বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর Class 11 Second Semester

Table of Contents

বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর
বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তর

1. বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধের সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও। ‘বোধি’ ও ‘বুদ্ধ’ কথাটির অর্থ কী?

গৌতম বুদ্ধ আনুমানিক ৫৬৭ খ্রিস্টপূর্বাব্দে হিমালয়ের পাদদেশে কপিলাবস্তুর এক রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পিতা ছিলেন শুদ্ধোধন এবং মাতার নাম ছিল মায়াদেবী। গৌতম বুদ্ধের বাল্যকালে নাম ছিল সিদ্ধার্থ। তিনি মাত্র ২৯ বছর বয়সে সংসার ত্যাগ করেন। মানুষের জীবনের নানাবিধ দুঃখ তাঁকে বিচলিত করেছিল তাই এই দুঃখ থেকে মুক্তি লাভের উপায় অনুসন্ধানের উদ্দেশ্যে তিনি তপস্যা করেন এবং ৩৫ বছর বয়সে বোধি বা প্রজ্ঞা লাভ করেন। সেইজন্য তাঁর নাম হয় বুদ্ধ বা জ্ঞানী।

বাল্যকালে সিদ্ধার্থ রাজ ঐশ্বর্যের মধ্যে পালিত হলেও মানব জীবনের দুঃখ-কষ্ট, জরা-মরণের দশাসমূহের তীব্রতা তাঁকে ব্যথিত করে তুলেছিল। তিনি এইসব দুঃখ-কষ্ট থেকে মুক্তির উপায় খোঁজার চেষ্টা করছিলেন। অবশেষে এক সন্ন্যাসীর দর্শন করে অতুল রাজ ঐশ্বর্য ও সংসার ধর্ম পরিত্যাগ করে মানুষের দুঃখ-কষ্টের কারণ ও তার পরিত্রাণের খোঁজে মাত্র ২৯ বছর বয়সে সন্ন্যাস ধর্ম গ্রহণ করেন। দীর্ঘ সাধনার পর তিনি ‘বোধি’ বা সত্যের জ্ঞান লাভ করেন। বোধি জ্ঞান লাভ করার পর সিদ্ধার্থ জনসমক্ষে পরিচিত হন ভগবান বুদ্ধ বা সম্যক জ্ঞানী নামে। এই ‘বোধি’ কথাটির অর্থ হল জ্ঞান এবং ‘বুদ্ধ’ কথাটির অর্থ সম্যক জ্ঞানী।

2. বৌদ্ধ বাণী বা ধর্মবাণী কী?

বোধিজ্ঞান লাভের পর গৌতম ‘বুদ্ধ’ বা ‘জ্ঞানী’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তিনি উপলব্ধি করেছিলেন জগৎ দুঃখময়। এই দুঃখের মূল কারণ অজ্ঞানতা বা অবিদ্যা। অবিদ্যার অন্ধকার থেকে মানুষকে মুক্তির পথের সন্ধান দেওয়া ছিল বুদ্ধদেবের লক্ষ্য।

বুদ্ধের বাণী হল “আত্মদীপোভবঃ”- অর্থাৎ ব্যক্তি আপন দীপ্তিতে উদ্ভাসিত হবে- তার আত্মবিকাশের জন্য ব্রাহ্মণ-পুরোহিতের সাহায্য নিষ্প্রয়োজন। সকল মানুষকে সমমর্যাদা দিয়ে ও অনন্ত শক্তির আধাররূপে ঘোষণা করে বুদ্ধ ধর্ম ও নীতির জগতে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠা করেন। কঠিন তপস্যার দ্বারা তিনি চারটি সত্যের সন্ধান পেয়েছিলেন যা আর্যসত্য চতুষ্টয় নামে পরিচিত। এই চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে অজ্ঞানতাই হল অবিদ্যা, যা দুঃখের কারণ। তাই এই চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান লাভ করলে ব্যক্তি মানুষ অজ্ঞানতার থেকে মুক্ত হবেন এবং দুঃখের বিনাশ সাধন করতে পারবেন। কারণ দুঃখের চিরনিবৃত্তি সাধনই ছিল বুদ্ধদেবের উদ্দেশ্য।

3. বৌদ্ধ দর্শনকে নাস্তিক দর্শন বলা হয় কেন?

