বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
বিজ্ঞানের অগ্রগতি ও পরিবেশ সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

আগুনের গোলক থেকে পৃথিবী গড়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই হয়তো জন্ম হয়েছিল প্রকৃতি ও পরিবেশের। ঠিক একই সময় হয়তো বিজ্ঞানেরও সূচনা হয়েছিল। তবে পাথরে পাথরে ঘর্ষণের মাধ্যমে উৎপন্ন আগুনের বিচ্ছুরণের মধ্য দিয়েই আদি মানবের কাছে বিজ্ঞানের আত্মপ্রকাশ আর তখন থেকেই মানুষের হাত ধরে শুরু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির পথচলা।

এ পৃথিবীর বক্ষজুড়ে প্রকৃতি তার সৌন্দর্য বিছিয়ে রেখেছে। ঠিক তেমনভাবেই প্রকৃতির নাড়ির মধ্যে যেন লুকিয়ে আছে নানান বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা। এমনই বিভিন্ন জ্ঞান এবং সম্ভাবনার সঙ্গে মানুষের প্রথম সাক্ষাৎকারের পর পেরিয়ে গেছে অনেক বছর। গ্যালিলিও-নিউটনের যুগ পেরিয়ে আইনস্টাইন, জগদীশচন্দ্র বসু কিংবা সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রমুখের মতো অসামান্য প্রতিভাধর বৈজ্ঞানিকদের উদ্ভাবনী কৌশল এবং মৌলিকতার জোরে মানুষ ঘোষণা করেছে মেধা ও মননের জয়ধ্বনি। শতসহস্র রকমের যন্ত্র ও পণ্য আবিষ্কারের ফলে বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি আজ স্পর্শ করেছে উন্নতির শিখর। দৈনন্দিন জীবনে, শিক্ষায়, চিকিৎসায় নব নব উদ্ভাবন পৃথিবীকে এনে দিয়েছে হাতের মুঠোয়। মানুষের ঘরে ঘরে পৌঁছে গেছে টিভি, কম্পিউটার, ফোন। এখনকার দিনে প্রযুক্তির কল্যাণেই গ্রহ থেকে গ্রহান্তরেও মানুষ বিস্তার করেছে নিজের প্রভুত্ব।

খাদ্য ও জল ব্যতীত কিছু সময় মানুষ বেঁচে থাকলেও আমরা সবাই জানি অক্সিজেন ছাড়া কয়েক মিনিটও বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। কিন্তু সভ্যতার অগ্রগতির নাম করে আজ আমরা এই পৃথিবীকে যেখানে এনে দাঁড় করিয়েছি, সেখানে প্রতিনিয়ত সংগত কারণেই প্রশ্ন উঠছে, বাতাস দূষিত করে আমরা নিজেরাই নিজেদের প্রাণ সংশয়ের কারণ হয়ে উঠছি না তো?

শিল্পবিপ্লব যেমন আশীর্বাদ, তেমনি আধুনিক দূষণের যাত্রাও সেখান থেকেই। কলকারখানায় ও মানুষের প্রাত্যহিক জীবনে কয়লা, তেল, গ্যাসের ব্যবহার রাতারাতি বেড়ে চলেছে। বেড়ে চলেছে কারখানার ধোঁয়া। কারখানার বর্জ্য এসে নদীতে পড়ে জলকে দূষিত করছে। লক্ষ লক্ষ যানবাহন চলতে শুরু করায় বাতাসে কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড, মিথেন, নাইট্রাস অক্সাইডের মতো ক্ষতিকারক গ্যাসের উপস্থিতি বেড়েই চলেছে। এর ফলে স্ট্র্যাটোস্ফিয়ারের ওজোন গ্যাসের আচ্ছাদনে ছিদ্র সৃষ্টি হয়েছে। এর মধ্য দিয়ে প্রবেশ করে চলেছে সূর্যের ক্ষতিকারক আলট্রা ভায়োলেট রশ্মি।

