আগুন নাটকের বিষয়বস্তু

প্রথম দৃশ্যে লক্ষ করা যায়-সমাজের নিম্নশ্রেণির মানুষের জীবনসংগ্রামের এক জীবন্ত চিত্র। অস্পষ্ট আলোয় লেখক তাদের অন্তঃপুরের যে ছবি তুলে ধরেছেন তা দেখে তাদের বাসস্থানের হতশ্রী চেহারা ধরা পড়ে। একদিকে তাদের যেমন খাদ্যের অভাব অন্যদিকে তাদের বাঁচার জন্য সুস্থ পরিবেশের অভাবও এক্ষেত্রে ধরা পড়েছে। এখানে পুরুষ (নেত্যর বাবা), নেত্য ও নেত্যর মা-এই তিনটি প্রতীক চরিত্র সমাজের অতিদরিদ্র পরিবারের সদস্য হয়ে নাটকে দেখা দিয়েছে। আসলে যুদ্ধোত্তর দুর্ভিক্ষপীড়িত বাংলার গ্রামেগঞ্জে নেত্যদের পরিবার হাজারে হাজারে। রাতের অন্ধকার কাটতে না কাটতেই তাদের জীবনসংগ্রাম শুরু হয়ে যায়। কোনো এক অজানা আশঙ্কায় যেন নেত্যর বাবার ঘুম ভেঙে যায়। দুর্ভিক্ষপীড়িত সময়ে একমুঠো চাল সংগ্রহের লড়াইটা, সংগ্রামটা যেন তার চোখের সামনে বারে বারে ভেসে ওঠে। তাই নেত্যর বাবা; নেত্য ও তার মাকে তাড়া দিয়ে ঘুম থেকে তুলে দিতে চায়। কারণ গ্রাম থেকে কিছু জিনিসপত্র (কলমি শাক, দাঁতন কাঠি, কলা ইত্যাদি) নিয়ে গিয়ে সেগুলি বিক্রি করে সামান্য যেটুকু অর্থ আয় হবে তা নিয়েই দাঁড়াতে হবে লাইনে একমুঠো চালের জন্য। বুভুক্ষু মানুষের প্রতিযোগিতা এতটাই তীব্র – যে, সময়মতো লাইনে দাঁড়াতে না-পারলে চাল পাওয়া মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। পেটের টান বড়ো বালাই যে, তাই সংগ্রামটা শুরু করতে হয় খুব সকালেই।
দ্বিতীয় দৃশ্যে লক্ষ করা যায়-এক কৃষাণের একক সংলাপ। কথায় আছে, ‘আশায় বাঁচে চাষা’-এ যেন তারই প্রতিচ্ছবি। চাষি তার স্ত্রীকে চৈতিফসল-পর তাদের সুখের গল্প শোনায়। নাট্যকার কৃষাণির মুখে কোনো সংলাপ না-দিয়ে শুধু ভাবলেশহীনভাবে তাকানোর মধ্যে ‘সুখ’ যে তাদের কাছে মরীচিকামাত্র তা বুঝিয়ে দিয়েছেন। চাষি স্বগতোক্তির মধ্য দিয়ে নিজের সহ্যক্ষমতাকে আরও দৃঢ় করেছে। মাঠের দিকে যেতে যেতে কৃষাণ কৃষাণিকে পরামর্শ দিয়ে যায় শহরে গিয়ে আগেভাগে চালের লাইনে দাঁড়াতে। কারণ মাঠ থেকে ফিরে এসে তার পেটে যেন ক্ষিদের আগুন জ্বলে ওঠে। কৃষাণির নিরুত্তর থেকে চাহনি অনেক অর্থ বহন করে। আর সে অর্থ চাষি বুঝতে পারে বলেই কৃষাণির উদ্দেশ্যে বলে- ‘ফের আবার ওইরকম করে তাকাচ্ছিস মুখপানে।’ আসলে কৃষাণির দৃষ্টির সামনে চাষির অসহায়তা প্রকট হয়েছে। এ যেন স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে একটা ছলনার অভিনয় অভিনীত হল, যা চাষি মৃদু হেসে কিছুটা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেছে।
তৃতীয় দৃশ্যে ক্ষুধার আগুন যে কতটা ভয়ংকর তা কারখানার শ্রমিক সতীশের কথাবার্তা ও আচার আচরণের মধ্যেই লক্ষ করা যায়। সতীশ খুব সকালে উঠে তার মেয়ে ফুলকিকে উদ্দেশ্য করে তার স্ত্রী ক্ষিরিকেও জাগিয়ে তুলতে চায়। উদ্দেশ্য একটাই জঠরাগ্নি অর্থাৎ ক্ষুধার আগুন নিভিয়ে সতীশ কারখানায় যাবে। প্রতিবেশী সহকর্মী জুড়োনের সঙ্গে বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলতে থাকে। কথার প্রসঙ্গ ধরে উঠে আসে একাকী জুড়োনের ভালো থাকার কথা, তিনমাস ধরে মিথ্যা চালের আশ্বাস দেওয়ার কথা। জুড়োনের কথার মধ্য দিয়ে উঠে আসে কোম্পানির ওপর ভরসা করা যে কতটা অবাস্তব-অন্তত চালের ব্যাপারে। সতীশের সে-কথা শুনে বিশ্বাসভঙ্গের