ধারণার বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো | ধারণা গঠনের স্তর | ধারণা গঠনের তত্ত্ব

ধারণা হল সবরকম শিখনের মৌলিক একক। শৈশব অবস্থা থেকে বার্ধক্য পর্যন্ত দৈনন্দিন জীবনে ব্যক্তি নতুন ধারণা আয়ত্ত করেছে বা অর্জিত ধারণা নতুন পরিস্থিতিতে ব্যবহার করেছে। বয়স, অভিজ্ঞতা এবং বৌদ্ধিক ক্ষমতা অনুযায়ী ব্যক্তির মধ্যে ধারণা গঠনে পার্থক্য দেখা যায়। আকাশ সম্পর্কে একটি শিশুর ধারণার সঙ্গে একজন জ্যোতির্বিদের ধারণার পার্থক্য থাকে। সদৃশ বৈশিষ্ট্যের নিরিখে বস্তু, ভাব ও চিন্তার একত্রীকরণ ও তার নামকরণকেই ধারণা বলা হয়।

মনোবিদ উওয়ার্থ (Woodworth) বলেছেন যে, কোনো জায়গায় যদি শব্দ চিন্তার হাতিয়ার হয় তাহলে অবশ্যই তা অর্থযুক্ত হবে। ধারণা হল শব্দের অর্থ। একটি উদাহরণের সাহায্যে ‘ধারণা’র অর্থ স্পষ্ট করা যেতে পারে-ডানা এবং ঠোঁটওয়ালা, উড়তে সক্ষম, ডিম পাড়ে, এই বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন প্রাণীকে ‘পাখি’ শব্দ দ্বারা প্রকাশ করা হয়। এই ‘পাখি’ হল একটি ধারণা। একটি নতুন প্রাণী যদি এই সব বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয় তাহলে তাকে এই শ্রেণিভুক্ত করা যায়। এভাবে উদ্ভিদ, বাড়ি, প্রাণী ইত্যাদি মূর্ত ধারণা, আবার মাতৃত্ব, গণতন্ত্র, সৌন্দর্য ইত্যাদি বিমূর্ত ধারণা।

ধারণার বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো
ধারণার বৈশিষ্ট্য গুলি আলোচনা করো

ধারণার সংজ্ঞা

ধারণার প্রথাগত সংজ্ঞাগুলির মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য লক্ষ করা যায়।

(1) কাগান প্রদত্ত সংজ্ঞা: 

মনোবিদ কাগান (Kagan)-এর মতে, বৌদ্ধিক কাজে মৌলিক উপাদান হল ধারণা। রসায়নশাস্ত্রে যেমন যোজ্যতা, জীববিদ্যায় যেমন জীবতত্ত্ব, পদার্থবিদ্যায় যেমন শক্তি, তেমনই মনস্তত্ত্বে ধারণা।

(2) ফ্লাডেল প্রদত্ত সংজ্ঞা: 

মনোবিদ ফ্লাভেল (Flavell) বলেন, ধারণা কয়েকটি গুণ বা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, যা ওই ধারণার অন্তর্ভুক্ত সব সদস্যের মধ্যে বর্তমান।

(3) উড্ডয়ার্থ প্রদত্ত সংজ্ঞা: 

মনোবিদ উত্তয়ার্থ (Woodworth)-এর মতে, কোনো বস্তু সম্পর্কে সামগ্রিক জ্ঞানকে ধারণা বলে।

(4) ডিসিকো প্রদত্ত সংজ্ঞা: 

মনোবিদ ডিসিকো (DeCecco) তাঁর The Psychology of Learning and Instruction গ্রন্থে বলেছেন, সাধারণ বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন এক শ্রেণির উদ্দীপনাকেই ধারণা বলে।

(5) রাসেল প্রদত্ত সংজ্ঞা: 

মনোবিদ রাসেল (Russell)-এর মতে, বিভিন্ন উপাত্ত থেকে যে সাধারণধর্মী মতামত গ্রহণ করা যায়, তা-ই হল ধারণা।

(6) ম্যাকডোনাল্ড প্রদত্ত সংজ্ঞা: 

মনোবিদ ম্যাকডোনাল্ড (Mcdonald)-এর মতে, সাধারণ বৈশিষ্ট্যসমন্বিত কিছু উদ্দীপকের শ্রেণিকে ধারণা বলা হয়।

