আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা উপন্যাস ও ছোটোগল্প প্রশ্ন উত্তর | Class 11 Second Semester WBCHSE

বাংলা সাহিত্যে বঙ্কিমচন্দ্রের প্রতিভা আলোচনা করো।
“বঙ্কিম বঙ্গসাহিত্যে প্রভাতের সূর্যোদয়ের বিকাশ করিলেন।”
বাংলা উপন্যাসের প্রথম যথার্থ শিল্পী বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘ইন্ডিয়ান ফিলড’ পত্রিকায় ধারাবাহিকভাবে ‘Rajmohan’s Wife’ উপন্যাসের মাধ্যমে উপন্যাস জগতে পাড়ি দিলেও ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘দুর্গেশনন্দিনী’ তাঁর প্রথম সার্থক বাংলা উপন্যাস। তিনি প্রায় ১৪টি বাংলা উপন্যাস রচনা করেছেন। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলিকে তিনটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায়। যথা-
(1) ইতিহাস ও রোমান্স আশ্রয়ী উপন্যাস: ‘দুর্গেশনন্দিনী’ (১৮৬৫), ‘কপালকুণ্ডলা’ (১৮৬৬), ‘মৃণালিনী’ (১৮৬৯), ‘যুগলাঙ্গুরীয়’ (১৮৭৪), ‘চন্দ্রশেখর’ (১৮৭৫), ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২), ‘সীতারাম’ (১৮৮৭) প্রভৃতি।
(2) দেশপ্রেমমূলক তত্ত্বাশ্রয়ী উপন্যাস: ‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২), ‘দেবী চৌধুরাণী’ (১৮৮৪) প্রভৃতি।
(3) সমাজ ও পারিবারিক উপন্যাস: ‘বিষবৃক্ষ’ (১৮৭৩), ‘ইন্দিরা’ (১৮৭৩), ‘রাধারাণী’ (১৮৭৬), ‘রজনী’ (১৮৭৭), ‘কৃষ্ণকান্তের উইল’ (১৮৭৮) প্রভৃতি।
বঙ্কিম সাহিত্যের বৈশিষ্ট্য
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা উপন্যাস ও প্রবন্ধরচনা সাহিত্যের পথিকৃৎ। বিদ্যাসাগরের সংস্কৃতবহুল সাধুগদ্যকে তিনি সুশৃঙ্খল, সুবিন্যস্ত, সাবলীল, সরস করে তুলেছেন। বর্ণনাভঙ্গির অন্তরঙ্গতা, চিন্তা ও কল্পনাশক্তির বিকাশ, ইতিহাস চেতনা, রোমান্টিক কাব্যের অপূর্ব মেলবন্ধন তাঁর সাহিত্যকে চমৎকারিত্ব দান করেছে। এ ছাড়া আখ্যায়িকার কায়াগঠনে, ঘটনাবিন্যাসের নৈপুণ্যে, চরিত্র নির্মাণের কৌশলে, জীবনবোধের গভীরতায়, রূপ ও রসের বৈচিত্র্যে বঙ্কিম সাহিত্য কালের সীমানাকে অতিক্রম করে বিশেষ বৈশিষ্ট্যের সাক্ষ্য বহন করে।
বঙ্কিমচন্দ্রের একটি তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক এবং একটি ঐতিহাসিক উপন্যাসের উদাহরণ দাও। সেই দুটি উপন্যাস সংক্ষেপে আলোচনা করো।
সাহিত্যসম্রাট বঙ্কিমচন্দ্রের একটি তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাসের নাম হল-‘আনন্দমঠ’ (১৮৮২) এবং একটি ঐতিহাসিক উপন্যাস- ‘রাজসিংহ’ (১৮৮২)।
(1) আনন্দমঠ: ছিয়াত্তরের মন্বন্তর ও সন্ন্যাসী বিদ্রোহের পটভূমিতে রচিত তত্ত্ব ও দেশাত্মবোধক উপন্যাস ‘আনন্দমঠ’। উপন্যাসটি ৪টি খণ্ডে ও ৪৬টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত হয়েছে। উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি হল- ভবানন্দ, জীবানন্দ, মহেন্দ্র, ধীরানন্দ প্রমুখ। উপন্যাসে প্রতিধ্বনিত ‘বন্দেমাতরম’ সংগীত সমগ্র বাঙালি জাতিকে দেশপ্রেমে উজ্জীবিত করেছিল। স্বাদেশিকতা, আধ্যাত্মিকতা, কর্মজীবনে কঠোর সন্ন্যাসের আদর্শই ‘আনন্দমঠ’-এর মূল সুর। দেশোদ্ধারকারী ‘সন্তান’ দলের প্রতিষ্ঠানের নাম ‘আনন্দমঠ’। ‘সন্তান’ সম্প্রদায়ের আরাধ্য দেবী স্বদেশ জননী। তাঁদের জীবনের মহামন্ত্রধ্বনি ‘জননীজন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপি গরীয়সী।’
