আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উত্তর – ইতিহাস প্রথম অধ্যায় Class 8 | ancholik shoktir utthan question answer

Table of Contents

আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উত্তর

আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উত্তর
আঞ্চলিক শক্তির উত্থান প্রশ্ন উত্তর

১। মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি কীভাবে হয়েছিল?

অথবা, কীভাবে মুঘলদের সাম্রাজ্যের অবনতি হয়েছিল- ব্যাখ্যা করো।

অথবা, মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির কারণ কী ছিল?

১৫২৬ খ্রিস্টাব্দে বাবর মুঘল সাম্রাজ্যের যে ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে সেই মুঘল সাম্রাজ্য দ্রুত অবনতির দিকে এগিয়ে যায় এবং পরবর্তী ৫০ বছরের মধ্যে মুঘল সম্রাটগণ নামমাত্র শাসকে পরিণত হন।

মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির কারণ

মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির কারণগুলি হল-

(i) ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটদের অযোগ্যতা: সম্রাটের দক্ষতার উপর মুঘল সাম্রাজ্যের সাফল্য নির্ভরশীল ছিল। সম্রাট জাহাঙ্গির ও শাহ জাহানের সময় থেকে মুঘল শাসনকাঠামোর মধ্যে সমস্যা দেখা দিয়েছিল। ঔরঙ্গজেবের শেষ দিকে তা আরও স্পষ্ট হয়। এসময় মারাঠারা মুঘল সম্রাটদের চারিত্রিক দুর্বলতা ও মুঘল অভিজাতদের পারস্পরিক দ্বন্দ্বের পূর্ণ সুযোগ গ্রহণ করে দাক্ষিণাত্যে মুঘল সাম্রাজ্য ছিন্নভিন্ন করতে সমর্থ হয়। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী সম্রাটদের অযোগ্যতার জন্য মুঘল সাম্রাজ্যের দ্রুত অবনতি হয়েছিল।

(ii) জায়গিরদারি ও মনসবদারি সংকট: মুঘল আমলে মনসবদারদের জায়গির দেওয়া হত। উন্নতমানের জায়গির পাওয়ার আশায় মনসবদারদের মধ্যে ক্রমে চরম দলাদলি শুরু হয়। সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময় থেকেই জায়গিরদারি সংকট সৃষ্টি হয়েছিল। তখন ভূমি রাজস্বের হিসাবে নানা গরমিল দেখা দেয়। সরকারি হিসাবে যে পরিমাণ রাজস্ব পাওয়ার কথা (জমা) আর যা পাওয়া যেত (হাসিল) তার মধ্যে মিল থাকত না। সম্রাট ঔরঙ্গজেব ও তাঁর পরবর্তীকালে এই সংকট তীব্র আকার ধারণ করে। জায়গিরের সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের ভিত নড়িয়ে দিয়েছিল।

(iii) আঞ্চলিক বিদ্রোহ: বিভিন্ন অঞ্চলের জমিদার ও কৃষকদের বিদ্রোহ মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। মুঘল যুগে জমির উপর জায়গিরদারদের অধিকার স্থায়ী ছিল না। জায়গিরদারদের বিভিন্ন জায়গায় বদলি করা হত। ফলে জায়গিরদাররা কৃষকদের কাছ থেকে অত্যধিক হারে রাজস্ব আদায় করত। এতে কৃষকদের উপর শোষণ ও অত্যাচার বাড়ত। মুঘল যুগের উল্লেখযোগ্য কৃষক বিদ্রোহগুলি হল জাঠ, শিখ ও সৎনামী বিদ্রোহ।

(iv) শিবাজী ও মারাঠাদের আক্রমণ: শিবাজী ও মারাঠাদের আক্রমণ মুঘল শাসনকে ব্যতিব্যস্ত করেছিল। ঔরঙ্গজেব মারাঠাদের দমন করার জন্য তাঁর জীবনের শেষ ছাব্বিশ বছর দাক্ষিণাত্যে কাটিয়েছিলেন। কিন্তু তাতেও সাফল্য পাননি।

(v) বৈদেশিক আক্রমণ: নাদির শাহের নেতৃত্বে পারসিক আক্রমণ (১৭৩৮-৩৯ খ্রি.) এবং আহমদ শাহ আবদালির নেতৃত্বে আফগান আক্রমণ (১৭৫৬-৫৭ খ্রি.) মুঘল সাম্রাজ্যের উপর চরম আঘাত হানে। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তরক্ষা করার কোনো সুবন্দোবস্ত না থাকায় নাদির শাহ এবং আহমদ শাহ আবদালির ভারত অভিযান সহজ হয়। ফলে মুঘলদের পক্ষে আর ফিরে দাঁড়ানো সম্ভবপর হয়নি।

মূল্যায়ন: উত্থানপতন প্রকৃতির নিয়ম হলেও মুঘল সাম্রাজ্যের পতনের ক্ষেত্রে উপরোক্ত কারণগুলি দায়ী ছিল। জাতীয়তাবোধের অভাব, আর্থসামাজিক পরিস্থিতির পরিবর্তন রাজনীতিতে গভীর প্রভাব বিস্তার করে। যোগ্য কর্মচারী বা আমলাশ্রেণির দক্ষতা দেখা যায়নি। ফলে মুঘল সাম্রাজ্য অবক্ষয়ের পথে দ্রুত এগিয়ে যায়।

২। মুঘল আমলের শেষদিকে জায়গিরদারি ও মনসবদারি ব্যবস্থার সংকট কীভাবে মুঘল শাসনকাঠামোকে বিপর্যস্ত করেছিল?

