আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা নাটক ও যাত্রা প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester WBCHSE

১। বাংলা নাট্যসাহিত্যে মধুসূদনের কৃতিত্ব আলোচনা করো
১৮৫৮ সালে বেলগাছিয়া থিয়েটারে রামনারায়ণ তর্করত্নের ‘রত্নাবলী’ নাটকের আমন্ত্রিত দর্শক হিসেবে উপস্থিত হয়ে অভিনয় দেখার পর অতৃপ্ত মধুসূদন দত্ত বাংলা ভাষা ও সংস্কৃতির দুঃসময়ে বাংলা ভাষায় রসোত্তীর্ণ নাটক রচনায় ব্রতী হন।
মধুসূদনের নাটকগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যায়। যথা-
(1) পৌরাণিক নাটক: ‘শর্মিষ্ঠা’ (১৮৫৯), ‘পদ্মাবতী’ (১৮৬০), মায়াকানন (১৮৭৪)।
(2) ঐতিহাসিক নাটক: ‘কৃষ্ণকুমারী’ (১৮৬১)।
(3) প্রহসন: ‘একেই কি বলে সভ্যতা?’ (১৮৬০), ‘বুড় সালিকের ঘাড়ে রোঁ’ (১৮৬০)।
নাট্যবৈশিষ্ট্য
(1) প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য নাট্যরীতির অপূর্ব সংমিশ্রণে বাংলা নাট্যসাহিত্যে নতুন করে প্রাণসঞ্চার করেন।
(2) তাঁর নাটকের সংলাপ অনেক স্থানে একঘেঁয়ে ও বৈচিত্র্যহীন হলেও প্রহসনে তিনি যে সংলাপ ব্যবহার করেছেন তার নাট্যগুণ অসাধারণ।
(3) তিনি গ্রিক নাটকের ঐক্যবিধি অনুসরণ করেছেন। এজন্য তাঁর নাটকের কাহিনি দৃঢ় সংবদ্ধ ও গতিশীল।
(4) বাংলা নাটকেও অমিত্রাক্ষর ছন্দের সফল প্রয়োগ করেছেন।
২। ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদকের নামোল্লেখসহ ‘নীলদর্পণ’ নাটক সম্পর্কে আলোচনা করো।
অথবা,
দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক সম্পর্কে আলোচনা করো।
নাট্যকার মধুসূদন দত্ত ‘The Indigo Planting Mirror’ নামে লঙ সাহেবের সহায়তায় ‘নীলদর্পণ’ নাটকের ইংরেজি অনুবাদ করেন।
‘নীলদর্পণ’ গ্রন্থটির বিষয় নীল চাষ, নীল চাষকে কেন্দ্র করে নীলকরদের অত্যাচার এবং সেই অত্যাচারের বিরুদ্ধে সংগ্রামের কাহিনি। নাটকটি উদ্দেশ্যমূলক। নাট্যকারের উদ্দেশ্য ছিল- (১) ইংরেজ স্বার্থপরতা ত্যাগ, (২) নিরাশ্রয় প্রজাদের মঙ্গল, (৩) বিলাতের মুখরক্ষা। বলাবাহুল্য এই তিন উদ্দেশ্যই সার্থক হয়েছিল।
স্বরপুর গ্রামের অধিবাসী গোলোকচন্দ্র বসু। তাঁর বড়ো ছেলে নবীনমাধব গ্রামের দরিদ্র কৃষকদের রক্ষা করতে নীলকর সাহেবদের বিরাগভাজন হন। এই নাটকের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল-গোলোকচন্দ্র বসু, নবীনমাধব, বিন্দুমাধব, সাবিত্রী, সাধুচরণ, আদুরী, ক্ষেত্রমণি, তোরাপ, উড সাহেব, রোগ সাহেব প্রমুখ।
