হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা - মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
  • হারিয়ে যাওয়া নানা রকমের। আক্ষরিক অর্থেই নয়, গভীর অর্থেও
  • হারিয়ে যাওয়া জীবন থেকে নয়, জীবনের মাঝখানে।
  • মাঝে মাঝে নতুনত্বের ক্ষেত্রে হারিয়ে গেলে গতানুগতিক জীবনচর্চার একঘেয়েমি দূর হয়।
  • স্বল্প বা বেশি সময়ের জন্য, শারীরিক বা মানসিকভাবে পরিচিত বা অপরিচিত জগতে হারিয়ে যাওয়া।
  • হারিয়ে যাওয়া মানে পালিয়ে যাওয়া নয়। কাজের জগতেও নিজেকে হারানো যায়।
  • অবসরবিনোদনের প্রকৃষ্ট উপায় নিজেকে কল্পনার জগতে হারিয়ে ফেলা

হারিয়ে যাওয়াটা কোনো ব্যাপার নয়; আমরা চাইলে যে-কোনো দিন যে-কোনো সময় হারিয়ে যেতে পারি। রবীন্দ্রনাথ তো তাঁর গানে বলেইছেন যে, “কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা…।” বাড়িতে আমার গুরুত্ব কতটা, আমি বাড়ির বোঝা হয়ে উঠেছি কি না, বাড়ির মানুষজন আমাকে ভালোবাসে কি না-এসব জানতে বা বুঝতে আমি কোথাও হারিয়ে যেতেই পারি। যখন দেখব আমাকে সবাই প্রচণ্ডভাবে খুঁজে বেড়াচ্ছে, নাওয়া- খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে-আমাকে খুঁজে পেল যখন, আমি তখনই বুঝলাম আমার গুরুত্ব আছে, বাড়িতে আমি বোঝা নই, সকলেই আমাকে ভালোবাসে। আবার আমি কোথাও চলে গিয়ে হারিয়ে গেলাম-এরকমটা নাও করতে পারি, হারাতে গেলে কোথাও গিয়ে হারাতে হবে কে মাথার দিব্যি দিয়েছে? আমি তো শক্তি চাটুজ্যের মতো বলতেই পারি- “যেতে পারি কিন্তু কেন যাব?” তাই তো! হারাতে গেলে যাওয়ার দরকার কী? আমি তো ‘মনে মনে’ হারিয়ে যেতে পারি? গান শুনতে শুনতে গানের জগতে হারিয়ে যেতে পারি, কোনো উপন্যাস বা ছোটোগল্প পড়তে পড়তে সাহিত্যের জগতে হারিয়ে যেতে পারি, অথবা কাজ করতে করতে কাজের জগতেও হারিয়ে যেতে পারি। হারিয়ে যাওয়া তাই দু-রকমের-আক্ষরিক ও গভীর।

শারীরিক বা মানসিকভাবে পরিচিত বা অপরিচিত জগতে আমরা কম সময়ের জন্য বা বেশি সময়ের জন্য হারিয়ে যেতেই পারি। আমি লেখাপড়ার চাপে তেমনভাবে কোনোদিন মাঠে নামিনি। একদিন মাঠে গিয়ে দেখলাম বন্ধুরা ফুটবল খেলছে। আমাকে জোর করল, খেলার জন্য মাঠে নামাল। খেলতে খেলতে কখন যে খেলাটার সঙ্গে শারীরিক ও মানসিকভাবে একাত্ম হয়ে পড়েছি বুঝতেও পারিনি। সময় ফুরিয়ে গেল কিন্তু আশ মিটল না। একবার দেশের বাড়িতে কোঠায় মাদুর পেতে শুয়ে খোলা জানালার দিকে তাকিয়েছিলাম উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে। তখন সন্ধে ৭টা। একটা আবছা আলো গ্রামের চারদিকে ছড়িয়ে আছে, কী অপরূপ রূপ লাভ করেছে, আমার ছোট্ট গ্রামটা! কিন্তু আধফালি চাঁদটার দিকে তাকিয়ে চোখ ফেরাতে পারলাম না, আমি যেন চাঁদের রাজ্যে হারিয়ে গেলাম, ঠিক যেমন অপু-দুর্গা রেলগাড়ি দেখার জন্য হারিয়ে গিয়েছিল।

হারিয়ে যাওয়া মানে কিন্তু কখনোই পালিয়ে যাওয়া নয়। বলা যায়, পালিয়ে না গিয়েও যে-কোনো মানুষ হারিয়ে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ বলেছেন- “বৈরাগ্যসাধনে মুক্তি সে আমার নহে/সহস্র বন্ধন মাঝে লভিব মুক্তির স্বাদ”। বন্ধনের মধ্য থেকেই মুক্তিপথের সন্ধান করতে হয়, দেহকে জানলে দেহাতীতকে পাওয়া সম্ভব, রূপসাগরে ডুব দিয়ে উঠলে অরূপরতন পাওয়া সম্ভব। ভোগ না করলে ত্যাগের মর্ম বোঝা যায় না। তেমনি না-পালিয়ে হারিয়ে যাওয়া যায়। আমরা অনেক কাজই মনের একাগ্রতা দিয়ে, মনোযোগ দিয়ে করি না, দায়সারাভাবে কার্যোদ্ধার করি। ফলে কাজগুলো ভালো হয় না, অনেক সময় সফলতাও আসে না। যদি আমরা কর্মজগতে হারিয়ে যেতে পারি তাহলে এক দারুণ আনন্দ লাভ করা যায় এবং একঘেয়েমি কাটে। কাজটিতে কোনো প্রকার বাধ্যবাধকতা না থাকলে তা সফলতার মুখ দেখতে বাধ্য।