অথবা, মুঘল আমলে জায়গিরদারি সংকটের কারণ কী ছিল? এর ফল কী হয়েছিল?

মুঘল শাসনব্যবস্থার অন্যতম প্রধান ভিত্তি ছিল জায়গিরদারি ব্যবস্থা। মুঘল আমলে অনেক মনসবদারকে জায়গির দেওয়া হত। এই ব্যবস্থাকেই জায়গিরদারি ব্যবস্থা বলা হত। মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের আমলে এই জায়গিরদারি ব্যবস্থায় অনেক সমস্যা বা সংকট সৃষ্টি হয় এবং সম্রাট ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে এই জায়গিরদারি সংকট চরম আকার ধারণ করে।

প্রকৃতি

জাগির একটি ফারসি শব্দ। এর অর্থ হস্তান্তরযোগ্য ভূমি। ইক্তা ব্যবস্থার অনুরূপ ছিল জায়গিরদারি ব্যবস্থা। মোট জমির খালিসা (রাজার খাসজমি) ও মদদ-ই-খাশ (দেবোত্তর জমি) বাদে বাকি অংশ ছিল জায়গির। বেতনের বদলে, বিশেষ পদের জন্য, পুরস্কার হিসেবে, জমিদারি হিসেবে জায়গির দেওয়া হত। মনসবদারদেরও বেতনের বদলে জায়গির প্রদান করা হত।

জায়গিরদারি সংকটের কারণ

(i) জায়গিরদারের সংখ্যা বৃদ্ধি: সম্রাট জাহাঙ্গিরের সময় থেকে মুঘল সম্রাটগণ যথেচ্ছভাবে জায়গিরদারের সংখ্যার বৃদ্ধি ঘটান। উর্বর জায়গির পাওয়ার আশায় জায়গিরদারদের মধ্যে দলাদলি চরমে ওঠে।

(ii) হিসাবের গরমিল: জায়গিরদারি সংকটের অন্যতম কারণ ছিল রাজস্বের হিসাবে গরমিল বা জমা ও হাসিলের মধ্যে ফারাক। জমা বলতে বোঝায় জায়গির থেকে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হবে তার সরকারি হিসাব। আর হাসিল বলতে বোঝায় বাস্তবে যে পরিমাণ রাজস্ব আদায় হত। জায়গিরদাররা উচ্চমানের জায়গির পাওয়ার জন্য নানা অনাচার ও দুর্নীতির আশ্রয় নিতেন। এই জায়গিরদারি সংকট মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতি ঘটিয়েছিল।

ফলাফল

জায়গিরদারি সংকটের ফলে-

  • মুঘল সম্রাটগণ আর্থিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছিলেন। 
  • মুঘল সম্রাটদের আয় কমে গিয়েছিল। তার ফলে তারা বেতন দিয়ে দক্ষ সেনাবাহিনী গঠন করতে পারেননি। 
  • ভালো জায়গির পাওয়ার জন্য অভিজাতরা মুঘল সম্রাটকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করতেন। এর জন্য তারা দলাদলি শুরু করেছিলেন। 
  • জায়গিরদাররা সাম্রাজ্যের স্বার্থের চেয়ে ব্যক্তিস্বার্থকে বড়ো করে দেখতে থাকে। 
  • জায়গিরগুলি শোষণের ক্ষেত্র হয়ে ওঠার ফলে কৃষিব্যবস্থা ও কৃষককুল উভয়েই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

মূল্যায়ন

জায়গিরদারি সংকটের প্রভাবে মুঘল সাম্রাজ্যের প্রাণশক্তি বিনষ্ট হয়ে যায়। এই সংকটের কোনো সুষ্ঠু সমাধান না হওয়ায় তা মুঘল সাম্রাজ্যের পতনকে অনিবার্য করে তোলে।

৩। অষ্টাদশ শতকে ভারতে প্রধান আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থানের পিছনে মুঘল সম্রাটদের ব্যক্তিগত অযোগ্যতাই কেবল দায়ী ছিল? তোমার বক্তব্যের পক্ষে যুক্তি দাও।

অষ্টাদশ শতকে ভারতে অনেকগুলি আঞ্চলিক শক্তির উত্থান হয়েছিল। তবে এই আঞ্চলিক শক্তিগুলির মধ্যে তিনটি শক্তি ছিল প্রধান। এগুলি হল বাংলা, হায়দরাবাদ ও অযোধ্যা।

মুঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত থাকার পর কীভাবে এই বাংলা, হায়দরাবাদ ও অযোধ্যার উত্থান হয়েছিল সে সম্পর্কে অনেক মত আছে। অনেকে বলেন – ১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর খুব দ্রুত মুঘল সাম্রাজ্যের শক্তি নষ্ট হতে থাকে। ঔরঙ্গজেবের পরবর্তী মুঘল সম্রাটদের পক্ষে সাম্রাজ্যের ঐক্য ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ মুঘল সম্রাটদের ব্যর্থতার জন্যই আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থান ঘটেছিল।

কিন্তু ভারতের বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের শাসন ও স্থায়িত্ব শুধুমাত্র ব্যক্তিগতভাবে সম্রাটের দক্ষতা ও যোগ্যতার উপর নির্ভর করে না। বিভিন্ন কারণে মুঘল সাম্রাজ্য দুর্বল হয়ে পড়ে এবং সেই সুযোগে আঞ্চলিক শক্তিগুলি মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে।

আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থানের কারণ

ভারতে আঞ্চলিক শক্তিগুলির উত্থানের কারণ হল-

(i) মুঘল সম্রাটদের সামরিক দুর্বলতা: মুঘল সম্রাটদের শক্তিশালী সেনাবাহিনীর অভাব মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির অন্যতম প্রধান কারণ ছিল। মুঘলদের অস্ত্রশস্ত্র ও যুদ্ধকৌশল ছিল পুরোনো ধাঁচের। তাই তারা আধুনিক অস্ত্রেশস্ত্রে সজ্জিত ইংরেজদের কাছে হেরে যায়।

(ii) জায়গিরদারি সংকট: মুঘল আমলে মনসবদারদের জায়গির দেওয়া হত। উন্নত জায়গির পাওয়ার আশায় অভিজাত ও মনসবদারদের মধ্যে দলাদলি শুরু হয়। তা ছাড়া মুঘল সম্রাট হিসাব মতো রাজস্বও পেতেন না। ফলে মুঘল শক্তি দুর্বল হয় ও আঞ্চলিক শক্তির উত্থান ঘটে।

(iii) কৃষক বিদ্রোহ: মুঘল যুগে জমিদার ও কৃষকদের বিদ্রোহ মুঘল সাম্রাজ্যের অবনতির জন্য বিশেষভাবে দায়ী। এই কৃষক বিদ্রোহের পিছনে কতকগুলি কারণ ছিল। যেহেতু জায়গিরের রাজস্ব থেকেই মনসবদাররা সামরিক বাহিনীর ভরণপোষণ করত, তাই তারা যথাসম্ভব চড়াহারে কৃষকদের কাছ থেকে রাজস্ব আদায় করত। এ ছাড়া ইজারা-রীতি প্রবর্তিত হলে এক নতুন জোতদার ও তালুকদার শ্রেণির আবির্ভাব ঘটে যারা কৃষকদের উপর শোষণ চালাত। ফলে কৃষকদের অসন্তোষ বিদ্রোহের রূপ নেয়। জাঠ, শিখ ও সৎনামী কৃষকদের বিদ্রোহ মুঘল শক্তিকে দুর্বল করেছিল।

(iv) বৈদেশিক আক্রমণ: নাদির শাহ ও আহমদ শাহ আবদালির আক্রমণ মুঘল শক্তিকে দুর্বল করেছিল।

(v) আঞ্চলিক শাসকদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা: বাংলা, হায়দরাবাদ ও অযোধ্যা-সহ বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক শাসকদের স্বাধীনতালাভের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ছিল। তাই এইসব অঞ্চলের শাসকরা আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য দেখালেও বাস্তবে স্বাধীনভাবে শাসন পরিচালনা করতেন।

৪। বাংলাদেশ কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?

শক্তিশালী মুঘল সম্রাটদের শেষ প্রতিনিধি ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল সাম্রাজ্য অবক্ষয়ের পথে চলে যায়। দুর্বল উত্তরাধিকারীদের আমলে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন সুবা কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ থেকে মুক্ত হয়। বাংলাদেশ ছিল তার মধ্যে অন্যতম।

বাংলাদেশে নবাবি শাসন প্রতিষ্ঠা

বাংলা সুবার উত্থান

বাবরের সময়ে বাংলার স্বাধীন সুলতান ছিলেন নুসরত শাহ। তিনি মুঘলবিরোধী জোটে যোগ দেন। ঘর্ঘরার যুদ্ধে (১৫২৯ খ্রিস্টাব্দে) তিনি পরাজিত হলেও বাংলা স্বাধীন থাকে। পরে সম্রাট আকবর ও জাহাঙ্গিরের আমলে কররানি বংশের ও বারো-ভুঁইয়াদের পতন ঘটলে বাংলাদেশ মুঘল সাম্রাজ্যের একটি সুবা বা প্রদেশে পরিণত হয়।

