গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তি দাও

গণতন্ত্রের বিপক্ষে যুক্তিসমূহ
(1) অজ্ঞ এবং অশিক্ষিতদের শাসনব্যবস্থা
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেকি গণতন্ত্রের সমালোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, গণতন্ত্র হল সবচেয়ে দরিদ্র, অজ্ঞ ও অযোগ্য ব্যক্তির শাসনব্যবস্থা, কারণ গণতন্ত্রে এরাই সংখ্যাগরিষ্ঠ Democracy is “the government by the poorest, the most incapable, who are necessarily the numerous”) IF কার্লাইল আরও কঠোর ভাষায় সমালোচনা করে বলেছেন, গণতন্ত্র হল মূর্খদের দ্বারা পরিচালিত মূর্খদের জন্য এবং মূর্খদের শাসন (‘Democracy is a government of the fools, for the fools and by the fools’)। সমাজের অধিকাংশ জনগণকেই অশিক্ষিত ও অজ্ঞ বলে এনারা মনে করেন। আর তাই গণতন্ত্র যেহেতু জনগণের শাসন, সেহেতু জনগণের শাসন মানেই অজ্ঞ ও অশিক্ষিতদের শাসন। কারণ তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধির স্বরূপও তাদের মতোই অজ্ঞ, অশিক্ষিত ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন।
(2) নৈতিকতার অবনতি ঘটায়
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা নৈতিকতার অবনতি ঘটায় বলে সমালোচকরা মনে করেন। তাঁদের মতে, গণতন্ত্রে যেহেতু জনগণ অজ্ঞ ও অশিক্ষিত থাকে, তাই ধূর্ত রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এর সুযোগ নিয়ে শাসনক্ষমতাকে কুক্ষিগত করে নিজেদের কাজে লাগায়। এর ফলে নির্বাচনের সময় বলপূর্বক বুথ দখল, উৎকোচ গ্রহণ ও প্রদান, কারচুপি ইত্যাদি দেখা যায়। এতে গণতন্ত্র নেহাতই তত্ত্বকথায় পরিণত হয় এবং নৈতিকতার দিক থেকে রাষ্ট্রের মান হ্রাস পেতে শুরু করে। অনৈতিকতার কড়াল গ্রাসে গোটা দেশে রাজনৈতিক ভণ্ডামি, স্বার্থকেন্দ্রিক রাজনীতি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এ প্রসঙ্গে আসিরভথম (Asirvatham) মন্তব্য করেছিলেন, “Democracy is a process of diseducation. It flatters people. It engenders people a false sense of equality.”।
(3) গুণের তুলনায় সংখ্যার উপর গুরুত্ব
গণতন্ত্র মূলত সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন। সমালোচকরা বলেন, এখানে গুণের তুলনায় সংখ্যার প্রাধান্য স্বীকৃত হয়। উৎকর্ষতার কোনো মূল্য গণতন্ত্রে পাওয়া যায় না। সংখ্যাগরিষ্ঠ অজ্ঞ জনগণ নির্বাচনের সময় রাজনৈতিক দলগুলির কূটকৌশলে পড়ে গুণী ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে অযোগ্য ব্যক্তিদের নির্বাচিত করতে বাধ্য হয়।
(4) সরকারের স্থায়িত্বহীনতা
সমালোচকদের মতে, গণতন্ত্রে সরকারের স্থায়িত্বহীনতা প্রকটভাবে দেখা দেয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেনরি মেইন মনে করেন, স্থায়িত্বের অভাব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার একটি প্রধান ত্রুটি। বস্তুত, গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় জনগণের বিভিন্ন রকমের স্বার্থ, জাতপাতের বৈষম্য, গোষ্ঠীগত আঞ্চলিক এবং ধর্মীয় সংকীর্ণতা ইত্যাদি পরস্পরবিরোধী বিষয়গুলিকে কোনোভাবেই সামঞ্জস্য করা যায় না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী লেকি মনে করেন, এর ফলেই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সরকারের স্থায়িত্বহীনতা দেখা দেয়।
