জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সংক্ষেপে আলোচনা করো

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সংক্ষেপে আলোচনা করো

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সংক্ষেপে আলোচনা করো
জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা সংক্ষেপে আলোচনা করো

জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ভাবনা

রবীন্দ্রনাথ মনে করতেন, জাতীয়তাবাদ কোনো স্বতঃস্ফূর্ত বিষয় নয়, এ এমন এক কৃত্রিম বন্ধন, যার ভিত্তি হল অর্থ ও ক্ষমতা। পশ্চিমি বাণিজ্যিক সভ্যতা ও শিল্পবিপ্লবের ফসল হল জাতীয়তাবাদ। এর পিছনে রয়েছে সাম্রাজ্যবাদের প্রেরণা। বস্তুত, জাতীয়তাবাদ সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথের ধারণা সম্পূর্ণ নিজস্ব ধরনের। তাঁর জাতীয়তাবাদী ভাবনা একদিকে যেমন স্বদেশি চেতনার সীমিত গন্ডির মধ্যে আবদ্ধ ছিল না, অন্যদিকে তেমনি ইউরোপীয় জাতীয়তাবোধের অহমিকার মধ্যেও সীমাবদ্ধ ছিল না। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ছিলেন বিশ্বমানবতাবাদের পূজারি। তাই তাঁর জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনা ছিল আন্তর্জাতিক চিন্তাভাবনার আলোয় আলোকিত।

জাতীয়তাবাদের বিষয়টিকে রবীন্দ্রনাথ বৃহত্তর প্রেক্ষাপটে দেখতে চেয়েছিলেন, সেখানে কোনোরকম সংকীর্ণতার স্থান ছিল না। তিনি জাতীয়তাবাদী ধারণাকে ধর্মনিরপেক্ষতা ও অসাম্প্রদায়িকতাবোধের আলোকে বিশুদ্ধ বনিয়াদের উপর ভিত্তি করে নির্মাণ করতে চেয়েছিলেন। সম্পূর্ণ মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি দ্বারা জাতীয়তাবাদী ধারণাকে রবীন্দ্রনাথ বিচার-বিশ্লেষণ করেছিলেন। স্বাজাত্যবোধের ইউরোপীয় অহমিকাকে রবীন্দ্রনাথ তাঁর জাতীয়তাবাদী ধারণায় স্থান দেননি। তিনি উগ্র জাতীয়তাবাদ এবং উগ্র দেশপ্রেমের বিরোধী ছিলেন। তবে তিনি ছিলেন একজন নির্ভেজাল দেশপ্রেমিক।

বিশ্বনাথ দে সম্পাদিত ‘রবীন্দ্রবিচিত্রা’ গ্রন্থের অন্তর্ভুক্ত রবীন্দ্রনাথের দেশনীতি শীর্ষক রচনায় প্রফুল্লচন্দ্র রায় বলেছেন, “সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় যেমন ভারতীয় জাতীয়তার কর্মযোগে সাধন করিয়াছিলেন, বিপিনচন্দ্র পাল ও অরবিন্দ ঘোষের জীবনে আমরা যেমন পাই তাঁর জ্ঞানযোগ, রবীন্দ্রনাথের সাধনায় তেমনি পাই দেশপ্রীতির ভক্তিযোগ।” আবার, অধ্যাপক দেবরাজ বালি তাঁর ‘Modern Indian Thought’ শীর্ষক গ্রন্থে মন্তব্য করেন, “Rabindranath was one of the greatest partiots that India produced in the nineteenth century. His Love for his motherland was real and pure…”

তাঁর দৃষ্টিতে অন্ধ দেশপ্রেম কিংবা স্বাদেশিকতা কখনোই প্রকৃত দেশপ্রেম নয়। কারণ এই ধরনের দেশপ্রেম সমাজের ক্ষতিসাধনের পাশাপাশি ব্যক্তিরও ক্ষতিসাধন করে। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত তাঁর ‘কালান্তর’ নামক গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ এই বিষয়টির কথাই তুলে ধরেছিলেন। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের সময় দেশপ্রেমের আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে বহু মানুষ বিদেশি পণ্য বর্জন এবং সেগুলিকে পুড়িয়ে প্রতিবাদের আনন্দে মুখর হয়ে উঠেছিল। কিন্তু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জাতীয়তাবাদ, স্বদেশিকতা, দেশপ্রেম প্রভৃতির নামে বিদেশি বস্ত্র পোড়ানোর কাজকে কোনো ভাবেই সমর্থন করেননি।

