আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ধারা পদ্যসাহিত্য | Class 11 Second Semester WBCHSE

১। যুগসন্ধির কবি’ বলে যিনি বিশেষিত তাঁর কাব্যের বিশেষ লক্ষণগুলি কী কী? তাঁর সম্পাদিত সমসাময়িক পত্রিকার নাম ও রচনাবলি উল্লেখ করো।
‘যুগসন্ধির কবি’ বলা হয় ঈশ্বর গুপ্তকে। কাব্যে তাঁর বিশেষ লক্ষণগুলি হল-১। বাস্তবতা ও সমাজচেতনার পরিচয়। । ২। সূক্ষ্ম পরিহাসছলে ব্যঙ্গবিদ্রুপ পরিবেশন। ৩। জীবনের প্রতি গভীর অনুরাগ ও বাঙালির জীবনবোধের প্রকাশ। ৪। বস্তুতান্ত্রিক, পরিচয় তির্যক অনুসন্ধানী দৃষ্টিতে উন্মোচন। ৫। নিসর্গ প্রকৃতি ও মানবের প্রভাব ইত্যাদি।
ঈশ্বর গুপ্ত সম্পাদিত সমসাময়িক পত্রিকার নাম হল- ‘সংবাদ প্রভাকর’ (১৮৩১)।
উল্লেখযোগ্য রচনাবলি
‘কালীকীর্তন’, ‘ভরতচন্দ্র রায়ের জীবনবৃত্তান্ত’, ‘প্রবোধ প্রভাকর’, ‘হিত প্রভাকর’, ‘বোধেন্দু বিকাশ’, ‘কবিগণ ও সত্যনারায়ণের ব্রতকথা’ প্রভৃতি।
২। কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায় ও তাঁর শ্রেষ্ঠ কাব্যের পরিচয় দাও।
বাংলা সাহিত্যে উনিশ শতকীয় আখ্যান কাব্যের ধারার প্রবর্তক রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। বাংলা কাব্যসাহিত্যে দেববাদ ও ধর্মবাদের ঘূর্ণাবর্ত থেকে দূরে সরে এসে ঐতিহাসিক মানবীয় আখ্যানকে কাব্যের বিষয় করে নতুনত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন কবি রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। ঈশ্বর গুপ্ত ও মধুসূদনের সমন্বয়কারী হিসেবে ভাষা, ছন্দ, প্রকাশরীতিতে উষার স্বর্ণদ্বার উন্মোচন করেছেন। তাঁর রচিত উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থগুলি হল-‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ (১৮৫৮), ‘কর্মদেবী’ (১৮৬২), ‘শূরসুন্দরী’ (১৮৬৮)। ‘কাঞ্চীকাবেরী’ (১৮৭৯)। বীররসাত্মক অনুবাদমূলক ব্যঙ্গকাব্য- ‘ভেক মুষিকের যুদ্ধ’ (১৮৫৮)।
রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের শ্রেষ্ঠ কাব্যগ্রন্থ ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’। এটি বাংলা কাব্যের প্রথম ইতিহাসাশ্রিত রোমান্স গ্রন্থ। এখানে রাজপুতদের সঙ্গে মুসলমান রাজাদের সংঘর্ষ উনিশ শতকের নবজাগ্রত জাতীয়তাবোধে ভারতীয় বীরদের স্বদেশ ও স্বাধীনতার জন্য বিদেশি শত্রুর বিরুদ্ধে সংগ্রাম রূপে চিত্রিত হয়েছে। কর্নেল উডের ‘Annals and Antiquities of Rajasthan’-এর ইতিহাসাশ্রয়ী ও কিংবদন্তীমূলক রাজপুত জাতির শৌর্যবীর্য কাহিনিগুলি চয়ন করে ইতিহাস ও রোমান্সের মিশ্রণে দেশপ্রেমকে প্রতিষ্ঠা করেছেন। দৈবী নির্ভরতার বাইরে ইতিহাসকে আশ্রয় করে মানব জীবনধর্ম প্রতিষ্ঠা কাব্যটির বিশেষত্ব। ‘পদ্মিনী উপাখ্যান’ আধুনিক কাব্যধারার উত্তরণের দিকচিহ্ন। প্রাচীন অতীতের গৌরব কাহিনি একদিকে যেমন সহজেই পাঠককে বিমোহিত করে জাতীয়তাবোধের প্রেরণা দিয়েছে, তেমনি অতীতের অনুকারে অবলুপ্ত কাহিনিগুলি অপরূপ রোমান্স রস পরিবেশন করে রসিক চিত্তকে রসাবিষ্ট করেছে।
৩। কবি মধুসূদন দত্তের একটি মহাকাব্য ও পত্রকাব্যের নাম লেখো এবং বাংলা কাব্যে মধুসূদনের অবদান লেখো।
উনবিংশ শতাব্দীর বাংলা সাহিত্যে নবজাগরণের মুক্তিদূত মাইকেল মধুসূদন দত্ত রচিত মহাকাব্য- ‘মেঘনাদবধ কাব্য’ (১৮৬১) ও পত্রকাব্য-‘বীরাঙ্গনা কাব্য’ (১৮৬২)।
কাব্য সাহিত্যে তাঁর অবদান
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, “আধুনিক বাংলা কাব্য শুরু হয়েছে মধুসূদন দত্ত থেকে। তিনিই প্রথম ভাঙনের এবং সেই ভাঙনের ভূমিকার ওপর গড়নের কাজে লেগেছিলেন সাহসের সঙ্গে।”