ফলে পৃথিবীর তাপমাত্রা বাড়তে শুরু করেছে ও মেরুর বরফ বেশি করে গলতে শুরু করেছে। মেরুর বরফগলা বাড়তি জল সমুদ্রে পড়ে ধীরে ধীরে সমুদ্রের জলের উচ্চতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। সুন্দরবনের ঘোড়ামারা দ্বীপের কিছু অংশ এই কারণেই জলের নীচে চলে গিয়েছে বলে মনে করেন বিজ্ঞানীরা। পরিবেশ দূষণের ফলে আমাদের ঋতুবৈচিত্র্য নষ্ট হয়ে গেছে। ‘এল নিনো’-র প্রতিক্রিয়ায় এখন ভারতে বর্ষা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। কমে যাচ্ছে বৃষ্টির পরিমাণ, যা এসে সরাসরি আঘাত করছে ফসলের উৎপাদনে। এর সঙ্গেই চলছে বৃক্ষ নিধন। বন কেটে সাফ করে দেওয়া হচ্ছে। হাতি, বাঘ খাবারের অভাবে লোকালয়ে চলে আসছে।

নানা সংরক্ষণ আইন সত্ত্বেও বহু প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে যাচ্ছে। কত পাখি নিখোঁজ হয়ে যাচ্ছে শহরের বুক থেকে। মাতৃক্রোড়ে জন্ম হচ্ছে অপরিণত শিশুর। কোন্ পথে চলেছি আমরা, এই প্রশ্ন উঠছে। জল, জঙ্গল, আকাশ, বাতাস, মাটি আমরা প্রতিদিনই দূষিত করে চলেছি নিজ হাতে।

পরিবেশের বুকে ক্রমবর্ধমান ভারসাম্যহীন উন্নয়ন এবং প্রযুক্তিসর্বস্বতায় মানুষ যতই উপকৃত হোক না কেন, প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ভয়াবহ বিপর্যয়ে মানুষের অস্তিত্ব সম্পূর্ণ নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনাও বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই এই যুগের বিজ্ঞানীরা ‘ইকো-ফ্রেন্ডলি টেকনোলজি’, অর্থাৎ পরিবেশ ও প্রকৃতির সঙ্গে মিতালি স্থাপন করে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তির সাহায্যে মানবসভ্যতার উন্নতিতে জোর দিয়েছেন। এর ফলে তৈরি হচ্ছে নানা ‘বায়ো-ডিগ্রেডেবল’ জিনিস, যেগুলো প্রকৃতির কাছেই আবার ফিরে যেতে পারে। বিদ্যুৎ উৎপাদনে ব্যবহার হচ্ছে সূর্যের রশ্মি এবং খোঁজ চলছে পরিবেশের বিন্দুমাত্র ক্ষতি করে না-এমন বিভিন্ন বিকল্প শক্তির। বিজ্ঞান এবং আধুনিক প্রযুক্তিবিদ্যা নিজের মতো করে পরিবেশবান্ধব হওয়ার চেষ্টা শুরু করেছে। এটাই আশার কথা। তবে সম্পূর্ণ বিপন্মুক্ত আমরা, এমন দাবি করার জায়গা থেকে এখনও যোজন যোজন দূরে আছি। এই আক্ষেপ ও হতাশা থেকেই কবি জীবনানন্দ লিখেছিলেন,

আমাদের এই শতকের 
বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু-বেড়ে যায় শুধু; 
তবু কোথাও তার প্রাণ নেই বলে অর্থময় 
জ্ঞান নেই আজ পৃথিবীতে; জ্ঞানের বিহনে প্রেম নেই।"

-অর্থাৎ প্রয়োজন প্রযুক্তি এবং পরিবেশের মধ্যে এক অর্থপূর্ণ মানবীয় সম্পর্কের বন্ধন। শুধু বিজ্ঞানীরা নয়, সাধারণ মানুষও যদি হাত বাড়িয়ে দেয় এই মেলবন্ধনে, তবেই আগামী দিনে আমরা দেখতে পাব এক সুন্দর পৃথিবীকে।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top