র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা 

র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

র‍্যাগিং ও ছাত্রসমাজ – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা
  • র‍্যাগিং-এর স্বরূপ
  • র‍্যাগিং-এর প্রক্রিয়া
  • র‍্যাগিং-এর প্রকৃতি
  • বর্তমান ছাত্রসমাজে প্রভাব
  • র‍্যাগিং-এর কারণ
  • র‍্যাগিং প্রতিকার
  • র‍্যাগিং-এর কুফল
  • র‍্যাগিং-এর বিরুদ্ধে সরকারি ব্যবস্থা

সভ্যতার তথাকথিত অগ্রগতিমূলক বহু বিবর্তনের পরেও মানুষের মধ্যে আজও একটা পশু বিরাজ করছে। সে অকারণে উৎপীড়কের ভূমিকা নেয়। এর কোনো যুক্তিসিদ্ধ ব্যাখ্যা খুঁজে পাওয়া যায় না। এইরকম উৎপীড়নকে র‍্যাগিং বলে। ছাত্রাবাসে অনুষ্ঠিত র‍্যাগিং একটি অনুরূপ বিষয় যাকে বর্বরতা ছাড়া আর কিছুই বলা যায় না। যার ফলে কলুষিত হয় শিক্ষার পবিত্র অঙ্গন। মানুষ গড়ার কারখানা হয়ে ওঠে পাশবিকতার অনুশীলন ক্ষেত্র। অভিধানে বিবর্ণ হয়ে যায় সহমর্মিতা, বন্ধুত্ব, মানুষ্যত্বের মতো শব্দগুলি। আমাদের সমাজে র‍্যাগিং একটি অন্যতম জলন্ত সমস্যা। এর প্রকৃতি অনুধাবন এবং এ থেকে পরিত্রাণের পন্থা-পদ্ধতি অনুসন্ধান বর্তমানে একান্ত প্রয়োজন।

র‍্যাগিং একটি ইংরেজি শব্দ। সোজা কথায় এর অর্থ হল অকারণে অন্যকে হেনস্থা করে আনন্দ লাভের প্রক্রিয়া। র‍্যাগিং-এর মূলে থাকে প্রভুত্বকামিতা, অন্যের উপরে আধিপত্য প্রতিষ্ঠার ইচ্ছা। আবার, নিছক আনন্দলাভও এর উদ্দেশ্য হতে পারে। সমাজে যে-কোনো স্তরেই র‍্যাগিং হতে পারে। যেমন- (১) শিক্ষা ক্ষেত্রে বহিরাগত ছাত্রছাত্রীরা যখন ছাত্রাবাসে ভরতি হয় তখন নবাগতদের উপর প্রবীণ ছাত্রছাত্রীরা এক ধরনের অত্যাচার করে থাকে। (২) সমাজে ‘দাদাগিরি’ এবং নেতাগিরিও এক ধরনের র‍্যাগিং, যেমন- রাস্তায় পরিবহণ আটকে চাঁদা তোলা, না- দিলে, চাহিদামতো না-দিতে পারলে মারধর করা, জিনিসপত্র কেড়ে নেওয়া ইত্যাদি। (৩) রাজনৈতিক র‍্যাগিং: এটি বর্তমানে এই গণতান্ত্রিক দেশে সবচেয়ে বড়ো র‍্যাগিং (৪) ধর্মীয় র‍্যাগিং ধর্মের নামে জোর করে ধর্মীয় ভন্ডামির শিকার করানোর মধ্যে রয়েছে একপ্রকার র‍্যাগিং।

র‍্যাগিং হল এক ধরনের মানসিক এবং শারীরিক অত্যাচার। শিক্ষাবর্ষের সূচনায় কারিগরি ও মেডিক্যাল শিক্ষা, ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলিতে র‍্যাগিং-কে কেন্দ্র করে অমানুষিক নিষ্ঠুর খেলায় মেতে ওঠে। সাধারণভাবে ছাত্রাবাস বা ছাত্রীনিবাসে ও কলেজের মধ্যে নবাগত ছাত্রছাত্রীদের ওপর পুরানো ছাত্রছাত্রীরা দৈহিক ও মানসিকভাবে নানা রকম পীড়ন চালিয়ে যায়। নানা অজুহাতে নবাগতদের বোকা বানানো, উদ্ভট প্রশ্নের উত্তর দিতে বাধ্য করা, প্রচণ্ড শীতের মধ্যে স্নান করতে বাধ্য করা, মাটিতে দীর্ঘ নাকখত দিতে বলা, জোর করে মদ খাইয়ে দেওয়া, শরীরে জলন্ত সিগারেটের ছ্যাঁকা দেওয়া, কখনও জামাকাপড় খুলে নেওয়া, অর্ধউলঙ্গ বা সম্পূর্ণ উলঙ্গ দাঁড় করিয়ে রাখা ইত্যাদি। উঁচু ক্লাসের ছাত্রদের নির্দেশ পালন বিন্দুমাত্র কুণ্ঠা বা অবহেলা দেখানো হলে কুৎসিত গালিগালাজ, চড়চাপড় ইত্যাদি উপরি পাওনা হয়।