মুর্শিদকুলি খান- দেওয়ান

সম্রাট ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে থাকার সময় মুর্শিদকুলি খান বেরারের দেওয়ান ছিলেন। তিনি তার দক্ষতার জন্য সম্রাটের সুনজরে পড়েন। সম্রাট তাকে বাংলার দেওয়ান পদে নিয়োগ করেন (১৭০০ খ্রিস্টাব্দে)। তিনি বাংলার রাজস্ব সংস্কারের মাধ্যমে আয় বৃদ্ধি করে সম্রাটের বিশ্বাস অর্জন করেন। তিনি সম্রাটকে নিয়মিত বার্ষিক পেশকাশ দান করতেন। এজন্য সম্রাট তাকে দেওয়ানি আদায়ের কাজে স্বাধীনতা দেন।

মুর্শিদকুলি খান- সুবাদার

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুয়াজ্জম প্রথম বাহাদুর শাহ উপাধি নিয়ে সম্রাট হন। তিনি মুর্শিদকুলি খানকে দাক্ষিণাত্যে বদলি করেন। দুবছর পরে আবার তাকে বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন। সম্রাট ফাররুখশিয়র তাকে সুবাদার (নাজিম বা নবাব) পদ দেন (১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে)।

মুর্শিদকুলি খান- নবাব

এর ফলে মুর্শিদকুলি খান একাধারে দেওয়ান এবং নাজিম বা নবাব হন। মুঘল শাসনব্যবস্থায় সুবার সর্বোচ্চ দুটি পদ এক ব্যক্তির হাতে থাকার ফলে তিনি কার্যত স্বাধীন শাসক হয়ে ওঠেন, যদিও তিনি সম্রাটের প্রতি আনুগত্য দেখাতেন এবং বার্ষিক পেশকাশ দিতেন।

এইভাবে মুঘল রাজশক্তির সঙ্গে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন না হয়েও বাংলাদেশ একটি অন্যতম উল্লেখযোগ্য আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।

৫। হায়দরাবাদ কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর মুঘল দরবারের রাজনীতি ও ষড়যন্ত্র প্রবল হয়ে ওঠে। তুরানি গোষ্ঠীর নেতা চিন কিলিচ খান (মির কামার উদ-দিন খান সিদ্দিকি) মহম্মদ শাহ-কে সম্রাট হতে সাহায্য করেন। কিন্তু দিল্লির রাজনীতিতে বিরক্ত হয়ে তিনি হায়দরাবাদ চলে যান। সেখানে তিনি স্বাধীনভাবে রাজত্ব করতে থাকেন।

হায়দরাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা

মির কামার উদ-দিন খান সিদ্দিকি: মুঘল দরবারে অভিজাত গোষ্ঠীর মধ্যে অন্যতম ছিল তুরানি বা চিন গোষ্ঠী। এই গোষ্ঠীর নেতা ছিলেন মির কামার উদ-দিন খান সিদ্দিকি। সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাকে চিন কিলিচ খান, সম্রাট ফাররুখশিয়র তাকে নিজাম-উল-মূলক এবং সম্রাট মহম্মদ শাহ তাকে আসফ ঝা উপাধি দেন। তার কর্মদক্ষতা ও প্রভাবের জন্য তিনি এই উপাধিগুলি লাভ করেছিলেন।

দিল্লির রাজনৈতিক অবস্থা

ফাররুখশিয়রের মৃত্যুর পর (১৭১৯ খ্রি.) সিংহাসন নিয়ে প্রবল দ্বন্দু শুরু হয়। ষড়যন্ত্র, হত্যাকান্ড ও সন্দেহ এক বিষাক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করে।

হায়দরাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা: এই অবস্থায় মির কামার উদ-দিন খান সিদ্দিকি দিল্লি ত্যাগ করে হায়দরাবাদ চলে যান। এখানে তিনি একটি রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু এখানকার মুঘল সুবাদার ছিলেন মুবারিজ খান। সম্রাট মহম্মদ শাহের নির্দেশে মুবারিজ খান কামার উদ-দিনের বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করেন। শকর খেদা-র যুদ্ধে কামার উদ-দিন জয়ী হন। মুবারিজ খান নিহত হন। ফলে সম্রাট মহম্মদ শাহ এক সন্ধির দ্বারা মির কামার উদ-দিন সিদ্দিকি-কে হায়দরাবাদ সুবার শাসক নিযুক্ত করেন।

স্বাধীন হায়দরাবাদ- নিজাম

এইভাবে মির কামার উদ্দিন সিদ্দিকি হায়দরাবাদ রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। তার উপাধি হয় নিজাম। তিনি প্রশাসনের বিকেন্দ্রীকরণ, জায়গিরগুলিকে বংশানুক্রমিক করা এবং নতুন কর্মচারী নিয়োগ করার মাধ্যমে প্রচলিত শাসনব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটান।

মূল্যায়ন

দিল্লির কেন্দ্রীয় শাসন থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীনতা ঘোষণা না করলেও নিজাম প্রকৃত স্বাধীন শাসকের মতোই ভূমিকা গ্রহণ করেন। তিনি মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য বজায় রেখেও স্বাধীন নিজামশাহী হায়দরাবাদ রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন, যদিও তিনি মুদ্রা এবং খুতবায় মুঘল সম্রাটের নাম ব্যবহার করতেন।

৬। অযোধ্যা কীভাবে আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে?

