খাদ্যচিন্তায় আপতিত তখন সকলেই। সমাজে তখন জ্বলছে কালোবাজারি, দুরাচার ও দুর্নীতির আগুন এবং সাধারণ মানুষের পেটে তখন ক্ষুধার আগুন। এই খিদের জ্বালায় সকলেই ভোর থেকে দোকানে লাইন দিচ্ছিল যাতে সেদিনের মতো অন্নসংস্থানটুকু হয়। তাই তারা যেমন লাইন ছেড়ে বেরোনোর ভুল করবে না, তেমনি তাদের মারধোর করা বা চাল থেকে বঞ্চিত করার মতো কাজ কেউ করলে তার প্রতিবাদ করতেও সাধারণ মানুষ ভুলবে না। ‘আগুন’ শব্দটি মূলত সাধারণ মানুষের শারীরিক ও মানসিক অবস্থাকেই দ্যোতিত করছে। আর বারবার ‘আগুন’ কথাটি বলে যুবক তাদের জীবনের দুরবস্থার প্রাবল্যকেই বুঝিয়েছে।

১৩।”এ কী বলছেন আপনি! লাইন ছেড়ে গেছি! আমি! কী আশ্চর্য।”-কে, কাকে উদ্দেশ করে উক্তিটি করে? উভয়ের মধ্যে ঘটে যাওয়া বাদানুবাদের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও।

অথবা

“সিভিক গার্ড লোকটিকে ঘুসি মারতে উদ্যত হয়। সঙ্গে সঙ্গে লোকটিও ওকে জাপটে ধরে।”-আলোচ্য অংশে লোকটি কে? নাট্যদৃশ্যটিতে এরূপ পরিস্থিতি তৈরি হওয়ার কারণ *আলোচনা করো।

লোকটি : বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকে চালের দোকানের সামনে লাইন দিয়ে দাঁড়ানো ৪র্থ পুরুষ চরিত্রটিকে ‘লোকটি’ বলে উল্লেখ করা হয়েছে, যে সিভিক গার্ডকে উদ্দেশ করে আলোচ্য উক্তিটি করে।

বাদানুবাদের পরিচয়

বাদানুবাদের কারণ: চালের দোকানের সামনে মানুষের অপেক্ষারত দীর্ঘ লাইন নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন সিভিক গার্ড নিয়োগ করা হয়। কর্তব্যনিষ্ঠা দেখাতে গিয়ে সে অন্যায় আচরণ করে। লাইনে দাঁড়ানো এক দুস্থ চেহারার লোকের গালে হঠাৎ চর মারে সে, তার ধারণা লোকটি লাইনে বারবার ঢুকছে আর বেরোচ্ছে এবং সেই সুযোগে চাল জমা করে রাখছে। সিভিক গার্ডের এই আচরণ থেকেই বিতর্ক শুরু হয়।

বাদানুবাদের পরিণতি: এই বাদানুবাদ দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকে এবং ঘটনাক্রমে অনেকে এর মধ্যে জড়িয়ে পড়ে। ৪র্থ পুরুষ ব্যক্তিটি প্রথমে একটু কাঁচুমাচু হয়েই সিভিক গার্ডের অভিযোগের প্রতিবাদ করে। তার পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা ৩য় পুরুষও সিভিক গার্ডকে তার অন্যায় আচরণের জন্য ধিক্কার জানায়। কিন্তু সিভিক গার্ড তার আচরণের যথার্থতায় অনড়। কথায় কথা বাড়তে থাকে। পাঁচ-ছয় ক্রোশ দূর থেকে একটু চাল নিতে আসা গরিব লোকটির সঙ্গে এই আচরণ মেনে নিতে পারে না অনেকেই। দুই দিন স্ত্রী-সন্তানসহ সেই ব্যক্তি অনাহারে আছে। জোর গলায় বারংবার বলছে যে চাল চুরি করেনি। এরই মধ্যে হরেকৃষ্ণর বেফাঁস কথায় পরিস্থিতি ঘোরালো হয়ে ওঠে। সিভিক গার্ড চরম দাম্ভিকতায় ৪র্থ পুরুষটিকে ‘যা ভাভাগ’ বলে তাড়িয়ে দিলে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে ব্যক্তিটি। বাদানুবাদ ক্রমে হাতাহাতির পর্যায়ে চলে যায়। পরে জনৈক যুবক ‘আগুন! আগুন!’ বলে হঠাৎ চিৎকার করে উঠলে এই উত্তপ্ত পরিবেশ নিয়ন্ত্রণে আসে।

