পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনশিল্প – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা
- পর্যটনশিল্প সম্পর্কে ধারণা
- পর্যটনশিল্পের সম্ভাবনা
- ধর্ম ও সংস্কৃতিকে কেন্দ্র করে পর্যটনশিল্প
- বিভিন্ন ধরনের পর্যটনশিল্প
ভূমিকা : পর্যটনশিল্প বলতে এক কথায় ভ্রমণ শিল্পকে বোঝায়। প্রাচীন কাল থেকেই মানুষের মধ্যে ভ্রমণের প্রবৃত্তি রয়েছে, যা আজও বহমান। তাই পর্যটনশিল্পের বিশাল সম্ভাবনার দিকগুলো সামনে রেখে বর্তমানে পৃথিবীর প্রত্যেকটি দেশ বা রাজ্যে পর্যটনশিল্প গড়ে উঠেছে। এদিক থেকে আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গও তার ব্যতিক্রম নয়। পশ্চিমবঙ্গের ভূ-বৈচিত্র্য, প্রাকৃতিক পরিবেশ, অতীত ঐতিহ্য, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক উৎসব প্রভৃতির জন্য সেই অতীত কাল থেকে বিশ্বের পর্যটন মানচিত্রে গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে এবং পর্যটকদের আকর্ষণ করে।
পর্যটন সম্ভাবনা: বর্তমানে পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনশিল্পের বিকাশ ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই বিকাশ নানা দিক দিয়ে ঘটেছে। যেমন-স্থাপত্য কেন্দ্রিক, প্রকৃতি কেন্দ্রিক, জীব ও উদ্ভিদের বৈচিত্র্যের মাধ্যমে, তীর্থস্থান কেন্দ্রিক সংস্কৃতিমূলক ইত্যাদি। এ ছাড়া সাম্প্রতিক কালে সরকারের পক্ষ থেকে নানা রকম নতুন নতুন পর্যটনশিল্পের পরিকল্পনা গ্রহণ করা হচ্ছে। রাজ্যের নানা জায়গায় তৈরি হচ্ছে পর্যটন আবাস, আয়োজন করা হচ্ছে পর্যটন মেলা ও উৎসব, নানাভাবে প্রচার চালানো হচ্ছে ইকো-টুরিজমের। পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও তার পর্যটন দপ্তর পর্যটনশিল্পের উন্নতি, সংস্কার এবং নতুন নতুন পরিকল্পনার জন্য আলাদাভাবে অর্থবরাদ্দ করেছেন। সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা, রাজ্যের আগ্রহী মানুষও পর্যটনশিল্পে বিনিয়োগ করছে। এর ফলে রাজ্যের বহু মানুষ এই শিল্পের ব্যাবসাবাণিজ্যের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে এবং বহু বেকারের কর্মসংস্থান হচ্ছে।
বিভিন্ন ধরনের পর্যটনশিল্প: অতীতের বিভিন্ন রাজা ও শাসকদের কৃতিত্বের জন্য পশ্চিমবঙ্গ নানান আকর্ষণীয় স্থাপত্যশিল্পে পূর্ণ। মধ্যযুগে ইতিহাসের দিকে ফিরে দেখলে দেখা যায়, পশ্চিমবাংলার মুরশিদাবাদ ছিল নবাবের বাংলার শাসনকেন্দ্র বা রাজধানী। পরবর্তী ব্রিটিশ ভারতবর্ষে কলকাতা ছিল রাজধানী। এ ছাড়া গৌড়ের রাজা শশাঙ্ক বা বাংলার পাল সেন প্রমুখ রাজারা তাঁদের শাসনকালে পশ্চিমবাংলায় বিভিন্ন স্থাপত্যকীর্তি সৃষ্টি করে গেছেন। সেই সমস্ত স্থাপত্য পশ্চিমবঙ্গে আজও অমর এবং শুধু দেশীয় নয় বিদেশি পর্যটকদের কাছে চরম আকর্ষণীয়। আর তাই প্রতি বছর অগণিত পর্যটক পশ্চিমবঙ্গে ভ্রমণে আসেন।