(2) রাজসিংহ: বাংলা সাহিত্যের প্রথম যথার্থ ঐতিহাসিক উপন্যাস রাজসিংহ। ৮টি খন্ডে ৬৪টি পরিচ্ছেদে বিন্যস্ত ‘রাজসিংহ’ উপন্যাস। এই উপন্যাসের মূল চরিত্রগুলি হল-রাজসিংহ, চঞ্চলকুমারী, আওরঙ্গজেব, জেবউন্নিসা, দরিয়া, মোবারক, নির্মলকুমারী, মানিকলাল প্রমুখ। আওরঙ্গজেবের সময়কালীন রাজপুত জাতির বীর্যদীপ্ত ইতিহাস থেকে এই উপন্যাসের কাহিনির উপাদান সংগৃহীত হয়েছে। মূল ঘটনা মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের সঙ্গে উদয়পুরের রাজা রাজসিংহের বিরোধ। মূল কাহিনির পাশাপাশি মানিকলাল-নির্মলকুমারীর ঔরঙ্গজেব নিয়ে গল্পভাষ এবং মোবারক-দরিয়া- জেবউন্নিসাকে নিয়ে উপকাহিনি গঠিত হয়েছে। ঐতিহাসিক ঘটনা ও রসের পাশাপাশি মননশীলতা ও ন্যায়-অন্যায়বোধ উপন্যাসটিকে অন্যতর মাত্রা দান করেছে।
রবীন্দ্রনাথের উপন্যাসগুলিকে ক-টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ও কী কী? তাঁর রচিত ‘চোখের বালি’ উপন্যাস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বাংলা কথাসাহিত্য ধারায় অন্যতম শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। জীবনদৃষ্টির গভীরতা, অন্তর্গুঢ় মনস্তাত্ত্বিক বিশ্লেষণ ও শিল্পশৈলীর অভিনবত্ব তাঁর উপন্যাসে পরিস্ফুট হয়েছে। তাঁর উপন্যাসকে ৪টি শ্রেণিতে বিভক্ত করা যেতে পারে-
(1) ইতিহাসাশ্রয়ী উপন্যাস: ‘বৌঠাকুরাণীর হাট’ (১৮৮৩), ‘রাজর্ষি’ (১৮৮৭)।
(2) পরিবার ও সমাজ দ্বন্দ্বমূলক উপন্যাস: ‘চোখের বালি’ (১৯০৩), ‘নৌকাডুবি’ (১৯০৬), ‘গোরা’ (১৯১০), ‘যোগাযোগ’ (১৯২৯), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)।
(3) স্বদেশচেতনা ও বৃহত্তর সমস্যামূলক: ‘গোরা’ (১৯১০), ‘ঘরে বাইরে’ (১৯১৫), ‘চার অধ্যায়’ (১৯৩৪)।
(4) মিস্টিক ও রোমান্টিক উপন্যাস: ‘চতুরঙ্গ’ (১৯১৫), ‘শেষের কবিতা’ (১৯২৯), ‘দুই বোন’ (১৯৩৩), ‘মালঞ্চ’ (১৯৩৪)।
চোখের বালি (১৯০৩)
বাংলা সাহিত্যের প্রথম মনস্তাত্ত্বিক উপন্যাস চোখের বালি। তাঁর রচিত এই উপন্যাসটি বাংলা উপন্যাসের জগতে নববিপ্লবের উন্মেষ ঘটিয়েছে। ৫৫টি পরিচ্ছেদে আধুনিক চরিত্র ও মনন সমন্বয়ে পরিবার ও সমাজসমস্যা-নির্ভর বিষয়কে কেন্দ্র করে উপন্যাসের প্লট রচিত হয়েছে। মহেন্দ্র এবং আশা, বিহারী ও বিনোদিনীর সমস্যা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যেরই জয় ঘোষণা করেছে। অবচেতনের যন্ত্রণা, দেহের ক্ষুধা এখানে শিল্পসার্থকভাবে রূপায়িত হয়েছে। রবীন্দ্রনাথ বালবিধবার প্রেমকে যেমন অস্বীকার করতে পারেননি, তেমনি সমাজসংস্কারের প্রভাবে স্বাভাবিক জীবনের মধ্যে বিধবার বিয়ে দিতে পারেননি। সেজন্য বিনোদিনীর ঠাঁই হয়েছে তীর্থধামে। বালবিধবা বিনোদিনীর চিত্তে পুরুষের প্রতি দুর্নিবার আকাঙ্ক্ষা ও তার মানসিক টানাপোড়ন এই উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। মনস্তত্ত্ব ও আধুনিকতা বর্ণনার সৌন্দর্যে উপন্যাসটি হৃদয়গ্রাহী হয়ে উঠেছে।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত প্রথম ছোটোগল্পটির নাম লেখো এবং কোন্ পত্রিকায় সেটি প্রকাশিত হয়েছিল? রবীন্দ্রনাথের রচিত গল্পগুলির শ্রেণিবিভাজন করো।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর রচিত প্রথম ছোটোগল্প ‘ভিখারিণী’। ১২৮৪ বঙ্গাব্দে শ্রাবণ-ভাদ্র সংখ্যায় ‘ভারতী’ পত্রিকায় গল্পটি প্রকাশিত হয়েছিল।