র‍্যাগিং-এর কারণ সম্পর্কে নানা জনের নানান অভিমত রয়েছে। কেউ বলেন, একদল মানুষের বিকৃত মানসিকতা। আবার অনেকে বলেন, নবাগত ছাত্রছাত্রীদের সংশ্লিষ্ট কলেজের উপযুক্ত করে তোলার জন্য নাকি র‍্যাগিং। এতে নাকি পুরোনোদের সঙ্গে নতুনদের যোগাযোগ নিবিড় হয়। কিন্তু এই ধরনের যুক্তি নেহাতই র‍্যাগিং করার পক্ষে অজুহাত মাত্র। আসলে মানুষের স্বভাবের মধ্যে যে প্রভুত্বপিপাসা নিহত থাকে তারই একটা উৎকট প্রকাশ র‍্যাগিং-এর মধ্যে লক্ষ করা যায়। ছাত্রাবাস বা ছাত্রীনিবাসে অভিভাবকদের শাসন থেকে মুক্ত ছাত্রছাত্রীদের অনেকের মানসিক গঠন এর জন্য দায়ী।

র‍্যাগিং যে কতটা ক্ষতিকারক হতে পারে তা আমরা প্রতিনিয়ত জানতে পারি সংবাদ মাধ্যমের দ্বারা। র‍্যাগিং-এর শিকার হয়ে অনেক মেধাবী ছাত্রছাত্রী কলেজ ছাড়তে বাধ্য হয়। অনেকে আবার মানসিকভাবে প্রতিবন্ধী হয়ে পড়ে। কেউ কেউ শারীরিকভাবে অক্ষম হয়ে যায়। র‍্যাগিঙে মৃত্যু ঘটেছে এমন ঘটনাও অজস্র আছে। এইসব ঘটনা চোখে পড়লে অনেক ছাত্রছাত্রী বিশেষ বিশেষ কলেজে পড়াশোনার সুযোগ পেয়েও ভরতি হতে ভয় পায়।

ছাত্রাবাসে নিপীড়নমূলক এই জঘন্য প্রথার অবসানকল্পে কতগুলি কার্যকরী পদক্ষেপ এখনই নেওয়া প্রয়োজন; সেগুলি হল-

(১) নবাগত ছাত্রছাত্রীদের পুরাতন ছাত্রদের সাথে একত্র না-রেখে আলাদা হোস্টেলে রাখতে হবে।

(২) নবাগত ছাত্রছাত্রীদের জন্য ‘ছাত্রবরণ’ অনুষ্ঠানটি কলেজের কনফারেন্স হলে বা অডিটোরিয়ামে শিক্ষক, কর্মচারী ও পুরাতন সকল ছাত্রছাত্রীদের উপস্থিতিতে ছাত্র ভরতি হওয়ার কিছুদিনের মধ্যেই সম্পূর্ণ করা।

(৩) র‍্যাগিং-এর সুযোগ যাতে না-থাকে। তার জন্য প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারি ব্যবস্থা করতে হবে।

(৪) এ সমস্ত ব্যবস্থা গ্রহণ সত্ত্বেও কোনো র‍্যাগিং-এর ঘটনা ঘটলে সঙ্গে সঙ্গে অ্যান্টি র‍্যাগিং অ্যাক্ট অনুযায়ী আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে এবং দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি প্রদান করতে হবে যাতে ভবিষ্যতে র‍্যাগিং করার ওপর একটি ভীতির সৃষ্টি হয়।

ইতিমধ্যে ২০০৯ সালে সুপ্রিমকোর্ট ‘অ্যান্টি র‍্যাগিং অ্যাক্ট’ তাতে র‍্যাগিং-এ অভিযুক্ত ছাত্রছাত্রীদের বিরুদ্ধে সরকার ফৌজদারি মামলা করবে। তাদের জামিন অযোগ্য গ্রেফতারি পরোয়ানায় বিচার বিভাগীয় কারাগারে বন্দি করা হবে।

রা‍্যাগিং নির্মূলের প্রধান অন্তরায় ছাত্রছাত্রীদের মনোভাব। এর পরিবর্তনে তিনটি জিনিসের অতি প্রয়োজন। অ্যাটিটিউড স্কিল এবং নলেজের উন্নতি। অ্যাটিটিউডের ‘এ’, স্কিলের ‘এস’ এবং নলেজ ইংরেজি শব্দের ‘কে’ একসঙ্গে যোগ করলে ‘ASK’ অর্থাৎ জিজ্ঞাসা। এই আত্মজিজ্ঞাসার একান্ত প্রয়োজন। অভিভাবক-অভিভাবিকা ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক-শিক্ষিকা সাধারণ মানুষ সকলেরই আত্মজিজ্ঞাসার দরকার আছে। যদি আমরা আচরণ, দক্ষতা এবং জ্ঞানের ভাণ্ডারকে স্ফীত করতে পারি। তাহলেই র‍্যাগিং অবসান সম্ভবপর হবে।

র‍্যাগিং-এর নাগপাশ থেকে শিক্ষাঙ্গনকে মুক্ত করতে হবে, সহমর্মিতা আর বন্ধুত্বের অমলিন আলোয় শিক্ষাক্ষেত্রকে আলোকিত করার দায়িত্ব সমাজের সকলের সহায়তায় ছাত্রসমাজকেই নিতে হবে। সমাজের বিভিন্ন স্তরের চাপে, সর্বোপরি ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে শুভ চেতনার জাগরণে আশা করি এই অমানবিক কুপ্রথা অচিরেই বিলুপ্ত হবে। আমরা সেই শুভ প্রভাতের জন্য অপেক্ষমান।

আরও পড়ুন – ছাত্রজীবন – মানস মানচিত্র অবলম্বনে প্রবন্ধ রচনা

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Scroll to Top