- বাংলা কাব্যসাহিত্যকে বিশ্ব সাহিত্যে উন্নীত করেছেন।
- প্রাচীন মহাকাব্য ও পুরাণ কথাকে ব্যবহার করে সমকালীন মূল্যবোধ ও রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গির নবীকরণ করেছেন কাব্য কবিতায়।
- প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য সাহিত্যকে একই সূত্রে গ্রথিত করে গীতিকবিতা, মহাকাব্য, পত্রকাব্য প্রভৃতি সাহিত্যরীতিতে অভিনবত্ব প্রতিষ্ঠা করেছেন।
- Blank verse-এর অনুসরণে এবং মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যে ব্যবহৃত পয়ার ছন্দের ঐতিহ্য পরম্পরায় মধুসূদন গড়ে তুলেছিলেন প্রবহমান পয়ারের এক নতুন রূপভেদ, যা পরবর্তী সময়ে অমিত্রাক্ষর ছন্দ নামে বিখ্যাত।
- স্বদেশপ্রেম ও জাতীয়তাবোধের উন্মেষ, নারীমুক্তি চেতনা, ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্যবাদ, মানবতাবাদ, যুক্তিবোধ তাঁর কাব্যে নতুন রূপে প্রাণপ্রতিষ্ঠা পেয়েছে।
৪। ‘মধুসূদনের যথার্থ উত্তরসূরি ছিলেন হেমচন্দ্র।’- মন্তব্যটির যথার্থতা নিরূপণ করো।
“মধুসূদন বাঙলা কাব্যসাহিত্যে সূচনা করিলেন একটি বীরযুগের এবং মধুসূদনের অন্তর্ধানের পর কাব্যের এই বীরযুগের সেনাপত্য গ্রহণ করিলেন উপযুক্ত উত্তরাধিকারী হেমচন্দ্র। এই বীরযুগের কবি হেমচন্দ্রের সাহিত্যের ভিতরেও আমরা পাই সেই স্বাধীনতার স্বপ্ন-সেই জাতীয়তাবোধ-ব্যক্তিত্বের স্পন্দন-বীর্যের গরিমা।” (বাঙলা সাহিত্যের নবযুগ/শশিভূষণ দাশগুপ্ত)
বাংলা কাব্যসাহিত্যের ইতিহাসে উনিশ শতকের প্রেক্ষাপটে হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় সহজসরল জীবনরসের রসিক কবি। স্বজাত্যবোধ ও স্বদেশপ্রেমে বাঙালিকে উদ্বুদ্ধ করার চেষ্টা করেছেন। শিবনাথ শাস্ত্রী লিখেছেন, “বাঙালি যাহা চায়, হেমচন্দ্রের প্রতিভা তাহাই দিয়েছে।” বাংলা সাহিত্যে মধুকবি রচিত কাব্য অনুসরণ করে কাব্যের প্লট নির্মাণ করার চেষ্টা করেছেন। কাব্যগুলি কিছু কিছু অংশে প্রশংসার দাবি রাখলেও বিষয়বিন্যাসে চমৎকারিত্ব, ছন্দলালিত্য না-থাকায় যুগোপযোগী হয়ে ওঠেনি। খন্ড কবিতা, পুরাণ অনুষঙ্গে নতুনত্ব না-থাকায় তাঁর কাব্য-কবিতা প্রাণহীন হয়ে পড়েছিল। তাঁর উল্লেখযোগ্য সৃষ্টিসম্ভারের মধ্যে রয়েছে- ‘চিন্তাতরঙ্গিণী’ (১৮৬১), ‘বীরবাহু কাব্য’ (১৮৬৪), ‘বৃত্রসংহার কাব্য’ (১-১১ সর্গ, ১৮৭৫, ১২-২৪ সর্গ ১৮৭৭), ‘আশাকানন’ (১৮৭৬), ‘ছায়াময়ী কাব্য’ (১৮৮০), ‘চিত্তবিলাস’ (১৮৯৮), ‘দশমহাবিদ্যা’ (১৮৮২) প্রভৃতি।
হেমচন্দ্রের সর্বশ্রেষ্ঠ সৃষ্টি ‘বৃত্রসংহার’ কাব্য। এই কাব্যে মধুকবির অনুরণন ঘটলেও শেষপর্যন্ত তিনি মহাকাব্যগুণের সার্থকতা প্রতিষ্ঠা করতে পারেননি। এই কাব্যের চরিত্র চিত্রায়নে, কাহিনিবিন্যাসে মহাকাব্যিক বৈশিষ্ট্য লঙ্ঘিত হয়েছে। তাঁর অন্যান্য কাব্যগুলিতে পুরাণ ও গীতিকবিতা প্রতিধ্বনিত হয়েছে। তাঁর কাব্যে পরাধীনতার বেদনা এবং স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা বিশেষভাবে অনুভূত হয়েছে। অনেকে তাঁকে ‘বাঙালির জাতীয় জীবনের কবি’ হিসেবে অভিহিত করেছেন।
৫। ‘ত্রয়ী’ কাব্যের রচয়িতার নামোল্লেখ করে কাব্যগুলির আলোচনা করো। অথবা, কবি নবীনচন্দ্রের কাব্যপ্রতিভা আলোচনা করো।
‘ত্রয়ী’ কাব্যের রচয়িতা নবীনচন্দ্র সেন।