গণতন্ত্রে বহু মতামত ও পরস্পরবিরোধী চাহিদার উপস্থিতি নানা রকম সংঘর্ষের সৃষ্টি করে। ফলে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে কোনো সরকারই গঠন করা সম্ভব হয় না। তাই জোট সরকার গঠনের প্রবণতা বৃদ্ধি পায়। অনেকে মনে করেন, এইরূপ সরকার তুলনামূলক দুর্বল ও ক্ষণস্থায়ী হয়ে থাকে। সরকারের পতন, পুনরায় নির্বাচন এবং নব সরকার গঠন ইত্যাদি প্রায়শই এই শাসনব্যবস্থায় দেখা যায়। আর এজন্যই কোনো সরকারই দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ বা তার বাস্তবায়ন করতে পারে না।
(5) রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা
সমালোচকরা গণতন্ত্রকে একটি রক্ষণশীল শাসনব্যবস্থা বলে অভিহিত করেছেন। তাঁদের মতে, গণতন্ত্র যেহেতু মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের শাসন, তাই এ ধরনের শাসনব্যবস্থাকে রক্ষণশীল বলা যায়। কারণ মূর্খ ও অযোগ্য ব্যক্তিদের মধ্যে কোনো প্রগতিশীল চিন্তার উন্মেষ ঘটে না। তারা সবসময় নতুন কিছু করার বিরোধী। স্থিতাবস্থা বজায় রাখার পক্ষে তারা বিশেষভাবে আগ্রহী হয়। এই কারণে গণতন্ত্রে বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় সংস্কার করা যায় না, জনগণের রক্ষণশীল মনোভাবের দরুণ বহু সরকারি নীতি ও কর্মসূচির যথাযথ রূপায়ণ সম্ভব হয় না। ফলত, গণতন্ত্র প্রগতিহীন চরম রক্ষণশীল শাসনবব্যবস্থায় পরিণত হয়। এ প্রসঙ্গে এফ ডব্লিউ কোকার (FW Coker) মন্তব্য করেছেন, “Democracies are…the most conservative of all forms of state.”
(6) দলব্যবস্থার কুফল
গণতান্ত্রিক শাসনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হল দলব্যবস্থা। রাজনৈতিক দলগুলির অস্তিত্ব ছাড়া গণতন্ত্র কল্পনা করা যায় না। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল ও বিরোধী দলের মধ্যে রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের দ্বন্দ্বকে কেন্দ্র করে যেভাবে দলীয় সংঘর্ষের সূচনা হয়, তার ফলে দেশের আইনশৃঙ্খলা বিনষ্ট হতে দেখা যায়। নির্বাচনের আগে এবং নির্বাচনের পরে দলীয় সংঘর্ষগুলি শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে নিছক তত্ত্বকথায় রূপান্তরিত করে। রাজনৈতিক দলগুলির কাছে অনেকসময় জাতীয় স্বার্থের চেয়ে দলীয় স্বার্থ বড়ো হয়ে দেখা দেয়। দলীয় স্বার্থসাধনে ক্ষমতাসীন দল একদিকে যেমন সরকারি ক্ষমতার অপব্যবহার করে, অন্যদিকে তেমনি, বিরোধী দলগুলি ক্ষমতালাভের দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি করে।
অনেকসময় আবার ক্ষমতাসীন দল বা সরকার পুনরায় নির্বাচনে সাফল্যলাভ করার জন্য সরকারি ক্ষমতা ও অর্থকে কাজে লাগাতেও দ্বিধাবোধ করে না। বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাজনৈতিক দলগুলি পরস্পরবিরোধী মিথ্যা প্রচারে জনগণকে অহেতুক বিভ্রান্তির মধ্যে নিমজ্জিত করে। সংখ্যাগরিষ্ঠের সমর্থনে সরকার গঠিত হলেও, পরবর্তী সময়ে কার্যত এই সরকার ব্যক্তিগত বা দলীয় স্বার্থে সকল রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা কুক্ষিগত করে। আমলাতন্ত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রাধান্য পায়। ব্রাইস একে “under power of party organization” বলে উল্লেখ করেছেন।
(7) ব্যয়বহুল
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে সমালোচকরা একটি ব্যয়বহুল ব্যবস্থা বলে অভিহিত করেন। গণতন্ত্রে দেশের সাধারণ নির্বাচনগুলিতে সরকারকে যে বিপুল পরিমাণ অর্থের ব্যবস্থা করতে হয়, তা অনেকসময় অপচয়ের নামান্তর হয়ে দাঁড়ায়। দেশে যদি স্থিতিশীল সরকার গঠিত না হয়, তাহলে অন্তর্বর্তী নির্বাচনের আয়োজন করার জন্য সরকারকে বিপুল পরিমাণ অর্থের অপচয় করতে হয়। এ ছাড়া জনমত গঠন ও নির্বাচনের প্রাক্কালে দলীয় প্রচারের কাজে রাজনৈতিক দলগুলি প্রচুর অর্থের অপচয় করে।