আমাদের কর্মব্যস্ততা এমনই যে আমরা শ্বাস ফেলার অবসরটুকুও ভালোভাবে পাই না, আমরা “খাচ্ছি দাচ্ছি চকচকে ব্লেডে দাড়ি কামাচ্ছি/ ঝাঁকের কই ঝাঁকেই মিশে যাচ্ছি।” আমাদের অবসর বলতে একটু টিভি দেখা, একটু কাগজ পড়া অথবা মোবাইলে খানিকক্ষণ চ্যাট করা। পড়ুয়াদেরও সারাক্ষণ বইখাতা নিয়ে দৌড়-দৌড়-দৌড়, আবার তাদের মাথা ঘামাতে হয় ফলাফলের ইঁদুরদৌড় নিয়ে। দৌড়োচ্ছেন তাদের বাবা-মায়েরা, ছেলেমেয়েদের একটা কিছু বানিয়েই তাঁরা বুকভরে শ্বাস নেবেন, অবসর বলে কোনো কথা নেই। আবার অবসর পেলে সাদামাটাভাব কেটে যায়। সত্যিকারের অবসরবিনোদন হতে পারে কল্পজগতে হারিয়ে যাওয়ার মধ্য দিয়ে। যেমন, অপটু রান্না না জানা হাতে কোনো নতুন রেসিপি তৈরির একটু চেষ্টা করা গেল, কোনো কবিতা বা গল্প লেখার চেষ্টা করা যেতে পারে, বিজ্ঞানজগতে প্রবেশ করে নতুন কিছু সৃষ্টির চেষ্টা করা হারাতে পারার দারুণ উপায়।

আমাদের জীবন গতানুগতিকতা ও একঘেয়েমিতে ভরা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত একই রুটিন, একই বাঁধাধরা ছক। জীবনটা ঠিকঠাক রইল কি না চিমটি কেটে দেখতে হয়। সকালে উঠেই বাবা ছোটেন বাজার-দোকান, দাড়ি কাটা, স্নান করা, দুটো পেটে গুঁজে নিয়ে বাসে বাদুড়ঝোলা হয়ে অফিসে ছোটা। সন্ধেতে ফিরেই আবার কাজ আর কাজ। মাও তথৈবচ-তাঁরও রান্না, অফিস-টফিস করে হাতে আর উদ্বৃত্ত সময় নেই। ছেলেও স্কুল, প্রাইভেট কোচিং-এ যাওয়া, টাস্ক করা, গলদঘর্ম হয়ে ইঁদুরদৌড়ে টিকে থাকা। আমরা জানি- “Time and Tide wait for none.’ সময় পেরিয়ে গেলে তা আর ফিরবে না। তাই নতুনত্বের স্বাদ না নিতে পারলে জীবন থাকবে না। জীবনই যদি না থাকে তাহলে রোজগার করে, পড়াশোনা করে লাভ কী? নতুনত্বের ছোঁয়া দিলে একঘেয়েমিও কাটে, তাই মাঝে মাঝে চড়ুইভাতিতে যেতে হবে, প্রকৃতির কোলে হারিয়ে যেতে হবে। কখনো-কখনো শুধু মাত্র নান্দনিক আনন্দ পেতে সপরিবারে ক্যামেরা ঝুলিয়ে বেরিয়ে পড়তে হবে। কখনও সপরিবারে পড়া-পড়া খেলা বা খেলা-খেলা পড়ায় মেতে উঠতে হবে। স্কুলব্যাগ ছেড়ে, প্রাইভেট টিউশন ছেড়ে খেলার মাঠে নেমে পড়তে হবে। মনের সুখে ছবি আঁকতে হবে, বিজ্ঞানের মডেল তৈরি করতে হবে-মনকে এভাবে মাঝে মাঝে বাঁধনছাড়া প্রশ্রয় দিতে হবে-হারিয়ে যেতে হবে।

জীবনের উচ্চ-নীচতা মেনে, জীবনের প্রয়োজনীয়তার দিকে খেয়াল রেখেই হারিয়ে যেতে হবে, পালিয়ে যাওয়া নয়, পলায়নি মনোবৃত্তির কোনো স্থান নেই। প্রতিদিনের প্রয়োজনটা থাক, হারিয়ে যাওয়াও থাক, এসো-ভারসাম্যের কথা ভাবি।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top