ছুটি গল্পের নামকরণের সার্থকতা

ভূমিকা: নামকরণ শিল্পবস্তুর অন্দরমহলে প্রবেশের চাবিকাঠি। শিল্পীর হৃদয়ের অন্তঃস্থলের দ্বারও নামকরণের মাধ্যমেই খোলা যায়। শিল্পবস্তুর প্রাথমিক ধারণা ও তত্ত্বসত্যকে ছোঁয়া যায় নামকরণের মাধ্যমেই। বিষয়বস্তুর নিরিখে ‘ছুটি’ গল্পের নামকরণ ব্যঞ্জনধর্মী। স্নেহপ্রেমহীন জীবন থেকে অবসর গ্রহণ করেছে এই গল্পের মূল চরিত্র। জীবন থেকে ‘ছুটি’, অর্থাৎ মুক্তি চেয়েছে ফটিক। তাই মুক্তির ব্যঞ্জনার নিরিখে এই গল্পের নামকরণ বিচার্য।
কাহিনির ভিত্তিতে নামের বিশ্লেষণঃ গ্রাম বাংলার জলে-হাওয়ায় বড়ো হয়ে ওঠা দুরন্ত-দামাল ফটিক, বন্ধুবর্গের সর্দারও বটে। বিধবা মায়ের একমাত্র দুশ্চিন্তার কারণ ফটিকের দস্যিপনা। অথচ ছোটোভাই মাখন সম্পূর্ণ বিপরীতধর্মী চরিত্রের। সে শান্ত, সুশীল প্রকৃতির। নিত্যদিন মাখনের সঙ্গে ফটিকের অনাবশ্যক লড়াই বিধবা, অসহায় রমণীকে অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। ফটিকের মামা বিশ্বম্ভরবাবু শহর কলকাতা থেকে গ্রামে আসেন বোনের খোঁজখবর নিতে। সেসময় তিনি বোনের জ্যেষ্ঠপুত্রটিকে নিয়ে দুশ্চিন্তার শেষ নেই জেনে, তার পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়ে শহরে তাকে নিজের কাছে রাখতে চাইলেন। ফটিকের মায়ের রাজি হওয়া ছাড়া, কোনো উপায় ছিল না। ফটিকও সানন্দে মামার সঙ্গে কলকাতায় চলে যায়।
কিন্তু গ্রাম্য ছেলে ফটিককে নিজের সংসারে সাদরে গ্রহণ করতে পারলেন না বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী। তার নিজের তিন ছেলে নিয়ে সাজানো সংসারের মাঝে বছর তেরো-চোদ্দোর একটি গ্রাম্য, অচেনা, অপরিচিত ছেলের আগমন তার অপছন্দই হল। সংসারে এই দুগ্রহ জীবটির ওপর শুরু হল মামির মানসিক অত্যাচার। বিমুখ শহর এবং স্নেহহীনা মামি ফটিকের জীবন অতিষ্ঠ করে তোলে। স্কুলেও মন বসাতে পারল না ফটিক। নির্বোধ ও অমনোযোগী ছাত্র হয়ে মাস্টারমশাইয়ের তীব্র তিরস্কারের ভার ক্লান্ত গদর্ভের মতো সে সহ্য করত।
ফলে শহরে মামার বাড়িতে স্নেহ-ভালোবাসা বিচ্যুত জীবন থেকে মুক্তি পেতে, ফটিক বাড়ি ফিরতে চায়। মামাতো ভাইরা তার সঙ্গে সমস্ত সম্বন্ধ অস্বীকার করত এবং ফটিকের যে-কোনো অপমানে তারা আমোদ প্রকাশ করত। তাই এমন নির্বান্ধব জীবন থেকে মুক্তি পেতে চাইল ফটিক। মানসিক অবসাদে, জ্বরগ্রস্ত হয়ে অভিমানী ফটিক একদিন সত্যিই মামার বাড়ি থেকে পালাল। মুশলধারে শ্রাবণের বৃষ্টিতে ভিজে অসুখ বাধিয়ে ফেলল। বিশ্বম্ভরবাবু অনেক খোঁজখবর করে অবশেষে ফটিককে নিজের বাড়িতে ফিরিয়ে আনলেন। যদিও বলা বাহুল্য, বিশ্বম্ভরবাবুর স্ত্রী তাতেও অসন্তুষ্টই হলেন।
অবশেষে ফটিকের অসুখ আরও বেড়ে যায়। বিশ্বম্ভরবাবু নিরুপায় হয়ে বোনকে খবর দেন। ফটিকের রোগশয্যায় এসে পৌঁছোন ফটিকের মা। কিন্তু ফটিক ততক্ষণে দূরের বাঁশির ডাক শুনতে পেয়েছে। শহরের চারদেয়ালের বন্দিত্ব থেকে ছুটি চেয়েছিল সে। এখন জীবন থেকে ছুটি নিতে সে মরিয়া। পৃথিবীর কোনো ভালোবাসার টানই তাকে আর বাঁধতে পারল না।
উপলব্ধি: ‘ছুটি’ নামকরণের মধ্যে রয়েছে মুক্তির ইশারা। বন্ধদশার শৃঙ্খল ঘুচিয়ে উদার মুক্তির পথের পথিক ফটিক ফিরতে চেয়েছে বাড়িতে-যেখানে তার যথার্থ ছুটি। তাই জীবনের পাঠশালা থেকে বিশ্বলোকে মুক্তিতে সে হয়ে উঠেছে ব্যার্নাদা দ্যসাঁৎ-পিয়্যার-এর ‘পল এ ভিরজিনি’ উপন্যাসের ‘ভিরজিনি’। ফটিকের মতো প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্নতাতেই তাঁরও মৃত্যু হয়েছিল। ব্যঞ্জনার দিক থেকে গল্পের নাম ‘ছুটি’ তাই সম্পূর্ণ সার্থক।