বাংলা সাহিত্যে সার্থক ও শ্রেষ্ঠ ছোটোগল্পকার রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তিনি প্রায় ১১৯টির মতো ছোটোগল্প রচনা করেছেন। শিলাইদহে পদ্মার বোটে বসে গ্রামবাংলার অপরূপ প্রকৃতি আর সেখানকার মানুষসহ অন্যান্য জীবকুলকে দেখে দেখে ছোটো ছোটো দুঃখ কথা নিয়ে তিনি ছোটোগল্প রচনা করেন। বিষয়ভাবনার আঙ্গিকে, কাহিনির সরলতায়, চরিত্রগুলির বাস্তবতায় তাঁর প্রতিটি ছোটোগল্প যেন অতি পরিচিত অ্যালবাম। তাঁর গল্পগুলিকে ৪টি শ্রেণিতে বিভাজন করা যেতে পারে-
(1) প্রকৃতি সম্পর্কিত রোমান্টিক ভাবাবেগের গল্প: ‘পোস্টমাস্টার’, ‘সুভা’, ‘ছুটি’, ‘অতিথি’, ‘সমাপ্তি’, ‘একরাত্রি’ প্রভৃতি।
(2) সমাজ সমস্যামূলক গল্প: ‘দেনাপাওনা’, ‘নষ্টনীড়’, ‘সমস্যাপূরণ’, ‘ত্যাগ’, ‘পয়লা নম্বর’ প্রভৃতি। (3) অতিপ্রাকৃত গল্প: ‘নিশীথে’, ‘কঙ্কাল’, ‘মণিহারা’, ‘ক্ষুধিত পাষাণ’, ‘দুরাশা’ প্রভৃতি।
(4) সামাজিক ও পারিবারিক গল্প: ‘শাস্তি’, ‘মধ্যবর্তিনী’, ‘দিদি’, ‘কাবুলিওয়ালা’, ‘রাসমণির ছেলে’ প্রভৃতি।
এ ছাড়াও সমসাময়িক পত্রিকায় প্রকাশের নিরিখে সমস্ত ছোটোগল্পকে তিনটি পর্বে বিভক্ত করা যেতে পারে। (১) হিতবাদী ও সাধনা পত্রিকার যুগ (১৮৯১-১৯০১)। (২) ভারতী ও সবুজপত্রের যুগ (১৯১৪-১৯৩০)। (৩) ‘তিনসঙ্গীর যুগ’ (১৯৩০-১৯৪০)।
শরৎচন্দ্রের উপন্যাসকে ক-টি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় ও কী কী? তাঁর শ্রেষ্ঠ উপন্যাস কোন্ন্টি এবং কেন শ্রেষ্ঠ?
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা কথাসাহিত্যে অমর কথাশিল্পী। তাঁর রচনারীতির প্রধানগুণ সরলতা ও মনোহারিতা। সমাজের পদস্খলিত, অন্তঃজ, অবহেলিত, অতিসাধারণ চরিত্রগুলিকে সাহিত্যের আলোয় তিনি উদ্ভাসিত করেছেন। কাহিনি পরিকল্পনায় ও বর্ণনায় স্বকীয় রসবোধের পরিচয় দিয়েছেন। তাঁর রচিত সাহিত্যকে সাহিত্য সমালোচকেরা মূলত ৫টি শ্রেণিতে বিভাজন করেছেন। যথা-
(1) সমাজ সমালোচনামূলক উপন্যাস: ‘অরক্ষণীয়া’ (১৯১৬), ‘পল্লীসমাজ’ (১৯১৬), ‘বামুনের মেয়ে’ (১৯২০), ‘দেনাপাওনা’ (১৯২৩)।
(2) দাম্পত্য সমস্যামূলক উপন্যাস: ‘শুভদা’ (১৯৩৮), ‘বড়দিদি’ (১৯১৩), ‘চন্দ্রনাথ’ (১৯১৬), ‘বিরাজবৌ’ (১৯১৪), ‘দেবদাস’ (১৯১৭)।
(3) পারিবারিক সমস্যামূলক উপন্যাস: ‘পণ্ডিতমশাই’ (১৯১৪), ‘বৈকুণ্ঠের উইল’ (১৯১৫), ‘নিষ্কৃতি’ (১৯১৭)।
(4) প্রেমপ্রাধান্যমূলক রোমান্টিক উপন্যাস: ‘চরিত্রহীন’ (১৯১৭), ‘পরিণীতা’ (১৯১৮), ‘দত্তা’ (১৯১৮), ‘শ্রীকান্ত’ (১৯১৬, ১৯১৮, ১৯২৭, ১৯৩৩), ‘গৃহদাহ’ (১৯২০)।
(5) তত্ত্বাশ্রয়ী মতবাদমূলক উপন্যাস: ‘পথের দাবী’ (১৯২৬), ‘শেষ প্রশ্ন’ (১৯৩১), ‘বিপ্রদাস’ (১৯৩৫)।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ ও ভিন্ন স্বাদের উপন্যাস ‘শ্রীকান্ত’।
শরৎচন্দ্রের ‘শ্রীকান্ত’ আত্মজীবনীমূলক উপন্যাস। নিজের ব্যক্তিজীবনের ছায়া প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে উপন্যাসের সর্বাংশে ছড়িয়ে রয়েছে। শ্রীকান্ত, রাজলক্ষ্মী, ইন্দ্রনাথ, শ্রীনাথ, অন্নদাদিদি, অভয়া, রোহিণী, মনোহরা, সুনন্দা-প্রতিটি চরিত্র বর্ণনার আতিশয্যে প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠেছে। উপন্যাসটি শ্রেষ্ঠত্বের দাবিদার; কারণ-(১) উত্তম পুরুষে অভিনব আঙ্গিকের প্রবর্তন। (২) ভ্রমণরীতিতে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতায় বিচিত্র ঘটনার বর্ণনা। (৩) ভবঘুরে শ্রীকান্তের মধ্যে নিরাসক্তি বাসা বেঁধেছিল অথচ প্রেম-সহানুভূতির বন্ধনে নানা মানুষের সঙ্গে সে জড়িত। (৪) নিষিদ্ধ সমাজ বিগর্হিত প্রেমের বিশ্লেষণে দুঃসাহসিকতা প্রভৃতি।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ৬টি ছোটোগল্পের নাম লেখো এবং ছোটোগল্পে শরৎচন্দ্রের গুরুত্ব লেখো।
শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় রচিত উল্লেখযোগ্য ৬টি ছোটোগল্প হল- ‘মহেশ’, ‘অভাগীর স্বর্গ’, ‘রামের সুমতি’, ‘কাশীনাথ’, ‘অনুপমার প্রেম’, ‘মন্দির’ প্রভৃতি।
ছোটোগল্পে শরৎচন্দ্রের গুরুত্ব
শরৎচন্দ্র মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত বাঙালির জীবনভাবনার বাস্তব রূপকার। বিশেষত নারীর প্রেম, দুঃখ, বঞ্চনা তাঁর সাহিত্যে বর্ণনার ঢঙে প্রাণবন্ত হয়ে উঠেছে। রোমান্টিক আবেগঘন অনুভূতির বহিঃপ্রকাশ বাস্তবের রঙে রাঙা তাঁর কথাসাহিত্যে। তাঁর ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) বাঙালির সুখ-দুঃখ-বিরোধ-সংঘাত-ঘাত-প্রতিঘাত-বাস্তবতার চিত্র রূপায়িত হয়েছে।
(2) দরিদ্রের অভাব-দুঃখ, আত্মমর্যাদা, সন্দেহপরায়ণতা, উঁচুনীচুর ভেদাভেদ, বঞ্চনা, সামাজিক কলঙ্ক প্রভৃতি।
(3) সহজসরল ভাষার প্রয়োগ আর হৃদয়স্পর্শী ভাবনা চমৎকারিত্ব দান করেছে।
(4) কাহিনির অবয়ব নির্মাণ, জমাট হৃদয়ের নির্মল হাস্যরস ও করুণরসের মেলবন্ধন তাঁর রচনার অন্যতম প্রসাদগুণ।
(5) সুখ আর দুঃখ-মাধুর্যে, সৌন্দর্যে ও বীরত্বে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে নারীচরিত্র।
(6) নিষিদ্ধ প্রেমের বিশ্লেষণে প্রথা ভেঙে কথাশিল্পের জাদুতে চরিত্রগুলিকে সামাজিক স্বীকৃতি দিয়ে নতুন প্রাণপ্রতিষ্ঠা প্রয়াস করেছেন।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রথম ছোটোগল্প ও প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসের নাম লেখো। তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাসটির বিশিষ্টতা সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় রচিত প্রথম ছোটোগল্প হল ‘উপেক্ষিতা’ (গল্পটি প্রবাসী পত্রিকায় মাঘ ১৩২৮ বঙ্গাব্দে প্রকাশিত হয়) এবং তাঁর প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস হল ‘পথের পাঁচালী’ (বিচিত্রা পত্রিকায় আষাঢ় ১৩৩৫ থেকে আশ্বিন ১৩৩৬ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়)।
‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাস সম্পর্কে আলোচনা
প্রথম বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে বাংলা উপন্যাসে সাহিত্যে বিভূতিভূষণের আবির্ভাব। তাঁর প্রথম প্রকাশিত ‘পথের পাঁচালী’ উপন্যাসের পরিচ্ছেদ সংখ্যা-৩৫, পর্ব সংখ্যা-৩ (‘বল্লালী বালাই’, ‘আম আঁটির ভেঁপু’ এবং ‘অক্রুর সংবাদ’)। এই উপন্যাসের প্রধান চরিত্রগুলি হল-অপু, সর্বজয়া, দুর্গা, হরিহর, ইন্দির ঠাকরুণ প্রমুখ। ভাগলপুরে অবস্থানকালে তিনি আত্মজীবনীনির্ভর এমন যুগান্তকারী উপন্যাস রচনা করেন। পথের পাঁচালীর বিশেষত্ব প্রকৃতিপট নির্মাণে নয়, পাঁচালীকারের অধিকতর সানুপুঙ্ক্ষ তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণে। তা ছাড়া পথের পাঁচালীর একমাত্রতা এবং অনন্যতা তার কেন্দ্রীয় চরিত্র নির্বাচনে। তাই অপু ও দুর্গা সমসাময়িক তরঙ্গাঘাত থেকে বিচ্ছিন্ন আলাদা জগতের শিশু। শিশুর মনে যে সোনার কাঠি পরিচিত জগতের তুচ্ছতার মধ্যে এক অলৌকিক মায়ারাজ্য সৃজন করে, বিভূতিভূষণ সেই রূপকথার রাজ্যের রহস্যটি আমাদের আদর্শলোকচ্যুত বয়স্ক অভিজ্ঞতার সম্মুখে বিশ্লেষণ করে তার ইন্দ্রজাল শক্তি সর্বসাধারণের দৃষ্টি নিবদ্ধ করেছেন।