‘নীলদর্পণ’ একটি সমাজ বিপর্যয়ের আখ্যান। ব্যক্তির ট্র্যাজেডি অপেক্ষা গোষ্ঠীর ট্র্যাজেডিই এই নাটকে প্রাধান্যলাভ করেছে। কাহিনি অখণ্ডভাবে ঐক্য রক্ষা করতে না পারায় ঘটনাও পারস্পরিকভাবে অবিচ্ছেদ্য থাকেনি। তাই নাটকের অখণ্ডতা হারিয়ে অনেকাংশে ‘নীলদর্পণ’ নাট্যচিত্র হয়ে উঠেছে। ১৮৭২ সালের ৭ সেপ্টেম্বর ন্যাশনাল থিয়েটারে নাটকটি প্রথম মঞ্চস্থ হয়। সাধারণ রঙ্গালয়ে এই নাটক অভিনয়ের সঙ্গে সঙ্গে বাঙালি সমাজে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি হয়। নবগোপাল মিত্র ‘নীলদর্পণ’-এর অভিনয়কে ‘An event of historical importance’ বলেছেন।
৩। গিরিশ ঘোষকে ইংল্যান্ডের কোন্ সুঅভিনেতার সঙ্গে তুলনা করা হয়? তাঁর রচিত দুটি করে পৌরাণিক, সামাজিক, ঐতিহাসিক নাটক ও প্রহসনের উদাহরণ দাও।
বাংলা নাট্যসাহিত্যের ইতিহাসে সর্বাধিক যশস্বী নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষকে ইংল্যান্ডের সুঅভিনেতা গ্যারিকের সঙ্গে তুলনা করা হয়।
গিরিশ ঘোষ রচিত নাটকের উদাহরণ
(1) পৌরাণিক নাটক: ‘অভিমন্যুবধ’ (১৮৮১), ‘সীতার বনবাস’ (১৮৮২)।
(2) সামাজিক নাটক: ‘প্রফুল্ল’ (১৮৮৯), ‘বলিদান’ (১৯০৫)।
(3) ঐতিহাসিক নাটক: ‘কালাপাহাড়’ (১৮৯১), ‘সিরাজদৌল্লা’ (১৯০৬)।
(4) প্রহসন: ‘বড়দিনের বখশিস’ (১৮৯৩), ‘আবুহোসেন’ (১৮৯৩) প্রভৃতি।
৪। ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় গিরিশচন্দ্র ঘোষকে কী বলে অভিহিত করা হয়েছে? তাঁর নাট্যবৈশিষ্ট্যগুলি লেখো।
নট ও নাট্যকার গিরিশচন্দ্র ঘোষকে ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’ পত্রিকায় ‘আধুনিক রঙ্গমঞ্চের জনক’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। (তাঁরই উদ্যোগে ‘ন্যাশনাল থিয়েটার’ নামে সর্বপ্রথম পেশাদারি থিয়েটার প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৭২ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে।)
গিরিশচন্দ্র ঘোষের নাট্যবৈশিষ্ট্য
(1) ভক্তিভাব ও পৌরাণিক আদর্শের আনুগত্য লক্ষ করা যায়।
(2) ঘটনার অত্যধিক বাহুল্য নাট্যরসের পক্ষে বিঘ্নকর এবং নাট্যরসিকের কাছে পীড়াদায়ক।
(3) কলকাতার সাধারণ গৃহস্থের ছবিই তাঁর নাটকের উপজীব্য বিষয়।
(4) শেকসপিয়রীয় নাট্যাদর্শ অনুসরণ ও গৈরিশ ছন্দের প্রবর্তন বাংলা নাট্যসাহিত্যে অভিনব সংযোজন।
(5) গভীর জীবন জিজ্ঞাসার মাধ্যমে সাবলীল ও গতিশীল সংলাপ ব্যবহার করে দর্শকদের হৃদয়গ্রাহী হয়েছেন।
