মানবতাবাদ’ কাকে বলে? রেনেসাঁর যুগে মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্যগুলি উল্লেখ করো
অথবা, রেনেসাঁ ও মানবতাবাদের মধ্যে সম্পর্ক নির্ধারণ করো

ভূমিকা
চতুর্দশ শতকে থেকে ষোড়শ শতকের অন্তর্বর্তীকালে প্রথমে ইটালি ও পরে সমগ্র ইউরোপে এক নতুন জীবনদর্শন আবির্ভূত হয়। সামাজিক ও সাংস্কৃতিক জীবনে ব্যাপক রূপান্তর সূচিত হয়। এই রূপান্তরের অন্যতম বিষয় ছিল মানুষ, মানুষের জীবন ও অধিকার সম্পর্কে নতুন চেতনা। এই পর্বে মানুষকে নিয়তি বা দৈবের অধীন একটি অসহায় জীব হিসেবে দেখার পরিবর্তে একটি স্বাধীন ও সৃজনশীল জীব হিসেবে গণ্য করা শুরু হয়। মানুষ সম্পর্কে এই স্বাধীন ও স্বতন্ত্র্য ধারণাকেই সাধারণভাবে মানবতাবাদ বলা হয়। নবজাগরণ ও মানবতাবাদ এই দুই বিষয়ের ওপর প্রথম আলোকপাত করেন ঐতিহাসিক জ্যাকব বুখার্ড (Jacob Burckhardt) তাঁর বিখ্যাত গ্রন্থ ‘The civilization of the Renaissance in Italy’-তে।
(1) মানবতাবাদের উৎসস্থল: ইটালিকে মানবতাবাদের উৎপত্তিস্থল হিসেবে গণ্য করা হয় এবং সেখান থেকে ইউরোপের অন্যান্য দেশে এর বিস্তৃতি ঘটে। মাধ্যম ছিল যাজক সম্প্রদায়, ব্যবসায়ী গোষ্ঠী, কূটনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ইত্যাদি। যাঁরা পেশাগত কারণে দেশান্তরে যাতায়াত করতেন।
(2) মানবতাবাদের বৈশিষ্ট্য: মানবতাবাদকে একটি নতুন জীবনদর্শন বলা যেতে পারে, যার কেন্দ্রে ছিল এক ধরনের ব্যক্তিস্বাতন্ত্রবাদী চেতনা। নবজাগরণের কালে নতুন করে মানবজীবনের ওপর যে গুরুত্ব দেওয়া শুরু হয় তাই-ই মানবতাবাদের মূল বৈশিষ্ট্য।
- নতুন যুগ চেতনা: মানবতাবাদীদের সকলের মধ্যেই একটা নতুন যুগ চেতনা ছিল যার অভিব্যক্তি প্রথম দেখা যায় ফ্রান্সিসকো পেত্রার্ক-এর লেখায়। যে কারণে তাঁকে মানবতাবাদের জনক আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কলুচিয়ো সালুতাতি, পজিয়ো লোরেজ্জো ভাল্লা বা মার্সিলিয়ো ফিচিনো প্রমুখ ইতালীয় মানবতাবাদের প্রধান আহ্বায়কদের প্রত্যেকের রচনায়, পেত্রার্ক-এর মতো নিজেদের সময়কে মধ্যযুগের থেকে আলাদা ভাবার বিষয়টি রয়েছে। রোমান সাম্রাজ্য ধ্বংস হওয়ার পর যে অন্ধকার যুগের সূচনা হয়েছিল তা কাটিয়ে নতুন আলোর দিশা আনতে চেয়েছেন তাঁরা।