এই কারণে চরমপন্থী নেতাদের উগ্র জাতীয়তাবাদী কার্যকলাপ বিষয়ে অরবিন্দের সঙ্গে তাঁর চরম মতানৈক্য দেখা দেয়। কারণ স্বদেশি আন্দোলনকে গ্রহণ ও সমর্থন করলেও তিনি বয়কট কর্মপন্থাকে মনে. প্রাণে মেনে নিতে পারেননি। অন্যদিকে, অরবিন্দ বয়কট কর্মসূচিকে সমর্থন করার পাশাপাশি এই কর্মসূচিকে একটি মানবিক প্রতিবিধানের মর্যাদা দান করেছিলেন। স্বদেশি ভাবধারায় রবীন্দ্রনাথ উদ্বুদ্ধ হলেও রবীন্দ্রনাথ কখনোই ইউরোপীয় নেশন অর্থে ভারতকে ব্যাখ্যা করার পক্ষপাতী ছিলেন না।

রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, ‘অতীতে সকলে মিলিয়া ত্যাগ দুঃখ স্বীকার এবং পুনর্বার সেই জন্য সকলে মিলিয়া প্রস্তুত থাকিবার ভাব হইতে জনসাধারণকে যে একটি একীভূত নিবিড় অভিব্যক্তি দান করে তাহাই নেশন।’ কিন্তু তার মতে, পশ্চিমি নেশন দানবস্বরূপ, যা রাষ্ট্রের দারিদ্র্য, দুর্বল, পরাধীন জাতিগুলিকে শোষণ করে। তাঁর মতে, আত্মশক্তির জাগরণই একটি জাতিকে আত্মমর্যাদাসম্পন্ন করে তোলে। আর নৈতিকতা, মূল্যবোধ, চেতনা, স্বদেশপ্রীতিকে জাগ্রত ও বিকশিত করার মধ্য দিয়ে আত্মশক্তির বিকাশকে ত্বরান্বিত করার আহবান জানিয়েছেন। তাঁর ভাষায়, “আমাদের চিত্ত যদি সকল বিষয়ে সতেজ থাকিত তাহা হইলে বিলাত আমাদের সে চিত্তকে বিহ্বল করিয়া দিতে পারিত না।”

ভারতে সামাজিক ঐক্যের প্রশ্নটি ছিল সেই সময়ের প্রেক্ষিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। আর এই ঐক্যকে তিনি হিন্দু ঐক্য হিসেবেই বিবেচনা করতেন এবং হিন্দুদের অতীত ঐতিহ্য নিয়ে গর্ববোধও করতেন। কারণ তাঁর কাছে ইউরোপের জাতীয় ঐক্য ছিল বস্তুতপক্ষে রাষ্ট্রতন্ত্রমূলক। রবীন্দ্রনাথ স্বদেশপ্রেমে আত্মনিয়োগ করলেও স্বদেশি আন্দোলনের আবহে তিনি ‘বিশ্বময়ীর, বিশ্বমায়ের আঁচল পাতা’ গানটির মাধ্যমে বিশ্বজনীনতার আদর্শ তুলে ধরেছিলেন, যা ঋষি অরবিন্দ সম্পূর্ণরূপে মেনে নিতে পারেননি। অরবিন্দ মন্তব্য করেছিলেন, “কোনো জাতি শুধুমাত্র বিদ্বেষ এবং শত্রুতাকে ভিত্তি করে কখনোই বড়ো হতে পারে না-একথা যেমন সত্য, তেমনই ইতিহাসের সংখ্যাতীত দৃষ্টান্ত এই সিদ্ধান্ত প্রমাণ করে যে, কোনো দেশই নিছক সৌভ্রাতৃত্ব, আন্তর্জাতিক মৈত্রী বা বিশ্বমানবতার আদর্শের উপর নির্ভর করে প্রতিষ্ঠালাভে সক্ষম হয়নি।”