ভারতীয় দর্শনের বিভিন্ন সম্প্রদায়কে প্রধানত দুটি ভাগে বিভক্ত করা যায়। যথা- আস্তিক ও নাস্তিক। বেদের প্রামাণ্য স্বীকার ও অস্বীকারের উপর নির্ভর করে আস্তিক ও নাস্তিক সম্প্রদায় গড়ে উঠেছিল। ভারতীয় দর্শনে বৌদ্ধ সম্প্রদায় একটি নাস্তিক সম্প্রদায়রূপে গণ্য হয়। কারণ বৌদ্ধরা বেদের প্রামাণ্যকে স্বীকার করেন না। বেদানুসারী চিন্তাধারার সঙ্গে বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের বিরোধিতা ছিল। বেদকে তাঁরা কখনোই প্রামাণ্য গ্রন্থ হিসেবে মান্যতা দেননি। তাই বৌদ্ধ দর্শন নাস্তিক দর্শন হিসেবে পরিচিত।

4. বৌদ্ধ নীতিতত্বের মূলকথা কী ?

বুদ্ধদেব ছিলেন সত্যদ্রষ্টা সাধক ও নীতিতত্ত্বের প্রচারক। নিছক ও নিরর্থক তত্ত্ব আলোচনাকে তিনি মূর্খতা বলে মনে করতেন। বুদ্ধদেব  উপলব্ধি করেছিলেন, মানুষ যেমন বাস্তব, মানুষের দুঃখও তেমনি বাস্তব, জীবমাত্রই সীমাহীন দুঃখে জর্জরিত। আর মানুষের এই দুঃখ-কষ্টের মূল কারণ হল অবিদ্যা (তত্ত্ব জ্ঞানের অভাব) বা অজ্ঞানতা। চারটি আর্যসত্যের সঠিক জ্ঞান এবং অষ্টাঙ্গিক মার্গের অনুশীলনের দ্বারা নৈতিক চরিত্র গঠন করতে পারলেই অবিদ্যার বিলোপসাধন তথা সমস্ত রকম দুঃখমুক্তি সম্ভব। যাকে বৌদ্ধ পরিভাষায় নির্বাণ বলা হয়। বৌদ্ধ দর্শনে মূলত নীতি ও ধর্মমূলক দিকটি প্রাধান্য পেয়েছে। তাই বৌদ্ধ নীতিতত্ত্বের মাধ্যমে ব্যক্তি মানুষ একদিকে আদর্শবান হয়ে উঠবেন এবং অন্যদিকে এক আদর্শনিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারবেন।

5. ত্রিপিটক কী? একে কয় ভাগে ভাগ করা হয় ও কী কী?

বুদ্ধদেব কোনো গ্রন্থ রচনা না করে মুখে মুখেই তাঁর শিষ্যদের উপদেশ দিতেন। পরবর্তীকালে মৃত্যুর পর তাঁর শিষ্যরা তাঁর উপদেশ বা বাণীগুলিকে লিপিবদ্ধ করেন। বুদ্ধদেবের এই বাণীর সংকলনকে বলা হয় ত্রিপিটক। এটি পালি ভাষায় রচিত। এখানে পিটক মানে ঝাঁপি। ত্রিপিটক তিনটি ভাগে বিভক্ত। যথা- বিনয়পিটক, সুত্তপিটক ও অভিধম্মপিটক।

বৌদ্ধ ভিক্ষু ও ভিক্ষুণীদের দৈনন্দিন আচার-আচরণ সম্পর্কে নিয়মাবলি সংকলিত হয়েছে বিনয়পিটকে। বুদ্ধদেবের উপদেশ, ভাষণ এবং শিষ্যদের সঙ্গে কথোপকথন সুত্তপিটকে সংকলিত হয়েছে। অভিধম্ম পিটকে দার্শনিক আলোচনা লিপিবদ্ধ আছে।

6. ‘পিটক’ শব্দের অর্থ কী? কোন্ পিটকে বৌদ্ধ দার্শনিক তত্ত্বসমূহ ও পরাতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে?

‘পিটক’ শব্দের অর্থ হল ঝাঁপি বা পেটিকা। বুদ্ধদেবের লিখিত কোনো গ্রন্থ ছিল না। বুদ্ধদেবের মহানির্বাণের পর তাঁর শিষ্যরা তাঁর উপদেশাবলি বা বাণীগুলিকে গ্রন্থাকারে লিপিবদ্ধ করেন। পালি ভাষায় রচিত বুদ্ধদেবের উপদেশাবলির সংকলনকে বলে পিটক। পিটকের সংখ্যা তিনটি। এই সংকলনকে বলা হয় ত্রিপিটক। পিটকগুলি হল- বিনয়পিটক, সুত্তপিটক এবং অভিধম্মপিটক।

অভিধম্ম পিটকে বৌদ্ধ দার্শনিক তত্ত্বসমূহ ও পরাতত্ত্ব আলোচিত হয়েছে।

7. বৌদ্ধ নীতিদর্শনে মধ্যপন্থা অবলম্বন করার কথা বলা হয়েছে কেন?