ঊনবিংশ শতাব্দীর মহাকাব্যের ধারায় নবীনচন্দ্রের শেষ কাব্য ‘ত্রয়ী’। রৈবতক (১৮৮৭), কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩) এবং প্রভাস (১৮৯৬)-এই তিনটি কাব্যকে একসঙ্গে ‘ত্রয়ী’ কাব্য বলা হয়। এই ত্রয়ী কাব্য লেখার প্রেরণা সম্পর্কে ‘আমার জীবন’ গ্রন্থে নবীনচন্দ্র লিখেছেন, “আমি ঘোরতর বিপন্ন হইয়া ১৮৭৭ সালের শেষভাগে চট্টগ্রাম হইতে শ্রীক্ষেত্রে বদলি নিলাম। আমার সেই যৌবন-সুলভ বিলাস-বাসনাপূর্ণ হৃদয়ে ভক্তের পবিত্র ছায়া পতিত হইত না, আমি রৈবতর্ক, কুরুক্ষেত্র ও প্রভাস কাব্য রচনা করিতে পারিতাম না। … সেখানে বসিয়াই আমি ভাগবতের ব্রজলীলা এক নতুন আলোকে দেখিতে লাগিলাম এবং সেখানে আমার হৃদয়ে প্রথম কৃষ্ণভক্তি অঙ্কুরিত হইল।”
(1) রৈবতক (১৮৮৭): মহাভারতের আদি পর্ব অবলম্বনে শ্রীকৃষ্ণের আদিলীলা কুড়িটি সর্গে বিন্যস্ত করেছেন কবি। কাব্যটি কবি তাঁর পিতৃদেব গোপীমোহন সেনকে উৎসর্গ করেছেন। কৃষ্ণের আলোচনা আর কৃষ্ণের ধর্মরাজ্য গঠনের ব্রত এবং সেজন্য অর্জুন ব্যাস ও কৃষ্ণের বিরোধী শক্তি দুর্বাসার প্রস্তুতির কথা বর্ণিত হয়েছে।
(2) কুরুক্ষেত্র (১৮৯৩): শ্রীকৃষ্ণের মধ্যলীলা বর্ণিত হয়েছে। মহাভারতের অভিমন্যু বধ এই কাব্যটির প্রধান উপজীব্য বিষয়। সতেরোটি সর্গে কবি কাব্যটি বিন্যস্ত করেছেন। উক্ত কাব্যটি কবি তাঁর স্বর্গীয়া জননী রাজরাজেশ্বরী দেবীকে উৎসর্গ করেছেন। অভিমন্যু বধের পাশাপাশি সুভদ্রার নারীধর্ম, শৈলের কৃষ্ণমহিমা কীর্তন আখ্যানের ঢঙে বর্ণিত হয়েছে।
(3) প্রভাস (১৮৯৬): কাব্যটিতে শ্রীকৃষ্ণের শেষজীবন বর্ণিত হয়েছে তেরোটি সর্গে। কাব্যটি কবি তাঁর পত্নী ও পুত্রকে উৎসর্গ করেছেন। এই • কাব্যে দুর্বাসা যেন কৃষ্ণের প্রতিদ্বন্দ্বীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে। এখানে গীতিরস প্রাণতা আখ্যায়িকার পরিণতিকে অনেকাংশে শ্লথ করে দিয়েছে।
রামায়ণে যেমন নতুন করে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছিলেন মধুসূদন, মহাভারতেও তেমনি নতুন আঙ্গিকে প্রাণপ্রতিষ্ঠা করেছেন নবীনচন্দ্র সেন। আখ্যানকে নতুনভাবে পরিবেশন করে তিনি অনেকের কাছে ‘বাংলার বায়রন’ হিসেবে অভিহিত হয়েছেন।
৬। কবি বিহারীলাল চক্রবর্তী সম্পর্কে আলোচনা করো।
বাংলা গীতিকবিতার ধারায় বিহারীলাল চক্রবর্তীর হাত ধরে ফল্গুস্রোতে উদ্দাম বেগবতী নদীর ন্যায় প্রবাহিত হয়েছিল। রবীন্দ্রনাথ তাঁকে ‘ভোরের পাখি’ বলে সম্বোধন করেছেন। কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ বিহারীলাল সম্পর্কে লিখেছেন, “সে প্রত্যুষে অধিক লোক জাগে নাই এবং সাহিত্যকুঞ্জে বিচিত্র কলগীত কূজিত হইয়া উঠে নাই। সেই ঊষালোকে কেবল একটি ভোরের পাখি সুমিষ্ট সুন্দর সুরে গান ধরিয়াছিল। সে তাহার নিজের। ঠিক ইতিহাসের কথা বলিতে পারি না, কিন্তু আমি সেই প্রথম বাংলা কবিতায় কবির নিজের সুর শুনিলাম।” বাংলা কাব্যসাহিত্যে গীতিকবিতার জনক বিহারীলাল চক্রবর্তী। তাঁর কবিতা একেবারে অভিনব-যথার্থভাবেই কবির ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের আত্মপ্রকাশ। ভোরের পাখির কলকাকলিতে যেমন ঘুম ভাঙে, প্রভাত রাঙা হয়ে ওঠে ঠিক তেমনি বিহারীলালের একলা মনের একলা গান রচনা করে নতুন ভোরের উন্মেষ ঘটিয়েছেন। তাঁর ‘সারদামঙ্গল’ কাব্যে গীতিকবিতার অপূর্ব সুরমূর্ছনা উদ্ভাসিত হয়েছে।
তাঁর উল্লেখযোগ্য চারটি কাব্য হল- (১) ‘বঙ্গসুন্দরী’ (১৮৭০), (২) ‘বন্ধুবিয়োগ’ (১৮৭০), (৩) ‘সারদামঙ্গল’ (১৮৭৯), (৪) ‘সাধের আসন’ (১৮৮৯)।
৭। ঊনবিংশ শতাব্দীর পাঁচজন মহিলা গীতিকবির নাম এবং প্রকাশকাল সহ তাঁদের তিনটি করে কাব্যের নাম লেখো।
উনবিংশ শতাব্দীর পাঁচজন বাংলা মহিলা গীতিকবি হলেন- গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী, কামিনী রায়, মানকুমারী বসু, স্বর্ণকুমারী দেবী ও মৈত্রেয়ী দেবী।