ধারণার বৈশিষ্ট্য

ধারণা (conception) একটি গুরুত্বপূর্ণ তত্ত্বগত বিষয় যা মানুষের চিন্তা, উপলব্ধি এবং বোধের প্রক্রিয়ার সাথে সম্পর্কিত। ধারণা হল মনের একটি অভ্যন্তরীণ চিত্র বা মডেল যা মানুষ বাস্তবতার বিভিন্ন দিক বোঝার জন্য তৈরি করে। এটি একটি মনস্তাত্ত্বিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি একটি বিষয় বা অবস্থা সম্পর্কে কিছু জানার চেষ্টা করে। এখানে ধারণার কিছু বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করা হল-

(1) মানসিক মডেল: 

ধারণা হল একটি মানসিক মডেল যা ব্যক্তির মনের মধ্যে তৈরি হয়। মডেলটি ব্যক্তির অভিজ্ঞতা, জ্ঞান এবং উপলব্ধির উপর ভিত্তি করে গঠিত হয়। ব্যক্তি কীভাবে একটি নির্দিষ্ট পরিস্থিতি বা বিষয়কে বুঝবে, তা এটি নির্ধারণ করে।

(2) সংগঠিত চিন্তা: 

ধারণা হল সংগঠিত চিন্তার একটি রূপ যা ব্যক্তি তার অভিজ্ঞতা এবং তথ্যের ভিত্তিতে গঠন করে। এটি ব্যক্তির চিন্তার প্রক্রিয়াকে একটি গঠিত এবং সুসংহত রূপ দেয়, যা তাকে নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে।

(3) বির্মূততা: 

ধারণা প্রায়শই বির্মূত হয়, যার মানে একটি বাস্তব জীবনের নির্দিষ্ট উদাহরণ বা ঘটনা থেকে পৃথক হয়। এটি সাধারণত একটি নির্দিষ্ট বিষয়ের সারমর্ম বা মৌলিক বৈশিষ্ট্যগুলি তুলে ধরে। উদাহরণস্বরূপ, সুন্দরতার ধারণা হল একটি বিমূর্ত ধারণা যা বিভিন্ন বিষয় বা পরিস্থিতির সৌন্দর্য সম্পর্কিত ধারণাকে বোঝায়।

(4) সাধারণীকরণ: 

ধারণা সাধারণীকরণের প্রক্রিয়া দ্বারা গঠিত হয়। ব্যক্তি অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সাধারণ নিয়ম এবং নীতিগুলি শনাক্ত করে এবং তাদের ভিত্তিতে একটি সাধারণ ধারণা তৈরি করে। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ব্যক্তি নতুন পরিস্থিতি বা বিষয়ের সাথে সহজে খাপ খাইয়ে নিতে পারে।

(5) জ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া: 

ধারণা গঠন একটি জ্ঞানভিত্তিক প্রক্রিয়া যার মাধ্যমে ব্যক্তি তথ্যসংগ্রহ, বিশ্লেষণ এবং সংরক্ষণ করে। এই প্রক্রিয়ায় ব্যক্তি তার পূর্ববর্তী জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে নতুন ধারণা তৈরি করে এবং তা মনের মধ্যে সংরক্ষণ করে যা তার ভবিষ্যতের চিন্তা এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করে।

(6) শিক্ষা এবং স্মৃতিতে ভূমিকা: 

ধারণাগুলি শিক্ষা এবং স্মৃতিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কারণ সেগুলি মানুষকে তথ্য সংগঠিত এবং স্মরণ করতে সহায়তা করে।

(7) স্থিতিস্থাপকতা: 

ধারণাগুলি সময়ের সাথে সাথে নতুন তথ্য অর্জন এবং একীভূত করার সাথে সাথে বিকশিত এবং পরিবর্তিত হতে পারে।

(8) যুক্তি এবং সমাধান: 

ধারণাগুলি যুক্তি এবং সমস্যা সমাধানে অপরিহার্য কারণ সেগুলি অনুমান এবং সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য একটি কাঠামো প্রদান করে।

(9) সাংস্কৃতিক এবং প্রাসঙ্গিক পরিবর্তনশীলতা: 

বিভিন্ন সংস্কৃতি এবং প্রসঙ্গের মধ্যে ধারণার অর্থ এবং ব্যাখ্যা পরিবর্তিত হতে পারে।

(10) হায়ারারকিকাল গঠন: 