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মৃত্যুর পর থেকে উত্তরাধিকার দ্বন্দু প্রবল হয়। কেন্দ্রীয় শাসন শিথিল হয়ে পড়ে। ফলে বিভিন্ন প্রদেশ স্বাধীন হতে চেষ্টা করে। অযোধ্যা রাজ্য ছিল তার মধ্যে অন্যতম।

অযোধ্যায় নবাবি শাসন প্রতিষ্ঠা

অযোধ্যা সুবা

দিল্লির নিকটে অবস্থিত এই অঞ্চল মুঘল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার শুরু থেকেই একটি সুবা হিসেবে পরিচিত ছিল। দোয়াব অঞ্চল হওয়ায় এই সুবা মুঘল রাজকোশে প্রচুর অর্থের জোগান দিত। ফলে অযোধ্যা সুবার একটি বিশেষ গুরুত্ব ছিল।

সাদাৎ খান- প্রধানমন্ত্রী

একদা ইরানের খোরাসান প্রদেশের ভাগ্যান্বেষী সাদাৎ খান ঘটনাচক্রে মুঘল সম্রাট মহম্মদ শাহের প্রধানমন্ত্রী (উজির-এ-আজম) হন। এই সময় অযোধ্যা রাজ্যে ভয়ানক কৃষক ও জমিদার বিদ্রোহ দেখা দেয়। সম্রাট তখন সাদাৎ খানকে শান্তি-শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব দেন। খুব কম সময়ের মধ্যে তিনি দক্ষতার সঙ্গে কাজটি সম্পন্ন করেন ফলে সম্রাট খুশি হয়ে সাদাৎ খানকে বুরহান-উল-মূলক উপাধি দেন।

সাদাৎ খান- সুবাদার

এরপর সম্রাট সাদাৎ খানকে অযোধ্যার সুবাদার পদ দেন। সাদাৎ খান প্রশাসনিক সংস্কার করেন। হিন্দুদের সরকারি কাজে নিয়োগ করেন। কৃষক স্বার্থে ভূমিরাজস্ব সংস্কার করে একটি সুগঠিত শাসনব্যবস্থা গড়ে তোলেন (১৭২২ খ্রি.)।

অযোধ্যা- নবাব পদ

সাদাৎ খান ছিলেন একদিকে অযোধ্যা সুবাদার এবং অন্যদিকে মুঘল সম্রাটের প্রধানমন্ত্রী। দরবারে তার প্রভাব থাকায় অযোধ্যা সুবার দেওয়ানিকে তিনি মুঘল সম্রাটের নিয়ন্ত্রণমুক্ত করেন। এই সুযোগে তিনি নিজ জামাতা সফদর জং-কে অযোধ্যার প্রশাসক পদে বসান। এই সময় থেকেই অযোধ্যায় নবাবি শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়। মুঘল সম্রাটের প্রতি আনুগত্য এবং মুদ্রায় সম্রাটের নাম তিনি বজায় রাখেন।

মূল্যায়ন

এইভাবে মুঘল সম্রাটের দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী সুবাদার সাদাৎ খান অযোধ্যায় স্বাধীন নবাবির প্রতিষ্ঠা করেন।

৭। মুর্শিদকুলি খান ও আলিবর্দি খান-এর সময়ে বাংলার সঙ্গে মুঘল শাসনের সম্পর্কের চরিত্র কেমন ছিল?

মুর্শিদকুলি খানের সময় থেকে মুঘল শাসনাধীন সুবা বাংলা আঞ্চলিক শক্তি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। ধীরে ধীরে সুবা বাংলার উপর মুঘল সম্রাটদের কর্তৃত্ব কমতে থাকে। নবাব আলিবর্দির শাসনকালে আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল কর্তৃত্বকে স্বীকার করা হলেও বাংলায় তিনি স্বশাসিত প্রশাসন চালাতেন।

মুর্শিদকুলি খানের সময়ে বাংলার সঙ্গে মুঘল শাসনের সম্পর্ক

মুর্শিদকুলি খানের পূর্বনাম ছিল মহম্মদ হাদি। মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব তার সততা ও দক্ষতায় মুগ্ধ হয়ে তাকে মুর্শিদকুলি খান উপাধি দেন।

১৭০০ খ্রিস্টাব্দে সম্রাট ঔরঙ্গজেব তাকে বাংলার অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও রাজস্ব সংস্কারের জন্য বাংলার দেওয়ান নিযুক্ত করেন।

মুঘল সম্রাট বাহাদুর শাহের আমলেও তিনি দেওয়ান পদে বহাল ছিলেন।

১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়র তাকে দেওয়ান পদের সঙ্গে নাজিম বা নবাব পদ দেন। এই সময় থেকে মুর্শিদকুলি খানের নেতৃত্বে বাংলার স্বাধীন ইতিহাসের সূচনা হয়।