বুদ্ধদেবের নীতিদর্শন মধ্যপন্থাকে অবলম্বন করে গড়ে উঠেছে। গৌতম বুদ্ধ নিজে ছিলেন মধ্যপন্থী। তিনি মনে করতেন সংসার ও সন্ন্যাসজীবন এই দুই জীবনের মাধ্যমেই জীবনের চরম লক্ষ্য নির্বাণ লাভ করা সম্ভব। জীবনের পরম উদ্দেশ্যতে পৌঁছানোর জন্য একমাত্র কঠোর তপস্যাকে তিনি প্রয়োজনীয় বলেননি। তিনি মনে করতেন ব্যক্তি নিজ কর্তব্য পালনের মধ্যে দিয়ে শরীরকে সুস্থ ও সুরক্ষিত রাখতে পারে। শরীরকে সুরক্ষিত রাখার জন্য মানুষের পরিমিত খাদ্য, বস্ত্র ও বাসস্থানের দরকার তবে সেগুলির প্রতি যেন আসক্তি না আসে। তাই বুদ্ধদেব একদিকে যেমন চূড়ান্ত সম্ভোগের জীবনকে মান্যতা দেননি, অন্যদিকে তেমন চরম কৃষ্ণসাধনের জীবনকেও গ্রহণ করতে বলেননি। তিনি এই দুই জীবনের মধ্যবর্তী জীবনকে গ্রহণ করার উপদেশ দিয়েছেন অর্থাৎ তিনি এক মধ্যম পথের নির্দেশ দিয়েছেন।

বৌদ্ধ নীতিদর্শনে মধ্যপন্থা অবলম্বনের উদ্দেশ্য ছিল সত্যের পথে চালিত হয়ে মানুষ যেন জীবনের আদর্শকে উপলব্ধি করতে পারে এবং এক আদর্শনিষ্ঠ সমাজ গড়ে তুলতে সহায়তা করতে পারে।

8. বৌদ্ধ দর্শনে কর্মবাদ বলতে কী বোঝায়? ব্যাখ্যা করো।

বৌদ্ধ ধর্মের মূল ভিত্তি হল কর্মবাদ। বৌদ্ধ মতে জীবনমাত্রই কর্মের অধীন। সবই কার্যকারণ পরম্পরায় যুক্ত। পূর্ববর্তী কারণ পরবর্তী কার্যকে উৎপন্ন করে পরক্ষণেই বিনষ্ট হয়ে যায়। মানুষ নিজ কর্ম অনুযায়ী কর্মফল ভোগ করে। ভালো কাজ করলে ভালো ফল এবং মন্দ কাজ করলে খারাপ ফল ভোগ করতে হবে। বৌদ্ধ মতে, আমাদের পূর্ব, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের সঙ্গে এক যোগসূত্র রয়েছে। কারণ পূর্বজীবনের কর্মফলের দ্বারা ভবিষ্যৎ জীবন নির্ধারিত হয়। প্রত্যেক মানুষের কর্মফল ভিন্ন ভিন্ন। কর্মানুযায়ী প্রত্যেকে ভিন্ন কর্মফল লাভ করে। বৌদ্ধ দর্শনে তিন প্রকার কর্মের কথা বলা হয়েছে। যথা- বাচিক, কায়িক ও মানসিক।

এ ছাড়া কর্মফলের দিক থেকেও কর্মকে চার ভাগে বিভক্ত করা হয়েছে। যথা-  

  • ভালো কর্মের ভালো ফল। 
  • মন্দ কর্মের মন্দ ফল।
  • আংশিক ভালো ও আংশিক মন্দ কর্মের আংশিক ভালো-মন্দ ফল।
  • যে কর্ম ভালো বা মন্দ নয়, তা কোনো প্রকার ফলপ্রসব করে না।

9. বুদ্ধদেবকে কেন ‘দুঃখ ত্রাতা মহাধন্বন্তরি’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে? অথবা, বুদ্ধদেবকে কেন ‘ভব চিকিৎসক’ বলা হয়?

