বাংলার ঋতুবৈচিত্র্য – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

আমাদের এক বাঙালি কবি প্রিয় জন্মভূমির সৌন্দর্য দেখে অভিভূত ও মোহিত হয়ে লিখে গেছেন, “সকল দেশের রানি সে যে আমার জন্মভূমি। -এখানে লিখিত একটি শব্দও অতিশয়োক্তি নয়। আমাদের এই বাংলার ঋতুচক্র ঋতুতে ঋতুতে আমাদের বঙ্গমাতাকে যে নতুন নতুন পোশাকে সাজিয়ে দেয়, তা সকল দেশের সকল রানির ঐশ্বর্যকে সহজেই হার মানায়। এমন পরিবর্তিত ঐশ্বর্য কখনও কি কোনো দেশ পেয়েছে?
বাংলাদেশে ছ-টি ঋতু পালাক্রমে একের-পর-এক এসে বাংলার প্রকৃতিকে পত্রে-পুষ্পে-পল্লবে সাজিয়ে দিয়ে যায়। পৃথিবীর বার্ষিক গতির ফলেই ঘটে ঋতুপরিবর্তন। এই বঙ্গে প্রকৃতির রমণীয় আঙিনায় ষড় ঋতু যেন ময়ূরের মতো নৃত্য করে চলে। এমন ঋতুবৈচিত্র্য কোনো দেশে নেই। তাই কবি বলেছেন- “এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি।”
বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ হল গ্রীষ্মকাল। বসন্তকালের শেষে গ্রীষ্ম দেখা দেয় রুদ্র সন্ন্যাসীর বেশে। নদী-নালা-খাল-বিল তখন জলশূন্য হয়ে শুকিয়ে যায়। আকাশ থেকে যেন আগুন ঝরে, দেখা দেয় কালবৈশাখী। ঈশানকোণের একখণ্ড সজল কালো মেঘ দেখতে দেখতে দাবদগ্ধ ধরণির বুকের ওপরে শীতল ছায়া বিস্তার করে। কালো মেঘ আশীর্বাদী বৃষ্টির ধারা হয়ে নেমে আসে তাপিত ধরণির বুকে।
গ্রীষ্মের পরে আসে বর্ষা। কালো মেঘের পাখায় ভর করে অফুরন্ত বৃষ্টির ধারা নিয়ে, সবুজের সম্ভার নিয়ে হয় বর্ষার আবির্ভাব। আষাঢ়-শ্রাবণকে বর্ষাকাল বলা হলেও, বস্তুত ভাদ্র মাস পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। বর্ষায় নবীন জলধারার স্পর্শে প্রকৃতি সবুজ পোশাকে সাজে। বর্ষা কৃষির উপযোগী ঋতু। তাই বর্ষা সমাগমে কৃষকের মুখে হাসি ফোটে। বর্ষায় নদীনালা-খাল-বিল জলে ভরে যায়। শস্যশ্যামলা হয়ে ওঠে বঙ্গভূমি।
বর্ষা যায়, আসে শরৎ- সৌন্দর্যের রানি। ভাদ্র-আশ্বিন দুই মাস শরৎকাল। এসময় আকাশ থাকে মেঘমুক্ত। কখনো-কখনো শুভ্র বলাকার মতো সাদা মেঘের ভেলা ভেসে যায় আকাশ গাঙে। সোনালি মিঠে রোদে চারদিক ঝলমল করে। এসময় শিউলি, কাশ, জুঁই প্রভৃতি ফুল ফোটে। দোয়েল-শ্যামার গানে বাতাস মুখরিত হয়। শরৎকালে বাংলার শ্রেষ্ঠ জাতীয় উৎসব দুর্গাপুজো অনুষ্ঠিত হয়।
শরতের পরে অল্প শীতের আমেজ নিয়ে আসে হেমন্ত। কার্তিক-অগ্রহায়ণ হেমন্ত ঋতু। পাকা ফসল ঘরে তোলার কাজে ব্যস্ত থাকে কৃষকসমাজ। নতুন অন্ন ঘরে আনবার আনন্দকে স্মরণীয় করে রাখার জন্য ‘নবান্ন’ উৎসবের আয়োজন করা হয়। কালীপুজো, জগদ্ধাত্রী পুজো আর কার্তিক পুজো হল হেমন্ত ঋতুর বড়ো আকর্ষণ।
হেমন্তের হাত ধরে আসে শীতকাল। পৌষ-মাঘ শীত ঋতু। শীত আসে বৃদ্ধের বেশে। গাছের পাতা ঝরে যায়। প্রকৃতি তখন রিক্ততার শিকার হয়ে পড়ে। বঙ্গে শীত ঋতুতে খাদ্যের সমারোহ দেখা যায়। এই মরশুমের বিশেষ আকর্ষণ পিঠেপুলি-পায়েস আর নলেন গুড়ের সন্দেশ।
শীতের অবসানে বসন্তের আবির্ভাব। বসন্ত ঋতুরাজ। শীতের জরাগ্রস্ত প্রকৃতিকে জিয়নকাঠি ছুঁইয়ে বসন্ত যেন তাকে নতুন জীবনদান করে। পুষ্প কিশলয়ের প্রাচুর্যে ও নবীনতার সম্পদে বসন্ত স্বমহিমায় প্রতিষ্ঠিত। ফাল্গুন-চৈত্র এই দুই মাস হল বসন্তকাল। বসন্তের আবির্ভাবে বৃক্ষলতা নব কিশলয়ে সুশোভিত হয়। বসন্তসখা কোকিলের কুহুতানে চতুর্দিক মুখরিত হয়, বসন্তে রাধাকৃষ্ণের দোললীলার স্মরণে হোলি খেলার আসর জমে ওঠে।
বাংলার মতো পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে এত স্পষ্টভাবে এই ঋতুবৈচিত্র্য লক্ষ করা যায় না। বাঙালির হৃদয়কে প্রভাবিত করে এই ঋতুবৈচিত্র্য। প্রতিটি ঋতু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য নিয়ে হাজির হয় বাঙালির কাছে। প্রতিটি ঋতুই নিয়ে আসে কোনো-না-কোনো উৎসব। এই উৎসবগুলি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একাত্মবোধ প্রদান করে।