(1) গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী (১৮৫৮-১৯২৪) : উল্লেখযোগ্য কাব্যসম্ভার- ‘ভারতকুসুম’ (১৮৮২), ‘অশ্রুকণা’ (১৮৮৭), ‘সিন্ধুগাথা’ (১৯০৭)।
(2) কামিনী রায় (১৮৬৪-১৯৩৩): উল্লেখযোগ্য কাব্যসম্ভার- ‘আলো ও ছায়া’ (১৮৮৯), ‘নির্মাল্য’ (১৮৯১), ‘অশোক সঙ্গীত’ সনেটগুচ্ছ (১৯১৪)।
(3) মানকুমারী বসু (১৮৬৩-১৯৪৩): উল্লেখযোগ্য কাব্যসম্ভার-‘প্রিয় প্রসঙ্গে’ (১৮৮৪), ‘কাব্যকুসুমাঞ্জলি’ (১৮৯৩), ‘কনকাঞ্জলি’ (১৮৯৬)।
(4) স্বর্ণকুমারী দেবী (১৮৫৫-১৯৩২): উল্লেখযোগ্য কাব্যসম্ভার-‘বসন্ত উৎসব’ (১৮৭৯), ‘গাথা’ (১৮৮০), ‘কবিতা ও গান’ (১৮৯৫)।
(5) মৈত্রেয়ী দেবী (১৯১৪-১৯৯০): উল্লেখযোগ্য কাব্যসম্ভার- ‘উদিতা’ (১৯২৯), ‘চিত্তছায়া’ (১৯৩৬), ‘স্তবক’ (১৯৬৩), ‘আদিত্য মরীচি’ (১৯৭৩)।
৮। কবি রবীন্দ্রনাথের কাব্য মানস প্রবণতা অনুসারে কয়টি পর্যায়ে ভাগ করা যায় ও কী কী? প্রতিটি পর্বের কমপক্ষে চারটি করে কাব্যের নাম প্রকাশকাল সহ লেখো। অথবা, রবীন্দ্র কাব্যমানস সম্পর্কে সংক্ষেপে আলোচনা করো।
বহুমুখী, প্রবাদপ্রতিম, বিস্ময়কর প্রতিভার অধিকারী কবিশ্রেষ্ঠ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর কাব্যমানসকে বিভিন্ন সাহিত্য সমালোচক বিভিন্ন পর্যায়ে বিভক্ত করেছেন।
কাব্যমানস প্রবণতা অনুসারে রবীন্দ্রনাথের কাব্যগুলির পর্যায়
(1) সূচনা বা কৈশোর পর্ব (১৮৭৪-১৮৮১)
(2) উন্মেষ পর্ব (১৮৮২-১৮৮৬)
(3) ঐশ্বর্য পর্ব (১৮৮৬/১৮৯০-১৮৯৬)
(4) ভাবনা বা অন্তর্বর্তী পর্ব (১৮৯৬-১৯১০)
(5) অন্তর্মুখী বা গীতাঞ্জলি পর্ব (১৯১০-১৯১৫)
(6) বলাকা পর্ব (১৯১৫-১৯২৯)
(7) পুনশ্চ পর্ব বা অস্তরাগ (১৯৩০-১৯৩৬)
(8) গোধূলি বা অন্ত্যপর্যায় (১৯৩৬-১৯৪১)
পর্বের অন্তর্গত কাব্য ও প্রকাশকাল
(1) সূচনা বা কৈশোর পর্ব: ‘কবি ও কাহিনি’ (১৮৭৬)।
(2) উন্মেষ পর্ব : ‘সন্ধ্যাসঙ্গীত’ (১৮৮২), ‘প্রভাতসঙ্গীত’ (১৮৮৩), ‘ভানুসিংহ ঠাকুরের পদাবলী’ (১৮৮৪), ‘কড়ি ও কোমল’ (১৮৮৬)।
(3) ঐশ্বর্য বা মানসী পর্ব: ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালী’ (১৮৯৬)।
(4) ভাবনা বা অন্তর্বর্তী পর্ব: ‘কথা ও কাহিনী’ (১৯০০), ‘ক্ষণিকা’ (১৯০০), ‘নৈবেদ্য’ (১৯০১), ‘খেয়া’ (১৯১০)।
(5) অন্তর্মুখী বা গীতাঞ্জলি পর্ব: ‘গীতাঞ্জলি’ (১৯১০), ‘গীতিমাল্য’ (১৯১৪), ‘গীতালি’ (১৯১৫)।
(6) বলাকা পর্ব : ‘বলাকা’ (১৯১৬), ‘পূরবী’ (১৯২৫), ‘পলাতকা’ (১৯১৮), ‘মহুয়া’ (১৯২৯)।
(7) পুনশ্চ: ‘বনবাণী’ (১৯৩১), ‘পরিশেষ’ (১৯৩২), ‘পুনশ্চ’ (১৯৩২), ‘পত্রপুট’ (১৯৩৬)।
(8) গোধূলি বা অন্ত্যপর্যায়: ‘প্রান্তিক’ (১৯৩৮), ‘সেঁজুতি’ (১৯৩৮), ‘নবজাতক’ (১৯৪০), ‘আরোগ্য’ (১৯৪১)।
৯। ঐশ্বর্য পর্বে রবীন্দ্রপ্রতিভা কীভাবে প্রতিফলিত হয়েছে?
রবীন্দ্র কবিমানসের সবচেয়ে সমৃদ্ধ পর্ব ‘ঐশ্বর্য’। রবীন্দ্র কাব্যপ্রবাহে এই পর্বের ব্যাপ্তি ১৮৮৬ থেকে ১৮৯৬ সাল অর্থাৎ প্রায় ছয় থেকে দশ বছর। রবীন্দ্রমানসের পূর্ণ আত্মোপলব্ধির বহিঃপ্রকাশ এই পর্বের কাব্যে-কবিতায় ঘটেছে। এই পর্বের উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি- ‘মানসী’ (১৮৯০), ‘সোনার তরী’ (১৮৯৪), ‘চিত্রা’ (১৮৯৬), ‘চৈতালী’ (১৮৯৬) প্রভৃতি।
এই পর্বে মর্ত্যপ্রীতি, প্রকৃতিপ্রীতি, বিশ্বপ্রকৃতির সঙ্গে সাযুজ্য লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি এই কাব্যপ্রবাহের বৈশিষ্ট্য। এই সময়ে উক্ত সব বিষয়ই অনবদ্য বাণীসুষমা লাভ করেছে। জীবনজিজ্ঞাসা গভীরার্থক ও তীক্ষ্ণ হয়ে উঠেছে; কল্পনাবিস্তার সুনির্দিষ্ট রূপসীমার মধ্যে ঘনীভূত হয়েছে; আবেগ ছন্দময় ভাষার অবলম্বনে ভাবের ঊর্ধ্বাকাশে স্থির আশ্রয়লাভ করেছে। কবির রোমান্টিক কল্পনা ও বিশিষ্ট জীবনদর্শন, বিশ্বসত্তার সঙ্গে মিলনাকৃতি জীবনদেবতার লীলাচেতনা, প্রেমভাবনার অতীন্দ্রিয়তার উন্নয়ন-এই পর্যায়ের কাব্যে স্বাতন্ত্র্য সমুজ্জ্বল হয়ে উঠেছে। রবীন্দ্র প্রতিভার জয়যাত্রার স্বর্ণতোরণ ঐশ্বর্য পর্বের কবিতাগুলি।
