জাতীয়তাবাদের পক্ষে ও বিপক্ষে যুক্তি দাও

জাতীয়তাবাদের সপক্ষে যুক্তি
(1) একটি মহান আদর্শ
জাতীয়তাবাদকে জাতীয় জীবনের এক মহান আদর্শ ও একটি গভীর অনুপ্রেরণা হিসেবে অভিহিত করা হয়। জাতীয়তাবাদ সমগ্র জাতিকে দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ করে দেশের জন্য আত্মত্যাগ করতেও অনুপ্রেরণা জোগায়। প্রতিটি জাতি জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হলে সামগ্রিকভাবে সারা বিশ্বের মানবসভ্যতার দ্রুত সমৃদ্ধি ঘটতে পারে।
(2) মুক্তির দিশারি
পরাধীন জাতিগুলির কাছে জাতীয়তাবাদ হল মুক্তির দিশারি। মুক্তিকামী দেশগুলির জন্য জাতীয়তাবাদ একটি আশীর্বাদস্বরূপ। একমাত্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে, পরাধীন জাতিগুলি মুক্তির জন্য আমরণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়। ভারতে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে উৎখাত করার জন্য ভারতবাসীরা জাতীয়তাবাদী আদর্শে দীক্ষিত হয়েছিলেন। একইভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরবর্তীকালে এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার প্রায় ১০০টির মতো দেশ পরাধীনতার শৃঙ্খলমোচন করে মুক্তির আস্বাদ লাভ করে।
(3) গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যকারী
জাতীয়তাবাদকে অনেকে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় সাহায্যকারীরূপে অভিহিত করেন। ইউরোপে নবজাগরণের সময়কালে যে জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়, তা পরবর্তীকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মুক্তিসংগ্রাম ও ফরাসি বিপ্লব-সহ পৃথিবীর বহু দেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হয়। একনায়কতন্ত্রের অবসান ঘটিয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করতে আদর্শ জাতীয়তাবাদের আর কোনো বিকল্প নেই। এই কারণে জাতীয়তাবাদকে স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের জন্মদাতা বলে আখ্যা দেওয়া হয়। মুক্তিকামী জনসমাজ জাতীয়তাবাদী আদর্শ দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে সাম্রাজ্যবাদ, উপনিবেশিকতাবাদ এবং স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্রকে প্রতিষ্ঠা করে।
(4) সম্প্রীতির প্রতীক
জাতীয়তাবাদ হল সহযোগিতা ও সম্প্রীতির প্রতীক। জাতীয়তাবাদের মূলমন্ত্র নিজে বাঁচো এবং অপরকে বাঁচতে দাও (Live and let others live)। জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন জাতিগুলির কাছে সংঘর্ষ ও সংঘাতের বদলে সহযোগিতা ও সম্প্রীতির বাণী পৌঁছে দেয়।
(5) মানবসভ্যতার সমৃদ্ধির সহায়ক
জাতীয়তাবাদ হল মানবসভ্যতার পূর্ণাঙ্গ বিকাশ ও সমৃদ্ধির সহায়ক। জাতীয়তাবাদের জনক ইতালির ম্যাৎসিনি-র মতে, জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর ভিন্ন ভিন্ন জাতিগুলির অন্তর্নিহিত গুণাবলির বিকাশ ঘটিয়ে মানবসভ্যতাকে সমৃদ্ধ ও বিকশিত হতে সাহায্য করে। প্রতিটি জাতির মধ্যে যে-সমস্ত গুণাবলি লুকিয়ে থাকে, তা একমাত্র জাতীয়তাবাদের মাধ্যমে সর্বাঙ্গীণভাবে বিকশিত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। এভাবে সারা বিশ্বের মানবসভ্যতার সমৃদ্ধি ঘটে।
