বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- বন ও বন্যপ্রাণী প্রাথমিক ধারণা
- বন্যপ্রাণীর বিলোপ ও বনক্ষয়
- বন্যপ্রাণী সংরক্ষণে মানবসমাজের অবদান
- বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের উপায়
- বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আবশ্যিকতা
ভূমিকা : মানুষের জন্ম থেকেই অরণ্য তার পরম আত্মীয়, অকৃত্রিম বন্ধু। অরণ্যের সবুজ সমারোহ আর প্রাণের অস্তিত্ব আমাদের পৃথিবীকে প্রাণবন্ত ও বসবাসের উপযোগী করে তুলেছে। বনের পরিবেশ বন্য প্রাণীদের সৌন্দর্য বিকাশের যেমন যথার্থ ক্ষেত্র, তেমনই বন্যপ্রাণী ছাড়া বনের সৌন্দর্যের পূর্ণতা কখনোই সম্ভব নয়। কবির ভাষায়-
বন্যেরা বনে সুন্দর,
শিশুরা মাতৃক্রোড়ে।
তবুও বিবেকহীন মানুষ নিজের সামান্য স্বার্থসিদ্ধির জন্য অরণ্যকে উচ্ছেদ করে চলেছে। আর তার ফলে ক্রমশ কমে যাচ্ছে অরণ্যে বসবাসকারী বন্যপ্রাণী।
বন্যপ্রাণীর বিলোপের কারণ: মানুষ তার নিজের সভ্যতার অগ্রগতির কারণে, নির্বিচারে বনাঞ্চল কেটে চলেছে। অরণ্যের অবলুপ্তির সঙ্গে সঙ্গে অরণ্যপ্রাণীও এক ভয়াবহ বিপদের সম্মুখীন হয়েছে। জনবিস্ফোরণ বন্যপ্রাণী বিলোপের প্রধান কারণ। জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে বসতি নির্মাণের ফলে অরণ্য হয়েছে সংকুচিত। পশ্চিমবঙ্গেই যেখানে বনভূমি হওয়া উচিত ছিল ৩৩ শতাংশ, সেখানে বর্তমানে রয়েছে ১৩.৫ শতাংশ। দ্বিতীয়ত কারণ হিসেবে বলা যায় বিভিন্ন সরকারি প্রকল্প। সরকার বিভিন্ন সময়ে বাঁধ নির্মাণ করে জলজ প্রাণী ও অন্যান্য প্রাণীর বাসস্থানকে নষ্ট করে দিয়েছে। কিছু লোভী চোরাশিকারি, তারা টাকার লোভে নিরীহ প্রাণীদের হত্যা করে। তাদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ নিয়ে আন্তর্জাতিক ব্যাবসা বিভিন্ন প্রাণীর বিলুপ্তির আরেকটি অন্যতম কারণ।
বন্যপ্রাণীর বিলোপ : মানুষের সভ্যতার অগ্রগতির পথে বলি হয়েছে নিরীহ, অসহায় প্রাণী। এই অপরাধ ক্ষমাহীন। বিভিন্ন অমেরুদণ্ডী ও মেরুদণ্ডী প্রাণী একেবারে বিলুপ্ত হয়ে গেছে, কিছু আবার বিলুপ্তির পথে। যেমন-বলিদ্বীপের বাঘ, মরিশাসের ডোডো পাখি, নিউফাউন্ডল্যান্ডের সাদা নেকড়ে, আমেরিকার প্যাসেঞ্জার পিজিয়ান এবং ভারতীয় চিতাবাঘ আজ নেই বললেই চলে। আরও বলা যায় তাসমেনীয় বাঘ যাকে দেখতে অর্ধেক বাঘ আর অর্ধেক কুকুরের মতো, এই প্রাণী বিলুপ্ত হয়েছে ১৯৩৬ সালে।
এ ছাড়া ২০১৮ সালের মধ্যে বিলুপ্তির পথে হারিয়ে গেছে অনেক প্রাণী। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়- লায়মান ক্রেক পাখি, বন্য জলগাই, কুয়াই-উ পাখি, পানামার গোল্ডেন ব্যাং, বাইজি ডলফিন, নর্দান সাদা গন্ডার, এক শৃঙ্গযুক্ত গন্ডার ইত্যাদি। আমাদের দেশে কাঠবিড়ালী ও দাঁড়কাক শ্রেণি প্রায় অবলুপ্ত। সুন্দরবনের বাঘও অস্তিত্বের শেষ ধাপে এসে পৌঁছেছে। ভারতবর্ষের মধ্যে বুনো গাধা, কৃষ্ণসার মৃগ, কস্তুরীমৃগ আজ বিলুপ্ত। পৃথিবীর আরও অনেক প্রাণী- বানগভুক ইগল, পদবিহীন গিরগিটি, নাচুনি হরিণ, স্নো লেপার্ড, বাইসন ইত্যাদি আজ আর পৃথিবীতে তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। মূলত আশ্রয়ের অভাব, খাদ্যাভাব এদের বিলুপ্তির কারণ। চিমত্মানি তেতো এটা কাজ।
বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের আবশ্যিকতা: সমগ্র পৃথিবী জুড়ে বন্যপ্রাণী বিলুপ্তির হার মানুষকে আতঙ্কিত করেছে। মানবসভ্যতার অগ্রগতি প্রাণী তথা বন্যপ্রাণীর বিলুপ্তির প্রধান কারণ হলে তা মানবজাতির লজ্জা। তাই সবাইকে সচেতন হতে হবে এবং এগিয়ে আসতে হবে বন্যপ্রাণীকে অবলুপ্তির হাত থেকে বাঁচানোর জন্য। আন্তর্জাতিক সংস্থা IUCN (International Union for Conservation of Nature) বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের বিভিন্ন প্রচেষ্টা শুরু করেছে। বিভিন্ন প্রজাতির প্রাণী ও তাদের জীবনধারণের উপযোগী পরিবেশ রক্ষা করাই প্রাণী সংরক্ষণের অন্যতম লক্ষ্য। ভারতে ১৯৭২ সালে বন ও বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের জন্য আইন পাস হয়েছে। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ ভারতীয় সংবিধানের যুগ্ম তালিকার অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
বর্তমানে ৩ মার্চকে বিশ্বপ্রাণী দিবস হিসেবে পালন করা হয় এবং এই বিশেষ দিনে প্রাণী সংরক্ষণের ওপর জনসচেতনতা বৃদ্ধি করবার প্রয়াস চলছে। সরকারের আন্তরিক প্রচেষ্টার ফলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পাবে। এই কাজে শুধু সরকার বা পরিবেশবিদরা ভাবলে চলবে না। সচেতন নাগরিক হিসেবে, নিজের অস্তিত্বের কথা ভেবে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের কথা গুরুত্ব সহকারে সবাইকে ভাবতে হবে। বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীদের তালিকা প্রস্তুত করে কীভাবে তাদের সংরক্ষণ করা যায় তার ব্যবস্থা করতে হবে। জলাভূমি ও স্থলভূমির সুসামঞ্জস্য ব্যবহার, বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য প্রাকৃতিক পরিবেশ বা বিভিন্ন সংরক্ষণশালাকে বন্যপ্রাণীর বাঁচার অনুকূল করে তুলতে হবে।
উপসংহার: শুধু আইন করে এই কর্মকাণ্ডের কোনো ফল হবার নয়। এরজন্য চাই সর্বস্তরের আন্তরিক প্রচেষ্টা। আমাদের বুঝতে হবে বন্যপশুদেরও বাঁচার অধিকার আছে। এইভাবে বন্যপ্রাণী পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত হতে থাকলে সেই পথে যে মানুষের বিলুপ্তি আসবে না-এই ভবিষ্যদ্বাণী আমরা করতে পারি না। পৃথিবীর বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্য রক্ষার ক্ষেত্রে বন্যপ্রাণী সংরক্ষণ একান্ত প্রয়োজনীয়। প্রাকৃতিক শোভা ও সৌন্দর্য, মানুষ ও প্রাণীর পারস্পরিক বিকাশের ক্ষেত্রে এই সংরক্ষণ একান্তই কাম্য।