আলিবর্দি খানের সময়ে বাংলার সঙ্গে মুঘল শাসনের সম্পর্ক

আলিবর্দি খানের শাসনকালে (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রি.) বাংলা সুবার অধিকার মুঘলদের হাত থেকে বেরিয়ে যায়। তিনি বাংলার শাসনতান্ত্রিক কোনো খবরাখবর মুঘল সম্রাটকে জানাতেন না। আলিবর্দি মুঘল সম্রাটকে নিয়মিত রাজস্বও পাঠাতেন না। আনুষ্ঠানিকভাবে মুঘল কর্তৃত্বকে স্বীকার করলেও বাস্তবে বাংলায় তিনি স্বশাসিত প্রশাসন চালাতেন।

৮। মুর্শিদকুলি খান থেকে আলিবর্দি খানের সময় পর্যন্ত বাংলার নবাবদের সঙ্গে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্ক কীরকম ছিল?

সপ্তদশ শতক থেকেই বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানি বাংলাদেশে ব্যাবসাবাণিজ্য করত। ১৭১৭ থেকে ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সময়কালে ভারতে বাণিজ্যরত বিভিন্ন ইউরোপীয় কোম্পানির মধ্যে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ছিল অন্যতম। বাংলার নবাবদের সঙ্গে এই কোম্পানির সম্পর্ক ছিল অম্লমধুর, যদিও নবাব মুর্শিদকুলি খানের সময় থেকে নবাব আলিবর্দি খানের সময় পর্যন্ত ইউরোপীয় বণিকরা নবাবের নিয়ন্ত্রণেই ছিল।

নবাবদের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক

(i) মুর্শিদকুলি খান: অষ্টাদশ শতকের প্রথম থেকে বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তখন বাংলার নবাব ছিলেন মুর্শিদকুলি খান। তিনি বাংলায় ইউরোপীয় বণিকদের ব্যাবসাবাণিজ্যে সর্বদা উৎসাহ দিতেন। এইসময় ইংরেজরা অন্যান্য বণিকদের তুলনায় বেশি সুযোগ নেওয়ার জন্য মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের ফরমান নিয়ে বিনাশুল্কে ব্যাবসাবাণিজ্য করত।

এ ছাড়া দস্তকের অপব্যবহার করে কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলায় তাদের ব্যক্তিগত বাণিজ্য চালাতে থাকলে নবাবের অর্থনৈতিক স্বার্থও প্রবলভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হতে থাকে। তাই মুর্শিদকুলি খান অন্যান্য বণিকদের অসুবিধার কথা চিন্তা করে ইংরেজদের বিশেষ অধিকার রদ করেন।

(ii) সুজা উদ-দিন (১৭২৭-১৭৩৯ খ্রিস্টাব্দ): ১৭২৭ খ্রিস্টাব্দে নবাব মুর্শিদকুলি খানের মৃত্যুর পর তার জামাতা সুজা উদ-দিন বাংলার মসনদে বসেন। ইউরোপীয় বণিকরা যাতে বাড়াবাড়ি করতে না পারে সেদিকে তিনি সজাগ দৃষ্টি রেখেছিলেন।

(iii) সরফরাজ খান (১৭৩৯-১৯৪০ খ্রিস্টাব্দ): সুজা উদ্দিনের মৃত্যুর পর সরফরাজ খান মাত্র কয়েক মাস নবাব পদে বসেছিলেন। তিনি ছিলেন অযোগ্য শাসক। ফলে শাসনকার্যে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়। এই সুযোগে আলিবর্দি খান ১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে গিরিয়ার যুদ্ধে সরফরাজকে পরাজিত ও নিহত করে বাংলার মসনদ দখল করেন।

(iv) আলিবর্দি খান (১৭৪০-১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ): নবাব আলিবর্দিও মুর্শিদকুলি খানের মতো বাংলায় ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বণিকদের বাণিজ্যে আগ্রহী ছিলেন। আলিবর্দি বাংলার স্বার্থেই ইউরোপীয় বণিকদের পছন্দ করতেন। ইংরেজদের সম্পর্কে আলিবর্দি বলতেন, ইংরেজরা মৌমাছির জাত। তাদের যথাযথ পালন করলে মধু পাওয়া যাবে, আর বিরক্ত করলে হুল ফুটিয়ে দেবে। তবে অনেকসময় তিনি অর্থ আদায়ের জন্য ইউরোপীয় বণিকদের চাপ দিতেন। ইংরেজরাও নবাবের নির্দেশ মানতে বাধ্য হত।

অস্ট্রিয়ার উত্তরাধিকার যুদ্ধে বাংলার ইংরেজ ও ফরাসি বণিকেরা যুদ্ধপ্রস্তুতি শুরু করলে আলিবর্দি দূত পাঠিয়ে বলেন, ‘তোমরা বণিক। তোমাদের দুর্গের কী প্রয়োজন? আমার রাজ্যে তোমরা নিরাপদ।’ তবুও তিনি ইংরেজ নৌশক্তি সম্বন্ধে আতঙ্কিত ছিলেন। তিনি বলেন, ‘সমুদ্রে আগুন জ্বললে নেভানোর ক্ষমতা আমার নেই।’