১৪। “মানুষ নাকি।”-কাকে লক্ষ্য করে, কার উক্তি? কোন্ পরিস্থিতিতে বক্তা উক্তিটি করে? উক্তিটির মধ্য দিয়ে সমকালীন সমাজের যে প্রতিচ্ছবি প্রকাশ পেয়েছে তার পরিচয় দাও।

বক্তা ও শ্রোতা : বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে জনৈক সিভিক গার্ড ৪র্থ পুরুষ হিসেবে চিহ্নিত ব্যক্তিটিকে লক্ষ্য করে আলোচ্য উক্তিটি করে।

পরিস্থিতি : চালের দোকানের সামনে অপেক্ষারত মানুষের দীর্ঘ লাইন নিয়ন্ত্রণের জন্য একজন সিভিক গার্ড নিয়োগ করা হয়। কর্তব্যনিষ্ঠা দেখাতে গিয়ে সে লাইনে দাঁড়ানো ৪র্থ পুরুষটির গালে হঠাৎ চর মারে, তার ধারণা লোকটি লাইনে বারবার ঢুকছে আর বেরোচ্ছে এবং সেই সুযোগে চাল জমা করে রাখছে। লোকটি প্রতিবাদ করে। তার প্রতিবাদে শামিল হয় ৩য় পুরুষটিও। শুরু হয় বাদানুবাদ।

সিভিক গার্ড চরম দাম্ভিকতায় ৪র্থ পুরুষটিকে ‘যা ভাগ ভাগ’ বলে তাড়িয়ে দিলে লোকটির আত্মসম্মানে আঘাত লাগে। সে অপমানিত কণ্ঠে বলে ওঠে “আমি কুকুর নই”। তখনই সিভিক গার্ড আলোচ্য উক্তিটি করে।

সমাজের প্রতিচ্ছবিঃ ঔপনিবেশিক ইংরেজদের স্বার্থসিদ্ধি ও এদেশের কিছু বর্বর মজুতদার ও কালোবাজারির নির্মমতার ফলশ্রুতিস্বরূপ প্রবল খাদ্যাভাব থেকে বাংলার বুকে নেমে আসে করাল দুর্ভিক্ষ। লক্ষাধিক মানুষ শুধু না খেতে পেয়ে মারা যায়। একটু খাদ্যের সন্ধানে গ্রামগঞ্জের মানুষ কলকাতার রাস্তাঘাটে জড়ো হয়। খাবারের সন্ধানে পশুর মতো আচরণ করতে থাকে বুভুক্ষু মানুষ। নিজের মানব সত্তা ভুলে গিয়ে • তারা যেন এক-একটা পশু সত্তায় পরিণত হয়। তাই সিভিক গার্ডের এই অশালীন বক্রোক্তিটি তৎকালীন সমাজের বাস্তব চিত্রটিকেই প্রতিফলিত করে।

১৫। “এই যে, বড্ড খাঁটি কথা বলেছ হে। বড্ড খাঁটি কথা…।।”- কাকে উদ্দেশ করে, কার এই উক্তি? কোন্ প্রসঙ্গে তিনি এই উক্তিটি করেন? তাঁর এই উক্তিটি কি যথাযথ? – ব্যাখ্যা করে বুঝিয়ে দাও।

বক্তা ও শ্রোতা: গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকের পঞ্চম দৃশ্যে হরেকৃষ্ণ জনৈক ওড়িয়া ব্যক্তিকে উদ্দেশ করে আলোচ্য উক্তিটি করেন।

প্রসঙ্গ : পঞ্চাশের মন্বন্তরের পরিপ্রেক্ষিতে রচিত এই নাটকে দেখা যায় দুর্ভিক্ষপীড়িত মানুষ একটু চাল কেনার জন্য দোকানের সামনে ভিড় করে দাঁড়িয়ে আছে। হিন্দু-মুসলমান- হতদরিদ্র-মধ্যবিত্ত-ব্রাহ্মণ-অব্রাহ্মণ সব একাকার হয়ে গেছে এখানে। দোকানি বিস্মিত। তার বিস্ময়পূর্ণ হতাশার উত্তরে ওড়িয়া ব্যক্তিটি বলে, চাল সবাই খায়-হিন্দুও খায়, মুসলমানও খায়, এমনকি সাহেব লোকও খায়। এইখানে সবাই এক। ওড়িয়া লোকটির এই কথার পরিপ্রেক্ষিতে হরেকৃষ্ণ আলোচ্য উক্তিটি করে।