‘মানসী’ (১৮৯০)-তে প্রেম, প্রকৃতি ও দেশাত্মবোধের সমন্বয় স্বতন্ত্র কাব্যরূপকে প্রকাশ করে। মোট ৬৪টি কবিতা মানসী কাব্যে কবি উপহার দিয়েছেন। Despair এবং Resignation-এর দ্বন্দ্বে কবিমন বিচলিত হয়ে বেদনা ও বৈরাগ্যকে অন্যতর মাত্রায় প্রতিষ্ঠা করেছেন। মর্ত্যানুরাগী কবি গভীর জীবনবোধে আসক্ত হয়ে ছন্দের নতুন বন্ধনে কল্পনা ও ইচ্ছার সংস্কার করলেন ‘সোনার তরী’ কাব্যে। বিশ্বপ্রকৃতি ও মানবলোক নিরুদ্দেশের যাত্রী হয়ে পাড়ি দিয়েছে ‘অন্য কোনখানে’। ‘চিত্রা’ কাব্যে কবির জীবনদেবতার অনুসন্ধান পান।
"জগতের মাঝে কত বিচিত্র তুমি হে তুমি বিচিত্র রূপিনী।”
রবীন্দ্রনাথ সত্য ও সুন্দরের দ্রষ্টা। কল্যাণের, মানুষের প্রকৃতির, মানবতার কবি, বিশ্ববন্দিত কবি তিনি। তাঁর সমগ্র কাব্যভাবনায় ব্যক্তি, বিশ্ব সসীম-অসীম মিলেমিশে একাকার হয়ে গেছে। রবীন্দ্রনাথের জীবনীকার প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায় বলেছেন কবির জীবনের সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ‘ঐশ্বর্য’ পর্ব। এই পর্ব কবির জীবন ও মননের অপরূপ ভাবসম্মিলনে সমৃদ্ধ পর্ব।
১০। কবি নজরুলের বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ কবে, কোন্ পত্রিকায় ঘটে? কবির কাব্য ও কাব্যবৈশিষ্ট্য আলোচনা করো। অথবা, কবি নজরুলের কাব্যপ্রতিভা বিশ্লেষণ করো।
১৯১৯ সালে ‘বঙ্গীয় মুসলমান সাহিত্য’ পত্রিকায় প্রকাশিত ‘মুক্তি’ কবিতার মধ্য দিয়ে কবি নজরুলের বাংলা সাহিত্যে আত্মপ্রকাশ ঘটে।
রবীন্দ্রোত্তর বাংলা কাব্যসাহিত্যে রবীন্দ্র মায়াজাল থেকে মুক্ত, মার্কিন কবি ওয়াল্ট হুইটম্যান অনুপ্রাণিত যে দুঃসাহসী ব্যক্তিত্ব আর্বিভূত হয়েছিলেন, তিনি হলেন সাম্যবাদী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। সামাজিক অবিচার, বৈষম্য ও শোষণের প্রতি মানুষের আবেদন নিয়ে জনগণের কবি হিসেবে সমস্ত বঞ্চনা ও সংস্কারের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ কণ্ঠে রবীন্দ্রচিন্তা, দর্শন, ভাষা, ভাব, ছন্দের বিরোধিতা করে মহামিলনের সুরে জন্ম দিলেন নতুন আশাবাদ, মানবতাবাদ, সাম্যবাদ ও মৈত্রী।
(1) নজরুল ইসলামের উল্লেখযোগ্য কাব্যসম্ভার: ‘অগ্নিবীণা’ (১৯২২), ‘দোলনচাঁপা’ (১৯২৩), ‘ছায়ানট’ (১৯২৪), ‘বিষের বাঁশি’ (১৯২৪), ‘ভাঙার গান’ (১৯২৪), ‘সাম্যবাদী’ (১৯২৫), ‘পুবের হাওয়া’ (১৯২৫), ‘চিত্তনামা’ (১৯২৫), ‘সর্বহারা’ (১৯২৬), ‘ফণীমনসা’ (১৯২৭), ‘সিন্ধুহিন্দোল’ (১৯২৭), ‘চক্রবাক’ (১৯২৯) প্রভৃতি।
(2) কাব্যবৈশিষ্ট্য: রবীন্দ্র পরবর্তী বিশিষ্ট কবি বুদ্ধদেব বসু নজরুল সম্পর্কে বলেছেন, “রবীন্দ্রনাথের পর ‘প্রথম মৌলিক কবি’।” কারণ বিষয় নির্বাচনে ও প্রকাশের ক্ষেত্রে তিনি উচ্চকিত। যুগসচেতন কবি হিসেবে বিদ্রোহ, অন্যায়, অসাম্য ও ভণ্ডামির বিরুদ্ধে তাঁর অভিযান দুঃসাহসিকতার পরিচয় দেয়। ভারতীয় ঐতিহ্য ও উদার ধর্মমতের পথিক কবি মানবপ্রীতি ও স্বদেশপ্রেমের তিনি মহাসাধক। এ ছাড়াও তাঁর কাব্যে লক্ষ করা যায়- (১) মহামিলনের সুরে শাশ্বত মানবাত্মার জয়গান, (২) শিশুসুলভ ভাবতন্ময়, (৩) ছন্দের চপলতা ও বাভঙ্গির ওজস্বিতা, (৪) বাংলা-আরবি-ফারসি ভাষার অপূর্ব সংমিশ্রণ প্রভৃতি।
