তেলেনাপোতা আবিষ্কার গল্পের বিষয়বস্তু

সম্ভবত, কোনো-এক মঙ্গলবার মাছ শিকারের নতুন জায়গার সন্ধান পেয়ে গল্পকথক তার দুই বন্ধুসহ রওনা দিয়েছিলেন তেলেনাপোতার উদ্দেশ্যে। ঘণ্টা দুয়েকের বাসযাত্রার পর তেলেনাপোতার কাছাকাছি এক বাসস্টপে নেমেও পড়েন তাঁরা। তেলেনাপোতার দিকে যাওয়ার জন্য মশার কামড় ও অদ্ভুত নীরবতার মধ্যে যে-কোনো একটা যানের অপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত যখন ফিরতি বাসে স্বস্থানে চলে আসা মনস্থির করেছেন, সেই সময় নিস্তব্ধ জঙ্গল থেকে অমানুষিক কান্নার মতো আওয়াজ করতে করতে একটা গোরুর গাড়ি তাদের সামনে এসে উপস্থিত হয়। গোরু দুটিকে দেখে গল্পকথকের মনে হয়েছে, পাতালের কোনো বামনের দেশ থেকে তাদের এই ক্ষুদ্র সংস্করণটি উপস্থিত হয়েছে।
ক্ষুদ্র গাড়িটির সরু ছইয়ের ভিতরে তিন বন্ধু কোনোরকমে নিজের হাত-পা গুটিয়ে গাদাগাদি করে বসে পড়লেন। অন্ধকার ক্রমে গাঢ় হয়, আর সেই অন্ধকার ভেদ করে জঙ্গল ঘেরা পথে হেলতে দুলতে এগিয়ে চলে সেই গোরুর গাড়ি। হঠাৎ এক সময় উৎকট এক বাজনার আওয়াজে চমকে উঠে কথক দেখলেন গাড়ির গাড়োয়ান ক্যানেস্তারা বাজাচ্ছে। কারণ, জিজ্ঞাসা করলে জানতে পারলেন, এই ক্যানেস্তারার শব্দ শুনে আশেপাশের চিতাবাঘ পালিয়ে যাবে।
কলকাতা থেকে মাত্র ত্রিশ মাইল দূরে এইরকম একটা স্থান থাকা সম্ভব কি না ভাবতে ভাবতে একসময় জঙ্গল-মাঠ পেরিয়ে পুকুরের পাশে বিশাল এক জরাজীর্ণ বাড়িতে তাঁরা ওঠেন। ধ্বংসপ্রায় এই অট্টালিকার অপেক্ষাকৃত বাসযোগ্য কোনো-একটি ঘরে তারা স্থান পান। তাদের মধ্যে একজন ঘুমকাতুরে। তাই চামচিকে, অসংখ্য ঝুল আর ধুলোয় ভরতি ঘরে ঢোকামাত্র একটি শতরঞ্জি বিছিয়ে তিনি ঘুমিয়ে পড়লেন। কথকের আর-এক বন্ধু পানরসিক। তিনিও খানিক বাদে পানপাত্রে নিজেকে সম্পূর্ণ ডুবিয়ে দিলেন। ঘরের আসবাব বলতে একটা লণ্ঠন ও জলের কলশি। দীর্ঘদিনের আবদ্ধ ঘরের ভাপসা গন্ধে আর মশার উৎপাতে থাকা দায়।
স্বাভাবিকভাবেই গল্পকথকের ঘুম আসে না। তিনি এই মশা আর গুমোট গরম থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য টর্চ হাতে ভাঙা সিঁড়ি দিয়ে কোনোক্রমে ছাদে উঠলেন। ছাদের আলসে বহু জায়গায় ভাঙা। নানা ভগ্নস্থান ভেদ করে বিভিন্ন গাছের শিকড় প্রাসাদটিকে একেবারে ধ্বংসের শেষ সীমায় নিয়ে গেছে। কিন্তু তারই মধ্যে কৃষ্ণপক্ষের ম্লান জোৎস্নায় চারিদিক যেন অপূর্ব মোহময় এক রূপকথার জগতে পরিণত হয়েছে বলে মনে হয়। হঠাৎ গল্পকথক অদূরে ছোটো রাস্তার ওপারে একটি ভাঙা বাড়ির কোনো-একটি জানালায় আলোর ক্ষীণ রেখা দেখতে পান, দেখতে পান একটি অস্পষ্ট ছায়ামূর্তিও। কিছু পরে সেই ছায়ামূর্তি সরে যায়। তখন গল্পকথকের মনে হয় এগুলো হয়তো তার মনের ভুল। নেমে আসেন নীচে এবং বন্ধুদের সঙ্গে ঘুমিয়েও পড়েন।