উপন্যাসের অভিনবত্বের দিকগুলি হল
(১) গ্রামবাংলার অতিপরিচিত রূপের মধ্যেও অপরিচিতের বিস্ময় মাধুরী ও রহস্য-সৌন্দর্যের আবিষ্কার। (২) গ্রামবাংলার সাধারণ জনজীবনের অজ্ঞাত, বিস্ময়কর উপাদান সংগ্রহ। (৩) শিশুমনের কৌতূহলী দৃষ্টিতে জগৎ ও জীবনকে উপলব্ধি। (৪) মানবমনের ছোটো ছোটো অনুভূতির সহজ প্রকাশ। (৫) অপুকে আশ্রয় করে তাঁর জীবনের পাঁচালী প্রভৃতি।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় কোন্ উপন্যাসের জন্য, কবে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান? তাঁর সমাজভাবনামূলক ও লোকায়ত ভাবনামূলক উপন্যাসের নাম ও চরিত্রগুলি লেখো।
বাংলা কথাসাহিত্য জগতের অন্যতম আঞ্চলিক ঔপন্যাসিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ‘গণদেবতা’ (১৯৪২) উপন্যাসের জন্য ১৯৬৬ খ্রিস্টাব্দে জ্ঞানপীঠ পুরস্কার পান।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের সমাজভাবনামূলক উপন্যাস ও তাদের চরিত্রসমূহ
- কালিন্দী (১৯৪০): রামেশ্বর, মহীন্দ্র, অহীন্দ্র, হেমাঙ্গিনী, সুনীতি, উমা।
- পঞ্চগ্রাম (১৯৪৩): দেবু ঘোষ, গিরীশ, সতীশ, অনিরুদ্ধ, পদ্ম, ছিরু পাল।
- গণদেবতা (১৯৪২): গিরীশ, হরেন, দ্বারকা, দেবু ঘোষ, অনিরুদ্ধ, পদ্ম।
- ধাত্রীদেবতা (১৯৩৯): শিবনাথ, গৌরী, জ্যোতির্ময়ী, কমলেশ, পিসিমা।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের লোকায়ত ভাবনামূলক উপন্যাস ও তাদের চরিত্রসমূহ
- হাঁসুলী বাঁকের উপকথা (১৯৫১): করালী, সুচাঁদ, বনওয়ারি, নসুবালা।
- নাগিনী কন্যার কাহিনী (১৯৫৫): শবলা, পিঙ্গলা, মহাদেব, গঙ্গাধর, নগুঠাকুর।
তারাশঙ্কর রচিত ৮টি ছোটোগল্পের নাম লেখো। বাংলা ছোটোগল্পে তাঁর অবদান সংক্ষেপে লেখো।
তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের উল্লেখযোগ্য আটটি ছোটোগল্প হল-‘তারিণী মাঝি’, ‘না’, ‘অগ্রদানী’, ‘জলসাঘর’, ‘রায়বাড়ি’, ‘নারী ও নাগিনী’, ‘বেদেনী’, ‘কালাপাহাড়’ প্রভৃতি।
বাংলা ছোটোগল্পে তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন আঞ্চলিক জীবনের কথাকার। তাঁর সাহিত্যে ক্ষয়িষ্ণু গ্রামবাংলার দারিদ্র্যলাঞ্ছিত, ব্যাধিগ্রস্ত জীবনের বাস্তব প্রতিচ্ছবি প্রতিভাসিত হয়েছে। শুধু দারিদ্র্য ও দীনতাই নয়, তাঁর ঐশ্বর্য ও মহিমাকে তিনি আবিষ্কার করেছেন। নতুন জীবনায়নের সার্থক রসশিল্পী হিসেবে রাঢ় অঞ্চলের বিচিত্র জীবনকাহিনি তাঁর সাহিত্যে জীবন্ত হয়ে উঠেছে। বাংলা ছোটোগল্পেও তাঁর গুরুত্ব অপরিসীম-
(1) তাঁর ছোটোগল্পে প্রকাশ পেয়েছে ক্ষয়িষ্ণু জমিদারতন্ত্রের সঙ্গে নবসৃষ্টি বণিকতন্ত্রের সংঘাত।
(2) চরিত্রের দ্বন্দু, নাটকীয়তা এবং কাহিনি ও ঘটনার গতিময়তা তাঁর গল্পের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(3) তাঁর গল্পের ভাষায় মাটির মানুষের ঘাম, রক্ত মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে।
(4) রাঢ় অঞ্চলের বিচিত্র জীবন নিয়ে তাঁর গল্প গড়ে উঠেছে।
(5) তিনি বাস্তবকে অস্বীকার করে কল্পনালোকে পাড়ি দিতে চাননি।
(6) তিনি তাঁর গল্পে সমাজে অন্ত্যজ শ্রেণির মানুষকে যথার্থ মর্যাদা দিয়েছেন।
সৃষ্টির সৌন্দর্যে, অফুরান প্রাণরসে ভরপুর তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছোটোগল্প সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছেন, “তুমি গাঁয়ের কথা লিখেছ। খুব ঠিক ঠিক লিখেছ। আর বড়ো কথা গল্প হয়েছে। তোমার মতো গাঁয়ের মানুষের কথা আগে পড়িনি।”