১১। ‘দুঃখবাদী কবি’ খাঁকে বলা হয় তাঁর কাব্যভাবনা বৈশিষ্ট্যসহ আলোচনা করো। অথবা, কবি যতীন্দ্রনাথের কাব্যপ্রতিভা আলোচনা করো।
বাংলা কাব্যসাহিত্যে ‘দুঃখবাদী’ কবিতায় কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত নিজেকে ‘দুঃখবাদী’ বলে পরিচয় দিয়েছেন। আসলে তাঁর দুঃখবাদের গভীরে নিহিত ছিল সুখবাদ।
রবীন্দ্রোত্তর যুগের ব্যতিক্রমী কবি যতীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত রবীন্দ্র রোমান্টিক ভাবনা বিরোধী দুঃখবাদী জীবনচেতনার কবি হিসেবে স্বমহিমায় ভাস্বর। বাস্তবজীবনকে তিনি নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখেছেন। পেশায় ইঞ্জিনিয়ার আর নেশায় কবি যতীন্দ্রনাথ সমাজ আর জীবনকে উপলব্ধি করেছেন রূঢ় বাস্তবের নির্মম কষাঘাতে। রবীন্দ্রনাথের ‘অবিরল অতীন্দ্রিয়তার পরে’ যতীন্দ্রনাথের একটি বিদ্রোহ কাব্যজগতে প্রতিষ্ঠা পেয়েছিল। রোমান্টিকতার মধুকুঞ্জ থেকে দুঃখদীর্ণ বাস্তবের প্রাত্যহিক আবর্তের মাঝে আদর্শবাদ ও সৌন্দর্যবোধকে জীবনের চরম বাস্তবে রসসিক্ত করে রাঙিয়ে দিয়েছেন তাঁর কাব্যজগৎকে। তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল- ‘মরীচিকা’ (১৯২৩), ‘মরুশিখা’ (১৯২৭), ‘মরুমায়া’ (১৯৩০), ‘সায়ম’ (১৯৪০), ‘অনুপূর্বা’ (১৯৪৬), ‘ত্রিযামা’ (১৯৪৮), ‘নিশান্তিকা’ (১৯৫৪) ইত্যাদি।
কাব্যবৈশিষ্ট্য
(1) রোমান্টিকতা নয়, বস্তুনিষ্ঠ দৃষ্টিভঙ্গির নির্মোহ প্রকাশ।
(2) দুঃখবাদী কবিচেতনা।
(3) ঈশ্বরে অবিশ্বাস বা নাস্তিকতা।
(4) তথাকথিত আধ্যাত্মিকতা ও ভাববিলাসকে ধিক্কার।
(5) সৌন্দর্যবাদের প্রবল বিরোধিতা।
(6) সামাজিক যন্ত্রণা ভুলতে নব চিকিৎসা ‘ঘুমিওপ্যাথি’ আবিষ্কার।
(7) নিজস্ব প্রকাশভঙ্গি আর কাব্যভাষার অভিনব প্রয়োগ।
১২। ‘ভোগবাদী বা অঘোরপন্থী কবি’ কাকে বলা হয় এবং কেন? অথবা, কবি মোহিতলালের কাব্যপ্রতিভা আলোচনা করো।
‘ভোগবাদী বা অঘোরপন্থী কবি’ বলা হয় মোহিতলাল মজুমদারকে।
ভোগবাদী বা অঘোরপন্থী বলার কারণ
জন্ম-রোমান্টিক কবি মোহিতলাল পঞ্চ ইন্দ্রিয়ের পঞ্চ প্রদীপ জ্বালিয়ে জগৎ ও জীবনের রূপসৌন্দর্য আকণ্ঠ পান করেছেন। প্রেমসৌন্দর্য ও রোমান্টিকতার মধ্যে তিনি তান্ত্রিকের মতো দেহকেই প্রাধান্য দিয়ে দেহাতীত ভোগাতীত রসোপলব্ধি করেছেন। দেহের মধ্যে ভোগের সুতীব্র বাসনায় বিষণ্ণতা বা ক্লান্তি ছিল না বলে তিনি অঘোরপন্থী কবি। আর নিঃশেষে নারীর সৌন্দর্য সুধা পান করেছেন দৈহিক রমণীয় ও কমনীয় আবেগ কামনায় সানন্দে। দেহ ও দেহাতীত, ভোগ ও মোক্ষকে তিনি তান্ত্রিকের মতো একাকার করে দেখেছেন। তীব্র ভোগবাদী দর্শনে প্রেম, কাম, জায়া, জননী, তৃষ্ণা ও তৃষ্ণার তৃপ্তি বাসনার রঙে রাঙা- সেখানে রাধা ও ম্যাডোনা, শব ও শিব একই সূত্রে গ্রথিত হয়েছে। সেজন্য বাংলা কাব্যাদর্শের প্রবহমান ধারায় ভোগবাদী কবি হিসেবে পরিচিত।
"মোর কামকলা-কেলি উল্লাস নহে মিলনের মিথুন বিলাস,"
১৩। প্রকাশকালসহ কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্যটি উল্লেখ করো। কবির রচিত আরও কয়েকটি কাব্যের নাম ও প্রকাশকাল লেখো এবং তাঁর কাব্যবৈশিষ্ট্য লেখো। অথবা, কবি জীবনানন্দ কাব্যপ্রতিভা মূল্যায়ন করো।
কবি জীবনানন্দ দাশের প্রথম কাব্য-‘ঝরাপালক’ (১৯২৭)। কবির আরও কয়েকটি উল্লেখযোগ্য কাব্য হল- ‘ধূসর পাণ্ডুলিপি’ (১৯৩৬), ‘বনলতা সেন’ (১৯৪২), ‘মহাপৃথিবী’ (১৯৪৪), ‘সাতটি তারার তিমির’ (১৯৪৮), ‘রূপসী বাংলা’ (১৯৫৭), ‘বেলা-অবেলা-কালবেলা’ (১৯৬১)।
জীবনানন্দ দাশের কাব্যবেশিষ্ট্য
(1) তাঁর কাব্যে প্রকৃতিচেতনা ও চিত্রকল্পধর্মিতার প্রকাশ লক্ষ করা যায়।