ধারণাগুলির প্রায়ই একটি হায়ারারকিকাল গঠন থাকে, যেখানে বৃহত্তর ধারণাগুলি আরও নির্দিষ্ট উপ-ধারণাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ‘প্রাণী’ ধারণাটি ‘স্তন্যপায়ী পাখি’ এবং ‘মাছ’-এর মতো উপধারণাগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে।

ধারণা গঠনের স্তর

ধারণা গঠন দু-ভাবে হতে পারে- বিনা চেষ্টায় স্বতঃস্ফূর্তভাবে এবং  প্রচেষ্টার সাহায্যে। লৌকিক ধারণাগুলি বিনা চেষ্টায় গঠিত হয়। বিজ্ঞানসম্মত ধারণাগুলি প্রচেষ্টার মাধ্যমেই গঠিত হয়। দ্বিতীয়টি সম্বন্ধে নীচে আলোচনা করা হল-

বিজ্ঞানসম্মত ধারণা গঠনে প্রধানত ছ-টি স্তর দেখা যায়, সেগুলি হল-

(1) পর্যবেক্ষণ: 

এই স্তরে নির্দিষ্ট শ্রেণির বিভিন্ন বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করা হয়। যেমন-ফুল সম্পর্কে ধারণা গঠন করতে হলে বিভিন্ন প্রকারের ফুল পর্যবেক্ষণ করতে হয়।

(2) বিশ্লেষণ: 

এই স্তরে পর্যবেক্ষিত বিভিন্ন বস্তুর ধর্ম, গুণ, বৈশিষ্ট্য ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা হয়। যেমন-ফুলের বিভিন্ন প্রকার গন্ধ, বর্ণ, আকার, অংশ ইত্যাদি বিশ্লেষণ করা হয়।

(3) তুলনা:

বিশ্লেষণ করার পর বস্তুগুলির গুণ এবং ধর্মের পারস্পরিক তুলনা করা হয় এবং সাদৃশ্য ও বৈসাদৃশ্যগুলি নির্দিষ্ট করা হয়। যেমন-ফুলের বিভিন্ন অংশের মধ্যে মিল আছে, অধিকাংশ ফুলেরই গন্ধ আছে ইত্যাদি। এখানে পার্থক্যও বিচার করা হয়, যেমন-বিভিন্ন ফুলের গন্ধ ও বর্ণের মধ্যে পার্থক্য আছে।

(4) পৃথকীকরণ: 

এই স্তরে বস্তুর গুণ বা ধর্মের সাদৃশ্যের ভিত্তিতে সংশ্লিষ্ট বস্তুগুলিকে মনে মনে পৃথক করে নেওয়া হয় এবং তার ওপর মনোনিবেশ করা হয়। যেমন-ফুলের ক্ষেত্রে সুন্দর গন্ধযুক্ত ফুল, গন্ধহীন ফুল, কটু গন্ধযুক্ত ফুল, সাদা রং-এর ফুল, লাল রং-এর ফুল, বেগুনি রঙের ফুল ইত্যাদি।

(5) সাধারণীকরণ বা সামান্যীকরণ:

যেসব ধর্ম বা গুণের ভিত্তিতে পৃথকীকরণ করা হয়েছে তার ভিত্তিতে সাধারণসূত্র স্থির করা হয়। ওই গুণ বা ধর্ম যেসব বস্তু পর্যবেক্ষণ করা হয়েছে কেবল তাদের মধ্যে উপস্থিত আছে তা নয়, ওই জাতীয় সমস্ত বস্তুর মধ্যেই তা উপস্থিত আছে বলে অনুমান করা হয়।

(5) নামকরণ: 

ধারণা গঠনের শেষ স্তর হল নামকরণ। ধারণার নাম দেওয়া হয়। সে নাম সকলের কাছে স্বীকৃতি পায়। এই নাম হল ধারণার প্রতীক। নাম উচ্চারণ করার সঙ্গে সঙ্গে বস্তুটির গুণ বা ধর্ম মনে ভেসে উঠবে।

ধারণা বিকাশের প্রক্রিয়া বা ধারণা বিকাশের স্তর

ধারণা বিকাশের প্রক্রিয়াটি ব্যক্তির মানসিক বিকাশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। শিশুরা ধাপে ধাপে বিভিন্ন ধারণা এবং ভাবনা গঠন করে, যা তাদের চিন্তা, সমস্যা সমাধান এবং শেখার ক্ষমতাকে প্রভাবিত করে। ধারণা বিকাশের পর্যায় সংখ্যা বা স্তর ঠিক কয়টি, সে বিষয় নিয়ে মনোবিদদের মধ্যে মতভেদ থাকলেও, বেশিরভাগ মনোবিজ্ঞানী ধারণা বিকাশের ক্ষেত্রে চারটি পর্যায় বা

