ডাইনি সন্দেহে মেয়েদেরই সবথেকে বেশি করে হত্যা করা হত কেন
অথবা, ডাইনি হত্যার মূলে লিঙ্গবৈষম্য কতখানি দায়ী ছিল

মধ্যযুগ থেকেই ইউরোপে ডাইনি হিসেবে নারী-নিধনের ঘটনা ব্যাপক আকার ধারণ করেছিল। পঞ্চদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে সপ্তদশ শতকের শেষভাগ পর্যন্ত সময়কালে যতজনকে ডাইনি সন্দেহে মেরে ফেলা হয়েছে, তাদের পাঁচভাগের চারভাগই ছিল স্ত্রীলোক। উইলিয়ম মন্টের (William Monter) তাঁর উইচক্রাফট ইন ফ্রান্স অ্যান্ড সুইটজারল্যান্ড (Witchcraft in France and Switzerland) নামক গ্রন্থে একটি পরিসংখ্যান দিয়ে দেখিয়েছেন যে, নিপীড়িত ও শান্তিপ্রাপ্তদের মধ্যে জেনেভায় ছিল ৭১% নারী, ফিনল্যান্ডে ৭৮%, ভেনিসে ৭৮%, জার্মানিতে ৮২% এবং ইংল্যান্ডে ৯২% নারী।
ডাইনি সন্দেহে নারীদের হত্যার কারণসমূহ
(1) পিতৃতান্ত্রিক সমাজ: মধ্যযুগে ইউরোপের পিতৃতান্ত্রিক সমাজে নারীদের অবস্থান গৃহের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তাদের দুর্বল বলে গণ্য করা হত এবং স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কাজ করার সুযোগ প্রায় ছিল না বললেই চলে। এমতাবস্থায় কোনও নারী প্রচলিত নিয়মের বাইরে গিয়ে নিজ ক্ষমতা প্রয়োগ করার চেষ্টা করলে তাকে প্রায়শই ডাইনি অপবাদ দেওয়া হত।
(2) ধর্মীয় কুসংস্কার: খ্রিস্টান ধর্ম ছিল পুরুষতান্ত্রিক। মধ্যযুগের ইউরোপের খ্রিস্ট ধর্মের কর্তাব্যক্তিরা ছিলেন তীব্র নারীবিদ্বেষী। তাঁদের কাছে সৌন্দর্য হল অশুভ ও সুখশান্তি হল পাপ, যৌনতা অন্যায় ও জন্মদান বিরক্তিকর। তাঁদের নারীবিদ্বেষের অপর গুরুত্বপূর্ণ কারণ ছিল-তাঁরা বিশ্বাস করতেন যে, নারীরা পুরুষকে পাপের পথে নিয়ে যায়। সমাজকে কলুষিত করে। তাই খ্রিস্টানরা ডাইনি অপবাদে ১৪৮০ থেকে ১৭৫০ খ্রিস্টাব্দের মধ্যে লক্ষাধিক নারীকে হত্যা করে। কিছু ক্ষেত্রে পুরুষরা মারা গেলেও নারীদের সংখ্যাই ছিল সর্বাধিক। এই কারণে অনেকেই ডাইনি-নিধনকে genderized mass murder বলে অভিহিত করেছেন।
(3) সম্পত্তি দখল: ডাইনি-নিধনের প্রক্রিয়ায় অর্থনৈতিক কারণও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল। অনেকসময় ধনী বৃদ্ধা বা একাকী নারীদের বিরুদ্ধে ডাইনিবিদ্যার অভিযোগ আনা হত, যার ফলে তাদের সম্পত্তি সমাজের ক্ষমতাশালী ব্যক্তিদের দখলে চলে যেত।
(4) সামাজিক দ্বন্দ্ব: গ্রামীণ সমাজে পারিবারিক বা প্রতিবেশীর সঙ্গে দ্বন্দ্ব বা শত্রুতার কারণেও নারীদের ডাইনি হিসেবে অভিযুক্ত করা হত অনেকসময়। এর ফলে সেইসব নারীদের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়া সহজ হত।
(5) চিকিৎসা: মধ্যযুগে সমাজের অনেক নারী গৃহচিকিৎসক বা ধাত্রীর ভূমিকা পালন করত। প্রাকৃতিক ওষুধ অর্থাৎ, গাছপালার বিভিন্ন অংশ ব্যবহার করে তারা সাধারণ মানুষকে সুস্থ করে তুলত। অনেকসময়ই মধ্যযুগের প্রথাগত চিকিৎসকরা এই নারীদের ডাইনি হিসেবে চিহ্নিত করতেন।
মূল্যায়ন
ঐতিহাসিক ও সমাজবিজ্ঞানীগণ ডাইনি নির্যাতন ও হত্যার পিছনে সামাজিক-ঐতিহাসিক কার্যকারণ লক্ষ করেছেন। নারীবাদী তাত্ত্বিকদের অনেকে বলেন যে, ডাইনি হত্যা আসলে নারীহত্যা। মার্কিন ঐতিহাসিক ক্যারল কার্লসেন (Carol Karlsen)-এর ভাষায় “The history of witch-craft is primarily a history of Women.”