চিকিৎসকের কাজ হল রোগ, রোগের কারণ, আরোগ্য লাভ এবং আরোগ্য লাভের উপায়ের ব্যাপারে রোগীকে পরামর্শ দেওয়া। বুদ্ধদেব তাঁর কঠোর তপস্যার দ্বারা জগৎ ও জীবন সম্বন্ধে চারটি আর্যসত্য উপলব্ধ করেন। সেই চারটি আর্যসত্য হল- দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধ মার্গ। বুদ্ধদেবের মতে, জগৎ দুঃখময়। তাই দুঃখের নিরোধ করতে হলে ব্যক্তি মানুষকে চারটি আর্যসত্যের জ্ঞান লাভ করতে হবে। তাঁর কাছে দুঃখ ছিল রোগ। তাই চিকিৎসকের মতো রোগের উপশমের অর্থাৎ দুঃখ নিরোধের উপায় নির্দেশ করার জন্য বুদ্ধদেবকে ‘ভব চিকিৎসক’-ও (দুঃখ ত্রাতা মহাধন্বন্তরি) বলা হয়।

10. বৌদ্ধ দর্শনে আর্যসত্য চতুষ্টয়কে মহান সত্য বলা হয় কেন?

বুদ্ধদেব রাজপরিবারে জন্মগ্রহণ করেও জরা, ব্যাধি ও মৃত্যু জর্জরিত জীবন থেকে পরিত্রাণ লাভের উপায় অনুসন্ধান করেন। সেই উদ্দেশ্যে যোগ সাধনায় নিমগ্ন থেকে জগৎ ও জীবন সম্পর্কে চারটি সত্যকে উপলব্ধি করেন। এই চারটি সত্য হল- দুঃখ, দুঃখের কারণ, দুঃখ নিরোধ ও দুঃখ নিরোধমার্গ। এই চারটিকে একত্রে বলা হয় আর্যসত্য চতুষ্টয়। বুদ্ধদেব মনে করেছিলেন এই আর্যসত্য চতুষ্টয়ের ফলে সমাজের সকল স্তরের মানুষ নির্বার্ণলাভ করতে পারবে। তাই এই চারটি সত্যকে মহান সত্য বলা হয়।

11. বৌদ্ধ দর্শন স্বীকৃত প্রথম আর্যসত্য সম্বন্ধে লেখো।

কঠোর তপস্যার পর গৌতম বুদ্ধ জগৎ ও জীবন সম্পর্কে চারটি মহান সত্য উপলব্ধি করেছিলেন। তাঁর মতে এই চারটি আর্যসত্য সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান হলে যাবতীয় দুঃখ নিরোধ সম্ভব। চারটি আর্যসত্যের মধ্যে প্রথম আর্যসত্যটি হল দুঃখ। বুদ্ধ বলেছিলেন জীবন দুঃখময়। দুঃখই একমাত্র সত্য। মানুষের জীবন কামনা-বাসনাজনিত। তাই দুঃখ চিরন্তন। সুখের মধ্যেও দুঃখ মিশ্রিত। দুঃখ ছাড়া সুখ সম্ভব নয়। প্রথম আর্যসত্যকে পর্যালোচনা করে অনেকে বুদ্ধদেবকে দুঃখবাদী দার্শনিক আখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু তিনি দুঃখকে একমাত্র সত্য বললেও দুঃখ পরিহারের কথাও বলেছেন। তাই গৌতম বুদ্ধকে দুঃখবাদী দার্শনিক বলা যথাযথ নয়।

12. বুদ্ধদেব কেন জীবনকে দুঃখময় বলেছেন?

বুদ্ধদেবের মতে, মানুষ জন্মগ্রহণ করলে দুঃখ, কষ্ট, যন্ত্রণা, ব্যাধির মধ্য দিয়ে তাকে জীবন নির্বাহ করতে হয়। এর থেকে মুক্তি নেই। তিনি বলেছেন, “সর্বং দুঃখম্”। যতই সুখের চেষ্টা করা হবে ততই দুঃখের মধ্যে তাকে পতিত হতে হবে। আসলে সুখ হল ক্ষণিকের, দুঃখই জীবনকে ভারাক্রান্ত করে তোলে। অজ্ঞানবশত মানুষ সুখ চায়। আর তার ফলেই দুঃখে পতিত হয়। সুখ হল দুঃখেরই নামান্তর। সুখকে হারানোর যন্ত্রনা, সুখ চলে যেতে পারে-এই আশঙ্কা, সুখের ক্ষণস্থায়িত্বের উদ্বেগ- এই সবই হল দুঃখের কারণ।

13. বৌদ্ধ দর্শন স্বীকৃত দ্বিতীয় আর্যসত্য কী?