স্তরের কথা উল্লেখ করেছে। এখানে সেই স্তরগুলি আলোচনা করা হল-

(1) মূর্ত স্তর বা কংক্রিট কার্যকর ধাপ: 

এই স্তরে শিশুদের চিন্তা সাধারণত স্পষ্ট এবং বাস্তবভিত্তিক হয়। তারা তাদের অভিজ্ঞতার উপর ভিত্তি করে ধারণা গঠন করে এবং সেই ধারণাগুলি ব্যবহার করে সমস্যা সমাধান করতে চেষ্টা করে। এই স্তরের সাথে পর্যবেক্ষণ, বিশ্লেষণ, তুলনা ও পৃথকীকরণ, সামান্যীকরণ, নামকরণ ইত্যাদি যুক্ত।

  • বৈশিষ্ট্য:

[i] অভিজ্ঞতা নির্ভর: শিশুদের ধারণা এবং চিন্তা সরাসরি অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, তারা একটি খেলনা থেকে তার আকার, রং এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে ধারণা গঠন করে।

[ii] বাস্তব বস্তু ও ঘটনা: এই স্তরে শিশুরা বাস্তব বস্তু এবং ঘটনাগুলির সাথে কাজ করে এবং তাদের গুণাবলি ও ব্যবহার সম্পর্কে জানে।

(2) পরিচিতির স্তর: 

এই স্তরে শিশুরা বস্তু ও ধারণার পরিচয় বা স্বতন্ত্রতা সম্পর্কে সচেতন হয়। তারা বুঝতে শুরু করে যে, কিছু বৈশিষ্ট্য সময়ের সাথে পরিবর্তিত হয় না।

  • বৈশিষ্ট্য:

[i] অস্তিত্বযুক্ত: শিশুরা বুঝতে পারে যে, বস্তু বা ঘটনা তাদের দৃষ্টির বাইরে থাকলেও, তার অস্তিত্ব আছে।

[ii] স্থায়িত্ব: বাহ্যিক পরিবর্তন ঘটলেও, একটি বস্তু বা ব্যক্তির পরিচয় বা স্বতন্ত্রতা বজায় থাকে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, একটি গাছের পাতা খসে পড়ে গেলেও সেটি গাছই থাকে।

এই স্তরে শিশু সামান্যীকরণ করে। এই স্তরে উপনীত হতে শিখন ও পরিণমন-এর প্রয়োজন হয়।

(3) শ্রেণিবিভাগের স্তর:

এই স্তরে শিশুরা বিভিন্ন বস্তু ও ধারণাকে শ্রেণিবদ্ধ করতে শেখে। তারা বিভিন্ন গুণাবলির ভিত্তিতে বস্তুগুলিকে বিভিন্ন শ্রেণিতে ভাগ করতে পারে।

  • বৈশিষ্ট্য:

[i] গ্রুপিং: শিশুরা বিভিন্ন বস্তু বা ধারণাকে গুণাবলির ভিত্তিতে গ্রুপ করতে শেখে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় যে, রং, আকার এবং ব্যবহার অনুযায়ী বস্তুগুলিকে শ্রেণিবন্ধ করা যায়।

[ii] বর্গীকরণ: তারা বিভিন্ন স্তরে বস্তু বা ধারণাকে বিভাজন করতে সক্ষম হয়। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, ফল, সবজি এবং পশুদের আলাদা আলাদা শ্রেণিতে ভাগ করা। যখন শিশু নিজেদের বাড়ির কুকুর এবং অন্যদের বাড়ির কুকুরকে কুকুর হিসেবে চিনতে পারে, তখনই মনে করা হয়, শিশু শ্রেণিবিভাগ স্তরে উপনীত হয়েছে।

(4) প্রথাগত স্তর বা আনুষ্ঠানিক পর্যায়: 

