প্রলয়ংকর আমফান – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

পৃথিবীর একদিকে যেমন মহিমাময় সৌন্দর্য লক্ষ করা যায় ঠিক তার অন্যদিকে আছে এক ভয়াল ও প্রলয়ংকর রূপ। আদিম অরণ্যচারী মানুষ থেকে আজকের অত্যাধুনিক বিজ্ঞানচেতনাসম্পন্ন মানুষ সকলেরই প্রকৃতির এই করাল রূপের কাছে আত্মসমর্পণ করা ছাড়া উপায় নেই। অরণ্যচারীদের সঙ্গে পার্থক্য শুধু এটুকু যে তারা কার্যকারণ অনুসন্ধানে ব্যর্থ ছিল, আর আজকের মানুষ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এ ব্যাপারে সফল। এইজন্যই আমরা ক্ষয়ক্ষতি ও প্রাণহানি কমাতে সক্ষম হয়েছি। সাম্প্রতিক কালে ঘটে যাওয়া ‘আমফান’ তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।
‘আমফান’ হল ঘূর্ণিঝড়। এটি একটি থাই শব্দ, যার অর্থ ‘আকাশ’। আরব সাগর ও বঙ্গোপসাগর তীরবর্তী রাজ্যগুলিকে নিয়ে গঠিত ‘ইকোনমিক অ্যান্ড সোশ্যাল কাউন্সিল ফর এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক’ (এসক্যাপ)-এর আট সদস্যের প্যানেল সকলের সম্মতির ভিত্তিতে নতুন ঘূর্ণিঝড়ের নামকরণ করে থাকে। পুরাতন তালিকার সর্বশেষ নামটি ছিল ‘আমফান’। থাইল্যান্ড নামকরণটি করেছে।
১৬ মে ২০২০ ক্রান্তীয় নিম্নচাপ থেকে তৈরি এই ঝড় ক্রমশ তার গতি বৃদ্ধি করতে করতে এগিয়ে এসেছে স্থলভাগের দিকে। প্রথমে আবহবিদরা অনুমান করেছিলেন এটি ওড়িশা উপকূলে আঘাত হানবে। পরবর্তীতে লক্ষ করা যায় যে, ঘূর্ণিঝড়টি পশ্চিমবঙ্গের দিঘা ও বাংলাদেশের হাতিয়া-র মধ্যবর্তী এলাকায় ২০ মে বিকেলের দিকে আঘাত হানে। এর ফলে পশ্চিমবঙ্গের দুই চব্বিশ পরগনা, কলকাতা, হাওড়া, হুগলি ও মেদিনীপুরের বিস্তীর্ণ এলাকায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বাংলাদেশের পশ্চিমাঞ্চলীয় জেলাগুলি যেমন- পটুয়াখালি, গলাচিপা, সাতক্ষীরা, খুলনা প্রভৃতি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
২০ মে-র আগে থেকেই অর্থাৎ পূর্বাভাস পাওয়া থেকে আবহাওয়া দপ্তর ও সরকার বারবার জনগণকে সাবধান করে গেছেন ধারাবাহিকভাবে। এর ফলে ঘরবাড়ি বাঁচানো না-গেলেও প্রাণহানি কমানো গেছে। ২০ মে-র সকাল থেকে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল এবং তার সঙ্গে ছিল বৃষ্টি ও ঝোড়ো বাতাস। এরপর বেলা যত বেড়েছে বাতাসের বেগ তত তীব্র হয়েছে। সন্ধ্যা ছ-টা থেকে সাতটায় এই বেগ সবচেয়ে তীব্রতর ছিল।