উক্তির যথার্থতাঃ জাতধর্ম, ধনী-নির্ধন, ছুত-অদ্ভুত এ সবকিছুই হল মানুষের তৈরি এক-একটি প্রহেলিকা। চরমতম বিপদেও দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার আগে পর্যন্ত মানুষ এই বিভাজন আঁকড়ে পৃথক হয়ে থাকতে ভালোবাসে। কিন্তু সমগ্র জাতি যখন মৃত্যুমুখে পতিত হয়, যখন খাদ্যের অভাবে জীবনধারণ অসম্ভব হয়ে পড়ে তখন এই কৃত্রিম ভেদাভেদ ভুলতে তারা বাধ্য হয়। পেটের ক্ষুধার কাছে কোনো মিথ্যা পরিচয় টিকে থাকতে পারে না। ওড়িয়া ব্যক্তিটির বক্তব্যের মধ্য দিয়ে এই সারসত্যটি প্রকাশিত হয়েছে। হরেকৃষ্ণ তা উপলব্ধি করেছে। তাই ওড়িয়া ব্যক্তিটির বক্তব্যকে সমর্থন করে সে যে কথাটি বলে তা অবশ্যই যথাযথ।

১৬। “খালি গা, মাথার চুল উস্কোখুস্কো – মজবুত শরীর।” – উদ্দিষ্ট ব্যক্তির চরিত্র বিশ্লেষণ করো।

অথবা

সতীশ চরিত্রটি বিশ্লেষণ করো।

সতীশ চরিত্র বিশ্লেষণ : পঞ্চাশের মন্বন্তরের পটভূমিতে রচিত ‘আগুন’ নাটকটির তৃতীয় দৃশ্যে স্বল্প পরিসরে উপস্থিত থেকেও সতীশ চরিত্রটি বিশেষভাবে আলোচনার দাবি রাখে।

পেশাগত দিক : সতীশ চরিত্রটি একজন কারখানার সাধারণ শ্রমিক। পেশার প্রতি তার আনুগত্যের খামতি লক্ষ করা যায় না, সে যথেষ্ট সময় সচেতন। তাই সকালে দু-মুঠো খেয়ে সে কারখানায় যায়। নাট্যদৃশ্যটিতে দেখা যায়, কারখানায় যাওয়ার জন্য সে স্ত্রী ও কন্যার ঘুম ভাঙিয়ে তাকে খাবার দিতে বলছে।

প্রতিবেশীর প্রতি আনুগত্য: সতীশের প্রতিবেশী মিস্ত্রির সঙ্গে তার সম্পর্ক খুবই ভালো, তা নাহলে বিপদের সময় যখন সামান্য চালও মহার্ঘ্য তখন মিস্ত্রি তাকে চাল ধার দিত না। সতীশের সহকর্মী জুড়োনের সঙ্গেও তার সম্পর্ক খুব ভালো। জুড়োনের সঙ্গে কথপোকথনে সতীশের পারিবারিক জীবনের দুর্দশার কথা বেরিয়ে আসে। পারিবারিক অশান্তি প্রসঙ্গে, তার মতো বিয়ে না করায় জুড়োন কতটা ভালো আছে এসব ব্যাপারে সে নির্দ্বিধায় জুড়োনের সঙ্গে আলোচনা করতে পারে।

সাংসারিক দিক : নাটকের তৃতীয় দৃশ্যের কেন্দ্রীয় চরিত্র সতীশ একজন সাংসারিক মানুষ। পেশায় সে কারখানার শ্রমিক। সংসারে তার যে দায়দায়িত্ব একেবারেই নেই তা কিন্তু নয়। সংসারে তার মন আছে বলেই সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠে কারখানায় যাওয়ার জন্য সে ব্যস্ত হয়ে ওঠে। বাড়ির বউ-মেয়েকে সে হয়তো অন্য সব পরিবারের মতো সুখস্বাচ্ছন্দ্যে ভরিয়ে দিতে পারেনি কিন্তু সে চেষ্টা করে সংসারকে ভালো রাখতে। শেষমেশ পরিস্থিতি যখন প্রতিকূল, সংসারে খাদ্য জোগান দিতে সে যখন অপারগ তখন তার মাথায় রাগ ওঠে, নিজেকে ঠিক রাখতে পারে না। সেসময় বিরক্ত হয়ে সে বউয়ের গায়ে হাত তুলতে ও লাথি মারতেও দ্বিধাবোধ করে না।