৫। দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের নাটককে ক-টি শ্রেণিতে ভাগ করা হয় ও কী কী? প্রতিটি শ্রেণির কমপক্ষে তিনটি করে নাটকের নাম লেখো।
বঙ্গ নাট্যসাহিত্যের নবযুগের নব রূপকার দ্বিজেন্দ্রলাল একাধারে কবি, নাট্যকার, সুরকার, গায়ক এবং স্বদেশ মুক্তিপ্রেমিক। তাঁর নাট্যসম্ভারকে চারটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা-ঐতিহাসিক নাটক, পৌরাণিক নাটক, সামাজিক নাটক, প্রহসন।
দ্বিজেন্দলালের নাটকের শ্রেণি অনুসারে তিনটি করে নাটক
(1) ঐতিহাসিক নাটক : ‘নূরজাহান’ (১৯০৮), ‘মেবার’-এর পতন (১৯০৮), ‘সাজাহান’ (১৯০৯), ‘চন্দ্রগুপ্ত’ (১৯১১)।
(2) পৌরাণিক নাটক : ‘পাষাণী’ (১৯০০), ‘সীতা’ (১৯০৮), ‘ভীষ্ম’ (১৯১৪)।
(3) সামাজিক নাটক : ‘পরপারে’ (১৯১২), ‘বঙ্গনারী’ (১৯১৫)।
(4) প্রহসন: ‘কল্কি অবতার’ (১৮৯৫), ‘বিরহ’ (১৮৯৭), ‘প্রায়শ্চিত্ত’ (১৯০২), ‘আনন্দবিদায়’ (১৯১২) ইত্যাদি।
৬। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত কৌতুক নাট্য, নৃত্যনাট্য ও রূপক সাংকেতিক নাটকের তিনটি করে উদাহরণ দাও।
বহুমুখী প্রতিভাধর, প্রবাদপ্রতিম রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সাহিত্যের বহু বিচিত্র শাখার ন্যায় নাট্যসাহিত্যের রাজাধিরাজ। তাঁর রচিত কৌতুক নাট্য, নৃত্য ও রূপক সাংকেতিক নাটকগুলি হল-
(1) কৌতুক নাটক: ‘গোড়ায় গলদ’ (১৮৮২), ‘বৈকুণ্ঠের খাতা’ (১৮৯৭), ‘চিরকুমার সভা’ (১৯২৫)।
(2) নৃত্যনাট্য: ‘চিত্রাঙ্গদা’ (১৯৩৬), ‘চণ্ডালিকা’ (১৯৩৭), ‘শ্যামা’ (১৯৩৯)।
(3) রূপক সাংকেতিক নাটক : ‘শারদোৎসব’ (১৯০৮), ‘অচলায়তন’ (১৯১২), ‘ডাকঘর’ (১৯১২), ‘রক্তকরবী’ (১৯২৪)।
৭। নাট্যকাব্য ও কাব্যনাট্য বলতে কী বোঝ? রবীন্দ্রনাথের এই শ্রেণির নাটকের উদাহরণ দাও।
নাট্যকাব্য ও কাব্যনাট্যের ভেদরেখাটি বিতর্কিত হলেও এ দুয়ের যে পার্থক্য শ্রীকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রবীন্দ্রসৃষ্টি সমীক্ষায় চিহ্নিত করেছেন তা বিশেষ প্রণিধানযোগ্য-“যেখানে কাব্যগুণের প্রাধান্য ও নাট্যরস কাব্যবেষ্টনী সংহত-সেখানেই নাট্যকাব্য।”
“যেখানে কাব্যগুণ নাট্যগুণকে অতিক্রম না করিয়া হয় উহার সমশক্তিসম্পন্ন সহযোগিতা অথবা আনুগত্য সম্পর্কে আবদ্ধ হইয়াছে সেখানে কাব্যনাট্য।”
(1) রবীন্দ্রনাথের নাট্যকাব্যের উদাহরণ: ‘বিদায়’, ‘অভিশাপ’, ‘কর্ণকুন্তী সংবাদ’, ‘গান্ধারীর আবেদন’, ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ ইত্যাদি।
