ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলাফল কী হয়েছিল

ভূমিকা
খ্রিস্টীয় ষোলো শতকে ইউরোপে যে ক্যাথোলিক রোমান চার্চ ও ধর্মবিরোধী সংস্কার আন্দোলন গড়ে উঠেছিল তা সমগ্র ইউরোপে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল। শুধুমাত্র ধর্মীয় ক্ষেত্রে নয়, ইউরোপের সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক সবদিকেই ব্যাপকভাবে পরিবর্তন সূচিত করেছিল। এই কারণেই ধর্মসংস্কার আন্দোলন ইউরোপের ইতিহাসে যুগান্তকারী ঘটনা হিসেবে স্বীকৃত।
(1) খ্রিস্টান ধর্মে বিভাজন: সামগ্রিক খ্রিস্টান জগৎ দুটি ভাগে বিভক্ত হয়ে যায় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে। ক্যাথোলিক সম্প্রদায় রোমান চার্চের ও পোপের অধীনে থাকে। অপরদিকে প্রোটেস্ট্যান্ট সম্প্রদায় সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র হয়ে পড়ে।
(2) ধর্ম ও রাজনীতির পৃথক্করণ: চার্চ ও রাষ্ট্রের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা করেছিল। এক্ষেত্রে শেষপর্যন্ত ইউরোপের বেশ কয়েকটি দেশে চার্চের ওপর রাষ্ট্রের জয় সূচিত হয়। ধর্মনীতি ও রাজনীতির মধ্যে স্পষ্ট সীমারেখা টানা হয়। ধর্মীয় প্রধান ও ব্যক্তিত্বদের রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হয়।
(3) যাজক শ্রেণির প্রভাব হ্রাস: ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে সামগ্রিকভাবে সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে যাজক শ্রেণির প্রভাব-প্রতিপত্তি কমে যায়। যাজক শ্রেণির মধ্যস্থতা ছাড়াও ঈশ্বরের কাছে পৌঁছোনো যায়-এই বিশ্বাস জনগণের মধ্যে ছড়িয়ে পড়ে। বিভিন্ন ভাষায় বাইবেল অনুবাদ ও ছাপার ফলে সাধারণ মানুষ ধর্মের স্বরূপ বুঝে যাজক শ্রেণির প্রতি অকারণ ভয় ও বাধ্যবাধকতা ঝেড়ে ফেলে।
(4) চিন্তার স্বাধীনতা: এযাবৎকাল চার্চ ও পোপতন্ত্র ধর্মের নামে মানুষের ব্যক্তিগত মতামতকে দমন করে রেখেছিল। ধর্মসংস্কার আন্দোলন চার্চের সেই ক্ষমতা ধ্বংস করে প্রতিটি মানুষের ব্যক্তিস্বাধীনতা ফিরিয়ে দেয়। মানুষের স্বাধীন চিন্তার ওপর চার্চের নিয়ন্ত্রণের অধিকার বিলুপ্ত } হলে মানুষের জ্ঞানচর্চা ও অন্যান্য নানাদিকে আগ্রহ বৃদ্ধি পায়।
(5) জাতীয়তাবাদী ভাবনার বিকাশ: ১৫৫৫ খ্রিস্টাব্দে অগসবার্গ-এর সন্ধিতে ‘রাজার ধর্ম প্রজার ধর্ম’, বলে স্বীকৃত হয়, এর ফলে ধর্মীয় বিভেদ দূরীভূত হয়ে ধর্মীয় ঐক্যবোধের জায়গা তৈরি হয়। ধর্মীয় ঐক্যবোধ থেকে রাজনৈতিক ঐক্যস্থাপনের আদর্শ গৃহীত হয়, যা জাতীয়তাবাদী ধারণার বৃদ্ধিতে সহায়ক হয়। ইংল্যান্ডের জাতীয় চার্চকে ঘিরেই (Anglican Church) ইংল্যান্ডের জনমনে জাতীয় ঐক্য দৃঢ় হয়েছিল।
মূল্যায়ন
ধর্মসংস্কার আন্দোলন মধ্যযুগের ধর্মীয় বিরোধ- তিক্ততা-যুদ্ধের অবসান ঘটিয়েছিল। নবজাগরণের ফলে যে যুক্তিবাদী মানসিকতার বিস্তার ঘটতে শুরু করেছিল তা আরও বিকশিত হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ফলে। অপরদিকে ধর্মীয় সহিষ্ণুতার বার্তাও পরিস্ফুট হয় এর মধ্য দিয়ে।