অসহায়তা : মন্বন্তরক্লিষ্ট সকলের মতোই সতীশও ভীষণ অসহায় এক চরিত্র। সে সবকিছুর ওপর ভরসা রাখতে চায়, কিন্তু পরিস্থিতির বিরূপতায় সেই ভরসা হারিয়ে ফেলে।

সহকর্মী জুড়োনের সঙ্গে কথাবার্তায় তার এই অসহায়তা প্রকট হয়ে পড়ে। চালের জন্য দোকানের সামনে ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইন দিলেও তার স্ত্রী ও কন্যা চাল পায় না, শেষে প্রতিবেশী মিস্ত্রির কাছ থেকে চাল ধার করে রাতের খিদে মেটায়। কোম্পানি চাল দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে না। তার প্রতিক্রিয়ায় সেই ক্ষোভ ও অসহায়তা ঝড়ে পড়ে-“কোম্পানির ভরসা করব না, দোকানের ভরসা করব না…শালা কারবারে ঘেন্না ধরিয়ে দিলে।”

অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধ : ঘরে চাল নেই, গত রাতে ধার করে আনা চালের সিংহভাগ ভাত সতীশ নিজেই খেয়েছে। তবু সকালে খেতে দেওয়ার জন্য বারংবার ডাকাডাকিতে তার স্ত্রী রেগে গেলে, কটু কথা বললে, পরিচিত এক ব্যক্তি কেলোর সঙ্গে সতীশের তুলনা করে তাকে অপমান করলে সতীশ ক্রোধ সংবরণ করতে পারে না এবং স্ত্রীকে লাথি মেরে আঘাত করে। স্ত্রীকে কটুকথা বলে সে বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়।

এইভাবে নাট্যকারের সুদক্ষ পরিকল্পনায় সতীশ চরিত্রটি মন্বন্তরক্লিষ্ট সময়ে নিম্নবিত্ত অসহায় এক কারখানা শ্রমিকের জীবন্ত প্রতিচ্ছবি হয়ে উঠেছে।

১৭। আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যের বর্ণনা দাও।

অথবা

‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে হরেকৃষ্ণ ও মনোরমার কথোপকথনের মধ্য দিয়ে যে চিত্রটি ফুটে উঠেছে তা নিজের ভাষায় লেখো।

চতুর্থ দৃশ্যের বর্ণনা : বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘আগুন’ নাটকের চতুর্থ দৃশ্যে নাট্যকার মধ্যবিত্ত কেরানির পারিবারিক জীবনের চিত্র তুলে ধরেছেন।