এই স্তরে শিশুরা বিমূর্ত চিন্তা এবং যৌক্তিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে ধারণা গঠন করতে সক্ষম হয়। তারা বিভিন্ন সম্ভাবনা এবং তত্ত্ব নিয়ে চিন্তা করতে এবং তা পরীক্ষা করতে পারে। শিশু যখন ধারণার নামকরণ করতে পারে, তখন সে প্রথাগত স্তরে বা আনুষ্ঠানিক পর্যায়ে পৌঁছেছে বলা হয়।

  • বৈশিষ্ট্য:

[i] বিমূর্ত চিন্তা: শিশুদের চিন্তা কংক্রিট অভিজ্ঞতার বাইরে গিয়ে বিমূর্ত ধারণা এবং তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, শিশুরা গণিতে সূত্র বা বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব নিয়ে কাজ করে। এক্ষেত্রে তারা বিভিন্ন সম্ভাবনা এবং তত্ত্বের ভিত্তিতে অনুমান করতে এবং তা পরীক্ষা করতে পারে।

[ii] সুশৃঙ্খল বিচার: তারা যুক্তিপূর্ণভাবে চিন্তা করতে পারে এবং সমস্যা সমাধান করতে সক্ষম হয়, যা বাস্তবতার বাইরে আদর্শ পরিস্থিতি নিয়ে চিন্তা করতে সাহায্য করে। 

ধারণা বিকাশের এই স্তর বা ধাপগুলি শিশুদের মানসিক বিকাশের বিভিন্ন পর্যায়ে ঘটে এবং তাদের চিন্তা, সমস্যা সমাধান এবং শেখায় ক্ষমতা গঠনে সহায়ক হয়।

ধারণা গঠনের তত্ত্ব

ধারণা গঠন সম্পর্কে বিভিন্ন মনোবিদ বিভিন্ন ধরনের তত্ত্বের কথা বলেছেন। প্রত্যেকটি তত্ত্বের কোনো না কোনো উপযোগিতা ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে দেখা যায়। ধারণা গঠনে পিঁয়াজে ও ব্রুনারের মতবাদ উল্লেখ করা হল।

পিঁয়াজের মতবাদ

ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে ফরাসি মনোবিদ জাঁ পিঁয়াজে (Jean Piaget)-র মতবাদটি বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। তিনি বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে ধারণা বিকাশের বিভিন্ন সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। তাঁর মতে, বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে সংগতি রেখে বিভিন্ন ধারণা সংগঠিত হয়। এ বিষয়ে তিনি চারটি প্রধান স্তরের কথা বলেন- সংবেদন চালকমূলক স্তর (Sensorimotor Stage): 0-2 বছর, প্রাক্-সক্রিয়তার স্তর (Pre-operational Stage): 2-7 বছর, মূর্ত-সক্রিয়তার স্তর (Concrete Operational Stage): 7-11 বছর এবং যৌক্তিক সক্রিয়তামূলক স্তর (Formal Separation Stage): 11 বছর। পিঁয়াজের মতে, এই স্তরগুলির সঙ্গে ধারণা বিকাশের বিশেষ সম্পর্ক আছে।

(1) প্রথম স্তর: 

প্রথম স্তরে (সংবেদন চালকমূলক স্তর 0-2 বছর) শিশু যে প্রক্রিয়ার মাধ্যমে ধারণা গঠন করে তা হল আত্মীকরণ (Assimilation) এবং উপযোজন (Accommodation)। এই স্তরে শিশু বিভিন্ন ধরনের স্কিমা (Schema) বা মানসিক প্রতিচ্ছবি প্রস্তুত করে এবং এর সাহায্যে ধারণা গড়ে তোলে।

(2) দ্বিতীয় স্তর: 

দ্বিতীয় স্তরে (প্রাক্-সক্রিয়তার স্তর 2-7 বছর) শিশু বিভিন্ন প্রতীকের সাহায্যে ধারণা সংগঠন করতে পারে। আগের বস্তুগুলি তার সামনে উপস্থিত না থাকলেও প্রতীকের সাহায্যে সে ধারণা গঠন করতে পারে। বারলিন (Berlyne) ও গোলেজ (Golledge) বিভিন্ন পরীক্ষা করে পিয়াজের এই স্তরের মতবাদটিকে সমর্থন করেছেন।

(3) তৃতীয় স্তর: 