মূল্যায়ন

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ফাররুখশিয়রের ফরমান বলে বাণিজ্যিক সুবিধা লাভ করলেও এইসব নবাবদের আমলে তা ভোগ করতে পারেনি। নবাবদের দৃঢ়তার জন্য অন্যান্য ইউরোপীয় বণিকদের মতোই তারাও শুল্ক দিতে বাধ্য হয়, যদিও উৎসাহ প্রদান এবং সুসম্পর্কের অভাব হয়নি। পরবর্তীকালে সিরাজ উদ-দৌলার সময়ে নবাবের সঙ্গে কোম্পানির সম্পর্ক তিক্ততার স্তরে পৌঁছোয়।

৯। ‘ফাররুখশিয়র ফরমান’ কী? ফাররুখশিয়র ফরমানে ইংরেজরা কী কী সুবিধা লাভ করেছিল?

মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের আমলে পুরোনো সম্পর্ক ও ব্যক্তিগত কারণে তিনি ইংরেজ কোম্পানিকে কিছু বাণিজ্যিক সুযোগসুবিধা প্রদান করেছিলেন।

ফাররুখশিয়র ফরমান

১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়র ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির অনুকূলে যে ফরমান জারি করেছিলেন, তা ফাররুখশিয়র ফরমান নামে পরিচিত। সুরম্যানের নেতৃত্বে গঠিত ইংরেজদল সম্রাট ফাররুখশিয়রের কাছ থেকে এই ফরমান লাভ করেন।

সুযোগসুবিধা লাভ 

ফাররুখশিয়র ফরমানে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কিছু বিশেষ সুযোগসুবিধা লাভ করেছিল।

  • মুঘল কোশাগারে বছরে তিন হাজার টাকা শুল্ক হিসেবে প্রদানের বিনিময়ে বাংলায় বিনাশুল্কে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য করার অধিকার দেওয়া হয়।
  • কলকাতার আশেপাশে ৩৮টি গ্রাম কিনে কোম্পানির জমিদারির অধীনে আনার অনুমতি দেওয়া হয়।
  • মুর্শিদাবাদে সম্রাটের টাঁকশালে হিসাবমতো রুপো জমা দেওয়ার বিনিময়ে কোম্পানিকে কোম্পানির মুদ্রা ছাপিয়ে নেওয়ার অধিকার দেওয়া হয়।
  • বাংলায় কোম্পানির বাণিজ্য ও পণ্য চলাচলে বাধা সৃষ্টি এবং অতিরিক্ত কর বা শুল্ক ধার্য না করার জন্য বাংলার নবাবকে নির্দেশ দেওয়া হয়।
  • বাংলার বাইরে অন্যান্য বাণিজ্যকেন্দ্রে যথা- হায়দরাবাদ, মাদ্রাজ প্রভৃতি স্থানে কোম্পানি যে হারে শুল্ক প্রদান করে আসছে তা-ই বহাল রাখা হয়।
  • কোম্পানিকে সুরাট বন্দরেও বিনাশুল্কে বাণিজ্যের অনুমতি দেওয়া হয়, বিনিময়ে কোম্পানি বাদশাহকে বছরে দশ হাজার টাকা দিতে অঙ্গীকার করে।
  • বোম্বাই-এর টাঁকশালে ছাপানো কোম্পানির মুদ্রা মুঘল সাম্রাজ্যের সর্বত্র বৈধ মুদ্রা বলে স্বীকৃত হয়।

উপসংহার

ফাররুখশিয়রের ফরমান প্রদান ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসে এক গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা। সি আর উইলসন বলেছেন, ‘ফাররুখশিয়র ফরমান ইংরেজদের কূটনৈতিক জয়ের প্রতীক।’ ঐতিহাসিক ওরম্ (Orme) ফাররুখশিয়র ফরমানকে ব্রিটিশ-বাণিজ্যের ম্যাগনা কার্টা বা মহাসনদ বলে অভিহিত করেছেন।

১০। পলাশির যুদ্ধের কারণগুলি উল্লেখ করো। 

অথবা,

সিরাজের সঙ্গে কোম্পানির বিরোধের কারণগুলি আলোচনা করো।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দে পলাশির প্রান্তরে বাংলার নবাব সিরাজ উদ-দৌলা ও ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে যে যুদ্ধ হয়েছিল, তা ইতিহাসে পলাশির যুদ্ধ নামে পরিচিত। বাংলার নবাব আলিবর্দি খানের মৃত্যুর পর তার কনিষ্ঠা কন্যা আমিনা বেগমের পুত্র সিরাজ উদ-দৌলা বাংলার নবাব হন (১৭৫৬ খ্রি.)। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে বিভিন্ন কারণে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটেছিল এবং এই বিবাদের পরিণতি হিসেবেই পলাশির যুদ্ধ হয়েছিল।