চতুর্থ দৃশ্যে কেরানি হরেকৃষ্ণ ও তার স্ত্রী মনোরমার কথোপকথন বর্ণিত হয়েছে। কেরানি হরেকৃষ্ণ ও মনোরমাদের আর্থিক স্বচ্ছলতা থাকলেও খাদ্যাভাব থেকে মুক্ত নয়। তাদের পরিবারেও চাল, চিনি, চা না থাকার দৃশ্য লক্ষ করা যায়। অফিসে কাজ করলেও অফিস থেকে চাল দেওয়ার বা সহযোগিতা করার কোনো লক্ষণ দেখতে পাওয়া যায় না। প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকলেও তা পূরণের কোনৌ আশা হরেকৃষ্ণ করে না। তাই অফিসে কাজ করার পাশাপাশি হরেকৃষ্ণর চালের দোকানে লাইন দেওয়ার কথাও উল্লেখ করা হয়। নাট্যকার চতুর্থ দৃশ্যের মাধ্যমে মূলত একটি বিষয় স্পষ্টতই উল্লেখ করেছেন, তৎকালীন সামাজিক পরিস্থিতির জন্য সকলেই ভুক্তভোগী, অর্থাৎ সকলকেই এই দুর্ভোগের শিকার হতে হচ্ছে। কী ধনী কী দরিদ্র কেউই এই জাঁতাকলের বাইরে নয়। চালের দোকানে সেই ভোরবেলা থেকে লাইন পড়ছে। তবে লাইনে দাঁড়ালেই যে চাল পাওয়া যাবে এমনটাও নয়। যদি চাল দিতে দিতে শেষ হয়ে যায় তাহলে খালি হতে বাড়ি ফেরা ছাড়া উপায় থাকবে না। আর এই পরিস্থিতিতে মনোরমা ভোঁদার কাছ থেকে শুনেছে আজ নাকি দু-সের করে চাল দেবে। তাই স্বামী হরেকৃষ্ণকে অফিসের যাওয়ার কথা ভুলে চালের দোকানে লাইন দেওয়ার কথা বলে। কথা প্রসঙ্গে যখন অফিস থেকে চাল দেওয়ার কথা ওঠে তখন হরেকৃষ্ণ বলে- “(বিরক্ত হয়ে)। সে সব কেলেঙ্কারির কথা আর বোলো না গিন্নি।”-অর্থাৎ বাবুদের নামে, মোসাহেবদের নামে যে চাল বরাদ্দ হচ্ছে, সেই চাল বাজারে কালোবাজারি করে চড়া দামে বিক্রয় করা হচ্ছে। ফলে খেটে-খাওয়া গরিব মানুষদের অবশ্যম্ভাবীভাবে না খেতে পেয়ে মরতে হবে। গতবারে সিভিক গার্ডের হাত ধরে কিছু চিনি জোগাড় করতে পেরেছিল হরেকৃষ্ণ, এবারেও যেন কিছু চিনি জোগাড় করা যায় তা বলতে শোনা গেল মনোরমার মুখ থেকে। কথোপকথন শেষে চালের ব্যাগ নিয়ে ঠাকুর প্রণাম করে দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা দেয় হরেকৃষ্ণ।

১৮। নাটকের পঞ্চম দৃশ্যের বর্ণনা দাও।

পঞ্চম দৃশ্যের বর্ণনা

নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা ‘আগুন’ নাটকের পঞ্চম দৃশ্যের শুরুতেই লক্ষ করা যায় দিনের আলোতে সমুজ্জ্বল চালের দোকানের সামনে একটা লাইন এঁকেবেঁকে দাঁড়িয়েছে।

লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজনের মধ্যে হই-হট্টগোল শোনা যায়। মহামন্বন্তরের কঠিন পরিস্থিতিতে ধনী-দরিদ্র-মধ্যবিত্ত সবাই খাদ্যসংকটে জর্জরিত। তাই সব শ্রেণির ঠাঁই হয়েছে চালের দোকানের লাইনে। হরেকৃষ্ণ সামনে দাঁড়িয়ে থাকা ওড়িয়াকে লক্ষ্য করে বলতে থাকে- “উড়িষ্যা থেকে নাকি লক্ষ লক্ষ মন চাল এসে পড়েছে। এ চাল উঠল কোথায়!” তার এই বক্তব্যকে কেন্দ্র করে লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে বাদানুবাদ চলতে থাকে। তবে এতে বাধ সাধে মোটা নাদুসনুদুস ভুঁড়িওয়ালা দোকানির আগমন। দোকানি তার গদি-চেয়ারে বসলে সিভিক গার্ডকে লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষদের উদ্দেশে বলতে শোনা যায়-টিকিট না থাকলে চাল মিলবে না এবং এও জানায় যে, খুচরো টাকা রাখতে হবে নাহলে চাল পাওয়া মুশকিল। তারপর লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা ব্যক্তিদের মধ্যে ২য় পুরুষ নামক একজনের সঙ্গে সিভিক গার্ডের বচসা বাঁধে। তাকে লাইন থেকে সে বের করে দিতে চায়। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষজন অসহায় মানুষটির হয়ে সওয়াল করে। এরপর মিথ্যে অপবাদ দিয়ে ৪র্থ পুরুষকে গার্ড লাইন থেকে তাড়াতে চাইলে সেই ৪র্থ পুরুষ বারবার অনুরোধ করে যে সে কোনোরূপ অপরাধ করেনি, দুটো চালের আশায় সকাল থেকে সে লাইনে দাঁড়িয়ে রয়েছে। এত অনুনয়-বিনয় করার পরও সিভিকের মন গলে না। তবে যখন সে শেষে ৪র্থ পুরুষকে মারতে উদ্যত হয় তখন ৪র্থ পুরুষও ওকে জাপটে ধরলে গণ্ডগোল শুরু হয়ে যায়। চারিদিকে যখন উত্তাল পরিবেশ, তখন একজন যুবকের হস্তক্ষেপে গণ্ডগোল পণ্ড হয়ে যায়। যুবকটি যখন “আগুন! আগুন!” বলে চিৎকার করে ওঠে তখন আগুনের প্রসঙ্গকে কেন্দ্র করে পরিবেশ ঠান্ডা হয়।