(6) স্থায়িত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক
জাতীয়তাবাদকে অভ্যন্তরীণ স্থায়িত্ব ও শান্তি প্রতিষ্ঠার সহায়ক বলে মনে করা হয়। জাতীয়তাবাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ জনসমাজ নিজেদের স্বশাসন প্রতিষ্ঠা করায় শাসক ও শাসিতের মধ্যে সুসম্পর্ক রচিত হয়। ফলে জনগণ রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের নিকট স্বাভাবিক আনুগত্য প্রদর্শন করতে ইচ্ছা প্রকাশ করে। জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিদ্বেষ, হানাহানি, অবিশ্বাস ইত্যাদি না থাকায় দেশে শাসনব্যবস্থায় স্থায়িত্ব প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব হয়।
(7) যুদ্ধবিরোধী
জাতীয়তাবাদ যুদ্ধের আশঙ্কা দূর করে বলে অনেকে মনে করেন। আদর্শ জাতীয়তাবাদ পৃথিবীর বিভিন্ন জাতিসমূহের মধ্যে যে সহযোগিতা ও সৌভ্রাতৃত্বের প্রতিষ্ঠা করে, তার ফলে জাতিগুলির মধ্যে পারস্পরিক বৈরী মনোভাব হ্রাস পায়। বর্তমানে প্রযুক্তিবিদ্যার অভাবনীয় উন্নতিতে যে-কোনো যুদ্ধই অবিশ্বাস্যরূপে ভয়াবহ হয়ে উঠেছে-এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই। তাই যুদ্ধের কড়াল গ্রাস থেকে বিশ্বসমাজকে রক্ষা করতে না পারলে সভ্যতার ধ্বংস অবশ্যম্ভাবী। এজন্য অনেকে জাতীয়তাবাদকে যুদ্ধ দূরীকরণের সঠিক পন্থা বলে মনে করেছেন। আদর্শ জাতীয়তাবাদ জাতি-দ্বন্দ্ব এবং পারস্পরিক প্রতিযোগিতাকে দূরীভূত করতে সক্ষম। এই কারণে যুদ্ধ বা যুদ্ধ সংক্রান্ত আশঙ্কা এড়ানো যায়। পৃথিবীতে সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশিকতাবাদকে নিশ্চিহ্ন করার ব্যাপারে জাতীয়তাবাদ এক উজ্জ্বল ভূমিকা পালন করেছে।
(8) আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক
আদর্শ জাতীয়তাবাদকে আন্তর্জাতিকতার পরিপূরক বলে মনে করা হয়। রাষ্ট্রবিজ্ঞানী জিমার্ন-এর মতে, জাতীয়তাবাদ হল আন্তর্জাতিকতাবাদে পৌঁছোনোর এক প্রশস্ত সরণি (“Nationalism is a highway to Internationalism”)। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, বর্তমান বিশ্বে কোনো রাষ্ট্রের পক্ষে এককভাবে এবং বিচ্ছিন্নরূপে টিকে থাকা সম্ভব নয়, তাই প্রতিটি রাষ্ট্র জাতীয়তাবাদী আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে যে পারস্পরিক সদ্ভাব ও মৈত্রীর বাতাবরণ গড়ে তোলে, তার ফলে আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত হয়।
জাতীয়তাবাদের বিপক্ষে যুক্তি
(1) বিকৃত জাতীয়তাবাদের জন্মদাতা
