গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি আলোচনা করো

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি আলোচনা করো

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি আলোচনা করো
গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি আলোচনা করো

গণতন্ত্রের সাফল্যের শর্তাবলি

রাষ্ট্রনৈতিক তত্ত্বে গণতন্ত্র সর্বোৎকৃষ্ট আদর্শ শাসনব্যবস্থা হিসেবে বিবেচিত হয়। তবে প্রচলিতভাবে উদারনৈতিক গণতন্ত্রই আধুনিককালে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা হিসেবে পরিচিত লাভ করেছে। উদারনৈতিক রাষ্ট্রতত্ত্বই এরূপ শাসনতন্ত্রের মূল ভিত্তি। একটি উন্নততর শাসনব্যবস্থারূপে গণতন্ত্র পরিগণিত হলেও, এর সাফল্যের জন্য কতকগুলি শর্তপূরণ আবশ্যক হয়ে পড়ে। লর্ড ব্রাইস, জন স্টুয়ার্ট মিল, বার্নস প্রমুখ রাষ্ট্রবিজ্ঞানী গণতন্ত্রের সমর্থক হলেও এই ব্যবস্থার ত্রুটিবিচ্যুতি সম্পর্কে এঁনারা প্রত্যেকেই অবগত ছিলেন। তাই এই ব্যবস্থাকে ত্রুটিমুক্ত করতে প্রত্যেকেই বেশ কিছু শর্তাবলির কথা বলেন।

জন স্টুয়ার্ট মিল তাঁর ‘Representative Government’ নামক গ্রন্থে গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য তিনটি শর্ত পূরনের কথা বলেছেন। এগুলি হল জনগণের গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা গ্রহণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য, গণতন্ত্রকে রক্ষা করার জন্য নিজ নিজ কর্তব্যপালন ও অধিকার রক্ষার সংগ্রামে জনগণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য এবং গণতন্ত্রের উদ্দেশ্যসাধনের জন্য অপরিহার্য কার্যসম্পাদনে জনগণের ইচ্ছা ও সামর্থ্য।

(1) গণতান্ত্রিক জনগণ

মিল-এর অভিমত ব্যাখ্যা করার পর আমরা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম শর্ত হিসেবে প্রথমেই গণতান্ত্রিক জনগণের কথা বলতে পারি। গণতান্ত্রিক চেতনা ও দৃষ্টিসম্পন্ন নাগরিকদের গণতান্ত্রিক জনগণ হিসেবে গণ্য করা হয়। গণতান্ত্রিক চেতনা জনগণকে সক্রিয়ভাবে রাষ্ট্রপরিচালনার কাজে অংশগ্রহণ করতে উৎসাহিত করে। এই সচেতনতার ভিত্তিতে জনগণ সরকারের কাজকর্মের ত্রুটিবিচ্যুতির সমালোচনা করে জনস্বার্থ রক্ষায় সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণ করে। তবে জনগণের আদর্শ ও ভাবধারা সঞ্চায়িত না হলে গণতন্ত্রের সাফল্য সুনিশ্চিত করা সম্ভব নয়। এপ্রসঙ্গে লয়েড (Lloyd) মন্তব্য করেছেন, “নাগরিকদের অলসতার জন্য গণতন্ত্র সংকটাপন্ন হতে পারে।” বস্তুতপক্ষে, জনগণের মধ্যে যত বেশি গণতান্ত্রিক চেতনা বিস্তৃত হবে গণতন্ত্র তত সাফল্যের পথে অগ্রসর হবে।

(2) গণতান্ত্রিক পরিবেশ

অনেকের মতে, গণতান্ত্রিক পরিবেশ ছাড়া গণতান্ত্রিক জনগণ সৃষ্টি হতে পারে না। এটি হল বিশেষ একটি অবস্থা বা পরিস্থিতি। নাগরিক অধিকার ও স্বাধীনতার ব্যাপক স্বীকৃতির মাধ্যমে এই