(8) আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়
গণতন্ত্রে আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায় বলে অনেকে মনে করেন। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নীতি অনুযায়ী, আপামর জনগণের নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার অধিকার থাকায় বেশিরভাগ ক্ষেত্রে যোগ্য ও সৎ ব্যক্তির চেয়ে অসৎ এবং অযোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচনে জয়লাভ করে সরকারি ক্ষমতা লাভ করে। এ ধরনের অজ্ঞ নেতারা প্রশাসন পরিচালনা করার ব্যাপারে অদক্ষ হওয়ায় উচ্চপদস্থ সরকারি কর্মী বা আমলাদের উপর অত্যধিক পরিমাণে নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। এভাবে গণতন্ত্রে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি অপেক্ষা আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পায়। আমলাতন্ত্রের প্রাধান্য বৃদ্ধি পাওয়ার অর্থ হল সরকারি কাজকর্ম রূপায়ণে দীর্ঘসূত্রতা এবং জনস্বার্থের প্রতি উপেক্ষা।
(9) সংখ্যালঘু শ্রেণির স্বার্থ উপেক্ষিত
গণতন্ত্র মানেই সংখ্যাগরিষ্ঠের শাসন, তাই সংখ্যালঘুরা এখানে উপেক্ষিত হন। আইনসভায় সংখ্যালঘুরা তাঁদের প্রয়োজনীয় সংখ্যক প্রতিনিধি পাঠাতে পারেন না, এর ফলে সংখ্যালঘু শ্রেণি নিজেদের স্বার্থরক্ষা করার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হন। সংখ্যালঘু শ্রেণির সমস্যা, অভিযোগ সম্পর্কে অবগত হওয়ার জন্য কোনো প্রতিনিধি না থাকায় তারা তাদের স্বার্থের অনুকূলে সরকারি নীতি নির্ধারণ বা সিদ্ধান্ত গ্রহণকে পরিচালনা করতে সক্ষম হন না।
(10) জরুরি অবস্থায় অনুপযুক্ত
সমালোচকরা মনে করেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা জরুরি অবস্থার পক্ষে সম্পূর্ণ অনুপযুক্ত। অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, যুদ্ধ বা বহিরাক্রমণ দেখা দিলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সাংবিধানিক নিয়মকানুনের প্রাধান্য থাকায় তড়িঘড়ি জরুরিকালীন ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে যে পরিমাণ সময়ের অপচয় ঘটে, তা জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণের ব্যাপারে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। কারণ, রাষ্ট্রনেতারা আলাপ-আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক, ভোটাভুটি প্রভৃতির মাধ্যমে উপযুক্ত সিদ্ধান্তগ্রহণ করতে বাধ্য থাকেন। ফলে অযথা কালবিলম্ব ঘটে। তাই তৎপরতার সঙ্গে আসন্ন পরিস্থিতির মোকাবিলা কঠিন হয়ে পড়ে।
(11) জীববিজ্ঞানীদের সমালোচনা
জীববিজ্ঞানীরা গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কঠোর সমালোচনা করেন। প্রেঙ্কট হল (Prescot Hall) এবং অ্যালেন আয়ার্ল্যান্ড (Alleyane Ireland)-এর মতো জীববিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রে ‘সব মানুষ সমান’ এই তত্ত্বকে সত্যের অপলাপ বলে আখ্যা দেন। তাঁদের মতে, জন্মগতভাবে মানুষে মানুষে গুণগত পার্থক্য রয়েছে, যা গণতান্ত্রিক মতাদর্শে স্বীকৃত হয় না। মনোবৈজ্ঞানিক ও জীববিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে এই শাসনতন্ত্রকে বন্য, সাধারণ ও স্থূল বলে তীব্র নিন্দা করা হয়েছে। এ ছাড়াও অনেকে মনে করেন, গণতন্ত্র অবৈজ্ঞানিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত, কারণ এখানে জাতিগত শ্রেষ্ঠত্বকে উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে অস্বীকার করা হয়েছে গণতান্ত্রিক সাম্য তত্ত্বের প্রচার করে।
