ভক্তিবাদ বলতে কী বোঝ
অথবা, ভক্তিবাদ সম্পর্কে টীকা লেখো

ভূমিকা
‘ভজ’ ধাতু থেকে ‘ভক্তি’ শব্দের উৎপত্তি। প্রাচীন হিন্দু ধর্মশাস্ত্রে ভক্তিবাদী আদর্শের উল্লেখ পাওয়া যায়। এই ‘ভক্তি’ আদর্শের ওপর ভিত্তি করেই মধ্যযুগে ভারতে হিন্দুধর্মের নানা কুসংস্কার ও রক্ষণশীলতার বিরুদ্ধে যে সংস্কার আন্দোলন হয়েছিল, তা সাধারণভাবে ‘ভক্তিবাদ’ বা ভক্তি আন্দোলন নামে পরিচিত।
(1) উদ্ভব: ভক্তিবাদের উদ্ভব সম্পর্কে নানা মতবাদ আছে। ঐতিহাসিক গ্রিয়ারসন, ওয়েবার প্রমুখরা মনে করেন, খ্রিস্টধর্ম থেকেই ভক্তিবাদী আদর্শের উদ্ভব ঘটেছে। অন্যদিকে অধ্যাপক ইউসুফ হুসেন, ড. কুরেশি প্রমুখের মতে, ইসলামের সাম্যবাদ ও একেশ্বরবাদী আদর্শ থেকেই ভক্তিবাদের জন্ম। তবে অধিকাংশ পন্ডিতরা মনে করেন বেদ, উপনিষদ প্রভৃতি প্রাচীন ধর্মশাস্ত্রগুলি হল ভক্তিবাদী আদর্শের মূল উৎস। সপ্তম থেকে দ্বাদশ শতকের মধ্যে দক্ষিণ ভারতের শৈব ‘নায়নার’ এবং বৈঘ্নব ‘আলওয়ার’ সম্প্রদায় ভক্তিবাদী আন্দোলনের সূচনা করেন।
(2) মূলকথা : ভক্তিবাদের মূলকথা হল আত্মার সঙ্গে পরমাত্মার মিলন অর্থাৎ ভক্তের সঙ্গে ভগবানের মিলন। ভক্তিবাদী সাধকদের মতে, একমাত্র প্রেম ও ভক্তির মাধ্যমেই ঈশ্বরের সান্নিধ্যলাভ সম্ভব হয়। তাঁরা মনে করতেন ঈশ্বর এক ও অদ্বিতীয়।
(3) ভক্তিবাদের প্রবক্তাগণ : ভক্তিবাদী প্রবক্তাদের মধ্যে অন্যতম ছিলেন রামানুজ, রামানন্দ, কবীর, নানক, শ্রীচৈতন্যদেব, মীরাবাঈ প্রমুখ। এঁদের অনেকেই ছিলেন সমাজের নিম্নবর্ণের মানুষ। ভক্তিবাদী সাধকদের মত ও আদর্শের ওপর ভিত্তি করে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল।
মূল্যায়ন
সবশেষে বলা যায় যে, মধ্যযুগে ভারতের ভক্তিবাদী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য ছিল হিন্দুধর্মের নানা ধর্মীয় কুসংস্কার ও সামাজিক ভেদাভেদ দূর করা। ভক্তিবাদ হিন্দুধর্মের জাতিভেদের কঠোরতা হ্রাস এবং হিন্দুসমাজের ভাঙনকে অনেকটাই রোধ করতে পেরেছিল বলা যায়। তা ছাড়া হিন্দু-মুসলিম ঐক্যের বাতাবরণ রচনায় ভক্তিবাদী সাধকদের ভূমিকাও ছিল অনস্বীকার্য।