(2) জীবনবোধের সঙ্গে ইতিহাসচেতনা ও সময়চেতনার তিনি প্রয়োগ ঘটিয়েছেন।
(3) প্রতীকধর্মিতা বা Symbolism তাঁর কাব্যের অন্যতম লক্ষণ।
(4) পরাবাস্তবতাবাদ বা Sur-realism এবং সুগভীর মৃত্যুচেতনা তাঁর কাব্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(5) দেশজ শব্দ ব্যবহার করে এমন সব চিত্রকল্প ও প্রতীকী ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করেছেন যা শব্দের সীমা ও কাব্যের ভাববস্তুর পরিধিকে বিভিন্ন দিকে বিস্তৃত করে দিয়েছে।
১৪। ‘কিন্তু মানবেতিহাসে মাঝে মাঝে মলমাস’- সুধীন্দ্রনাথের বেশিরভাগ কবিতাই মানবেতিহাসের মলমাসেরই প্রতিচ্ছবি -সংক্ষেপে আলোচনা করো।
সুধীন্দ্রনাথ নাস্তিকদর্শন, নৈরাশ্য ও নিরালোকের কবি। বন্ধ্যাত্ব, অক্ষমতা, নিষ্ফলতাবোধ তাঁর কবিতার প্রধান কথা। এই নিঃসঙ্গতা ও একাকিত্ব ইতিহাসের বিস্তীর্ণ প্রেক্ষাপটে প্রতিফলিত বলেই তা তাঁর কবিতায় নিয়তিবাদের রূপ নিয়েছে। সবই আপেক্ষিক নৈমিত্তিক বিষয় তাঁর কাব্য-কবিতার ক্যানভাস। সভ্যতার অবক্ষয়ে বেদনার্ত কবি ব্যক্তিব্যথায় নয়, বিশ্ববেদনায় স্তম্ভিত হয়েছেন। এককথায় তিনি নেতিবাদী, শূন্যতাবাদী ও ক্ষণবাদী। এই কাব্যচেতনায় আধুনিক সভ্যতার যে প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে তা মলমাসের সভ্যতা। রবীন্দ্রনাথ তাঁর প্রথম সৃষ্টি কাব্য ‘তন্বী’ (১৯৩০) সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন, “তাঁর কাব্য অনেকখানি রূপ নিয়েছে আমার কাব্য থেকে-নিয়েছে নিঃসংকোচে-অথচ তার প্রকৃতি সম্পূর্ণ তাঁর আপন। তাঁর স্বকীয়তা চেষ্টামাত্র করেনি অনন্যত্বের রূপ ধরে যথাস্থান থেকে প্রাপ্তি স্বীকার উপেক্ষা করতে। এই সাহস ক্ষমতারই উৎস।”
রবীন্দ্রোত্তর আধুনিক কাব্যধারার একজন বিশিষ্ট কবি সুধীন্দ্রনাথ দত্ত। রবীন্দ্র পরবর্তী যুগে কবির স্নেহভাজন হয়েও রবীন্দ্র ভাবদর্শন থেকে সরে এসে দাঁড়িয়েছেন স্বকীয় জীবন অভিজ্ঞতার স্বাতন্ত্র্যে ও চৈতন্যের একান্ত আত্মনিষ্ঠায়। তাঁর সৃষ্ট কাব্য সম্ভারের মধ্যে উল্লেখযোগ্য-‘তন্বী’ (১৯৩০), ‘অর্কেস্ট্রা’ (১৯৩৫), ‘ক্রন্দসী’ (১৯৩৭), ‘উত্তর ফাল্গুনী’ (১৯৪০), ‘সংবর্ত’ (১৯৫৩), ‘প্রতিধ্বনি’ (১৯৫৪), ‘দশমী’ (১৯৫৬) প্রভৃতি।
সমগ্র কাব্যজুড়ে কবি লক্ষ করেছেন, জীবনের সান্ত্বনাহীন ধ্বংসস্তূপের মাঝখানে দাঁড়িয়ে যুগের বন্ধ্যাত্ব ও রোমান্টিক কাব্যলোকের অন্তঃসারশূন্যতা। যুক্তিবাদী কবি সুধীন্দ্রনাথ ঈশ্বরের মঙ্গলময়ত্বে বিশ্বাস করেননি। তাঁর কাব্যের প্রেম দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন নয়। তাই তাঁর কাব্যের নায়ক-নায়িকারা বারংবার জীবনের নতুন ডাঙায় এসে ঘুরে দাঁড়িয়েছে। তাঁর সমগ্র কাব্যজুড়ে প্রতিধ্বনিত হয়েছে রূপহীন, নীরস, মরুধুসর সমসাময়িক যুগচিত্র। সেখানে নরনারীর প্রেমের শাশ্বত ঐশ্বর্য, মাধুর্য নেই, কেবল ভোগের ক্ষণবিলাস বিরাজিত। রাজনীতি, প্রেম, ঈশ্বর, গণতন্ত্র সবই সংশয়াচ্ছন্ন। সেজন্যই যুগের প্রেক্ষাপটে তাঁর বৈচিত্র্যপূর্ণ সৃষ্টি সমাহার মানবেতিহাসের মলমাসেরই প্রতিচ্ছবি।
১৫। কবি অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যপ্রতিভা মূল্যায়ন করো।
“রবীন্দ্র বিরোধ তাঁর কবিতায় নেই, নেই ঐতিহ্যকে অবহেলা করার নঞর্থক প্রয়াস, পরিবর্তে তাঁর কবিতায় ধরা পড়েছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্য সাহিত্যলব্ধ জ্ঞান, বিশ্ব পরিক্রমার অভিজ্ঞতা, বিজ্ঞানকে মঙ্গলের সঙ্গে অন্বিত করে সব কিছুর মধ্যে এক গভীর সংগতি আবিষ্কারের চেষ্টা।” -ড. অশোক কুমার মিশ্র