চাল বিক্রির কাজ যখন সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হচ্ছে তখন দোকানিকে লক্ষ্য করে মুসলিম ভাই বলতে থাকেন-আজ যেন সবাই চাল পান। কেউ যেন বাদ না যান। উত্তরে দোকানি তাকে কেটে পড়তে বলে। পরে দোকানির মুখ থেকেই শোনা যায়- “… বাব্বা! লুঙ্গি, টিকি, পৈতে, টুপি সব একাকার হয়ে গেছে।” তাই ব্যবসায় আর সুখ পাওয়া যাবে না। দোকানির কথা শুনে ওড়িয়া তার নিজের চাল বাঁধতে বাঁধতে বলে যে হিন্দু, মুসলমান, সাহেব সবাই চাল খাবে তাই সবাই এক হয়ে গেছে। আর এরা যদি চাল না খায় তোমার বাণিজ্য কেমন করে চলবে। ওড়িয়া ব্যক্তির কথা শুনে হরেকৃষ্ণ বলে- “বড্ড খাঁটি কথা বলেছ হে।” এরপর লাইনে দাঁড়ানো ব্যক্তিদের মধ্যে কথোপকথনের মধ্য দিয়ে একতা ও সমন্বয়ের প্রয়োজনীয়তার দিকটি ফুটে ওঠে ও একসময় সকলেই প্রস্থান করে।

১৯। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকটি যে প্রেক্ষাপটে রচিত তার পরিচয় দাও।

প্রেক্ষাপটঃ গণনাট্য আন্দোলনের পুরোধা, সমাজতান্ত্রিক আদর্শের পথিক বিজন ভট্টাচার্যের ‘আগুন’ নাটকটির প্রেক্ষাপটে রয়েছে পঞ্চাশের মন্বন্তরের ভয়ংকর পটভূমি।

প্রথমতঃ সমগ্র পৃথিবীর ওপর সাম্রাজ্যবাদী দেশগুলির দখলদারির প্রতিযোগিতার অনিবার্য পরিণতি ১৯৩৯ খ্রিস্টাব্দের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই যুদ্ধে ভারতের কোনো স্বার্থ জড়িত না থাকলেও ঔপনিবেশিক ইংরেজ জোর করে ভারতকে এই যুদ্ধে জড়িয়ে ফেলে। যুদ্ধাস্ত্র ক্রয়ের অর্থ এবং সৈনিকদের খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্য ইংরেজ সরকার চাষিদের কাছ থেকে বলপূর্বক অল্পমূল্যে খাদ্যশস্য কিনে মজুত করতে থাকে। তাদের সেই কাজে সহায়ক হয় এদেশেরই নরপিশাচ কালোবাজারি শক্তি। ফলে অচিরেই খাদ্যশস্যে কৃত্রিম সংকট তৈরি হয়।

দ্বিতীয়তঃ ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দে ভারতছাড়ো আন্দোলনের প্রবল ঢেউ আছড়ে পড়ে মেদিনীপুর জেলায়। ব্রিটিশবিরোধী এই আন্দোলন দমন করার জন্য ইংরেজ রাজশক্তি নির্মমভাবে ধ্বংস করে দেয়ে গ্রামগঞ্জ। চাষের অভাবে একরের পর এক জমি নিস্ফলা হয়ে যায়।

তৃতীয়তঃ পরিস্থিতি যখন বিরূপ তখন জাপানের আক্রমণের সম্ভাবনায় ‘পোড়ামাটি নীতি’ গ্রহণ করে আগুন জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয় শস্যখেত। যার ফলে শুরু হয় তীব্র খাদ্যসংকট।