জাতীয়তাবাদ এক প্রবল জাত্যভিমানে আদর্শভ্রষ্ট হয়ে যখন শুধুমাত্র নিজের জাতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ এবং অন্যদের অত্যন্ত নিকৃষ্ট বলে মনে করে, তখন বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদের জন্ম হয়। বিকৃত জাতীয়তাবাদ এক অন্ধ আবেগ সৃষ্টি করে হিংসা ও ঘৃণার বাতাবরণ তৈরি করে, যার ফলে সভ্যতার সংকট ঘনিয়ে আসে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রাক্কালে হিটলার (Hitler)-এর জার্মানির দিকে দৃষ্টি ফেরালে বিষয়টি আমাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে।
(2) সাম্রাজ্যবাদের জন্মদাতা
বিকৃত জাতীয়তাবাদকে সাম্রাজ্যবাদের জনকরূপে অভিহিত করা হয়। ঊনবিংশ শতাব্দীতে এক সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী উন্মাদনায় ইউরোপীয় ঔপনিবেশিক শক্তিগুলি এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশসমূহে সাম্রাজ্যবাদ বিস্তারে সচেষ্ট হয়েছিল। রাষ্ট্রবিজ্ঞানীদের মতে, ঊনবিংশ শতাব্দীর তৃতীয় বিশ্বের ইতিহাস হল স্বাধীনতা হরণ ও সম্পদ লুণ্ঠনের ইতিহাস। কারণ এই সময় বিদেশি রাষ্ট্রগুলিতে নিত্য নতুন বাজার দখল, অনুন্নত দেশগুলি থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ এবং বিদেশি রাষ্ট্রে পুঁজি বিনিয়োগ ইত্যাদি খেলায় বিকৃত জাতীয়বাদী আদর্শে উদ্বুদ্ধ হয়ে রাষ্ট্রগুলি মেতে উঠেছিল। জাতির আত্মস্বার্থ ও অহংবোধ থেকেই জন্ম নেয় সাম্রাজ্যবাদ। এ প্রসঙ্গে ল্যাস্কি বলেছেন, “ক্ষমতা বৃদ্ধি পেলে জাতীয়তাবাদ সাম্রাজ্যবাদে রূপান্তরিত হয়” (“As power extends, nationalism becomes transformed into imperialism.”)
(3) জাতি বিদ্বেষ ছড়ায়
উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদ জাতি বিদ্বেষ ছড়াতে সাহায্য করে। বিকৃত জাতীয়তাবাদের প্রবক্তারা শুধুমাত্র নিজের জাতিকে শ্রেষ্ঠ বলে মনে করেন। শুধু তাই নয়, নিজেদের সংস্কৃতি ও সভ্যতা যেহেতু সর্বশ্রেষ্ঠ, তাই তা অন্যদের কাছে প্রসারিত করাকেও তাঁরা কর্তব্য বলে মনে করেন। উদাহরণস্বরূপ ঊনবিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসকদের কথা বলা যায়। ব্রিটিশরা একদা ভারতবর্ষকে নিজেদের ঔপনিবেশিক শাসনের অধীনে রাখার জন্য শ্বেতাঙ্গদের বোঝা (Whiteman’s Burden) বা নরডিক কুলের উৎকর্ষ (Superiority of Nordic Race)-এর নীতি প্রচার করেছিলেন। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর মন্তব্য করেছিলেন, “বণিকের মানদণ্ড পোহালে শর্বরী দেখা দিল রাজদণ্ডরূপে।” অনুরূপভাবে হিটলারও মনে করতেন যেহেতু জার্মানরা খাঁটি আর্য বংশধর, তাই বিশ্বের অবশিষ্ট অনার্যদের উপর পূর্ণ কর্তৃত্ব করার অধিকার তাঁদের আছে।
(4) সুস্থ সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিপন্থী
