পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও
পলিবিয়াসের রাষ্ট্রচিন্তার সংক্ষিপ্ত পরিচয় দাও

রোমক চিন্তার অন্যতম প্রবক্তা এবং বিশিষ্ট গ্রিক বুদ্ধিজীবী পলিবিয়াস (Polybius, আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ২০৪-১২২ অব্দ) প্রথম রোমের রাষ্ট্রব্যব্যস্থা ও সরকারের রাজনীতির গতিপ্রকৃতি নিয়ে আলোচনা করেন। স্টোয়িক দর্শনের পথিকৃৎ পলিবিয়াস গ্রিসে তাঁর দর্শনচর্চা শুরু করেন। পরবর্তীকালে গ্রিস রোমের সাম্রাজ্যভুক্ত হলে একজন যুদ্ধবন্দি হিসেবে তাঁকে রোমে আনা হয়।

গ্রন্থ রচনা

রোমে এসে পলিবিয়াস রাষ্ট্রনীতি বিষয়ে গবেষণা চালানোর সুযোগ পান। রোম সরকারের আনুকূল্যে পলিবিয়াসের গ্রিস, ইটালি ও ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলের নানা দেশ পরিভ্রমণের সুযোগ ঘটে। রোমে বসবাসকালীনই সেখানকার রাষ্ট্রব্যবস্থা এবং সংবিধানের সঙ্গে তিনি পরিচিত হওয়ার সুযোগ লাভ করেন। বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে পলিবিয়াস রোমের জনজীবন ও রাষ্ট্রনীতি সম্পর্কে রচনা করেন বিখ্যাত গ্রন্থ হিস্ট্রি অফ রোম (History of Rome)I

রাষ্ট্রচিন্তার স্বরূপ

পলিবিয়াস যখন হিস্ট্রি অফ রোম গ্রন্থ রচনা শুরু করেন তখন রোমান প্রজাতন্ত্রের স্বর্ণযুগ। তিনি এই গ্রন্থে রোমান সরকারের পক্ষে কীভাবে আইনকানুন এবং শাসনতন্ত্র প্রয়োগ করে একটি বৃহত্তর সাম্রাজ্য গড়ে তোলা সম্ভবপর হয়েছে, তারই বিস্তারিত ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন। তাছাড়া রোমের উত্থান ও সাফল্যের ইতিহাস রচনার সঙ্গে সঙ্গে পলিবিয়াস রাষ্ট্রশাসন ও রাজনৈতিক পরিবর্তন সম্পর্কে কিছু তাত্ত্বিক আলোচনাও উপস্থাপন করেন।

স্বাভাবিক আবর্তন তত্ত্ব

পলিবিয়াস স্বাভাবিক আবর্তন তত্ত্ব (Natural Cycle) উপস্থাপিত করে সরকার বা শাসনব্যবস্থার বিভিন্ন ধরন এবং বিভিন্ন রাষ্ট্রব্যবস্থার উৎপত্তি বর্ণনা করেন। এ ছাড়া অ্যারিস্টটলকে অনুসরণ করে তিনি বলেন যে, সরকার তিন ধরনের হতে পারে- রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতন্ত্র। প্রতিটি সরকারই ন্যায়নীতির রক্ষক কিংবা অত্যাচারী হতে পারে। এই কারণে সরকারের রূপের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। পলিবিয়াস বলেন যে, প্রথম অবস্থায় রাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থার উদ্ভব ঘটে।

কিন্তু অধিকাংশ রাজতন্ত্রই শেষপর্যন্ত স্বেচ্ছাচার ও নিপীড়নমূলক রাজনীতি গ্রহণ করে। এর প্রতিবাদে মানুষ সংগঠিত হয় এবং অভিজাততান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। কিন্তু অভিজাতদের মধ্যে কেউ কেউ স্বার্থসিদ্ধির জন্য লোভ, ষড়যন্ত্র ও গোষ্ঠীবদ্ধতার শিকার হন। ফলে এই শাসনব্যবস্থাতেও ভাঙন দেখা দেয়। এসময় সাধারণ মানুষ অভিজাততন্ত্রের বিরুদ্ধে সংগঠিত আন্দোলন গড়ে তুলতে বাধ্য হন। অবশেষে জনসাধারণের উদ্যোগে সূচনা ঘটে গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থার। অবশ্য পলিবিয়াস এরূপ আশঙ্কা করেন যে, গণতান্ত্রিক সরকারও যেমন বিপথগামী হতে পারে তেমনই সাধারণ মানুষের অজ্ঞতা এবং উচ্ছৃঙ্খলতার প্রভাবে এই শাসন উচ্ছৃঙ্খল জনতার শাসনেও রূপান্তরিত হতে পারে।

