পরিবেশদূষণ ও তার প্রতিকার – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

- পরিবেশদূষণ রোধে ছাত্রছাত্রীদের ভূমিকা
- পরিবেশদূষণের প্রাথমিক ধারণা
- পরিবেশদূষণের কারণ
- পরিবেশদূষণের কুফল
- বায়ুদূষণ
- শব্দদূষণ
- ভূমিদূষণ
- জলদূষণ
- পরিবেশদূষণের কুফল
ভূমিকা: জীবজগতের চারপাশে যাবতীয় সজীব ও জড় উপাদান রয়েছে-যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে আমরা অর্থাৎ প্রাণীকুল বেঁচে আছি, জীবন অতিবাহিত করছি-তাদেরকে পরিবেশ বলে। পরিবেশ হল আমাদের সকলের অস্তিত্বের আধার, পৃথিবীর সবচেয়ে মূল্যবান সম্পদ। মানুষ তার সভ্যতার যতই অগ্রগতি ঘটাক-না কেন, সুস্থ, সুন্দর, নির্মল প্রাকৃতিক পরিবেশ ছাড়া তা মূল্যহীন। এই মানুষ তার পরিবেশের সঙ্গে এমনই এক বন্ধনে আবদ্ধ যে, তা থেকে মুক্তির অর্থ নিজের অস্তিত্বের বিনাশ, পৃথিবীর অস্তিত্বকে ধ্বংস করা। কিন্তু বর্তমানে মানুষ তার সভ্যতার অগ্রগতি, উন্নয়নের জন্য নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য, লোভ-লালসার জন্য পরিবেশকে ক্রমাগত ক্ষতিগ্রস্ত ও ধ্বংস করে চলেছে, নষ্ট করে চলেছে পরিবেশের ভারসাম্যকে। আর তার ফলেই সৃষ্টি হচ্ছে পরিবেশদূষণ। এজন্যই গভীর এক সংকটের মুখে দাঁড়িয়ে আছে গোটা পৃথিবী। মানুষ, পৃথিবীকে এই অনিবার্য ধ্বংস থেকে রক্ষা করতে আমাদের সকলকে বিশেষ করে ছাত্রসমাজকে সচেতন ও অঙ্গীকারবদ্ধ হয়ে পরিবেশদূষণ রোধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে হবে। কবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের কথায় বলতে হয়-
এ বিশ্বকে এ শিশুর বাসযোগ্য করে যাব আমি,
নবজাতকের কাছে এ আমার দৃঢ় অঙ্গীকার।
মানুষ তার সভ্যতার অগ্রগতি ঘটাতে, নিজের সুখস্বাচ্ছন্দ্য বৃদ্ধি করতে সভ্যতার রথে চেপে যতই এগোচ্ছে ততই ধ্বংস করছে পরিবেশকে। বর্তমানে নগরবিলাসী যান্ত্রিক সভ্যতার কারণে পরিবেশের দূষণ বেড়ে চলেছে। অর্থনৈতিক মুনাফার লোভে অত্যধিক পরিমাণে শিল্পকলকারখানার সৃষ্টি, সাম্রাজ্যবাদী ক্ষমতা প্রদর্শনে পারমাণবিক শক্তির ব্যবহার, নগরায়ণের জন্য বনাঞ্চল ধ্বংস, দ্রুত হারে বংশবৃদ্ধি, কৃত্রিম ও রাসায়নিক পদার্থের অত্যধিক ব্যবহার প্রভৃতি আরও কত কী কারণে পরিবেশ দূষিত হয়ে উঠেছে। আর তাই পরিবেশ আজ বিভিন্ন ধরনের দূষণের কবলে। বায়ুদূষণ, ভূমিদূষণ, জলদূষণ, শব্দদূষণ এমনকি দৃশ্যদূষণ প্রভৃতি সবই রয়েছে তাতে।
বিশুদ্ধ বায়ু ছাড়া প্রাণীকুল সুস্থভাবে বাঁচতে পারে না বা অস্তিত্ব রক্ষা করতে পারে না। বর্তমানে কলকারখানার উৎপাদন, পেট্রোল, ডিজেল চালিত গাড়ির অত্যধিক ব্যবহার, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, বিদ্যুৎ উৎপাদনে থার্মাল ইউনিটের বহুল ব্যবহারের ফলে ধোঁয়া, তেজস্ক্রিয়তা, কার্বন ডাইঅক্সাইড, কার্বন মনোক্সাইড গ্যাস প্রভৃতির দ্বারা দূষিত বায়ু পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে প্রাণীজগৎকে ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাচ্ছে।