দ্বিতীয় আর্যসত্যে বুদ্ধদেব দুঃখের কারণ নির্দেশ করেছেন। দুঃখ যখন আছে, তখন দুঃখের কারণও আছে। দুঃখের হাত থেকে মুক্তি পেতে হলে দুঃখের কারণকে নির্মূল করা প্রয়োজন। দ্বিতীয় আর্যসত্য থেকে বৌদ্ধ দর্শনের যে নীতিটি অনুসৃত হয়েছে তাকে বলা হয় প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি। প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি অনুসারে এই জগতের প্রতিটি ঘটনারই কারণ আছে। দুঃখ একটি কার্য বা ঘটনা তাই এরও কারণ আছে। দুঃখের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব একটি কার্যকারণ শৃঙ্খলের উল্লেখ করেছেন। এই শৃঙ্খলের দ্বাদশটি অঙ্গ থাকায় একে দ্বাদশ নিদান বলে।

অবিদ্যা থেকে ক্রমান্বয়ে দুঃখের অন্যান্য কারণগুলির সৃষ্টি হয় বলে অবিদ্যাকে দুঃখের মূল কারণ বলা হয়েছে। এই দ্বাদশটি অঙ্গ কার্যকারণ শৃঙ্খলে চক্রাকারে যুক্ত হয়ে মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু, মৃত্যু থেকে জন্ম- এই জন্মান্তর প্রবাহে আবর্তিত করে চলে। অর্থাৎ মানুষ জন্মগ্রহণ করছে, দুঃখভোগ করছে এবং মৃত্যুমুখে পতিত হয়ে পুনরায় সে জন্মগ্রহণ করছে। এইভাবে কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে মানুষ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এজন্য এই কার্যকারণ শৃঙ্খলকে বা দ্বাদশ নিদানকে ভবচক্র (Wheel of Life) বলা হয়।

14. কোন কোন আর্যসত্যে বৌদ্ধ দর্শনকে নৈরাশ্যবাদী বলা হয়েছে এবং কেন?

চারটি আর্যসত্যের মধ্যে প্রথম ও দ্বিতীয় আর্যসত্যে বৌদ্ধ দর্শনকে নৈরাশ্যবাদী বলা হলেও বৌদ্ধ দর্শনে বাস্তবকে স্বীকার করা হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে জীবন যে জরা-মরণ কবলিত অর্থাৎ দুঃখময় – এ কথা অস্বীকার করা যায় না। তাই দুঃখ-তাপে নিরন্তর দগ্ধ হয়ে ‘জীবনে দুঃখ নেই’ বললে তা মিথ্যাভাষণ হয়। মূলত বুদ্ধদেব দুঃখকে স্বীকার করে জীবনের অন্ধকার দিকটির প্রতি আলোকপাত করেছেন এবং মানুষকে সে বিষয়ে সতর্ক করেছেন। কেবলমাত্র দুঃখকে স্বীকার করেই তিনি থেমে থাকেননি, বরং দুঃখ থেকে মুক্তির উপায়ও দেখিয়েছেন।

15. ভবচক্র কাকে বলে? দ্বাদশ নিদানকে কেন ভবচক্র বলা হয়?

ভবচক্র

বৌদ্ধ দর্শনে চারটি আর্যসত্যের অন্তর্গত দ্বিতীয় আর্যসত্য থেকে যে নীতিটি অনুসৃত হয়েছে তাকে বলা হয় প্রতীত্যসমুৎপাদ নীতি। এই নীতি অনুসারে এই জগতের প্রতিটি ঘটনারই কারণ আছে। দুঃখ একটি কার্য বা ঘটনা তাই এরও কারণ আছে। এই দুঃখের কারণ নির্দেশ করতে গিয়ে বুদ্ধদেব একটি কার্যকারণ শৃঙ্খলের উল্লেখ করেছেন। এই শৃঙ্খলের দ্বাদশটি অঙ্গ থাকায় একে দ্বাদশ নিদান বলা হয়। সেগুলি হল-জরা-মরণ, জাতি, ভব, উপাদান, তৃয়া, বেদনা, স্পর্শ, ষড়ায়তন, নামরূপ, চেতনা, সংস্কার ও অবিদ্যা। এই অবিদ্যা থেকেই অন্যান্য নিদানগুলি উদ্ভূত হয়েছে।