- ধ্রুপদি সংস্কৃতির পুনরুত্থান: প্রাচীন দর্শনের জীবন মাহাত্ম্যকে প্রাধান্য দিয়ে, মধ্যযুগীয় সংস্কৃতির প্রতি বিতৃয়া থেকে ধ্রুপদি সংস্কৃতির পুনরুত্থান শুরু হয়েছিল। কনস্ট্যান্টিনোপলের ধ্বংসস্তূপ থেকে প্রাচীন পুথি-পাণ্ডুলিপির পুনরাবিষ্কার ও সেগুলির চর্চা ও অনুবাদ ব্যাপকভাবে জ্ঞানচর্চার ক্ষেত্র প্রস্তুত করে।
- মধ্যযুগীয় ধর্মান্ধতার অবসান: ধর্ম ও গির্জাকেন্দ্রিক মানবজীবনের পরিসরকে বদলে দিতে চেয়েছিলেন মানবতাবাদীরা। মানুষের চিন্তা, শিক্ষা, আচরণ, জীবন সব কিছুকে নিয়ন্ত্রণে চার্চের যে সর্বগ্রাসী ভূমিকা মধ্যযুগে ছিল তাকে অস্বীকার করে মানুষের নিজস্ব ভাবনা, সৃষ্টি, বিবেচনাবোধের ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়। কোনোপ্রকার দিব্যজ্ঞান বা ধর্মীয় মহিমা নয়, মানবতাবাদ গুরুত্ব দিয়েছিল মানুষের বাস্তব কীর্তিকে।
(3) নতুন দর্শন রূপে মানবতাবাদ: ঐতিহাসিকদের একাংশ মানবতাবাদকে একটি নতুন দর্শন রূপে দেখেছেন সেখানে মানবপ্রকৃতিতে গৌরবান্বিত করা হয়েছিল, কোনো অতীন্দ্রিয় শক্তিকে নয়। ইহজগতের বাস্তব জীবনের অস্তিত্বকেই একমাত্র সত্য বলে ধরা হয়েছিল। যদিও এই ধারণাকে অনেক ঐতিহাসিকই সমর্থন করেন না, তাঁদের মতে চতুর্দশ শতকে মানবতাবাদীরা মধ্যযুগীয় অ্যারিস্টট্লীয় ‘স্কলাস্টিসজম’ থেকে বেরোতে পারেননি। কাজেই মানবতাবাদ কোনো নতুন দর্শন নয়-এটি একটি বৌদ্ধিক অগ্রগতির প্রক্রিয়া।
(4) ইতিহাসবোধের উন্মেষ: মানবতাবাদের হাত ধরে ইতিহাসবোধের উন্মেষ ঘটেছিল। পেত্রার্ক-এর ‘Letters to the Ancient Dead’-এ প্রথম আভাস পাওয়া যায়। এ ছাড়া লিওনার্দো বুনি। ম্যাকিয়াভেলি প্রমুখ পৃথক বিষয় হিসেবে ইতিহাস চর্চাকে প্রতিষ্ঠিত করতে চেয়েছিলেন।
(5) মানবতাবাদের প্রকারভেদ: মানবতাবাদী আন্দোলন দুটি ভাগে বিকশিত হয়েছিল-ধর্মনিরপেক্ষ (Secular) এবং ধর্মীয় বা খ্রিস্টান (Christian) মানবতাবাদ। দ্বিতীয় ধারণাটি মূলত যাজক সম্প্রদায়ের মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল। ধর্মনিরপেক্ষ মানবতাবাদ মানবজীবনকে ভিত্তি করে বিকশিত হয়েছিল। সাহিত্য, শিল্প, জ্ঞান-বিজ্ঞান, অনুসন্ধিৎসা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবোধ সব কিছুকেই প্রভাবিত করেছিল (Secular humanism) |
মূল্যায়ন
ধর্মীয় অনুশাসন ও বিধিনিষেধকে অগ্রাহ্য করে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কোনো কিছু গ্রহণ বা বর্জন করার শিক্ষাই মানবতাবাদের সবথেকে বড়ো শিক্ষা। এটি ছিল নবজাগরণের যুগে সবরকম সাংস্কৃতিক অনুপ্রেরণার উৎস।