বিকৃত জাতীয়তাবাদ সুস্থ সংস্কৃতি ও সভ্যতার পরিপন্থী। প্রতিটি জাতিসত্তার নিজ নিজ সংস্কৃতি ও সভ্যতা রয়েছে। পারস্পরিক ভাব বিনিময় ও বন্ধুত্বপূর্ণ আদান-প্রদানে এই সংস্কৃতি আরও সমৃদ্ধ হয়। কিন্তু বিকৃত বা উগ্র জাতীয়তাবাদ সর্বদা নিজের সংস্কৃতিকে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে মনে করে, এমনকি নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের জন্য তারা অপরের সভ্যতা ও সংস্কৃতিকে ধ্বংস করতেও কুণ্ঠাবোধ করে না। তাছাড়া উগ্র বা বিকৃত জাতীয়তাবাদী শক্তি নিজেদের রাষ্ট্রে কোনো ভিন্নধর্মী সংস্কৃতিকে বিকশিত হওয়ার বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয় না। তারা যাবতীয় বিকল্প সংস্কৃতিকে সমূলে বিনষ্ট করার পক্ষপাতী। এভাবে বিকৃত জাতীয়তাবাদ সুস্থ সংস্কৃতি ও সভ্যতার অপমৃত্যু ঘটায়।
(5) অন্যায় এবং অকল্যাণের উৎস
রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হায়েস-এর মতে, বর্তমান বিশ্বে জাতিরাষ্ট্রের ধারণা, জাতীয়তাবোধ, দেশপ্রেম ইত্যাদির সংমিশ্রণে যে জাতীয়তাবাদ গড়ে উঠেছে সেই জাতীয়তাবাদ হল চরম অন্যায় ও অকল্যাণের প্রধান উৎস। জাতীয় সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রসমূহ আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতিকে লঙ্ঘন করে দুর্বল রাষ্ট্রগুলির উপর আধিপত্য কায়েম করে। ইউরোপের সাম্রাজ্যবাদী জাতীয়তাবাদকে ঋষি বঙ্কিমচন্দ্র ‘ঘোরতর পৈশাচিক পাপ’ বলে অভিহিত করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথ তাঁর ‘সভ্যতার সংকট’ নামক গ্রন্থে এ ধরনের জাতীয়তাবাদকে মানবসভ্যতার শত্রুরূপে চিহ্নিত করেছিলেন (“Nationalism is a menace to Civilization.”)।
(6) গণতন্ত্রের হত্যাকারী
বিকৃত জাতীয়তাবাদকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানীরা গণতন্ত্রের হত্যাকারীরূপে আখ্যায়িত করেন। বিকৃত জাতীয়তাবাদের শাসনকালে কোনো বিরোধী কণ্ঠস্বরকে জীবিত রাখা হয় না। যাবতীয় বিরোধিতাকে কঠোর হস্তে দমন করা হয়। গণতান্ত্রিক অধিকার ও স্বাধীনতাকে হত্যা করা হয়। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়কালের নাৎসি জার্মানি ও ফ্যাসিবাদী ইতালির কথা উল্লেখ করতে পারি।
(7) অন্ধ কূপমণ্ডুকতার জন্মদাতা
বিকৃত জাতীয়তাবাদ জাতীয় জীবনে অন্ধ কূপমণ্ডুকতার জন্ম দেয়। এ ধরনের জাতীয় রাষ্ট্র এক অন্ধ উন্মাদনায় শুধুমাত্র নিজস্ব সংস্কৃতিকে বিশ্বের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ বলে গণ্য করায়, অন্যান্য জাতিসমূহের উন্নত সংস্কৃতির কাছ থেকে যা কিছু শিক্ষণীয় বস্তু সব বিসর্জন দিয়ে থাকে। শুধু তা-ই নয়, এরূপ অন্ধ উন্মাদনা অন্যান্য জাতির সভ্যতা, সংস্কৃতি, জ্ঞান-বিজ্ঞান ইত্যাদি সবকিছুকেই গ্রহণ না করার সপক্ষে জোরালো যুক্তি প্রদর্শন করে থাকে। এভাবে একটি জাতি তার নিজস্ব গণ্ডির বাইরে জগতের উৎকৃষ্ট বস্তুগুলির কোনো সন্ধান না পাওয়ায় অন্ধ কূপমণ্ডুকতায় পরিণত হয়। এই অবস্থা জাতির জীবনে স্থবিরতা ডেকে আনে।
(8) বিশ্বশান্তির বিরোধী
