বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- বিজ্ঞানের আবিষ্কার ও মানবসমাজ
- মানবজীবনে বিজ্ঞানের প্রভাব
- অতিরিক্ত বিজ্ঞান নির্ভরতা
- বিজ্ঞানের অভিশপ্ত দিক
- বিজ্ঞানের অভিশাপ মুক্তি
- বিজ্ঞানের কল্যাণকামনায় মানুষের ভূমিকা
বিজ্ঞান মানুষের বহু শতাব্দীর অতন্দ্র সাধনার সম্পদ। বিজ্ঞানের অগ্রগতি মানবসভ্যতার অগ্রগতি তথা মানুষের মঙ্গলসাধনেরই নামান্তর। মানুষের হিতসাধনের জন্যই বিজ্ঞানের সৃষ্টি। কিন্তু ভাবনার বিষয় বিশ শতকের বিজ্ঞানকে অকল্যাণকর দিকে নিক্ষেপ করা হয়েছে। ফলে বিজ্ঞানের আশীর্বাদী মূর্তি আজ সংহারিণী মূর্তিতে পর্যবসিত হতে চলেছে।
আদিম মানুষ যেদিন প্রথম আগুন জ্বালাতে শেখে সেদিন থেকে বিজ্ঞানের জয়যাত্রার সূচনা। তারপর প্রস্তরযুগের অবসান ঘটিয়ে উন্নত ধাতু ব্যবহারের মধ্য দিয়ে ক্রমশ সভ্যতার যে অগ্রগতি ঘটেছে তা বিজ্ঞানেরই অবদান। বিজ্ঞানের কল্যাণেই আবিষ্কার সম্ভব হয়েছে বৈদ্যুতিক শক্তি, বাষ্প শক্তি, যন্ত্রশক্তির; আবিষ্কার হয়েছে বেতার যন্ত্র ও দূরদর্শন, যা দূরকে আরও নিকট করে দিয়েছে। বিজ্ঞানের সাহায্যেই দুরারোগ্য ব্যাধির কবল থেকেও মানুষ বাঁচতে পারছে, এ ছাড়া কৃত্রিম উপগ্রহ যেমন ইনস্যাট ১এ, ইনস্যাট-১বি প্রভৃতির মাধ্যমে দূরদূরান্তের বিভিন্ন খবরাখবরও জানতে পারি। এই সমস্ত উপগ্রহের দ্বারা মানুষ বাড়িতে বসে খেলাধুলাও দেখতে পারছে। অটোমেশন বা স্বশাসিত যন্ত্র মানুষের প্রতি পরিশ্রমের কাজগুলি করে কষ্ট লাঘব করছে। এতদিন খনির অভ্যন্তরে যে বিপুল খনিজ সুপ্ত ছিল তার ঘুম ভেঙেছে বিজ্ঞানের ছোঁয়ায়। নদীর জলে বাঁধ দিয়ে জলবিদ্যুৎ উৎপাদন করে মানুষ আজ তা বিভিন্ন কাজে প্রয়োগ করেছে। তাই প্রগতির ক্ষেত্রে বিজ্ঞানের জয়যাত্রা অনবদ্য।
মানুষের জীবনের প্রতিটি মুহূর্ত বিজ্ঞান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। টুথপেস্ট, ব্রাশ, ফ্যান, হিটার, ফ্রিজ, গ্যাস ইত্যাদি সব কিছুই বিজ্ঞানের দান। কৃষি, শিল্প, যানবাহন, আমোদ-প্রমোদ প্রভৃতি সব ক্ষেত্রেই এই বিজ্ঞানের প্রয়োগ ও প্রসার লক্ষ করা যায়। বিজ্ঞান আজ মানবসভ্যতায় এনেছে যুগান্তর।
বর্তমান যন্ত্রসভ্যতার যুগে দিন দিন মানুষ পরিণত হচ্ছে যন্ত্রে। মানুষ তার ছোটো থেকে ছোটো কাজের জন্য নির্ভরশীল বিজ্ঞানের প্রতি। যন্ত্রনির্ভর মানুষ ধীরে ধীরে তার নিজস্ব শ্রমে অপারগ হয়ে পড়ছে। বস্তুত মানুষ যন্ত্রকে না, যন্ত্র যেন মানুষকে চালনা করছে। এই অতিরিক্ত নির্ভরশীলতা মানুষকে বিজ্ঞানের দাসে পরিণত করছে।