মিশ্র শাসনতন্ত্রের ধারণা

রাষ্ট্রশাসন ব্যবস্থার এহেন পরিবর্তন রোধ করে স্থায়ী শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য পলিবিয়াস মিশ্র শাসনতন্ত্র (Mixed Rule)-এর প্রতিষ্ঠার পরামর্শ দেন। তাঁর মতে, রাজতন্ত্র, অভিজাততন্ত্র ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রদর্শনের সমন্বয়ে গঠিত একটি মিশ্র শাসনতন্ত্রই কার্যকরী হতে পারে। এই শাসনতন্ত্রকে রাষ্ট্রের পক্ষে স্থায়িত্ব, শক্তি ও শান্তির প্রতীকরূপে গণ্য করা সম্ভব। নগররাষ্ট্র স্পার্টায় লাইকারগাস (Lycurgus) স্পার্টানদের মধ্যে নিয়মশৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে আংশিকভাবে এই প্রকার সমন্বয় সাধনে সক্ষম হয়েছিলেন।

প্রসঙ্গত পলিবিয়াস রোমান প্রজাতান্ত্রিক যুগের শাসনব্যবস্থার দৃষ্টান্ত তুলে ধরেন। তিনি দেখান যে, প্রজাতন্ত্রের যুগে কনসাল ছিলেন রাজার মতোই ক্ষমতাশালী। কিন্তু তাঁর স্বেচ্ছাচারী হওয়ার সুযোগ ছিল না। সিনেট-এর সদস্যরা ছিলেন ধনী, প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ- তাঁরা ছিলেন অভিজাততন্ত্রের প্রতীক। অন্যদিকে জনগণের সভা (কমিসিয়া সেঞ্চুরিয়াটা) ছিল গণতন্ত্রের প্রতিভূ। বাস্তবিক ক্ষেত্রে বলা যায় যে কনসাল, সিনেট এবং জনগণের মধ্যে একরকম নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের নীতি (The principle of checks and balances) প্রচলিত ছিল। বলাবাহুল্য এই ত্রয়ীর শাসনকালে রোম গৌরবের শীর্ষে আরোহণ করতে পেরেছিল।

মূল্যায়ন

পলিবিয়াসের রাষ্ট্রদর্শনে নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য (Check and Balance)-এর তত্ত্ব উপস্থাপিত হয়েছে। তিনি মনে করেন যে, সমাজের বিভিন্ন শ্রেণি বা গোষ্ঠী স্বার্থকেন্দ্রিক ঘাতপ্রতিঘাতের (Interaction) মধ্য দিয়ে একটি ভারসাম্য বিশিষ্ট শাসনধারা অনুসরণ করতে পারবে। স্যাবাইন (Sabine)-এর মতে, পলিবিয়াসের মিশ্র শাসনতন্ত্রের ধারণা পরবর্তীকালে ফরাসি দার্শনিক মন্তেঙ্কু এবং মার্কিন সংবিধান রচয়িতাদের প্রভাবিত করেছিল। গেটেল (Gettell) বলেছেন যে, পলিবিয়াসের এই নিরপেক্ষ ও মোহমুক্ত দৃষ্টিভঙ্গির আদর্শ ম্যাকিয়াভেলির রাষ্ট্রচিন্তায় প্রতিফলিত হয়েছে। আবার ডানিং (Dunning) মনে করেন যে, পলিবিয়াসের রাষ্ট্রদর্শন আধুনিক যুগের উদারতান্ত্রিক রাষ্ট্রব্যবস্থাকে অনুপ্রাণিত করতে সক্ষম।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top