পঞ্চদশ শতকের পূর্বে সমুদ্রযাত্রার আদি উদ্যোগ সম্পর্কে আলোচনা করো

পঞ্চদশ শতকে ইউরোপের আর্থিক ও রাজনৈতিক ইতিহাসের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ছিল বিভিন্ন সামুদ্রিক অভিযান এবং নতুন নতুন দেশ-মহাদেশ সম্পর্কে ভৌগোলিক জ্ঞান অর্জন করা। তবে এরও বহুপূর্বে এমনকি খ্রিস্টপূর্ব কালেও সমুদ্রযাত্রার উদ্যোগের সূত্রপাত হয়ে গিয়েছিল।
পঞ্চদশ শতকের পূর্বে সমুদ্রযাত্রার আদি উদ্যোগসমূহ
(1) স্কাইল্যাক্সোর ভূমিকা: খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ শতকে পারস্যের ডেরিয়াসে কর্মরত স্কাইল্যাক্স (Scylax of Caryanda) যে পেরিপ্লাস (Periplus) বা ভাসমান অবস্থায় পরিভ্রমণ অর্থাৎ, সমুদ্রযাত্রার নকশা তৈরি করেন, সেটিকে সমুদ্রযাত্রার প্রাথমিক উদ্যোগ বলা যায়। তিনি সমুদ্রযাত্রা ও পরিভ্রমণের সুবিধার্থে মিশরের নীল অববাহিকার মধ্যে দিয়ে ভূমধ্যসাগরীয় জিব্রাল্টার প্রণালী পর্যন্ত একটি সঠিক দিকনির্দেশ করেছিলেন।
(2) ফোয়েনিশিয়ানদের উদ্যোগ: প্রাচীন ফোয়েনিশিয়ানরা (Phoenicians) সমুদ্রযাত্রায় অভ্যস্ত ছিল। এরা সাধারণভাবে একটি সামুদ্রিক যাত্রাবাহী সম্প্রদায় হিসেবেই পরিচিতি লাভ করে। মনে করা হয় যে, আরব জাতি এদের কাছ থেকেই সমুদ্রযাত্রা ও বাণিজ্যের উত্তরাধিকার পেয়েছে।
(3) আরবদের উদ্যোগ: বলা হয় যে, আরবীয়রা প্রাচীন প্রাচ্য সম্বন্ধে জ্ঞান উত্তরাধিকার সূত্রে গ্রহণ করে এবং তার যথোপযুক্ত ব্যবহারও করে। খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে আরব বণিকরা ভারত মহাসাগরে উপস্থিত হয়ে বিজ্ঞান ও সংস্কৃতির বার্তাবাহকরূপে বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ করেছিল।
(4) চেলিক উদ্যোগ: চিনে মিং বংশের (Ming Dynasty) শাসনকালে তারা ভারত মহাসাগর ও তীরবর্তী দেশগুলিতে নৌযাত্রা করেছিল। তবে এক্ষেত্রে চিনের উদ্দেশ্য স্পষ্ট নয়। সম্ভবত মিং রাজবংশের গৌরব প্রচার করাই ছিল নৌযাত্রার উদ্দেশ্য। জানা যায় যে, পঞ্চদশ শতকে আবিষ্কারের যুগ-এর আগে কোনও নাবিক উত্তমাশা অন্তরীপ (Cape of Good Hope) অতিক্রম করার উদ্যোগ নেননি।
(5) ভাইকিংদের উদ্যোগ: দুঃসাহসিক অভিযাত্রিক দল রূপে ভাইকিংরা বিশেষ পরিচিত। পঞ্চদশ শতকের অনেক আগেই তারা আবিষ্কারের নেশায় মেতে উঠেছিল। ৯৮০ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ Eric the red বা লাল এরিকের নেতৃত্বে গ্রিনল্যান্ডে ভাইকিংরা বসতি স্থাপন করে। ১০০১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ তারা ল্যাব্রাডার উপকূলের নিউ ফাউন্ডল্যান্ডের দিকে অভিযান করলেও স্থানীয় অধিবাসীদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়। মোটামুটিভাবে ত্রয়োদশ শতকের মধ্যে তাদের বসতি ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। তবে তাদের দুঃসাহসিক সামুদ্রিক অভিযানের কাহিনি ইতিহাসের পাতায় আজও বর্ণিত হয়ে আছে।
(6) প্ল্যানো কারপিন ও বুবুকের উদ্যোগ: ত্রয়োদশ শতকে জিওভান্নি দ্য পিয়ান দেল কারপিন (Giovanni da Pian del Carpine) বা প্ল্যানো কারপিন (Plano Carpini) এবং উইলিয়ম অফ রুরুক (Willam of Rubruck/ Guillaume de Rubrouck) ডন ও ভলগা নদীর মধ্যবর্তী অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন। তাঁদের ভৌগোলিক জ্ঞান পরবর্তীতে সমুদ্রযাত্রায় সহায়ক হয়েছিল।
(7) মার্কোপোলোর উদ্যোগ: ১২৭১ খ্রিস্টাব্দে মার্কোপোলো (Marco Polo) সমুদ্র অভিযান চালিয়ে ভারতবর্ষ ও এশিয়া মহাদেশের বিপুল সম্পদের বিবরণ তুলে ধরেন। এই বিবরণ ইউরোপে অজানা ভূখণ্ড সম্পর্কে প্রবল উৎসাহ সঞ্চার করেছিল। পরবর্তীকালে তিনি চিনেও পরিভ্রমণ করেছিলেন।