(2) কাব্যনাট্যের উদাহরণ: ‘রুদ্রচণ্ড’, ‘প্রকৃতির প্রতিশোধ’, ‘রাজা ও রাণী’, ‘বিসর্জন’, ‘মালিনী’ ইত্যাদি।
৮। IPTA কী ও কীভাবে গড়ে উঠেছিল এবং এর আদর্শ কী ছিল? কয়েকজন এই গোষ্ঠীর নাট্যকারের নাম লেখো।
IPTA হল একটি ভারতীয় গণনাট্য সংঘ। IPTA-এর সম্পূর্ণ নাম ‘Indian Peoples Theatre Association’।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ও ভারত ছাড়ো আন্দোলন, পঞ্চাশের মন্বন্তরে বাংলার ভয়াবহ লোকক্ষয়, অর্থনৈতিক মন্দা, কালোবাজারি, চোরাকারবারির দিনে যুগসংকটের নিদারুণ তমসাচ্ছন্ন পটভূমিতে বাংলা নাটক ও নাট্যমঞ্চ প্রায় অচল-অসাড় হয়ে পড়ায় পুনরুজ্জীবিত করতে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টি তার সামাজিক দায়বদ্ধতায় সাহিত্য ও সংস্কৃতির মধ্যে গণমুখী সংগ্রামী চেতনা প্রতিফলিত করতে সচেষ্ট হন। ফ্যাসিবিরোধী লেখক ও শিল্পীসংঘ নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিরা সাম্যবাদী আদর্শে অনুশীলিত করতে বদ্ধপরিকর হন। এমন সময় ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্য দিবালোকে প্রগতিশীল লেখক সোমেনচন্দ্র খুন হন (১৯৪২, ৮ মার্চ)। এর প্রতিক্রিয়ায় ১৯৪৩ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ভারতীয় গণনাট্য সংঘ IPTΑΙ .
গণনাট্য সংঘের আদর্শগুলি
(1) নাটক বা যে-কোনো শিল্পে বাস্তবজীবন সমস্যার রূপায়ণ থাকবে।
(2) ব্যক্তি নায়কের পুরানো চিন্তার অনবর্তন চলবে না, মুখ্য হয়ে উঠবে সমষ্টির কথা।
(3) নাট্যশিল্পের উদ্দেশ্য হবে জনতার মনোরঞ্জন, একইসঙ্গে শিক্ষাবিধান।
গণনাট্য ধারার কয়েকজন নাট্যকার হলেন-বিজন ভট্টাচার্য, দিগিন্দ্রচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।
৯। ‘নবনাট্য আন্দোলন’ সম্পর্কে আলোচনা করো।
জনসাধারণকে নিয়ে জনসাধারণের জন্য রাজনৈতিক সচেতনতা বৃদ্ধি, মানবিক দায়বদ্ধতা গণনাট্য পরবর্তী পর্যায়ে ‘নবনাট্য’ আন্দোলনের হাতিয়ার হয়ে উঠেছিল। নবনাট্য সম্পর্কে গঙ্গাপদ বসু মন্তব্য করেছেন, “মোটামুটি বলা যায়, সৎ মানুষের নতুন জীবনবোধের এবং নতুন সমাজ ও বলিষ্ঠ জীবন গঠনের মহৎ প্রয়াস যে সুলিখিত নাটকে শিল্পসুষমায় প্রতিফলিত, একেই বলতে পারি নবনাট্যের নাটক এবং এইরকম নাটক নিয়ে মঞ্চে সমাজসচেতন শিল্পীর সত্য ও রিয়ালিটির যে অন্বেষণ তাকেই বলতে পারি নবনাট্য আন্দোলন।”