বিজ্ঞান আর বহুল আবিষ্কারের মধ্য দিয়ে মানবজীবনকে দান করেছে প্রশান্তি। কিন্তু বর্তমান সভ্যতায় বিজ্ঞানের আবিষ্কার ভয়ানক মারণাস্ত্র, যা নিমেষে ধ্বংস করে দিতে পারে কত অমূল্য তাজা জীবন। সেই বিজ্ঞান সভ্যতার এক কলঙ্কময় অধ্যায় হল হিরোশিমা ও নাগাসাকির হত্যাকান্ড। উন্নত দেশগুলি পারমাণবিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে আজ ক্ষুদ্র দেশগুলির ওপর নির্বিচার শোষণ চালাচ্ছে। নিত্যনৈমিত্তিক সন্ত্রাসবাদের শিকার হচ্ছে মানুষ। যানবাহনের ধোঁয়া বর্জ্য পদার্থ আজ প্রকৃতির ভারসাম্য বিনষ্ট করছে। কৃত্রিম জীবনযাপন, মানবিকতার শোষণ, আধুনিক বিজ্ঞাননির্ভর সভ্যতার চরম অভিশাপ। বিজ্ঞানকে এই অভিশপ্ত করার জন্য দায়ী মানুষ। স্বার্থান্বেষী, জ্ঞানপাপী মানুষের অন্তরে শুভবোধ জাগ্রত না হলে বিজ্ঞান বিপথে চালিত হবেই। মানুষের কল্যাণে বিজ্ঞানকে নিয়োগ করতে হবে; এর জন্য প্রয়োজন মানুষের শুভবোধ জাগরণ এবং বিজ্ঞান পরিচালককেও শুভবোধ দ্বারা পরিচালিত হতে হবে। তবেই বিজ্ঞান হবে মানুষের কাছে আশীর্বাদ স্বরূপ।
মানুষের কল্যাণ কামনায় যেমন বিজ্ঞান নিয়োজিত তেমনি মানুষকেও বিজ্ঞানের কল্যাণের কথা ভাবতে হবে। পারস্পরিক কল্যাণ ভাবনার মধ্য দিয়েই বিজ্ঞান প্রকৃত কল্যাণকর ভূমিকায় অবতীর্ণ হবে। বিজ্ঞান যেন প্রতিটি পদক্ষেপে মানুষের সুখ স্বাচ্ছন্দ্য ও নিশ্চয়তা প্রদান এবং তার কল্যাণবিধানে লিপ্ত থাকে সেদিকে নজর দিতে হবে। সন্ত্রাসবাদ দমনমূলক কাজে সর্বস্তরের মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই বিজ্ঞান কল্যাণকামী শক্তিরূপে সকলের কাছে ধরা দেবে।
সমাজের বিবেকহীন মানুষের স্বার্থসর্বস্ব মানসিকতার কাছে ‘বিজ্ঞান তো সংকলিত জিনিসের ভিড় শুধু’। সাম্রাজ্যবাদী মানসিকতা ভুলে মানুষ যদি বিশ্বমানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয় তাহলে বিজ্ঞানকে আশীর্বাদ রূপে লাভ করা সম্ভব। তাই ভরসা রাখা যেতেই পারে। মানুষ একদিন বুঝতে পারবে যে, বিজ্ঞানের অপব্যবহার আত্মহননের নামান্তর মাত্র। আমরা সেই দিনটির অপেক্ষায় থাকব, যে দিন মানুষ বিজ্ঞানকে শুধু মানবকল্যাণে ব্যবহার করার কথা ভাববে।