কল্লোলের কুলবর্ধন কে এবং তাঁর লেখা দুটি রাজনৈতিক গল্পের নাম লেখো। তাঁর রচিত ছোটোগল্পগুলির বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করো।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়কে ‘কল্লোলের কুলবর্ধন’ বলেছেন অচিন্ত্যকুমার সেনগুপ্ত।
মাণিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা দুটি বিখ্যাত রাজনৈতিক গল্প হল- (১) ‘হারানের নাতজামাই’, (২) ‘ছোটোবকুলপুরের যাত্রী’।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা ছোটোগল্পের বৈশিষ্ট্য
বাংলা কথাসাহিত্যে মরমি-দরদি কথাশিল্পী মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়। তিনি মার্কসীয় শ্রেণিসংগ্রাম তত্ত্ব ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বকে সুন্দরভাবে বাস্তবে রূপায়িত করেছেন তাঁর সাহিত্যে। তাঁর ছোটোগল্পগুলির বৈশিষ্ট্যগুলি হল-
(1) মধ্যবিত্ত জীবনের সংকীর্ণতা ও কৃত্রিমতাজনিত স্বপ্নভঙ্গ, নিঃসঙ্গতাবোধ, হতাশা তাঁর গল্পের বিষয়।
(2) তাঁর গল্পের ভাষা জীবন্ত। চরিত্রগুলি বাস্তবের অতিপরিচিত। দরদ দিয়ে তিনি তাঁর গল্পকাহিনির অবয়ব নির্মাণ করেছেন।
(3) বাস্তবজীবন দর্শন অর্থাৎ তাঁর গল্পে দেখা যায় বাস্তবের সঙ্গে নিজের জীবন টিকিয়ে রাখার লড়াই।
(4) সমাজজীবনের পরিচিত ঘটনা এবং চরিত্র সহজ ও স্বাভাবিক ভঙ্গিতে অসাধারণভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
(5) নির্মোহ ও সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গি।
(6) বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসার কারণে পরিণামে যত ভয়াবহ সত্য অনাবৃত হোক না কেন, তাকে নির্ভয়ে প্রকাশ করেছেন।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ৫টি উপন্যাসের নাম লেখো এবং যে-কোনো একটি উপন্যাসের বিষয় ও চরিত্র লেখো।
‘কল্লোলের কুলবর্ধন’ মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় আধুনিক যুগের কথাসাহিত্য ধারায় মরমি-দরদি কথাকার। তাঁর সাহিত্যে তারুণ্যের দুঃসাহসী কল্পনার সঙ্গে মিলিত হয়েছে শিল্পীর সংহতি বোধ, অনাবিষ্কৃত পথে পরীক্ষা-নিরীক্ষার কুণ্ঠিত পদক্ষেপের বদলে দেখা দিল অস্খলিত পদচারণার পরিবর্তে বলিষ্ঠ পদচারণা। সভ্যতার অন্তঃসারশূন্য দেউলে রূপটি তাঁর লেখায় অনাবৃত হল। নির্মোহ সংস্কারমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গিতে সত্য ও জীবন বাস্তবে উন্মোচিত হল। মার্কসীয় দর্শন ও ফ্রয়েডীয় মনস্তত্ত্বের মেলবন্ধনে তাঁর সাহিত্যের ভাষা মানবজীবনের বাস্তব ও সত্যের শাশ্বত ধারাভাষ্য হয়ে উঠেছে। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য ৫টি উপন্যাস হল-‘দিবারাত্রির কাব্য’ (১৯৩৫), ‘জননী’ (১৯৩৫), ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’ (১৯৩৬), ‘পদ্মানদীর মাঝি’ (১৯৩৬), ‘শহরতলী’ (১৯৪০, ১৯৪১)।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের একটি জনপ্রিয় উপন্যাস ‘পদ্মানদীর মাঝি’। ৭টি পরিচ্ছেদে পূর্ববঙ্গের পদ্মাতীরবর্তী মাঝিদের জীবনকাহিনি বর্ণিত হয়েছে। উপন্যাসের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলি হল-ফুবের, কপিলা, হোসেন মিঞা, মালা, ধনঞ্জয় প্রমুখ।