আমাদের রাজ্য পশ্চিমবঙ্গের দক্ষিণে রয়েছে উত্তাল সমুদ্র বঙ্গোপসাগর। মেদিনীপুরের দিঘা, মন্দারমণি, শংকরপুর, তাজপুর, দঃ ২৪ পরগনার বকখালি, ডায়মন্ড হারবার প্রভৃতি স্থানের সমুদ্র সৈকত পর্যটনশিল্পে খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। এ প্রসঙ্গে সুন্দরবন, টাকিও সমানভাবে আকর্ষণীয়। পৃথিবীর উল্লেখযোগ্য ম্যানগ্রোভ অরণ্য, সমুদ্র ও নদীর লবণাক্ত মিলনভূমির মোহময় প্রকৃতি এবং বিভিন্ন প্রকার পশুপাখির টানে পর্যটকরা ছুটে আসে। সুন্দরবনের ম্যানগ্রোভ অরণ্য ইউনেস্কোর তরফ থেকে বিশ্বের ঐতিহ্যপূর্ণ স্থান বা ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ তকমা পেয়েছে। তা ছাড়া এই সমস্ত অঞ্চল এবং সমুদ্র সৈকত অঞ্চলগুলোতে মৎস্য শিল্প ব্যাপক আকারে উন্নতি করেছে-যা পশ্চিমবঙ্গের পর্যটনশিল্পের একটা উপরি আকর্ষণ।
পশ্চিমবঙ্গের উত্তরাঞ্চলও পর্যটনশিল্পে চরম আকর্ষণীয়। হিমালয় পর্বতের অন্তর্গত সিঙ্গালিলা পর্বতশ্রেণি, সেখানে ব্রিটিশদের তৈরি উৎকৃষ্ট চা-বাগান, চা-শিল্প, শৈলশহর দার্জিলিং এবং পার্বত্য অঞ্চলের পাদদেশ তরাই ও ডুয়ার্স অঞ্চল প্রভৃতি অপরূপ সুন্দর। সেখানকার প্রকৃতি, নদনদী, প্রাচীন জনগোষ্ঠীর লোকসংস্কৃতি পর্যটকদের কাছে ভ্রমণের স্বর্গভূমি। পশ্চিমবঙ্গের মানুষ প্রাচীন কাল থেকেই ধর্মপ্রাণ। বিভিন্ন ধর্মের মানুষের বসবাসভূমি পশ্চিমবঙ্গ তাদের ধর্মসাধনার স্থানকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে বিভিন্ন তীর্থভূমি। তারাপীঠ, নবদ্বীপ, মায়াপুর, তারকেশ্বর, ব্যান্ডেল চার্চ, ফুরফুরা শরিফ, বিষ্ণুপুর, ঠাকুরনগর প্রভৃতি তীর্থস্থানে অসংখ্য পুণ্যার্থী, পর্যটক ভিড় করে থাকেন।
পশ্চিমবঙ্গের মূল অধিবাসী বাঙালি জাতি। তাদের বিবিধের মধ্যে বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি শুধু দেশেরই নয়, বিশ্বের পর্যটকদেরও দৃষ্টি আকর্ষণ করে। গ্রাম বাংলার ভাটিয়ালি, কবিগান, ভাওয়াইয়া, ছৌ নৃত্য, গম্ভীরা নৃত্য, বিভিন্ন মেলা ব্রত, দোল উৎসব, টুসু ভাদু প্রভৃতি সংস্কৃতি উৎসবে পর্যটকরা ভিড় জমায়। আর এই সংস্কৃতির রসের টানে পর্যটকদের আসা-যাওয়া লেগেই আছে।
উপসংহার: পশ্চিমবঙ্গের এই নানা বৈচিত্র্যের জন্য সারা বছর বহু পর্যটক এখানে আসে। সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে পশ্চিমবঙ্গে পর্যটনশিল্প সংক্রান্ত সম্ভাবনা বিপুল। পশ্চিমবঙ্গ সরকার ও পশ্চিমবঙ্গবাসী সঠিক পথে পরিকল্পনা মাফিক কাজ করলে পর্যটনশিল্পের যে চূড়ান্ত উন্নতি হবে, তাতে সন্দেহ নেই। পশ্চিমবঙ্গের সমৃদ্ধি উন্নতির জন্য পর্যটনশিল্প একটা উল্লেখযোগ্য পথ। সরকার যদি সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে তবেই পর্যটনশিল্পটির বিকাশ ঘটবে এবং পশ্চিমবঙ্গ স্বমহিমায় ভারতবর্ষ তথা সারা বিশ্বের কাছে জনপ্রিয় আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে উজ্জ্বল হয়ে উঠবে।