গণতান্ত্রিক পরিবেশ গড়ে উঠতে পারে। সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকারগুলির যথাযথ স্বীকৃতি ও সংরক্ষণ এক্ষেত্রে জরুরি। এভাবে নাগরিকদের মধ্যে সব ধরনের বৈষম্যের অবসান ঘটলে ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ ব্যক্তিত্ব বিকাশের পরিবেশ রচিত হয়। এই পরিবেশ গণতন্ত্রের সাফল্য সুনিশ্চিত করতে সক্ষম। এই পরিবেশ সৃষ্টি হলে গণতন্ত্রের বিপক্ষে যেসকল যুক্তির অবতারণা করা হয়, তার বহুলাংশই অযৌক্তিক ও ভিত্তিহীন হয়ে পড়বে। সামাজিক বৈষম্যের অবসান ঘটিয়ে ব্যক্তির সামাজিক অধিকারগুলিকে সর্বাগ্রে প্রতিষ্ঠা করতে হবে, যা একটি গণতান্ত্রিক সমাজের অত্যন্ত প্রয়োজনীয় শর্ত। কারণ বৈষম্যমূলক সমাজ কখনই ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব বিকাশে সহায়ক হতে পারে না।

(3) অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা

অধ্যাপক ল্যাস্কি-র মতে, শুধুমাত্র রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলি স্বীকৃত হলে গণতন্ত্রের সাফল্য আসে না, তার জন্য প্রয়োজন অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা। তাঁর মতে, অর্থনৈতিক গণতন্ত্র ছাড়া রাজনৈতিক গণতন্ত্র মূল্যহীন (“Political democracy is meaningless without economic democracy.”)। যে সমাজে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্য বিদ্যমান, যেখানে দেশের সম্পদ মুষ্টিমেয় পুঁজিপতির নিয়ন্ত্রণাধীন সেখানে জনগণ কখনও সুষ্ঠু গণতান্ত্রিক জীবনযাপন করতে পারে না। অর্থনৈতিক সাম্য এবং জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি গণতন্ত্রে সাফল্যের সহায়ক হিসেবে কাজ করে। আর উৎপাদন ব্যবস্থার উপর সামাজিক নিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তিগত সম্পত্তির অধিকারের বিলুপ্তি, অর্থনৈতিক সাম্য প্রতিষ্ঠা রাষ্ট্রীয় অর্থবৈষম্য দূরীকরণের জন্য বাঞ্ছনীয়। আর ল্যাস্কি মনে করেন, গণতন্ত্র একমাত্র পরিপূর্ণতা লাভ করে সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে।

(4) শিক্ষার ব্যাপক প্রসার

শিক্ষার ব্যাপক প্রসারকে গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। গণতন্ত্র হল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণের শাসন। এক্ষেত্রে জনগণের গরিষ্ঠ অংশ যদি অশিক্ষিত থাকে, তাহলে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। অশিক্ষিত জনগণের মধ্যে রাজনৈতিক সচেতনতা দেখা যায় না। সুনাগরিকই হল গণতন্ত্রের সাফল্যের চাবিকাঠি। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জন স্টুয়ার্ট মিল এই কারণে মন্তব্য করেছেন যে, ‘সর্বজনীন ভোটাধিকারের স্বীকৃতির পূর্বে সর্বজনীন শিক্ষার ব্যবস্থা করা প্রয়োজন।’ (Universal teaching must precede universal enfranchisement.) এই শিক্ষা হবে যথার্থ নাগরিকতার জন্য শিক্ষা, যার ফলে নাগরিকরা নির্লিপ্ততা, ব্যক্তিগত স্বার্থপরতা ও সংকীর্ণ দলীয় মনোভাব বর্জন করে দেশের সামগ্রিক জাতীয় স্বার্থে নিজেদের বিচারবুদ্ধি অনুযায়ী কাজ করতে সক্ষম হয়।

এই শিক্ষা কেবল পুঁথিগত জ্ঞানার্জন নয়, এই শিক্ষাকে হতে হবে ‘নাগরিকত্বের জন্য শিক্ষা’ (Education of Citizenship)। কারণ এই শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারলে তবেই মানুষ সংকীর্ণ ব্যক্তিস্বার্থকে উপেক্ষা করে রাষ্ট্রের সার্বিক কল্যাণে অগ্রসর হবে। আব্রাহাম লিঙ্কন মনে করতেন, জনগণ শিক্ষিত না হলে সুচতুর রাজনীতিবিদরা তাদের ভ্রান্ত পথে চালিত করতে সক্ষম হবে। অতএব গণতন্ত্রের অন্যতম শর্ত হল সর্বজনীন শিক্ষার প্রবর্তন।