নবনাট্য আন্দোলনে সেজন্য সুগভীর সমাজমনস্কতার সঙ্গে মানুষের সহজিয়া জীবনযাত্রা, কৃষক-শ্রমিকদের হাঁড়ির খবর-মাটির কথা অনুসন্ধানে তৎপর হন নাট্যশিল্পীরা। তারই ফলশ্রুতি হিসেবে দেখা যায় শ্রমিক-কৃষক, বঞ্চিত শ্রমজীবী জীবন, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি, পুঁজিপতিদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম প্রাধান্যলাভ করে এবং সকল শ্রেণির মানুষেরা অনৈতিকতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হন। মানুষের মৃত্যু আর মনুষ্যত্বের অপমৃত্যুর দহন জ্বালায় নাট্যকারের চরিত্র-সংলাপ হয়ে ওঠে শানিত ফলা। নবজীবনের সুর এই নাট্য আন্দোলনে স্পন্দিত হওয়ায় মানুষ আগামীকে ঘিরে বাঁচার আশ্বাস খুঁজে পান। জাতীয় জীবনের সামগ্রিক সাংস্কৃতিক চেতনায় নবনাট্য আন্দোলন প্রসারলাভ করে।
১০। গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ কে ছিলেন এবং তাঁর রচিত নাটকগুলির নাম লেখো।
গণনাট্য আন্দোলনের পথিকৃৎ হলেন নাট্যকার সুঅভিনেতা কলাবিদ, নাট্যপরিচালক বিজন ভট্টাচার্য।
বিজন ভট্টাচার্য পঁচিশটিরও বেশি নাটক রচনা করেছেন। তাঁর নাটকগুলিকে কয়েকটি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল-
(1) পূর্ণাঙ্গ নাটক: ‘নবান্ন’ (১৯৪৩), ‘অবরোধ’ (১৯৪৭), ‘গোত্রান্তর’ (১৯৫৭), ‘মাস্টারমশাই’ (১৯৬১), ‘জতুগৃহ’ (১৯৬২), ‘মরাচাঁদ’ (১৯৪৬), ‘ছায়াপথ’ (১৯৬১), ‘ধর্মগোলা’ (১৯৬৭), ‘গর্ভবতী জননী’ (১৯৭১), ‘সোনার বাংলা’ (১৯৭১) ইত্যাদি।
(2) একাঙ্ক নাটক: ‘আগুন’ (১৯৪৩), ‘জবানবন্দি’ (১৯৪৩), ‘কলঙ্ক’ (১৯৫০), ‘জননেতা’ (১৯৫০), ‘হাঁসখালির হাঁস’ (১৯৭৭), ‘লাশ ঘুইর্যা যাউক’ (১৯৭০)।
(3) রূপক নাটক: ‘স্বর্ণকুম্ভ’ (১৯৭০)।
(4) গীতিনাট্য: ‘জীয়নকন্যা’ (১৯৪৮)।
(5) নাট্য রূপায়ণ: ‘গুপ্তধন’ (১৯৭২), ‘নীলদর্পণ’ (১৯৭২)।
(6) চিত্রনাট্য: ‘নাগিন’, ‘বসু পরিবার’, ‘সাড়ে চুয়াত্তর’, ‘ডাক্তারবাবু’, ‘তৃষ্ণা’ ইত্যাদি।
১১। ‘বাংলা নাট্যধারায় নতুনত্বের প্রতিষ্ঠাতা বিজন ভট্টাচার্য।’ -মন্তব্যটির যৌক্তিকতা/সার্থকতা বিচার করো।
বাংলা নাট্যরচনায় চিরাচরিত ঐতিহ্য থেকে সরে এসে সাধারণ মানুষের জীবন সমস্যার কথা সাধারণ মানুষকে দেখানোর উদ্দেশ্য নিয়ে নাটক রচনায় যাঁরা ব্রতী হয়েছিলেন, তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন বিজন ভট্টাচার্য।