বাংলা কাব্যসাহিত্যে কবি অমিয় চক্রবর্তীর আত্মপ্রকাশ ‘বিচিত্রা’ পত্রিকার পাতায় ঘটেছিল। তিনিই একমাত্র কবি যিনি রবীন্দ্র প্রতিবেশে লালিত হয়েও স্বতন্ত্র। জগৎ ও জীবনকে দেখার বাসনা, প্রকৃতির সঙ্গে সামগ্রিক সংসারের ছবি, গভীর ধ্যান ও চিন্তাচেতনার জগৎ, আধুনিক বিশ্বজীবন, হতাশা ও নিরাশার জগৎ থেকে উত্তরণের দিশা তাঁর কাব্য-কবিতায় নতুনত্বে প্রতিফলিত হয়েছে। তাঁর কবিমানস জটিল ও দ্বিধাবিভক্ত।
বিচিত্র কাব্যসম্ভার
তাঁর উল্লেখযোগ্য কাব্যগ্রন্থ হল- ‘খসড়া’ (১৯৩৮), ‘একমুঠো’ (১৯৩৯), ‘মাটির দেওয়াল’ (১৯৪২), ‘অভিজ্ঞান বসন্ত’ (১৯৪৩), ‘দূরযানী’ (১৯৪৪), ‘পারাপার’ (১৯৫৩), ‘পালাবদল’ (১৯৫৫), ‘ঘরে ফেরার দিন’ (১৯৬১), ‘হারানো অর্কিড’ (১৯৬৬), ‘পুষ্পিত ইমেজ’ (১৯৬৭), অমরাবতী’ (১৯৭২), ‘অনিঃশেষ’ (১৯৭৬), ‘নতুন কবিতা’ (১৯৮০) প্রভৃতি।
কাব্যবৈশিষ্ট্য
(1) রবীন্দ্র অনুসরণ ও অনুরণন তাঁর কাব্যে স্বতন্ত্রভাবে ফুটে উঠেছে।
(2) তিনি বস্তু ও চেতনার মধ্যে দেখেছেন ঐক্য, যন্ত্রের ঘর্ঘরে শুনেছেন কল্যাণের ওংকার, সব কিছুর মধ্যে বস্তুর বা যন্ত্রের প্রকাশ লক্ষ করে এক অদ্ভুত বিশ্ব রহস্যের আভাস লাভ করেছেন। প্রত্যক্ষগম্য জগৎকে তিনি কাব্যে প্রতিষ্ঠা করেছেন।
(3) প্রথাগত রবীন্দ্র ছক ভেঙে বাংলা কাব্যের মুক্তির জন্য তিনি নব নব শৈলী আবিষ্কার করেছিলেন ও ব্যাকরণ বিভ্রাট ঘটিয়েছিলেন। ফলে ‘দুর্বোধ্যতা’ তাঁর কবিতার বিশেষ লক্ষণ হয়ে উঠেছে।
(4) যুগের বিরোধিতা করলেও সংগতিই ছিল কবির কাম্য।
(5) তাঁর কবিতায় চলচ্চিত্রের কৌশল দেখা যায়।
(6) আশাবাদের গভীর প্রকাশ তাঁর কাব্যে পরিলক্ষিত হয়েছে।
মন্তব্য
রবীন্দ্রস্নেহপুষ্ট কবি অমিয় চক্রবর্তীর কাব্যকলা কৌশলের দিক থেকে দুঃসাহসিক। অভিনব হওয়ার শক্তি ও আত্মপ্রত্যয় নিয়ে তিনি অভিনব। তাঁর ছন্দের বিচিত্র তির্যক গতি, অদ্ভুত শব্দযোজনা, দৃষ্টিভঙ্গির বিশেষত্ব-সমস্তই নিবিড় মননশক্তির ফল। তাঁর কাব্যের সমস্ত উপমা ও রূপক আধুনিক মানুষের জীবনের সঙ্গেই সংশ্লিষ্ট। প্রচ্ছন্নতা, ইমপ্রেশনিষ্ট ধর্ম, কথ্যরীতি ও কাব্যরীতির মিশ্রণ, অতিগদ্যময় ইংরেজি শব্দের ব্যবহার, টেলিস্কোপীয় রীতি প্রভৃতি তাঁর কাব্যকে অন্যতর মাত্রা দান করেছে। অমিয় চক্রবর্তী রবীন্দ্রনাথের মিস্টিক চেতনার একমাত্র উত্তরাধিকারী। তিনি সময়সচেতন একজন আধুনিক কবি।
১৬। প্রেমেন্দ্র মিত্রের কয়েকটি কাব্যের নাম ও কাব্যবৈশিষ্ট্য আলোচনা করো।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের উল্লেখযোগ্য কাব্যগুলি হল-‘প্রথমা’ (১৯৩২), ‘সম্রাট’ (১৯৪০), ‘ফেরারী ফৌজ’ (১৯৪৮), ‘সাগর থেকে ফেরা’ (১৯৫৬), ‘কখনও মেঘ’ (১৯৬০), ‘হরিণ চিতা চিল’ (১৯৬১), ‘অথবা কিন্নর’ (১৯৬১), ‘সঙ্গীর নিকটে’ (১৯৭২) প্রভৃতি।
প্রেমেন্দ্র মিত্রের কাব্যবৈশিষ্ট্য
(1) শ্রমজীবী মানুষের মুখের ভাষাকে তিনি কবিতার রূপ দিয়েছেন। যেমন-“আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের মুটে মজুরের,/আমি কবি যত ইতরের।”
(2) আত্মবিরোধ ও অনিকেত মনোভাব তাঁর অন্যতম বৈশিষ্ট্য।
(3) পুরাণকেও নতুন প্রতীকী অর্থে তিনি গ্রহণ করেছেন।
(4) নগরজীবনের দুঃখযন্ত্রণা তাঁর কবিতায় বাস্তবসম্মতভাবে প্রকাশ পেয়েছে।
(5) তিনি মানবতার গান রচনা করেছেন এবং সমগ্র মানবসত্তার অর্থ অনুসন্ধান করার চেষ্টা করেছেন।-“মানুষের মানে চাই/গোটা মানুষের মানে। রক্ত, মাস, হাড়, মেদ, মজ্জা/ক্ষুধা তৃষ্ণা, লোভ, কাম, হিংসা সমেত গোটা মানুষের মানে চাই।”
(6) বাংলা কবিতায় রবীন্দ্রনাথের কবিতা আর আধুনিক কবিতার সমন্বয় সেতু তিনিই নির্মাণ করেন।