তৃতীয় স্তরে (মূর্ত-সক্রিয়তার স্তর 7-11 বছর) শিশু বিভিন্ন ধরনের মূর্ত চিন্তন করতে শেখে এবং বিভিন্ন বস্তুকে শ্রেণিকরণের ক্ষমতা দেখা যায় তার মধ্যে। এই শ্রেণিকরণে শিশু বিভিন্ন বস্তুর সাধারণ বৈশিষ্ট্যগুলিকে চিহ্নিত করে এবং সেগুলির মধ্যে সাদৃশ্য ও পার্থক্যও লক্ষ করে। এ ছাড়া ক্রমপর্যায়ে বিন্যস্ত করার (Seriation) দক্ষতাও তার মধ্যে দেখা যায়। অর্থাৎ, এই স্তরে সাদৃশ্য, পার্থক্য ও ক্রমপর্যায়, এই তিনটি প্রক্রিয়ার সাহায্যে শিশু বিভিন্ন ধরনের ধারণা গঠন করে। থমসন (Thomson) ও পিয়াজে এই স্তরে বিকাশ ও ধারণা গঠনের ওপর একাধিক পরীক্ষা করেন এবং এর কার্যকারিতা প্রমাণ করেন।

(4) চতুর্থ স্তর:

চতুর্থ স্তরটি (যৌক্তিক সক্রিয়তামূলক স্তর 11 বছর) ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই স্তরে বৌদ্ধিক বিকাশ চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছোয়। শিক্ষার্থীর মধ্যে প্রকল্প (Hypothesis) গঠন করার ক্ষমতা পরিলক্ষিত হয়। এ ছাড়া যেসব বস্তু তার সামনে উপস্থিত নেই (বিমূর্ত বিষয়) সেগুলি সম্পর্কে সে চিন্তা করতে পারে। হ্যাভেল (Havell) বিভিন্ন সমীক্ষা করে দেখেন যে, এই স্তরে বৌদ্ধিক বিকাশের সঙ্গে উচ্চতর ধারণা গঠনের বিশেষ সম্পর্ক আছে।

বিভিন্ন ধরণের ধারণা গঠনে সহায়ক বিষয়

বিভিন্ন ধরনের ধারণা গঠনে সম্ভাব্য সহায়ক বিষয়গুলি নীচে উল্লেখ করা হল।

(1) সময় সম্পর্কিত ধারণা: 

ঘড়ির সাহায্য নিলে এই ধরনের ধারণা গঠনের কাজটি অপেক্ষাকৃত সহজ হয়।

(2) সংখ্যা সম্পর্কিত ধারণা: 

সংখ্যার সাহায্যে খেলা বা সংখ্যা-সম্পর্কিত ধাঁধার উত্তর প্রভৃতির সাহায্য নিলে এই জাতীয় ধারণা গড়ে তোলা তুলনামূলকভাবে সহজ হয়।

(3) উষ্ণতা সম্পর্কিত ধারণা: 

বিভিন্ন ধরনের থার্মোমিটারের সাহায্য নিলে উষ্ণতার ধারণা গঠনের কাজটি সহজে করা যায়।

(4) বর্ণবিষয়ক ধারণা:

বিভিন্ন রঙের বস্তুর সাহায্য নিলে বর্ণ বিষয়ক ধারণা গঠনে সুফল পাওয়া যায়।

(5) সামাজিক পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা: 

সামাজিক প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে এই প্রকার ধারণার গঠন সহজ হয়।

(6) প্রাকৃতিক পরিবেশ সম্পর্কে ধারণা: 

পরিবেশের বিভিন্ন উপাদান যেমন-জল, মাটি প্রভৃতি নিয়ে খেলাধুলো করলে এই রকমের ধারণা সহজেই গড়ে ওঠে।

শিক্ষায় ধারণা গঠনের প্রয়োজনীয়তা

শিক্ষাক্ষেত্রে ধারণা সম্পর্কিত জ্ঞান, বিশেষ করে, ধারণা কীভাবে গঠিত হয় এবং এক্ষেত্রে শিক্ষকের ভূমিকা কী হওয়া উচিত ইত্যাদি তথ্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। বৌদ্ধিক বিকাশ এবং সমস্যা সমাধানে ধারণা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা নেয়। শিক্ষার ক্ষেত্রে সঠিক ধারণা গঠনের প্রয়োজনীয়তা নীচে আলোচনা করা হল-

(1) উদ্দীপকের জটিলতা হ্রাস: 