(12) সততা ও যোগ্যতার স্থান নেই
গণতন্ত্রে সততা ও যোগ্যতার কোনো দাম দেওয়া হয় না বলে অনেকে সমালোচকরা মনে করেন। বস্তুতপক্ষে, দলীয় রাজনীতির স্বার্থসিদ্ধ সংকীর্ণ চেহারা দেখে সৎ ও যোগ্য ব্যক্তিরা নির্বাচনের রাজনৈতিক আসরে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে চান না। অনেক সময় আবার দলীয় প্রথার কুফলে সৎ ও যোগ্য প্রার্থীরা নির্বাচনে নেমেও পরাজয় বরণ করতে বাধ্য হন। আমরা একথা কখনই অস্বীকার করতে পারি না যে, যে-কোনো শাসনতন্ত্রের সাফল্য যোগ্য, অভিজ্ঞ, বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন রাজনৈতিক কর্তৃত্বের বা নেতৃত্বের উপর নির্ভরশীল। আর বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রনৈতিক সমস্যাগুলি পূর্বের তুলনায় অত্যন্ত জটিল। কিন্তু গণতন্ত্রে অসৎ, অশিক্ষিত, অদক্ষ প্রার্থীদেরও নির্বাচনি প্রতিদ্বন্দ্বিতায় সমানাধিকার দেওয়া হয়। ফলে সম্পূর্ণ ব্যবস্থাটি দুর্নীতিগ্রস্থ হয়ে পড়ে। নিৎসে এর মতে, গণতন্ত্রে সাধারণ মানুষেরা পূজিত হয়, আর জ্ঞানীগুণীরা পায় অবজ্ঞা (Worship of the mediocre and hatred of excellence) I
(13) শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বিরোধী
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেনরি মেইন, লে বঁ (Le Bon) প্রমুখরা গণতন্ত্রকে শিল্প, সাহিত্য, চারুকলা ও বিজ্ঞানের বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন। সমালোচকদের মতে, সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের প্রতিভার কোনো মর্যাদা গণতন্ত্রে দেওয়া হয় না। মুষ্টিমেয় এলিট মানুষেরা রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখায় তাঁরা এক ধরনের এলিট সংস্কৃতি গড়ে তোলার জন্য সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার ব্যবস্থা করেন। অনেকে মনে করেন, সমাজের অধিকাংশ জনসাধারণই অজ্ঞ, অশিক্ষিত – হওয়ার তারা শিল্প, সংস্কৃতি, সাহিত্য, বিজ্ঞান, চারুকলা প্রভৃতি বিষয়গুলির – গুরুত্বকে বুঝতে পারেন না। তাই এই বিষয়গুলির বিকাশসাধনে তারা সচেষ্ট – হন না।
এ প্রসঙ্গে লে বঁ মন্তব্য করেছেন, “সভ্যতার অগ্রগতির পক্ষে এটা খুবই সৌভাগ্যের বিষয় যে, বিজ্ঞান ও শিল্পের ক্ষেত্রে শ্রেষ্ঠ আবিষ্কারগুলি হওয়ার পর জনসাধারণ রাজনৈতিক ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে।” গণতন্ত্রে রাজনীতিবিদদের মর্যাদা বেশি হওয়ায় অনেকসময় শিল্পী, সাহিত্যিক ও বিজ্ঞানীরা রাজনীতির প্রতি আকৃষ্ট হন, এর ফলে শিল্প, সাহিত্য ও বিজ্ঞানের বিকাশের গতি ব্যাহত হয়।
(14) নিম্নস্তরের নেতৃত্ব
গণতন্ত্রে অযোগ্য নেতৃবৃন্দ রাজনৈতিক ক্ষমতা কুক্ষিগত করায়, গণতন্ত্রের মানও নিম্ন হয়ে যায় বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেছেন। নির্বাচনের মধ্য দিয়েই এঁনারা নির্বাচিত হন বলে সমালোচকরা দাবি করেছেন। তাই তারা গণতান্ত্রিক নেতৃত্বকে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি নিম্নমানের বলে প্রতিপন্ন করতে ইচ্ছুক।
(15) মনোস্তাত্ত্বিক মতবাদ