উপকূলে এই ঝড়ের গতিবেগ ছিল ১৫০-১৬০ কিমি/ঘণ্টা। কলকাতায় যা ছিল প্রায় ১৩৩ কিমি/ঘণ্টা। এই ঝড়ে গতিবেগ সবচেয়ে তীব্র হয়েছিল ২৭০ কিমি/ঘণ্টা যা তিন মিনিট স্থায়ী হয়েছিল। শহর কলকাতা থেকে প্রত্যন্ত গ্রামবাংলাকে একটানা কয়েক ঘণ্টা ঝোড়ো হাওয়া বারে বারে আঘাত হেনে লন্ডভন্ড করে দিয়েছিল। শহর থেকে গ্রাম-জনজীবনকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল এই ঝড়। খেতের ফসল, ঘরবাড়ি, বিদ্যুতের খুঁটি, বড়ো বড়ো গাছপালাকে মাটিতে শুইয়ে দিয়ে গেছে এই ঝড়।
আগাম খবর থাকার ফলে পরিকল্পনামাফিক মানুষের মৃত্যুমিছিল এড়ানো গেলেও ঝড়ের পরবর্তী পরিস্থিতিতে জনজীবন স্বাভাবিক করতে প্রশাসনকে ভালোরকম বেগ পেতে হয়েছে। অতিমারি করোনা সংকটকালে এই ঝড় মানুষের কাছে ছিল মড়ার ওপর খাড়ার ঘায়ের মতো। পশ্চিমবঙ্গের ডিজাস্টার ম্যানেজমেন্ট, পুলিশ ও নানান সংস্থা এ ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা নিয়েছিল। এই ঝড়ে মোট প্রায় ১১৮ জন মারা গেছে। আমাদের পশ্চিমবঙ্গে সংখ্যাটি হল প্রায় ৭২। সরকার ছাড়াও বিভিন্ন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা দুর্গতদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। কোথাও কোথাও রান্না করা খাবার পর্যন্ত দেওয়া হয়েছে। তবে সব কিছুই চাহিদার চেয়ে কম ছিল।
এক মার্কিন সংস্থার মতে বাংলাদেশ ও ভারতের প্রায় ৩.৮৯ কোটি মানুষ এই ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ২১৭০০০ একর জমির ধান এবং ৫০০০০০ একর জমির শাকসবজি নষ্ট হয়েছে। সরকার আর্থিক সাহায্যের কথা ঘোষণা করেছে। এ ছাড়া বাড়িঘর নির্মাণের জন্যও অর্থ অনুদানের কথা বলেছে। মোট ক্ষতির পরিমাণ ১৩.২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
অতিমারি যখন মানুষকে ঘরবন্দি করেছে ঠিক তখনই এই ঝড় আঘাত হেনেছে সেই ঘরে। বিপর্যস্ত পরিস্থিতি থেকে স্বাভাবিক হতে মানুষের প্রায় একমাসেরও বেশি সময় লেগেছে। শহর কলকাতাসহ বিভিন্ন শহরে এ যন্ত্রণা ছিল গ্রামের চেয়ে তীব্র। আসলে প্রশাসন থেকে মানুষ এরকম তাণ্ডব কোনোদিন দেখেনি এবং অনুমান না-করতে পারায় আয়োজনও করেনি। মানুষ ঠেকে শেখে-তাই আগামীতে হয়তো নিজেকে আরও শুধরে নেবে সকলেই।
একদিন ঝড় থেমে যাবে, পৃথিবী আবার শান্ত হবে-এ বিশ্বাস নিয়ে মানুষ এগিয়ে যাবে। তবে যে-কোনো ঘটনা থেকেই মানুষ শিক্ষাগ্রহণ করে। আমরা মানে আমজনতা থেকে প্রশাসনিক কর্তা-ব্যক্তি সকলেই এ থেকে শিক্ষা নেবে এবং নতুন নতুন পরিকল্পনা গ্রহণ করবে। তবে এই অতিমারি ও ঘূর্ণিঝড় আমাদের কিছু কিছু ক্ষেত্রে মানবিকতার উদাহরণ তুলে ধরলেও মানুষের অমানবিক রূপটিকেই বেশি করে তুলে ধরেছে। ত্রাণবন্টন থেকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, রেশন বণ্টন থেকে মজুতদারি-সব অসততাই সমাজ অলিন্দে জ্বলজ্বল করছে, তা আরও একবার প্রমাণ হল।