(5) পরমতসহিষ্ণুতা

পরমতসহিষুতা গণতন্ত্রের সাফল্যের অপর একটি শর্ত। গণতন্ত্রে জনগণের বাক্ ও মতামত প্রকাশের পূর্ণ স্বাধীনতা থাকে, যার ফলে বহুমতের সৃষ্টি হয়। সেজন্য এখানে পরস্পর ভিন্নমতাবলম্বী ব্যক্তিদের মধ্যে সহিমু মনোভাব থাকা প্রয়োজন। সমাজস্থ সকলেই যাতে নিজ নিজ মতাদর্শ স্বাধীনভাবে প্রচার করতে এবং যে-কোনো আদর্শকে সমর্থন করতে সক্ষম হয়, তার জন্য গণতন্ত্রে উপযুক্ত পরিবেশ থাকা বাঞ্ছনীয়। আত্মসংযম ও সহিমুতাই একমাত্র এই পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বোঝাপড়ার মনোভাব থাকলে তা গণতন্ত্রের সাফল্যের পক্ষে সহায়ক হিসেবে কাজ করে। গণতন্ত্রে সরকার ও বিরোধীপক্ষকেও সহিষ্ণু হতে হয়। সরকারকে মান্য করা যেমন বিরোধীপক্ষের কর্তব্য, তেমনি বিরোধীপক্ষের মতামতকে যথাযোগ্য মূল্য দেওয়া সরকারের কর্তব্য বলে বিবেচিত হয়। এই পরমতসহিষুতা ও পারস্পরিক সমঝোতা না থাকলে গণতন্ত্র সফল হয় না।

(6) ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ

গণতন্ত্রকে সাফল্যমণ্ডিত করে তুলতে হলে ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণ প্রয়োজন। ক্ষমতা বিকেন্দ্রীকরণের সাহায্যে জনগণ আরও সক্রিয়ভাবে প্রশাসনিক কাজে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। স্থানীয় স্তরে স্বায়ত্তশাসনমূলক প্রতিষ্ঠানগুলিকে পরিচালনা করার মধ্য দিয়ে জনগণ তাদের রাজনৈতিক দায়িত্ববোধকে বাস্তবায়িত করে, যার ফলে রাজনৈতিক জ্ঞান সমৃদ্ধ হয়। প্রশাসনিক ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণ জনগণের রাজনৈতিক জ্ঞান ও দায়িত্ববোধ বৃদ্ধি করতে সাহায্য করে। তাই লর্ড ব্রাইস বলেছেন, স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনব্যবস্থা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে সুদৃঢ় করতে একান্ত আবশ্যক।

(7) লিখিত সংবিধান

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হেনরি মেইন, লেকি প্রমুখের বক্তব্য হল, লিখিত সংবিধান গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য আবশ্যক। সংবিধান লিখিত থাকলে জনগণ সরকারের ক্ষমতার সীমানা ও নিজেদের অধিকার এবং কর্তব্য সম্বন্ধে সচেতন থাকতে পারে। এই সচেতনতা সরকারকে স্বৈরাচারী হতে বাধা দেয়। তাই গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে সাফল্যমণ্ডিত করতে জাগ্রত, সক্রিয়, সদাসতর্ক, বলিষ্ঠ জনমতের প্রয়োজন হয়।

(8) সৎ, সুদক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ সরকারি কর্মী

গণতন্ত্রের সাফল্যের অপর এক অপরিহার্য শর্ত হিসেবে সৎ, সুদক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ সরকারি কর্মচারীর কথা বলা হয়। দক্ষতা সহকারে শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য যে জ্ঞান বা শিক্ষা দরকার, তা গণতন্ত্রে জনপ্রতিনিধিদের থাকে না। তাই, গণতন্ত্রে প্রশাসনিক দায়িত্ব জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের হাতে থাকলেও বাস্তবে স্থায়ী সরকারি কর্মচারীরা প্রশাসনের পরিচালনার কাজে নিযুক্ত থাকেন। এই সমস্ত কর্মচারীদের উপর জনপ্রতিনিধিদের নির্ভরশীল হতে হয়। কিন্তু সরকারি কর্মচারীরা সৎ, সুদক্ষ ও কর্তব্যপরায়ণ জনকল্যাণব্রতী না হলে গণতান্ত্রিক সরকার তার ইপ্সিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারে না।