ধারণা গঠন উদ্দীপকের জটিলতা হ্রাস করে। প্রতিটি উদ্দীপকের প্রতি প্রতিক্রিয়া করে অভিজ্ঞতা অর্জন অত্যন্ত কঠিন, প্রায় অসম্ভবই বলা যায়। উদ্দীপকের বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী যদি শ্রেণিকরণ করা হয়, অর্থাৎ যদি ধারণা গঠন করা হয় তাহলে সংরক্ষণ এবং পরবর্তী সময়ে তার ব্যবহার অনেক সহজ হয়।

(2) নতুন শিখনে সহায়তা: 

শিক্ষার্থীরা যখন নতুন শিখনীয় পরিস্থিতির মুখোমুখি হয় তখন অর্জিত ধারণার প্রেক্ষিতে নতুন পরিস্থিতিকে প্রত্যক্ষ করে প্রতিক্রিয়া করে এবং শেখে। এইভাবে ধারণা নতুন শিখনে সাহায্য করে।

(3) অপ্রয়োজনীয় উদ্দীপকের পরিহার:

ধারণা শিখন পরিস্থিতির অপ্রয়োজনীয় উদ্দীপকগুলিকে বাদ দিয়ে শিক্ষার্থীর পরিশ্রম হ্রাস করে। উদাহরণস্বরূপ, ‘অয়ন একজন সৎ ব্যক্তি’-এ কথা শুনলেই অয়ন কী ধরনের বৈশিষ্ট্যের অধিকারী এবং কী ধরনের আচরণ অয়নের মধ্যে দেখা যাবে না তা অনুমান করা যায়। অয়নের সব আচরণের সব দিক বলার প্রয়োজন হয় না। এইভাবে ধারণা অপ্রয়োজনীয় উদ্দীপকগুলিকে পরিহার করতে সাহায্য করে শিক্ষার্থীর পরিশ্রম লাঘব করে।

(4) সমস্যা সমাধানে সহায়তা: 

শিক্ষার্থী যখন কোনো সমস্যামূলক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়, তখন সে পূর্ব ধারণার ভিত্তিতে সমস্যার উপাদানগুলি বিশ্লেষণ করে সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট হয়। যেমন, যে শিক্ষার্থীর ‘ফিউজ’ সম্পর্কে ধারণা আছে তার বাড়িতে যদি হঠাৎ আলো নিভে যায় তাহলে সে প্রথমেই ‘ফিউজ’ পরীক্ষা করে সমস্যা সমাধানের চেষ্টা করে। 

(5) তথ্যসংরক্ষণে সহায়তা: 

ধারণা গঠনের ফলে শিক্ষার্থী অনেক তথ্য স্মৃতিতে সংরক্ষণ করতে পারে। ভাষা বা অন্য সংকেতের সাহায্যে শিক্ষার্থীরা ধারণা গঠনের দ্বারা অর্জিত সংশ্লিষ্ট তথ্য স্মৃতিতে ধরে রাখে।

(6) ভাষার বিকাশে সহায়তা:

ধারণা গঠনে ভাষার ব্যবহার প্রয়োজন হয়। ধারণা গঠনের শেষ পর্যায়ে নামকরণের প্রয়োজন হয়। এই নামকরণ শিশুর ভাষার বিকাশে সহায়তা করে।

(7) শিক্ষা সঞ্চালনে সহায়তা: 

ইতিবাচক শিক্ষা সঞ্চালন আমাদের ব্যাবহারিক জীবনে অত্যন্ত কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করে। শৈশব এবং বাল্যকালের বিদ্যালয়ের শিক্ষা পরিণত বয়সে পরিবেশের সঙ্গে অভিযোজনে বিশেষ ভূমিকা নেয়। বিভিন্ন গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, ধারণা গঠনের মধ্য দিয়ে সঞ্চালনের সম্ভাবনা অধিক হয়।

ধারণা গঠনে শিক্ষকের ভূমিকা

কীভাবে শিক্ষক, শিক্ষার্থীর ধারণা গঠনে সাহায্য করতে পারেন সে সম্পর্কে মনস্তত্ত্ববিদরা অনেক পরীক্ষা করে কিছু সুপারিশ করেছেন, যা উল্লেখ করা হল-

(1) বস্তুকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করানো:

ধারণা গঠনে সবচেয়ে কার্যকরী কৌশল হল বস্তুকে সরাসরি প্রত্যক্ষ করা। যে বিষয়ে শিক্ষার্থী ধারণা গঠন করবে সেই বিষয় যাতে সে প্রত্যক্ষ করে তার ব্যবস্থা শিক্ষক করবেন।