মনোস্তাত্ত্বিক দিক থেকেও গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা সমালোচনার সম্মুখীন হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ম্যাক্সি (Maxey) জনসাধারণকে পশুর মতো মানসিকতাসম্পন্ন বলে মনে করতেন। তাঁর মতে, মানুষ ক্ষমতালোভী, স্বার্থপর, ন্যায়নীতিহীন নিকৃষ্ট মানসিকতাবিশিষ্ট, আবার অনেক ক্ষেত্রে আবেগতাড়িত। মানুষ উত্তেজনা, আবেগের বশবর্তী হয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন। তাই জনগণের শাসন এই গণতন্ত্র একসময় দায়িত্বজ্ঞানহীন, আবেগতাড়িত, যুক্তিহীন শাসনে পরিণত হয়ে, যা কখনই আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের জন্য কাম্য নয়।
(16) পুঁজিবাদের সমর্থক
অনেকে মনে করেন, পুঁজিবাদ গণতন্ত্রকে প্রশ্রয় দেয়। কারণ তারা মনে করেন, গণতন্ত্রে রাজনৈতিক ও সামাজিক সাম্যকে কিছু ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বীকৃতি প্রদান করা হলেও, অর্থনৈতিক সাম্যকে কখনোই স্বীকৃত দেওয়া হয় না। কিন্তু একথা সত্য যে, অর্থনৈতিক সাম্য সমাজে প্রতিষ্ঠা করা না গেলে অপর দুই সাম্যের উপস্থিতি অর্থহীন হয়ে পড়ে। বুর্জোয়া শ্রেণির হাতে পুঁজি কুক্ষিগত থাকায় তারা নিজেদের স্বার্থে শাসনতন্ত্রকে ব্যবহার করার চেষ্টা করে। অনেকসময় নেতৃবর্গ জনগণের পরিবর্তে ধনীশ্রেণির পৃষ্ঠপোষকতা করার জন্য নিজেদের প্রশাসনিক ক্ষমতাকে কাজে লাগায়। ফলে গণতন্ত্র ‘ধনিক-বণিকতন্ত্রে’-র শাসনে পরিণত হয়।
উপসংহার
বহু বিরুদ্ধ সমালোচনা সত্ত্বেও এটা বলা যায় যে, আজও গণতন্ত্রের কোনো বিকল্প নেই। গণতন্ত্র মূর্খের শাসন নয়। বিচ্যুতি সত্ত্বেও • গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা আজও বিশ্বের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ শাসনব্যবস্থা। গণতন্ত্রের বিরুদ্ধে যেসব সমালোচনা করা হয়েছে, তার মধ্যে বেশ কয়েকটি যুক্তি অবাস্তব ও কাল্পনিক। অধ্যাপক জোহারি-র ভাষায় বলা যায়, গণতন্ত্র হল সর্বোৎকৃষ্ট শাসনব্যবস্থা। কারণ গণতন্ত্র জনগণের অংশগ্রহণকে সুনিশ্চিত করে। এটি হল একমাত্র শাসনব্যবস্থা, যার স্থায়িত্ব জনগণের সম্মতির উপর নির্ভরশীল। এই শাসনব্যবস্থা দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থায় অংশগ্রহণ করার জন্য জনগণকে উৎসাহ দেয়। (“Democracy is the best form of government for the reason that it ensures popular participation. It is the only government that stands on will of the people and stimulates them to take part in the political affairs of the country.”)
আবার, লর্ড ব্রাইস-এর মতানুসারে, গণতন্ত্র বিশ্বসমাজে সৌভ্রাতৃত্ববোধ জাগ্রত করতে, শিক্ষিত জনসমাজকে সম্পূর্ণরূপে রাষ্ট্রীয় ক্রিয়াকলাপে অন্তর্ভুক্ত করতে, কিংবা রাজনৈতিক ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করতে না পারলেও গণতন্ত্র নিজেকে অতীতের শাসনতন্ত্রগুলির তুলনায় যথেষ্ট ভিত্তিপূর্ণভাবে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থ হয়েছে। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী বার্নস (Bums)-ও অনুরূপ দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করেছেন। তথাপি উপরোক্ত ভুলত্রুটিগুলিকে সংশোধন করে নেওয়ার মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে সাদরে গ্রহণ করে নেওয়াই শ্রেয় বলে রাষ্ট্রবিশেষজ্ঞরা অভিমত প্রকাশ করেছেন। দলব্যবস্থার ত্রুটি দূরীকরণ, অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সমতা প্রতিষ্ঠা, দেশব্যাপী শিক্ষার সম্প্রসারণ, অনগ্রসর শ্রেণির স্বার্থরক্ষা, রাজনীতিতে দুর্নীতি হ্রাস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতিসাধন ইত্যাদিকে বাস্তবায়ন করতে সক্ষম হলেই গণতন্ত্র আদর্শ শাসনব্যবস্থায় উপনীত হবে, একথা অস্বীকার করার উপায় নেই।
Read More – The Garden Party Question Answer