(1) গণনাট্য সংঘের আদর্শগুলি: নাট্যধারায় নতুনত্ব: সুগভীর সমাজচেতনা ও প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রসারের মাধ্যমে বাংলা নাটককে তিনি নতুনত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন। হিরণকুমার সান্যাল তাঁর নাট্যপ্রতিভা বিষয়ে আলোচনা করতে গিয়ে মন্তব্য করেছেন, “সংলাপে, বিষয়বস্তুতে, ঘটনা সমাবেশে, বিজনবাবুর কলম ও কল্পনা এতদূর এগিয়েছে যে বাংলা রঙ্গমঞ্চ ও বাংলা সাহিত্যে তিনি নতুন হাওয়া এনেছেন, এ কথা না বললে তার প্রতি অবিচার হবে।” তিনি আরও বলেছেন, “নবান্ন সত্যিকারের জননাট্যের পথ তৈরি করেছে।”
(2) বিজন ভট্টাচার্যের নাট্যবৈশিষ্ট্য:
- সমসাময়িক সমস্যা, আর্থসামাজিক, আর্থরাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সাধারণ মানুষের সুখ-দুঃখ, শোষণ-বঞ্চনার করুণ কাহিনি বাস্তবে রাঙা হয়ে উঠেছে তাঁর সৃষ্ট নাটকের বিষয়বিন্যাসে, চরিত্র ও সংলাপে।
- মার্কসবাদী নন্দন তত্ত্বের প্রয়োগে তিনি অভিনবত্ব দেখিয়েছেন।
- মঞ্চায়নে নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুতিকরণ ও ব্যক্তি অভিনয়ের বদলে দলগত সংহতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন।
- বাস্তবের গণজীবনের ছবি, দুর্গতি ও প্রতিবাদ-প্রতিরোধ চিত্র প্রাণবন্ত রূপে প্রকাশ পেয়েছে।
মন্তব্য
বাংলা নাট্যসাহিত্যে পুরোনো নাট্যধারার সংস্কার করে নতুন ধারা গণনাট্য ও নবনাট্য আন্দোলন প্রতিষ্ঠা করে নাট্যধারার গতিকে ত্বরান্বিত করেছেন। বিদেশীয় ও রবীন্দ্র নাট্যরীতির অনুরণনে নতুন নাট্যধারায়, প্রচলনের পথদ্রষ্টা হওয়ায় উদ্দিষ্ট মন্তব্যটি যথার্থ বলে আমার অভিমত।
১২। ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ যিনি গড়ে তোলেন তাঁর কয়েকটি নাটকের নাম উল্লেখ করে তাঁর নাটকের বৈশিষ্ট্য লেখো। অথবা, উৎপল দত্তের নাট্যপ্রতিভার পরিচয় দাও।
‘গণনাট্য সংঘ’ থেকে বেরিয়ে এসে নাট্যকার উৎপল দত্ত ‘লিটল থিয়েটার গ্রুপ’ গড়ে তোলেন।
উৎপল দত্ত প্রায় সত্তরটির মতো নাটক রচনা করেছেন। তাঁর উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল-
(1) নাট্যসম্ভার: ‘ছায়ানট’ (১৯৫৪), ‘অঙ্গার’ (১৯৫৯), ‘ফেরারী ফৌজ’ (১৯৬১), ‘রাতের অতিথি’ (১৯৬৩), ‘কল্লোল’ (১৯৬৮), ‘মানুষের অধিকার’ (১৯৬৮), ‘রাইফেল’ (১৯৬৮), ‘ব্যারিকেড’ (১৯৭২), ‘টিনের তলোয়ার’ (১৯৭৩), ‘লেনিন কোথায়’ (১৯৭৬), ‘তিতুমীর’ (১৯৭৮), ‘নীল সাদা লাল’ (১৯৮১), ‘একলা চলো রে’ (১৯৮৯) প্রভৃতি।
(2) উৎপল দত্তের নাট্যবৈশিষ্ট্য:
(1) উৎপল দত্ত সমাজ পরিবর্তনের হাতিয়ার হিসেবে নাটককে ব্যবহার করেছেন।
(2) তাঁর নাটকে ফ্যাসিবাদ, পুঁজিবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছে সাধারণ মানুষকে।