মাঝির জীবন থেকে কৃষক জীবনে উত্তরণের মর্মস্পর্শী বর্ণনা ‘পদ্মানদীর মাঝি’ উপন্যাসের উপজীব্য বিষয়। উপন্যাসটি বিষয়ের অভিনবত্বে, পূর্ববঙ্গের কথ্যভাষার সুষ্ঠু প্রয়োগে, মানুষের সহজাত প্রবৃত্তির ক্ষুদ্র সংঘাত ও মৃদু উচ্ছ্বাসে হৃদয়স্পর্শী হয়ে উঠেছে। উপন্যাসের নায়ক কুবের মাঝির নিষিদ্ধ ভালোবাসা, কপিলার আদিমঅসংস্কৃত মনোবৃত্তির মধ্যে ছলনাময় নারী প্রকৃতির সনাতন রহস্য বাসা বেঁধেছে। আর হোসেন মিঞা লেখকের এক অদ্ভুত সৃষ্টি। কাহিনির সুসংগতি, উপস্থাপনা, বিষয় নির্বাচন, বাস্তবের মাটিমাখা চরিত্রের সমন্বয় উপন্যাসটিকে অন্যতম মাত্রা দান করেছে।
রাজশেখর বসু ও প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছদ্মনাম কী? দুই সাহিত্যিকের ৬টি করে গল্পগ্রন্থের নাম লেখো।
রাজশেখর বসুর ছদ্মনাম ‘পরশুরাম’ এবং প্রেমেন্দ্র মিত্রের ছদ্মনাম ‘কৃত্তিবাস ভদ্র’।
(1) রাজশেখর বসুর ৬টি গল্পগ্রন্থ: ‘হনুমানের স্বপ্ন’ (১৯৩৭), ‘মানুষ জাতির কথা’ (১৯৩৮), ‘ধুস্তরীমায়া’ (১৯৫২), ‘কৃষ্ণকলি’ (১৯৫৩), ‘নীলতারা’ (১৯৫৬), ‘গল্পকল্প’ (১৯৫০) প্রভৃতি।
(2) প্রেমেন্দ্র মিত্রের ৬টি গল্পগ্রন্থ: ‘বেনামী বন্দর’ (১৯৩০), ‘পুতুল ও প্রতিমা’ (১৯৩১), ‘অফুরন্ত’ (১৯৩২), ‘পঞ্চশর’ (১৯৩৪), ‘মৃত্তিকা’ (১৯৩৫), ‘মহানগর’ (১৯৩৭) প্রভৃতি।
‘জাগরী’ ও ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’ উপন্যাস দুটির রচয়িতা ‘জাগরী’ উপন্যাসটি সংক্ষেপে আলোচনা করো।
‘জাগরী’ (১৯৪৫), ‘ঢোঁড়াইচরিত মানস’ (১৯৪৯, ১৯৫১) উপন্যাস দুটির রচয়িতা সতীনাথ ভাদুড়ী।
জাগরী
সতীনাথ ভাদুড়ীর লেখা প্রথম উপন্যাস জাগরী (১৯৪৫)। এটি একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। এই উপন্যাসে স্বাধীনতা পূর্ববর্তী ভারতের রাজনৈতিক চালচিত্রে একটি পরিবারের কাহিনি পরিস্ফুট হয়েছে। ‘জাগরী’ উপন্যাসের প্রথম সংস্করণের ভূমিকায় লেখক বলেছিলেন, “রাজনৈতিক জাগৃতির সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক মতবাদের সংঘাত অবশ্যম্ভাবী। এই আলোড়নের তরঙ্গ বিক্ষোভ কোনো কোনো স্থলে পারিবারিক জীবনের ভিত্তিকেও আঘাত করিতেছে। এইরূপ একটি পরিবারে কাহিনি।”
আগস্ট আন্দোলনের পটভূমিতে আত্মকথনের ভঙ্গিতে উপন্যাসটি রচিত হয়েছে। আত্মকথনে- ‘ফাঁসি সেল-বিলু’, ‘আপার ডিভিসন ওয়ার্ড-বাবা’, ‘আওরত কিতা-মা’ এবং ‘জেল গেট-নীল’ চরিত্রগুলি বাস্তবের প্রতীকী রূপ। চরিত্রের মনস্তত্ত্ব ও অনুভূতির সূক্ষ্ম বিশ্লেষণ, সৌন্দর্যানুভূতি ও রহস্যবোধ, ভাষার ঐন্দ্রজালিক সম্পদ, অর্থ গৌরবপূর্ণ, সংক্ষিপ্ত রেখাবিন্যাসে বৃহৎ ঘটনার মর্মোদ্ধার, মন্তব্যের গভীরতা ও চরিত্রবিশ্লেষণ কুশলতা-এ সমস্ত শৈলী তাঁর এই উপন্যাসে বিদ্যমান। ‘জাগরী’ উপন্যাসটি কারা সাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নিদর্শন। জেল জীবনের পূর্ণাঙ্গ তথ্যবহুল, মননশীলতা সমৃদ্ধ এই উপন্যাস বাংলা সাহিত্যের মূল্যবান সম্পদ।
আশাপূর্ণা দেবীর কয়েকটি গল্পগ্রন্থসহ ত্রয়ী উপন্যাসের নাম লেখো এবং উপন্যাস সাহিত্যে তাঁর গুরুত্ব লেখো।
আধুনিক কথাসাহিত্য ধারার অন্যতমা মহিলা সাহিত্যিক আশাপূর্ণা দেবীর প্রথম গল্প ‘পত্নী ও প্রেয়সী’ প্রকাশিত হয় শারদীয় আনন্দবাজার-এ ১৩৪৩ বঙ্গাব্দে, মাঘ মাসে।
তাঁর কয়েকটি গল্পগ্রন্থের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল
‘পত্নী ও প্রেয়সী’ (১৯৩৬), ‘ছোটো ঠাকুরদার কাশী যাত্রা’ (১৯৩৮), ‘জল আর আগুন’ (১৯৩৮), ‘রঙিন মলাট’ (১৯৪১), ‘হাফ হলিডে’ (১৯৪১), ‘মজারুমামা’ (১৯৯২) ইত্যাদি।