(9) নেতৃবৃন্দের ন্যায়নীতি ও বিবেকবোধ

রাষ্ট্রবিজ্ঞানী শ্যুমপিটার (J A Schumpeter)-এর মতে, গণতন্ত্রের সাফল্য অনেকটাই রাষ্ট্রনৈতিক নেতৃবৃন্দের ন্যায়নীতি ও বিবেকবোধের উপর নির্ভরশীল। রাষ্ট্রনেতাদের মধ্যে এসব গুণাবলির ঘাটতি হলে গণতন্ত্র আদর্শভ্রষ্ট হয়। কারণ রাষ্ট্রক্ষমতা স্বার্থপর, হীন মনোবৃত্তিসম্পন্ন ব্যক্তিদের দ্বারা কুক্ষিগত হলে জনগণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধিত হতে পারে না। তাই রাষ্ট্রনেতাদের সততা, গুণগত যোগ্যতা, কর্মতৎপরতার, উদার দৃষ্টিকোণ, বিবেকবোধের উপর গণতান্ত্রিক সরকারের সাফল্য একান্তভাবে নির্ভরশীল। শাসনকার্য পরিচালনা করার জন্য দক্ষ, অভিজ্ঞ, জ্ঞানী, উদ্যমী সরকারি কর্মচারী প্রয়োজন।

(10) বিরোধী দলের ভূমিকা

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য বিরোধী দলের ভূমিকা বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। অধ্যাপক আইভর জেনিংস-এর মতে, বিরোধী দল না থাকলে গণতন্ত্রের অস্তিত্ব থাকে না (If there be no opposition there is no democracy)। কারণ বিরোধী দলের অস্তিত্বহীনতা, দুর্বল বিরোধী দলের উপস্থিতি ক্ষমতাসীন দলকে স্বৈরাচারী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। কিন্তু একটি শক্তিশালী বিরোধী পক্ষ থাকলে সরকারকে সংযত থেকে কার্যাবলি সম্পাদন করতে হয়। অগণতান্ত্রিক কাজ থেকে সরকার বিরত থাকতে বাধ্য হয়। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সুস্থ এবং সক্রিয় জনমত গঠনের ব্যবস্থা থাকা দরকার। একটি শক্তিশালী বিরোধী দল থাকলে সরকার সবসময় সতর্ক থাকে। বিরোধী দলের অস্তিত্ব সম্পর্কে সচেতনতাই সরকারকে সঠিক পথে পরিচালিত করে। হার্ভে এবং ব্যাথার-এর মতে, বিরোধী দল জনগণের স্বাধীনতার প্রতীক। গণতন্ত্রের অন্যতম রক্ষাকবচ হিসেবেও অনেকে শক্তিশালী বিরোধী দলের উপস্থিতিকে বর্ণনা করেছেন।

(11) সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত ব্যবস্থা

সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের উপযুক্ত ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম একটি শর্ত। জন স্টুয়ার্ট মিল এই যুক্তির সপক্ষে মতামত ব্যক্ত করেন। গণতন্ত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠের ভোটে সরকার গঠিত হয়। এখানে সংখ্যালঘিষ্ঠের ভোটের কোনো মূল্য থাকে না। সংখ্যালঘু শ্রেণির কাছে গণতন্ত্র অর্থহীন হয়ে পড়ে। তার ফলে জনগণের একটি অংশ সরকারি সিদ্ধান্তগ্রহণের প্রক্রিয়ায় ভাগ নিতে পারে না। তাই গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য সংখ্যালঘু প্রতিনিধিত্বের ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক।

(12) সদাজাগ্রত জনমত

আধুনিক বিশ্বে জনমতকে গণতন্ত্রের সাফল্যের একটি প্রধান শর্তরূপে স্বীকৃতি দেওয়া হয়। সুস্থ সবল সদাজাগ্রত জনমত গণতন্ত্রের সাফল্যের অতন্দ্র প্রহরী হিসেবে কাজ করে। সরকারি স্বৈরাচারিতাকে রোধ করতে সক্ষম হয় শক্তিশালী জনমত। সক্রিয় জনমত সরকারকে গণমুখী হয়ে উঠতে সাহায্য করে। জনমতকে সুসংহত করে তুলতে রাজনৈতিক দলগুলির এবং গণমাধ্যম সংস্থাগুলির ইতিবাচক ভূমিকা অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়।

(13) জাতীয় সংহতি ও ঐক্য

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য জাতীয় সংহতি ও ঐক্য থাকা প্রয়োজন। মিল-এর মতে, জাতির ভিত্তিতে রাষ্ট্রগঠন গণতন্ত্রের বিকাশের পক্ষে জরুরি। জনগণের মধ্যে জাতীয় ঐক্যবোধ না থাকলে গণতন্ত্র সাফল্যমণ্ডিত হয় না। সামাজিক ঐক্যবোধের জন্য জাতিভেদ প্রথা-সহ অন্যান্য সামাজিক বৈষম্যের বিলুপ্তি প্রয়োজন।