পলাশির যুদ্ধের কারণ

(i) ইংরেজ কোম্পানির ষড়যন্ত্র: সিরাজ উদ-দৌলা যখন বাংলার নবাব হন তখন তার আত্মীয়স্বজনেরা তার বিরোধিতা করেছিলেন। সুযোগ বুঝে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সিরাজ-বিরোধী ঘসেটি বেগম ও সৌকত জঙ্গ-এর সঙ্গে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সিরাজ উদ-দৌলা এই ষড়যন্ত্রের কথা জানতে পেরে ইংরেজ কোম্পানিকে উচিত শিক্ষা দিতে চেয়েছিলেন।

(ii) দুর্গ নির্মাণ সংক্রান্ত বিরোধ: বাংলায় ইংরেজ এবং ফরাসি কোম্পানি দুর্গ নির্মাণ করে তাদের ক্ষমতা বৃদ্ধি করতে চেয়েছিল। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা এই বিদেশি কোম্পানিগুলিকে দুর্গ নির্মাণ বন্ধের নির্দেশ দিলে নবাবের নির্দেশ ফরাসিরা মেনে নেয়, কিন্তু ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি তা অগ্রাহ্য করে। এর ফলে নবাব সিরাজ উদ-দৌলার সঙ্গে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সম্পর্কের অবনতি ঘটে।

(iii) দস্তকের অপব্যবহার: সর্বোপরি ইংরেজদের সঙ্গে নবাবের সম্পর্কের চূড়ান্ত অবনতি ঘটে দস্তকের অপব্যবহারকে কেন্দ্র করে। মুঘল সম্রাট ফাররুখশিয়রের ফরমান অনুযায়ী শুধুমাত্র কোম্পানি দস্তক অর্থাৎ বিনাশুল্কে বাণিজ্যের ছাড়পত্র পেয়েছিল, কোম্পানির কর্মচারীরা নয়। কিন্তু কোম্পানির কর্মচারীরা এই সুযোগের অপব্যবহার করতে শুরু করলে সিরাজ ইংরেজদের উপর ক্ষুব্ধ হন।

(iv) কৃষ্ণদাস প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বিরোধ: ঘসেটি বেগমের প্রিয়পাত্র ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভের বিরুদ্ধে নবাবি তহবিল তছরুপের অভিযোগ ছিল। নবাব সিরাজ উদ-দৌলা মুর্শিদাবাদে এসে তাকে হিসাবপত্র দেখানোর নির্দেশ দেন। তখন দেওয়ান রাজবল্লভ তার পুত্র কৃষ্ণদাসকে প্রচুর ধনরত্নসহ কলকাতায় ইংরেজদের কুঠিতে পাঠিয়ে দেন। নবাব বারংবার কৃষ্ণদাসকে প্রত্যর্পণ করার নির্দেশ দিলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ অগ্রাহ্য করে।

(v) নবাবের দূতকে অপমান: নবাবের সঙ্গে ইংরেজ কোম্পানির দুর্গ নির্মাণ, কৃষ্ণদাস প্রত্যর্পণ সংক্রান্ত বিরোধের মীমাংসার জন্য নবাব নারায়ণ দাসকে দূত হিসেবে কলকাতায় পাঠান। ইংরেজরা নারায়ণ দাসকে অপমান করলে নবাব ইংরেজদের প্রতি ক্ষুব্ধ হন।

(vi) নবাবের প্রতি ইংরেজ কোম্পানির অপমানজনক আচরণ : সিরাজ উদ-দৌলা বাংলার মসনদে বসার পর প্রচলিত রীতি অনুযায়ী ফরাসি, ওলন্দাজ প্রমুখ বিদেশি বণিকরা প্রত্যেকেই তাকে অভিনন্দন জানায়। তারা প্রথা মেনে উপঢৌকন পাঠালেও ইংরেজরা ছিল এর ব্যতিক্রম। ফলে ইংরেজ কোম্পানির এই অপমানজনক ব্যবহার সিরাজকে ক্ষুব্ধ করে তোলে।

আলিনগরের সন্ধিভঙ্গ

এরপর নবাব সিরাজ উদ-দৌলা কলকাতা আক্রমণ ও দখল করেন। কলকাতার নাম রাখেন আলিনগর। এই সংবাদে রবার্ট ক্লাইভ ও ওয়াটসন মাদ্রাজ থেকে এসে কলকাতা পুনর্দখল করেন। যুদ্ধ না হয়ে দুপক্ষে আলিনগরের সন্ধি হয় (১৭৫৭, ৯ ফেব্রুয়ারি)। এর একটি শর্ত ছিল- নবাব ফরাসিদের সাহায্য করবেন না। কিন্তু চন্দননগরের ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয়লাভ করে। ক্লাইভ তখন সন্ধিভঙ্গের অপরাধে নবাবের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

অতঃপর ইংরেজরা নবাব সিরাজ উদ-দৌলার বিরুদ্ধে মির জাফরের সঙ্গে ষড়যন্ত্র করে এবং ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন পলাশির যুদ্ধে সিরাজ উদ-দৌলাকে চূড়ান্তভাবে পরাজিত করে।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top