চতুর্থত: ১৯৪২ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে প্রচণ্ড ঘূর্ণিঝড় ও সামুদ্রিক বন্যার তাণ্ডব আছড়ে পড়ে মেদিনীপুর ও চব্বিশ পরগনা জেলার উপর।

সময়ের ‘নির্মম পরিহাসে অন্ন-বস্ত্র-গৃহহীন মানুষ গাঁ- গঞ্জের ভিটেমাটি ছেড়ে জড়ো হতে থাকে শহরে। শহরের কালোবাজারি ও মুনাফাখোররা সুযোগ বুঝে বাংলার নানা প্রান্ত থেকে অবশিষ্ট শস্যসামগ্রী বলপূর্বক কেড়ে নিয়ে মজুত করতে থাকে। ভয়াবহ এই নির্মমতার ফলশ্রুতিতে বাংলা জুড়ে নেমে আসে দুর্ভিক্ষ।

বিজন ভট্টাচার্যের মতো সাহিত্যিকরা চুপ থাকতে পারেননি। তাঁদের লেখনীতে ফুটে ওঠে এই নির্মমতা ও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদের ছবি। ‘আগুন’ নাটকটি তারই এক প্রতিচ্ছবি।

২০। নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্য রচিত ‘আগুন’ নাটকটিতে সমকালীন সমাজবাস্তবতার যে প্রকাশ ঘটেছে তার পরিচয় দাও।

সমাজবাস্তবতা

সমকালীন দুর্ভিক্ষপীড়িত সমাজ : ভারতীয় গণনাট্য সংঘের প্রতিষ্ঠা পর্বের নাট্যকার বিজন ভট্টাচার্যের লেখা প্রথম নাটক ‘আগুন’। এই নাটকের পটভূমি বাংলায় ১৩৫০ বঙ্গাব্দের ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ। মনুষ্যসৃষ্ট এই দুর্ভিক্ষে অনাহার আর অপুষ্টিতে লক্ষাধিক মানুষ প্রাণ হারায়। দরিদ্র মানুষ আরও দরিদ্র হতে থাকে, মধ্যবিত্ত শ্রেণির ঘরেও দুবেলা খাওয়ার অন্ন জোটে না। অথচ দুর্নীতিপরায়ণ, লোভী, হঠাৎ ধনী হয়ে ওঠা মানুষগুলো বহাল তবিয়তে থাকে। তাদের পাশবিকতার জন্যই তো এই দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষে মানুষের মৃত্যুমিছিল দেখে সরকার কিছু কিছু জায়গায় রেশনের মাধ্যমে স্বল্পমূল্যে চাল-ডাল বিক্রি করতে বাধ্য হয়। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় নগণ্য। ভোর হতে না হতেই মানুষ লাইনে দাঁড়ায়। তারপরেও যে রেশন পাওয়া যাবে তার নিশ্চয়তা নেই।

নাটকের কাহিনিতে সমকালের প্রতিচ্ছবি : ‘আগুন’ নাটকে আমরা দেখি প্রথম দৃশ্যে নেত্যর বাবা তার স্ত্রী ও ছেলেকে সকাল সকাল ঘুম থেকে উঠতে বলছে। কলমি শাক, দাঁতন কাঠি বিক্রি করে যা রোজগার হবে তাই দিয়ে কিনতে হবে রেশনের চাল-ডাল। দ্বিতীয় দৃশ্যের কৃষাণ, তৃতীয় দৃশ্যের সতীশ সকলের একই অবস্থা। দারিদ্র্য আর অন্নাভাবে সতীশ ও তার স্ত্রী ক্ষিরির তীব্র বাদানুবাদ হয়, সতীশ ক্রোধে স্ত্রীকে লাথি মারে। চতুর্থ দৃশ্যে অপেক্ষাকৃত মধ্যবিত্ত হরেকৃষ্ণও রেশনের লাইনে দাঁড়ানোর জন্য রওনা হয়। পঞ্চম দৃশ্যে লাইনে মানুষের ঠেলাঠেলি, নাদুসনুদুস দোকানদার, সিভিক গার্ডের খবরদারি, তর্কাতর্কির মাঝে জনৈক যুবকের “আগুন! আগুন জ্বলছে আমাদের পেটে” বলে আর্তনাদ সমকালীন সমাজবাস্তবতার প্রত্যক্ষ দলিল হয়ে ওঠে।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top