(14) স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগ

অনেকে আবার গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য স্বাধীন ও নিরপেক্ষ বিচার বিভাগের উপস্থিতির কথা বলেন। বিচার বিভাগ স্বাধীন ও নিরপেক্ষ না হলে জনগণ ন্যায়বিচার পেতে পারে না। এরূপ ব্যবস্থা গণতন্ত্রের সাফল্যের পথে প্রধান অন্তরায়। ফলত, কেবলমাত্র বিচার বিভাগই নয়, সমগ্র গণতান্ত্রিক শাসন কাঠামোর উপর থেকে জনগণ আস্থা হারিয়ে ফেলে।

(15) নাগরিক অধিকারের রূপায়ণ

গণতন্ত্রের সাফল্যের জন্য নাগরিকদের রাজনৈতিক ও সামাজিক অধিকারগুলিকে শুধুমাত্র তত্ত্বগত স্বীকৃতি দিলেই চলবে না, সেগুলিকে বাস্তবে কার্যকরী করে গড়ে তোলা প্রয়োজন। এ জন্য বাক্ ও মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা, চলাফেরার স্বাধীনতা, সংঘ বা সমিতি গঠনের স্বাধীনতা, অবাধ নির্বাচনের পরিবেশ, জীবনের অধিকার, কর্মের অধিকার ও সামাজিক সাম্যের অধিকার সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষিত থাকা দরকার।

(16) জাতি, ধর্ম ও ভাষাগত সংকীর্ণতা বর্জন 

অনেকে জাতিগত, ধর্মগত এবং ভাষাগত সংকীর্ণতাকে গণতন্ত্রের সাফল্যের প্রতিবন্ধক হিসেবে চিহ্নিত করেন। বলা হয় যে, গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে প্রতিটি মানুষকে সর্বপ্রকার সংকীর্ণতার ঊর্ধ্বে উঠে সুনাগরিক হিসেবে জাতীয় কর্তব্যপালনে উদ্যোগী হওয়া প্রয়োজন। আঞ্চলিকতা, প্রাদেশিকতা, বিচ্ছিন্নতা, ধর্মান্ধতা গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে তোলে। তাই গণতন্ত্রে নাগরিকদের এসব থেকে দূরে থাকা আবশ্যক। যে-কোনো প্রকারের সংকীর্ণতাই গণতন্ত্রের সাফল্যের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করে।

(17) গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য

গণতন্ত্রকে সাফল্যমন্ডিত করতে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য একান্ত আবশ্যক। গণতন্ত্রের স্বরূপ ও যথার্থতাকে উপলব্ধি করতে হলে গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য থাকা বাঞ্ছনীয় বলে অনেকে মনে করেন। আর গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ব্যাতীত গণতন্ত্র তথা গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার সংগ্রামে সামিল হওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে।

(18) সামাজিক দায়িত্ববোধ

গণতন্ত্রের সাফল্যের অন্যতম প্রধান শর্ত হল সামাজিক দায়িত্ববোধ। যতদিন না দেশবাসী নিজেদের ব্যক্তিগত স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠে সমাজের সামগ্রিক স্বার্থকে গুরুত্ব দেবে, ততদিন পর্যন্ত গণতন্ত্র সাফল্য লাভ করতে পারবে না। বৃহত্তর সামাজিক স্বার্থকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার মধ্য দিয়ে জনগণ সৌভ্রাতৃত্ব ও মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ হতে পারবে। তবেই আদর্শ গণতন্ত্রের স্বরূপ উপলব্ধি করা সম্ভব হবে।

পরিশেষে বলা যায়, একটি গণতান্ত্রিক সমাজ ও গণতান্ত্রিক ঐতিহ্য ছাড়া গণতন্ত্রকে সফল করা যায় না। গণতান্ত্রিক সমাজ বলতে এমন একটি সমাজকে বোঝায়, যেখানে পারস্পরিক আলোচনা, স্বাধীনভাবে মত বিনিময়, বৈষম্যের অনুপস্থিতি ও দায়িত্বশীলতার উপাদান উপস্থিত থাকে।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top