(2) বহু সম্পর্কে বৈচিত্র্যপূর্ণ অভিজ্ঞতা অর্জনে সহায়তা: 

বিভিন্ন পরিবেশ, পরিস্থিতিতে একই বস্তুর বৈচিত্র্যপূর্ণ রূপ থাকতে পারে। এ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা অর্জনে শিক্ষক শিক্ষার্থীকে সাহায্য করবেন।

(3) নতুন ধারণার সঙ্গে অর্জিত ধারণার সমন্বয়: 

অর্জিত ধারণাকে ভিত্তি করে নতুন ধারণা গঠন করা প্রয়োজন, অন্যথায় নতুন ধারণা গঠন কঠিন হয়। এক্ষেত্রে নতুন ধারণার সঙ্গে অর্জিত ধারণার পার্থক্যের প্রতিও শিক্ষককে শিক্ষার্থীর মনোযোগ আকর্ষণ করতে হবে।

(4) বন্ধু বা বিষয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্যাবলির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ: 

বস্তু বা বিষয়ের প্রধান বৈশিষ্ট্যাবলির প্রতি শিক্ষার্থীর দৃষ্টি আকর্ষণে শিক্ষক সচেষ্ট হবেন। এর ফলে বস্তুর সংলক্ষণ বা গুণগুলিকে শিক্ষার্থী নির্দিষ্ট করতে পারবে, যা ধারণা গঠনে গুরুত্বপূর্ণ।

(5) মূর্ত বস্তুর সাহায্যগ্রহণ: 

বিভিন্ন ধারণা গঠনে, বিশেষ করে শিশুদের ক্ষেত্রে, মূর্ত বস্তুর সাহায্য গ্রহণ করা উচিত। কারণ শিশুদের সম্পূর্ণ মানসিক বিকাশ না হওয়ায় বিমূর্ত ধারণা গঠন করায় অসুবিধা দেখা যায়।

(6) শিক্ষণপদ্ধতি: 

ধারণা গঠনের ক্ষেত্রে শিক্ষণপদ্ধতির বিশেষ গুরুত্ব আছে। বর্তমানে বিভিন্ন ধরনের সৃজনশীল শিক্ষণপদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়েছে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন ধরনের ধারণা সৃষ্টি সম্ভব। শিক্ষককে পাঠদানকালে উত্ত পদ্ধতিগুলির সাহায্য নিতে হবে।

(7) ধারণার বিকাশ: 

পিঁয়াজের মতে, বয়সভেদে ধারণা বিকাশের বিভিন্ন স্তর আছে। শিক্ষক শিক্ষার্থীর বয়সের সঙ্গে সংগতি রেখে ধারণা বিকাশে ব্যবস্থা নেবেন।

(8) বিভিন্ন কৌশল প্রয়োগ: 

ধারণা গঠনে শিক্ষার্থীদের মধ্যে পার্থক্য দেখা যায়। সব শিক্ষার্থীর মধ্যে একইভাবে ধারণা গড়ে ওঠে না। ধারণা গঠনে শিক্ষার্থীভেদে শিক্ষক বিশেষ কৌশল অবলম্বন করবেন।

(9) ধারণার প্রয়োগ: 

অর্জিত ধারণা পরবর্তীকালে যাতে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্রয়োগ করা যায়, তার সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। কারণ প্রয়োগের মাধ্যমে মূল ধারণাটি আরও কার্যকরী হয়।

(10) উৎসাহদান: 

শিক্ষার্থীরা যাতে নিজেরাই নতুন ধারণা গঠনে এগিয়ে আসে সে ব্যাপারে শিক্ষক তাদের উৎসাহ দেবেন। ধারণা গঠনে সাহায্য করার লক্ষ্যে শিক্ষক বিভিন্ন ধারণার যত বেশি সম্ভব উদাহরণ দেবেন।

আরও পড়ুনLink
শ্রীমদ্ভগবতগীতা – নিষ্কাম কর্মের ধারণা প্রশ্ন উত্তরClick Here
বৌদ্ধদের অষ্টাঙ্গিক মার্গের ধারণা প্রশ্ন উত্তরClick Here
নৈতিক প্রত্যয়সমূহ প্রশ্ন উত্তরClick Here
নিরপেক্ষ ন্যায় – মূর্তি, সংস্থান ও বৈধতা বিচারClick Here

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top