কথা মনে পড়ে এবং সে উত্তেজিত হয়ে বলে ওঠে- “তাহলে কাকে বিশ্বাস করব?” নিজের প্রতি, ভাগ্যের প্রতি ধিক্কার জানিয়ে অত্যন্ত রূঢ়কণ্ঠে সতীশ ফুলকি ও তার মায়ের উদ্দেশে চিৎকার করে বলে ওঠে- “তোদের ঘুমের জন্য কারখানার গেট খোলা থাকবে নাকি?” আসলে সতীশের এই আস্ফালন শুধুমাত্র একটু খাবারের জন্য। কিন্তু সাংসারিক অভাব যে পারিবারিক সম্পর্কের ওপর কতটা আঘাত হানে তা ক্ষিরি ও সতীশের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাই আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়। এই অভাব শুধু পারস্পরিক দোষারোপের মধ্যে তখন সীমাবদ্ধ থাকে না-তা পৌঁছোয় হাতাহাতি সংঘর্ষে। তাই তৃতীয় দৃশ্যের শেষে সতীশকে দেখি স্ত্রীকে লাথি পর্যন্ত মারতে।
প্রথম, দ্বিতীয় ও তৃতীয় দৃশ্যে যখন লক্ষ করি খেটেখাওয়া নিম্নবিত্ত পরিবার, কৃষক, শ্রমিক সকলেই প্রায় ক্ষুধার আগুনে একটু একটু করে দগ্ধ হচ্ছে, তখন চতুর্থ দৃশ্যে হরেকৃষ্ণবাবুর মতো মধ্যবিত্ত পরিবারও যে সে আগুন থেকে রেহাই পায়নি তাও লক্ষ করা যায়। তীব্র অনিশ্চয়তার মধ্যে তাদেরও যে দিন কাটছে তা হরেকৃষ্ণবাবু ও মনোরমা দেবীর কথাবার্তার মধ্য দিয়ে সহজেই অনুমান করা যায়। তা ছাড়া মধ্যবিত্ত কেরানি হরেকৃষ্ণবাবু অফিসে যে চাল-ডাল নিয়ে ম্যানেজার ও তার মোসাহেবরা একটা কালোবাজারি করছে তা বুঝতে পেরেও কিছু করতে অর্থাৎ প্রতিবাদ করতে পারছে না। শুধু রক্ষকই ভক্ষক এই বলে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলা ছাড়া আর কিছু করণীয় নেই। হতাশাব্যঞ্জক আক্ষেপ নিয়ে চালের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। ঈশ্বরে বিশ্বাসী স্ত্রী মনোরমা দেবী হরেকৃষ্ণবাবুকে ঠাকুর প্রণামের কথা মনে করিয়ে দিলে ঈষৎ ব্যঙ্গের সুরে তিনি স্ত্রীর উদ্দেশ্যে বলেন- “সুবিধে হবে হলে মনে করছ, আচ্ছা!”
চারটি খণ্ডদৃশ্যের মধ্য দিয়ে বিজন ভট্টাচার্য সমস্যার সংকটময় মুহূর্তটি দর্শকদের সামনে আনতে সমর্থ হন। পঞ্চম বা পরিণতি দৃশ্যে ওড়িয়া, প্রথম, দ্বিতীয়, তৃতীয় ও চতুর্থ পুরুষ এবং জনৈক যুবক ও মুসলমান ভাই সমবেত হয়ে জাতিগত বিভেদ দূরে রেখে একত্রিত হয়ে বাঁচার একটা তাগিদ অনুভব করে। সব পথ এসে শেষে যেন মিলে গেল ঐক্যের সাগরে। পাশাপাশি লাইনে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে সামান্য গোলযোগ ঘটলেও সিভিক গার্ড ও দোকানদারের কথার তীব্র প্রতিবাদ করে সমবেতভাবে। দুর্ভিক্ষের বাজারে চোরাকারবারি, এক শ্রেণির শোষকের বিরুদ্ধে এ যেন সংঘবদ্ধ প্রতিরোধ। সিভিক গার্ড দ্বিতীয় পুরুষ ও চতুর্থ পুরুষের লাইনে দাঁড়ানো নিয়ে যে ঔদ্ধত্যপূর্ণ ব্যবহার করেছে তার বিরুদ্ধে লাইনে দাঁড়ানো অন্যান্য চরিত্রগুলি প্রতিবাদ করেছে। দোকানির বিরুদ্ধেও প্রতিবাদ গড়ে তুলতেই উভয়েরই সুর শেষমেশ কিছুটা হলেও নরম হয় এবং সকলেই সুষ্ঠুভাবে লাইন দিয়ে চাল পায় এবং অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছোতে পারে। এই ঘটনার প্রেক্ষিতে সকলেই বুঝতে পারে এক না-হলে চলবে না। তৃতীয় পুরুষের বক্তব্য থেকে তা স্পষ্ট-“আর মনে করাকরিই বা কেন? যথেষ্ট তো হয়েছে, এখন বাঁচতে হবে, বাঁচতে হলে একসাথে চলতে হবে।” এই উপলব্ধিই ছোটো কল্পনাটক ‘আগুন’ নাটকের প্রধান প্রাপ্তি। বাঁচতে হলে জোট বাঁধতে হবে।