বিকৃত জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তির পরিপন্থী। বিকৃত জাতীয়তাবাদের জনক মুসোলিনি-র অভিমত ছিল, ‘মহিলাদের কাছে মাতৃত্ব যেমন স্বাভাবিক, পুরুষদের কাছে যুদ্ধও তেমনই স্বাভাবিক’। মুসোলিনি বিশ্বশান্তির প্রচেষ্টাকে কাপুরুষের স্বপ্ন বলে ব্যঙ্গ করেন। বিংশ শতাব্দীতে যে দুটি বিশ্বযুদ্ধ পরিচালিত হয় তা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, দুটি যুদ্ধেই বিকৃত জাতীয়তাবাদী নেতৃবৃন্দ মুখ্য ভূমিকা পালন করেছিলেন। তবে, বর্তমানে যুদ্ধের অর্থই হল ধ্বংসলীলা। এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বার্ট্রান্ড রাসেল বলেছিলেন, মানুষ যুদ্ধকে ধ্বংস করবে নতুবা যুদ্ধ মানুষকে ধ্বংস করবে। তাই এ কথা বলাই যায় যে, বিকৃত জাতীয়তাবাদ বিশ্বশান্তি, মানবসভ্যতা তথা আন্তর্জাতিকতাবাদের চরম পরিপন্থী।
(9) আন্তর্জাতিকতার সরণি নয়
মার্কসবাদী পন্ডিতদের মতে, জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতায় পৌঁছানোর রাজপথ নয়। তাঁদের মতে, জাতীয়তাবাদ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন চেহারায় আবির্ভূত হয়ে শুধুমাত্র শোষকশ্রেণির স্বার্থের সহায়ক হিসেবে কাজ করেছে। জাতীয়তাবাদ এমন এক অন্ধ আবেগ সৃষ্টি করে যার ফলে জাতিগত বিরোধের মনস্তাত্ত্বিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক আচরণ প্রতিষ্ঠা লাভ করতে সক্ষম হয়। এ ধরনের সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদের সোপান বেয়ে কখনোই আন্তর্জাতিকতার প্রশস্ত আঙিনায় পৌঁছোনো যায় না। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সূচনালগ্নে উগ্র জাতীয়তাবাদের নগ্নরূপ প্রত্যক্ষ করে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ জাতীয়তাবাদকে সংকীর্ণ স্বার্থে রাজনীতি ও অর্থনীতিকে ব্যবহার করার অপকৌশলরূপে আখ্যায়িত করেছিলেন। মার্কসবাদী তাত্ত্বিকরা আবার, বুর্জোয়া জাতীয়তাবাদকে প্রলেতারিয়েত আন্তর্জাতিকতাবাদের পরিপন্থী বলে মনে করেন।
উপসংহার
উপরোক্ত আলোচনার শেষে এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায় যে, বিকৃত জাতীয়তাবাদ হল মানবসভ্যতা তথা বিশ্বশান্তির প্রধান শত্রু। হায়েস-এর মতানুসারে, ‘বিকৃত জাতীয়তাবাদ হল কৃত্রিম, ভণ্ড জাতিপ্রেম’ (‘Nationalism is artificial and it is far from ennobling, in a word it is patriotic snobbery.’)। তবে প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সম্পর্কে এ কথা বলা যায় না। প্রকৃত জাতীয়তাবাদ হল মানব মুক্তির অগ্রদূত। অধ্যাপক জোহারি-র ভাষায়, ‘যদি ইতিবাচক ও গঠনমূলক দিক থেকে গ্রহণ করা যায় তাহলে এ কথা বলা যেতে পারে জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতার পথ প্রশস্ত করে (‘Nationalism would provide roots for internationalism if it is taken in its positive and constructive dimension.’)।
আবার, অধ্যাপক হায়েস-এর মতে, ‘যথার্থ দেশপ্রেম জাতীয়তাবাদের আদর্শের মাধ্যমে মূর্ত হলে বিশ্বসভ্যতা ও মানবতার পক্ষে তা আশীর্বাদস্বরূপ। (“Nationalism when it becomes synonymous with purest patriotism will prove a unique blessings to humanity and to the world.”) ।
Read More – The Garden Party Question Answer