মৎস্য শিকার করা গল্পকথকের উদ্দেশ্য। তাই পরের দিন মাছ ধরার যথাযথ আয়োজন করে শ্যাওলা ঢাকা ভাঙা পুকুর ঘাটের এক পাশে স্থান করে নিলেন তিনি। বেলা বাড়তে থাকে, একটা মাছরাঙা পাখি মাঝেমধ্যে টুক করে জলে ডুব দিয়ে মাছ শিকার করে একটা বাঁশের আগায় বসে পড়ে এবং দুর্বোধ্য ভাষায় তাঁকে বিদ্রূপ করে। হঠাৎ জলের শব্দ শুনে চমক ভেঙে তিনি দেখেন লজ্জা ও আড়ষ্টতাহীনা একটি মেয়ে কলশিতে করে পুকুরে জল নিতে এসেছে। এমন একটি নির্জন স্থানে মেয়েটিকে দেখে গল্পকথক অবাক, কিন্তু মেয়েটির বিশেষ ভূক্ষেপ ছিল না। জল ভরে চলে যাওয়ার পথে অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে ঘাড় বেঁকিয়ে সে কথককে বড়শিতে টান দিতে বলে। মেয়েটির মুখের শান্ত-করুণ গাম্ভীর্য আর অপুষ্ট শরীর দেখে গল্পকথক মেয়েটির বয়স অনুমান করতে পারলেন না।
এই মেয়েটির বাড়িতেই দুপুরের খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা হয়। জানা যায়, মেয়েটির নাম যামিনী। খাওয়া-দাওয়ার সময় মাঝেমধ্যেই উপরতলার কোনো-এক ঘর থেকে একটা ক্ষীণ কণ্ঠের আওয়াজ শোনা যায়। যামিনী তখন চঞ্চল হয়ে ওঠে, উপরে যায়, ফিরে আসে বিষণ্ণ মুখে। খাওয়া শেষে বিশ্রামের সময় গল্পকথক তাঁর বন্ধু মণির কাছ থেকে জানতে পারলেন, যামিনীর মা অন্ধ। যামিনীর ভবিষ্যতের জন্য চিন্তান্বিতা মা তাঁর হবু জামাই নিরঞ্জনের জন্য অপেক্ষা করে থাকেন।
কিন্তু নিরঞ্জন ইতোমধ্যেই অন্যত্র বিয়ে করে সংসার করছে। যামিনীও জানে সেটা। কিন্তু বৃদ্ধাকে সে-কথা বলা যায় না।
যামিনীর কাতর অনুরোধে তার সম্পর্কিত দাদা মণি বৃদ্ধার সঙ্গে দেখা করতে গেলেন, গল্পকথকও তার সঙ্গী হলেন। তাদের পায়ের শব্দে সেই কঙ্কালসার মূর্তিতে যেন প্রাণের স্পন্দন আসে। বৃদ্ধার স্থির বিশ্বাস, তাঁর হবু জামাই নিরঞ্জন এসেছে। বৃদ্ধা তাঁর কল্পনার নিরঞ্জনকে অনুরোধ করে, এবার যেন সে পালিয়ে না যায়। মণি আসল বিষয়টি খোলসা করে দিতে উদ্যত হতেই গল্পকথক নিজেকে নিরঞ্জনের ভূমিকায় নিয়ে এসে বৃদ্ধাকে কথা দেন, “না মাসিমা, আর পালাব না।” গল্পকথকের এই আশ্বাসবাণী যামিনী ও মণিকে স্তম্ভিত করে দেয়।
সেদিনই বিকেলবেলা তাদের ফেরার পালা। গোরুর গাড়ি এসে হাজির। গল্পকথক ছিপ নিতে ভুলে গেলে যামিনী তা স্মরণ করিয়ে দেয়, প্রত্যুত্তরে গল্পকথক তাকে বলেন- “এবারে পারিনি বলে তেলেনাপোতার মাছ কি বারবার ফাঁকি দিতে পারবে?” অতঃপর মহানগরের আলোকোজ্জ্বল পরিবেশে তেলেনাপোতার স্মৃতিতে কিছুদিন ভাসতে থাকেন গল্পকথক। অবশেষে পুনরায় তেলেনাপোতা যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলে সেদিনই প্রবল জ্বরে আক্রান্ত হন তিনি। ডাক্তার জানালেন, এটি ম্যালেরিয়া।
দীর্ঘ রোগভোগের পর যখন সুস্থ হলেন গল্পকথক তখন আলো-হাওয়ায় বেরিয়ে নিজেই উপলব্ধি করেন, নিজের অজ্ঞাতসারে তাঁর দেহ ও মনের অনেক ধোয়া-মোছা ইতোমধ্যেই হয়ে গেছে। তেলেনাপোতার স্মৃতি তার কাছে একটা ঝাপসা স্বপ্ন বলে মনে হয়। এভাবেই তেলেনাপোতা হঠাৎ আবিষ্কৃত হয়ে আবার গভীর রাত্রির অতলে ডুবে যায়।