১। ‘প্রথম প্রতিশ্রুতি’ (১৯৬৫), ২। ‘সুবর্ণলতা’ (১৯৬৬) এবং ৩। ‘বকুলকথা’ (১৯৭৩)-উপন্যাস তিনটিকে আশাপূর্ণা দেবীর ত্রয়ী উপন্যাস বলা হয়।
এই উপন্যাস সাহিত্যে গুরুত্ব
আধুনিক বাংলা সাহিত্যে মহিলা সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতমা হলেন আশাপূর্ণা দেবী। চলমান সমাজজীবন তাঁর সাহিত্যে বারে বারে ঘুরে ফিরে এসেছে। তাঁর সাহিত্যে বাঙালি মধ্যবিত্ত জীবন আন্তরিকতার সাথে চিত্রিত হয়েছে। তাঁর উপন্যাসে নতুন কালের পটভূমিকায় একান্নবর্তী পরিবারকে উপস্থাপিত করেছেন। যৌথ পরিবার ও ভেঙে যাওয়া সংসার জীবনের সমস্যার কথা হাস্য ও করুণ রসে সুগভীর দক্ষতার সাথে প্রকাশ করেছেন মরমি হৃদয়ের ভাষা দিয়ে। সাধারণ কথা চরিত্র ভাবনাকে অসাধারণ করে প্রকাশ করেছে শিল্পনৈপুণ্যের সাথে।
বাংলা সাহিত্যে শিশু-কিশোর সাহিত্য প্রসঙ্গে আলোচনা করো।
উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যভাগ থেকেই বেশকিছু পত্রপত্রিকার হাত ধরে, বেগবতী হয়ে ওঠে শিশু-কিশোর সাহিত্যধারা। উল্লেখ্য কেশবচন্দ্র সেনের ‘বালকবন্ধু’ (১৮৮২) থেকে শুরু করে মুকুল, সাথী, সন্দেশ, মৌচাক, রামধনু, রংমশাল, শুকতারা, আনন্দমেলা প্রভৃতি পত্রিকা শিশু-কিশোর সাহিত্যচর্চায় ধারাকে সমৃদ্ধ করে।
(1) শিশু সাহিত্যের উষাকাল : উনবিংশ শতকের প্রথমার্ধে কৌতূহলী শিশুমনের চাহিদা পূরণের জন্য নীতিকথা বা নীতিগল্পের পথ ধরে শিশু সাহিত্যের জন্ম। ছড়া-রূপকথা-উপকথা জুড়ে সাহিত্যের উপাদান হয়ে ওঠে-রাজপুত্র, রাজকন্যা, দৈত্য-দানো, যাদুকাঠি ছোঁয়া, পরী, প্রেত জীবজন্তু ও পরিচিত ঘটনা।
(2) শিশু-কিশোর সাহিত্যের চর্চা: বিদ্যালয়ে বাংলা ভাষার পঠনপাঠন শুরু হলে পড়ানোর পদ্ধতি নিয়ে সমস্যা দেখা দেয়। বাংলা ভাষার যথার্থ শিল্পী বিদ্যাসাগর এই সমাধানের সূত্র দেন। অক্ষর পরিচয়ের জন্য ‘বর্ণপরিচয়’, দ্রুতপঠনের জন্য ‘কথামালা’, ‘আখ্যানমঞ্জরী’, ‘বোধোদয়’ প্রভৃতি পাঠ্যপুস্তক রচনা করেন। অক্ষর পরিচয়ের বইকে আরও মনোরম শিশুমনের উপযোগী আর সচিত্র করে তুললেন যোগীন্দ্রনাথ সরকার তাঁর রচিত ‘হাসিখুশি’, ‘হাসিরাশি’, ‘ছবি ও গল্প’, ‘হাসিমেলা’ প্রভৃতি গ্রন্থে।
(3) শিশু-কিশোর সাহিত্যের সমৃদ্ধিকাল: বাংলা শিশু-কিশোর সাহিত্য যাঁদের হাত ধরে সমৃদ্ধ ও স্বাবলম্বী হয়ে উঠেছে, তাঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী, সুকুমার রায়, সুখলতা রাও, যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত, সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়, মনিলাল গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ। রূপকথা-উপকথা-প্রচলিত কাহিনিনির্ভর উপেন্দ্রকিশোরের টুনটুনির বই, পানতাবুড়ি, সাক্ষীশেয়াল; সুকুমার রায়ের ‘আবোল-তাবোল’ বই; শিশুমনের লাগামছাড়া কল্পনাকে রূপকথা, ব্রতকথা আর পাঁচালির গল্প দিয়ে সংযোজন করলেন দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদার ‘ঠাকুরমার ঝুলি’, ‘ঠাকুরদার ঝুলি’ রচনায়। এরই পাশাপাশি অবনীন্দ্রনাথের ‘ক্ষীরের পুতুল’, ‘রাজাকাহিনি’, ‘নালক’, ‘বুড়ো আংলা’ প্রভৃতি গ্রন্থ শিশুসাহিত্যের হৃদয়গ্রাহী সম্পদ। প্রবাদপ্রতিম রবীন্দ্রনাথের ও ‘শিশু’, ‘শিশু ভোলানাথ’, ‘সহজ পাঠ’ গ্রন্থ শিশু-কিশোর সাহিত্যের ধারায় মূল্যবান সংযোজন। সেই ধারা আজও প্রবহমান।