তবে, রবীন্দ্রনাথ-এর কাছে জাতির চেয়ে মানুষই ছিল বড়ো। এ প্রসঙ্গে ভি পি ভার্মা তাঁর ‘Modern Indian Political Thought’ গ্রন্থে বলেছেন, “Tagore was a champion of the ‘people’ and not of the ‘nation’. He believed in the regeneration of the spirit of the people of India. India was and is an undying spiritual entity. But he wanted to guard against the fetish of nation.” অর্থাৎ, রবীন্দ্রনাথ ছিলেন জনগণের সমর্থক, কিন্তু জাতির পূজারি নন। যে জাতীয়তাবাদ স্বতন্ত্র রাষ্ট্রগঠন, সমাজের মূলস্রোত থেকে কোনো একটি জাতির বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া, জাতিতে জাতিতে, ধর্মে ধর্মে, ভাষায় ভাষায় এরূপ পারস্পরিক দ্বন্দ্বে লিপ্ত হওয়ার ইন্ধন জোগায় রবীন্দ্রনাথ সেই জাতীয়তাবাদকে কখনোই সমর্থন করেননি।

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বাস করতেন যে, জাতীয়তাবাদের প্রভাবে মানুষের মধ্যে যে বিচ্ছিন্নতার সৃষ্টি হয়, তাতে মনুষ্যত্বের অবক্ষয় ঘটে। জাতীয়তাবাদী ধারণা ব্যক্তিমানুষকে বলি দেয়। এখানে মানুষের সৃজনশীল সত্তার স্বাধীন বিকাশ ঘটে না। ব্যক্তিমানুষ ‘নেশনের’ অধীনে যন্ত্রে পরিণত হয়। জাতীয়তাবাদের জাতীয় গরিমার যে আবেগ মানুষের মনে বিভেদের সৃষ্টি করে, তা ক্রমশ মানুষকে দানবে পরিণত করে। মানুষের যাবতীয় শুভ চিন্তা, শুভ চেতনা সব ধ্বংস হয়ে যায়। এভাবে জাতীয়তাবাদ মানবসভ্যতার সংকট ডেকে আনে। তাঁর ভাষায়, ‘জাতি নিজেই জাতির পক্ষে অকল্যাণকর। জাতি নিজেই জাতির সবচেয়ে বড়ো শত্রু।’ তাঁর মতানুসারে, জাতীয়তাবাদী আদর্শের মধ্যে অন্ধ দেশপ্রেম ও সাম্রাজ্যবাদের বীজ নিহিত থাকে।

জাতীয়তাবাদ এমন একটি নেশা, যাতে আচ্ছন্ন হয়ে মানুষ বুদ্ধিভ্রষ্ট হয়ে পড়ে। মানুষে মানুষে বিচ্ছিন্নতা এবং মনুষ্যত্বের অবক্ষয় মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। জাতীয়তাবাদ মানুষের মধ্যে থাকা শুভসত্তার বিনাশ ঘটিয়ে কালক্রমে সাম্রাজ্যবাদী জাতিসমূহের রণহুঙ্কারে পরিণত হয়। ‘শিক্ষার মিলন’ শীর্ষক প্রবন্ধে এই উগ্র জাতীয়তাবাদের বিরুদ্ধে রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, “পৃথিবীতে নেশন গড়ে উঠল সত্যের জোরে, কিন্তু ন্যাশনালিজম সত্য নয়, অথচ সেই জাতীয় গণ্ডীদেবতার পূজার অনুষ্ঠানে চারদিক থেকে নরবলির জোগান চলতে লাগল। যতদিন বিদেশি বলি জুটত ততদিন কোনো কথা ছিল না; হঠাৎ ১৯১৪ খ্রিস্টাব্দে পরস্পরকে বলি দেওয়ার জন্য স্ময়ং-যজমানদের মধ্যে টানাটানি পড়ে গেল।… যুদ্ধ যখন পুরোদমে চলছিল তখন সকলেই – ভাবছিল, যুদ্ধ মিটলেই অকল্যাণ মিটবে। যখন মিটল তখন দেখা গেল সেই – যুদ্ধটাই এসেছে সন্ধিপত্রের মুখোশ পরে।

এই দুর্বুদ্ধিরই নাম ন্যাশনালিজম, দেশের সর্বজনীন আত্মম্ভরিতা। এ হল রিপু, ঐক্যতত্ত্বের উল্টোদিকে অর্থাৎ আপনার দিকটাতেই এর টান।” প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, রবীন্দ্রনাথ বাংলা জাতীয়তাবাদ শব্দটির পরিবর্তে ন্যাশনালিজম শব্দটি বাংলায় ব্যবহার করার পক্ষপাতী ছিলেন। তবে, কিছু কিছু ক্ষেত্রে তিনি ন্যাশনালিজম- এর বিকল্প হিসেবে নেশনতত্ত্ব শব্দটিও ব্যবহার করেছিলেন।

Read More – The Garden Party Question Answer

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top