কৃষি ও শিল্পবিপ্লব এবং আধুনিক নগরবিলাসী সভ্যতা ভূমি বা মাটি দূষণের প্রধান কারণ। বর্তমানে আধুনিক কৃষিকাজে রাসায়নিক সার, কীটনাশক ওষুধ, অত্যধিক পরিমাণ ফসল উৎপাদনে মাটি দূষিত হয়ে যাচ্ছে। বৃক্ষচ্ছেদন করে নগরায়ণ, তার ফলে মাটি ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে। এর পাশাপাশি শিল্পকলকারখানার বর্জ্য পদার্থ, মানুষের ব্যবহারের আবর্জনা, প্লাস্টিক, থার্মোকল প্রভৃতি মাটিকে দূষিত করছে। আর এর ফলে মানুষ তথা সমগ্র প্রাণীকুল বিনাশের দিকে এগিয়ে চলেছে।
জলের অপর নাম জীবন। বিশুদ্ধ জল ছাড়া প্রাণী বেঁচে থাকতে পারে না। আর তাই বর্তমানে জলদূষণের ফলে বহুপ্রাণী বিশেষ করে জলজ প্রাণী বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং সমগ্র প্রাণীজগৎ নানান সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। সর্বোপরি বাস্তুতন্ত্রের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। জলদূষণের প্রধান কারণ আধুনিক কৃষিকাজে কীটনাশক ও রাসায়নিক সার ব্যবহার। এ ছাড়া কলকারখানা ও গৃহস্থালির বর্জ্য নদীবক্ষে সংযোজন।
শব্দদূষণ আধুনিক সভ্যতার আর-এক অভিশাপ। গ্রামের তুলনায় শহরে এর ভয়াবহতা বেশি। মোটরগাড়ি, কলকারখানা, বাজি, বোম, লাউডস্পিকারের মাত্রাতিরিক্ত আওয়াজের ফলে সুস্থ পরিবেশে নানান সমস্যা সৃষ্টি হচ্ছে।
বর্তমানে নগরবিলাসী উন্নত আধুনিক জীবনযাত্রার ফলে মানুষ প্রকৃতির ভারসাম্য নষ্ট করে এবং পরিবেশদূষণ ঘটিয়ে নিজের অজান্তেই ধ্বংসের দিকে এগিয়ে চলেছে। তাই বিভিন্ন দিক থেকে বিভিন্নভাবে পরিবেশ দূষিত হয়ে প্রাণীজগৎকে গভীর সংকটের মুখোমুখি করেছে। শ্বাসকষ্ট, হৃদ্যন্ত্রের সমস্যা, মস্তিষ্কের সমস্যা এবং দুরারোগ্য ক্যানসারের মতো প্রভৃতি বিভিন্ন কঠিন রোগে মানুষ আক্রান্ত হচ্ছে ও প্রকৃতির স্বাভাবিক অবস্থা নষ্ট হচ্ছে।
বর্তমানে ক্রমবর্ধমান দূষণ থেকে আমাদের পরিবেশকে রক্ষা করতে পরিবেশ বিজ্ঞানীরা নানা গবেষণা করে কিছু উপায়ের কথা জানিয়েছেন। যেমন- প্রথমত, মানুষের ক্রমবর্ধমান চাহিদা, ভোগবাদী মানসিকতার পরিবর্তন। দ্বিতীয়ত, অবাধে গাছ কাটা বন্ধ করে বৃক্ষরোপণ করা। তৃতীয়ত, রাসায়নিক সার, রাসায়নিক পদার্থ কম ব্যবহার। চতুর্থত, প্লাস্টিক, থার্মোকল ব্যবহার ও যত্রতত্র ফেলে দেওয়া বন্ধ করতে হবে। পঞ্চমত, পারমাণবিক বিস্ফোরণ না-ঘটানো। ষষ্ঠত, মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি ঘটানো ইত্যাদি।
আজকের যারা ছাত্রছাত্রী তারাই হবে আগামী দিনের নাগরিক। তাই পরিবেশকে দূষণের হাত থেকে রক্ষা করে সুস্থ, নির্মল পৃথিবী গড়ার দায়িত্বও তাদের নিতে হবে। ছাত্রসমাজই পারে পরিবেশরক্ষা আন্দোলনে সবার আগে এগিয়ে এসে জনমানুষকে সচেতন করতে। তারা বিদ্যালয় থেকে শিখে বা জেনে সভাসমিতির মধ্য দিয়ে মানুষের মধ্যে পরিবেশরক্ষার মন্ত্র ছড়িয়ে দিতে পারে। ছাত্রছাত্রীদের মাধ্যমে পরিবেশদূষণ রোধ কর্মসূচি পরিবার থেকে সমাজ, সমাজ থেকে দেশ এবং দেশ থেকে সমগ্র পৃথিবীতে সহজে ছড়িয়ে পড়বে তাতে সন্দেহ নেই।