(3) পরিবেশের পুঙ্খানুপুঙ্খ বাস্তবতা এবং চরিত্রের যথাযথ রূপায়ণ ঘটেছে তাঁর নাটকে।
(4) ইতিহাসনির্ভর সংগ্রাম, মানুষের জীবনের দ্বান্দুিক বাস্তবতা প্রতিবাদী চরিত্র ও সংলাপে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে।
১৩। বাদল সরকারের প্রকৃত নাম কী এবং তাঁর প্রতিষ্ঠিত নাট্যদলের নাম লেখো। তাঁর রচিত কয়েকটি নাটকের নাম লেখো।
বাংলা নাট্যজগতে আলোড়ন সৃষ্টিকারী বাদল সরকারের প্রকৃত নাম সুধীন্দ্রনাথ সরকার। ১৯৬৮ সালের প্রচলিত নাট্যধারার বাইরে এক তৃতীয় নাট্যচর্চার গতিকে ত্বরান্বিত করতে ‘শতাব্দী’ নামে তিনি নাট্যদল প্রতিষ্ঠা করেন।
বাদল সরকার রচিত উল্লেখযোগ্য নাটকগুলি হল
‘বড়ো পিসীমা’ (১৯৬১) ‘এবং ইন্দ্রজিৎ’ (১৯৬৫), ‘রাম-শ্যাম-যদু’ (১৯৬২), ‘বাকি ইতিহাস’ (১৯৬৭), ‘পাগলা ঘোড়া’ (১৯৬৭), ‘ত্রিংশ শতাব্দী’ (১৯৬৯), ‘মিছিল’ (১৯৭৪), ‘সুখপাঠ্য ভারতবর্ষের ইতিহাস’ (১৯৭৬), ‘যদি আর একবার’ (১৯৭৬) প্রভৃতি।
১৪। অ্যাবসার্ড নাটক কাকে বলে? বাংলা নাট্যসাহিত্যে এই নাট্যরীতির পথিকৃৎ কে এবং তাঁর নাট্যবৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
সুসংহত নিয়মবদ্ধ নাটক, যাকে পরিভাষায় বলা হয়ে থাকে ‘Well made play’-তারই বিরুদ্ধ প্রতিক্রিয়ায় পাশ্চাত্যের আধুনিক নাট্যচর্চার অন্যতম ফসল অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট নাটক। বিষয়বস্তু, আঙ্গিক, মঞ্চরীতি, অভিনয় ইত্যাদি সমস্ত বিভাগেই যে নাটক স্বতন্ত্র, দুরধিগম্য, মহাযুদ্ধোত্তর জীবনদর্শন ও প্রশ্ন জিজ্ঞাসার এক দুঃসাহসিক অভিজ্ঞান।
বাংলা নাট্যসাহিত্যে এই নাট্যরীতির পথিকৃৎ হলেন থার্ড থিয়েটার আন্দোলনের প্রবক্তা বাদল সরকার।
বাদল সরকারের নাট্যবৈশিষ্ট্য
(1) তাঁর নাটকে মানুষকে দেখা গেল নির্বান্ধব, বৈরী, বিশ্বে বিচ্ছিন্ন, বিপন্ন এক জীব হিসেবে-যার কোনো উদ্দেশ্য নেই, যার দিনযাপনের কোনো অর্থ নেই।
(2) বিষয়, রীতি, মুক্ত মঞ্চে অভিনয় প্রভৃতি ক্ষেত্রে তিনি অভিনবত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।
(3) সংগতি, সামঞ্জস্য ও অর্থময়তার বিরুদ্ধে অ্যাবসার্ড বা উদ্ভট জীবনদর্শন বিদ্রোহ করেছে। অনেকাংশে তাঁর রচনায় অস্বাভাবিক মনস্তত্ত্বধর্মী ভাবনার বহিঃপ্রকাশ লক্ষ করা যায়।
(4) আধুনিক জনজীবনের বিচিত্র সুর-যন্ত্রণা, হতাশা, বিচ্ছিন্নতাবোধ, তাঁর নাটকে বাস্তব চরম সত্যরূপে উদ্ভাসিত হয়েছে।
(5) তাঁর নাটকে নাট্যঘটনার গতি ও কোনো সুনির্দিষ্ট পরিণতি লক্ষ করা যায় না।