দ্বাদশ নিদানই হল ভাবচক্র

বারোটি কার্যকারণ শৃঙ্খল চক্রাকারে পরস্পর যুক্ত হয়ে মানুষকে জন্ম থেকে মৃত্যু এই জন্মান্তর প্রবাহে আবর্তিত করে। তাই এই কার্যকারণ শৃঙ্খলটিকে ভবচক্র বলা হয়।

এইভাবে কার্যকারণ শৃঙ্খলে আবদ্ধ হয়ে মানুষ অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যৎ জীবনের মধ্যে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে। এজন্য এই কার্যকারণ শৃঙ্খল বা দ্বাদশ নিদানকে ভবচক্র (Wheel of Life) বলা হয়।

16. পঞ্চস্কন্ধ বলতে কী বোঝো?

বৌদ্ধ দর্শনে জীবকে পাঁচটি উপাদানের মাধ্যমে ব্যাখ্যা করা  হয়েছে। এই উপাদানগুলি স্কন্ধ নামে পরিচিত। বৌদ্ধ দর্শনে এই পাঁচটি উপাদানের সমষ্টি হল পঞ্চস্কন্ধ। সেগুলি হল রূপ, বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার এবং বিজ্ঞান। এদের মধ্যে রূপস্কন্ধ হল দৈহিক উপাদান এবং বেদনা, সংজ্ঞা, সংস্কার ও বিজ্ঞানস্কন্ধের মিলিত রূপ হল নামস্কন্ধ, যা মানসিক উপাদানের অন্তর্গত।

বৌদ্ধ মতে দৈহিক ও মানসিক অবস্থাসমূহের সমষ্টি হল আত্মা। অর্থাৎ আত্মা হল পঞ্চস্কন্ধের সমাহার। বুদ্ধদেব এই মতবাদকেই সংঘাতবাদ বলেছেন। দেহ-মনের পরিবর্তনশীল অবস্থাই আত্মারূপে বিবেচিত হয়। বৌদ্ধ দর্শনে স্থায়ী আত্মাকে অস্বীকার করা হয়েছে।

17. বৌদ্ধ স্বীকৃত তৃতীয় আর্যসত্য সম্বন্ধে লেখো।

বুদ্ধদেব তৃতীয় আর্যসত্যে ঘোষণা করেছেন যে, দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি সম্ভব। বৌদ্ধ মতে, দুঃখের মূল কারণ যে অবিদ্যা, সেই অবিদ্যার বিনাশ হলে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি হয়। বৌদ্ধ দর্শনে দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তিকে বলা হয়েছে নির্বাণ। বুদ্ধদেবের মতে, নির্বাণের অর্থ জীবন্মুক্তি, অর্থাৎ জীবিত অবস্থায় মুক্তিলাভ। তৃয়াজনিত কামনা-বাসনাকে সম্পূর্ণরূপে নিয়ন্ত্রণ করে সত্যের নিয়ত অনুধ্যানের দ্বারা কোনো ব্যক্তি সমাধির বিভিন্ন স্তরের মধ্যে দিয়ে পরিপূর্ণ প্রজ্ঞার স্তরে উন্নীত হলে তিনি আসক্তি থেকে মুক্ত হন। এই অবস্থায় সমস্ত কামনা-বাসনা দগ্ধ হওয়ায় তৃয়ার ক্ষয় হয় এবং দুঃখের আত্যন্তিক নিবৃত্তি বা নির্বাণ (Nirvana) লাভ হয়।

‘নির্বাণ’ শব্দের ব্যুৎপত্তিগত অর্থ হল ‘নিভে যাওয়া’ বা ‘নির্বাপিত হওয়া’। বুদ্ধদেব তাই বলেছেন দুঃখের কারণ অবিদ্যা। এই অবিদ্যার বিনাশ বা অবলুপ্তি ঘটলে মানুষের দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ সম্ভব হবে। তিনি এই মুক্ত অবস্থাকে নির্বাণরূপে উল্লেখ করেছেন। নির্বাণপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে বৌদ্ধ মতে বলা হয় অর্হৎ। নির্বাণের স্বরূপ সম্পর্কে বৌদ্ধ মতে চারটি মতবাদ লক্ষ করা যায়। যথা-

  • নির্বাণ হল অবলুপ্তি।
  • নির্বাণ হল শাশ্বত আনন্দময় অবস্থা।
  • নির্বাণ হল এক অনির্বচনীয় অবস্থা।
  • নির্বাণ হল অপরিবর্তনীয় অবস্থা।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top